প্রশাসনিক সংস্কারের ফাঁকা বুলিঃ অসন্তোষ আর বিভাজন বাড়ছে

রকারি প্রশাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ সব সরকারের আমলেই কমবেশি উঠেছে। বিশেষ করে সরকারবিরোধীরা প্রশাসনের পরিবর্তন এবং স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসনের পক্ষে সব সময়ই সরব ছিলেন। জনগণও বাস্তবতার নিরিখে গণবিচ্ছিন্ন আমলাতান্ত্রিক চরিত্রের পরিবর্তে গণমুখী ও গণতান্ত্রিক প্রশাসন ব্যবস্থাই কামনা করে। কিন্তু কোনো সরকারই এই জনআকাগ্ধক্ষা পূরণে আগ্রহী হয়নি। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশাসনিক সংস্কারের কিছু পদক্ষেপ নিলেও স্বাভাবিক কারণে তা কোনো কাজে আসেনি।
তখন প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা ও অবসরপ্রাপ্ত সচিবদের সমন্বয়ে প্রশাসন সংস্কার সংক্রান্ত একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সে কমিটি বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন পদ্ধতির পরিবর্তে কর্মকর্তাদের দক্ষতা ও কর্মস্পৃহার ভিত্তিতে উন্মুক্তভাবে প্রতিবেদন প্রদান, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখার জন্য সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট প্রণয়ন, রাজনৈতিক বিবেচনায় পদোন্নতির পরিবর্তে মেধাবী, দক্ষ, সৎও নিষ্ঠাবানদের পদোন্নতি নিশ্চিত করতে কয়েক দফা সুপারিশ করে। সে সবের ভিত্তিতে প্রায় দু’বছর আগে সিভিল সার্ভিস অ্যাক্টের খসড়াও প্রস্তুত করা হয়। বর্তমান সরকার শুরুতে দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত, শক্তিশালী, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ প্রশাসন গড়ে তুলতে সংস্কারের কথা বলেছিল। মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে এ লক্ষ্যে প্রশাসনিক সংস্কারের সিদ্ধান্তও গ্রহণ করা হয়। কিন্তু ওই পর্যন্তই। কার্যত দিনবদলের স্লোগান তুলে প্রশাসনে মুখবদলই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এখন রাজনৈতিক পরিচয় ও ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভিত্তিতেই প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের তালিকাভুক্তি এবং ব্যবস্থাগ্রহণ জোরদার হয়ে উঠেছে। ক্ষমতাসীনদের ঘনিষ্ঠ হিসেবে সুবিধাভোগী ও নজিরবিহীন জনতার মঞ্চ সংশ্লিষ্ট আমলারাই এখন প্রশাসন চালাচ্ছেন। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। ৯৭২ কর্মকর্তার তালিকা করে ৪১১ জনকে বিএনপি, ৭১ জনকে জামায়াতপন্থী হিসেবে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে আর ১৫০ জনকে আওয়ামী লীগপন্থী দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে আবার ভাগ আছে। একনিষ্ঠ আওয়ামীপন্থী ৫৮ জন, সক্রিয় আওয়ামী লীগ ১৩ জন আর সুবিধাবাদী আওয়ামী লীগপন্থী মাত্র ৪ জন। ‘একনিষ্ঠ’ আওয়ামীপন্থীরাই যে এসবের নেপথ্যে ভূমিকা পালন করছেন, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। পদোন্নতি ও ভালো পোসিল্টং তাদের জন্য আর কালো তালিকাভুক্তদের জন্য বরাদ্দ হয়েছে ওএসডি ও হয়রানিমূলক বদলি। এসবের কারণে বিভক্তি আর অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে প্রশাসনের সর্বস্তরে। কালো তালিকাভুক্তদের তালিকায় নিজেদের নাম দেখে ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ করা অনেকেই ক্ষিপ্ত হয়ে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রশাসনের ভূমিকা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণেই প্রশাসনে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কর্মক্ষেত্রে হতে হয় নির্মোহ, নিরপেক্ষ এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু বর্তমান প্রশাসনে এই অবস্থা পুরো অনুপস্থিত। সেখানে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে রাজনৈতিক বিভাজন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রশাসনে যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে অতীতে তা কখনোই দেখা যায়নি। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি এক্ষেত্রে যদি প্রধান বিবেচনার বিষয় হয়ে থাকে তাহলে তাকে আর যাই হোক, প্রশাসনের সংস্কার বলা যাবে না। এসবের কারণে প্রশাসনিক কাজে শিথিলতা সরকারের সার্বিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা বাড়িয়ে তুলেছে। মন্ত্রণালয়গুলোতে বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতার শিকার হচ্ছেন ভুক্তভোগীরা। প্রশাসনকে দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখার আওয়ামী মহাজোটের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিরও কবর হয়েছে। দলীয় পরিচয়ই এখন সর্বত্র প্রধান হয়ে উঠেছে। ফলে নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক কার্যকর প্রশাসনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারের পথে সরকারকেই প্রধান বাধা হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। এটা দূর হওয়ার সম্ভাবনা ক্রমেই স্তিমিত করে তুলছে সৃষ্ট পরিস্থিতি। মহাজোট সরকারের বিষয়ে যারা উত্সাহী ও আশাবাদী ছিলেন তাদের হতাশাও আর গোপন থাকছে না। দিনবদলের সরকারের বছর পূরণের আগেই দুঃস্বপম্নই যে এমনভাবে ঘিরে ধরবে, সেটা কে ভাবতে পেরেছিল?

No comments

Powered by Blogger.