জয়নুলের প্রিয়তমা by সুমন রহমান
মেঘ উড়ে যায়।
আকাশ ওড়ে না।
আকাশের দিকে।
উড়েছে নতুন সিঁড়ি।
জয়নুলের সাফল্যের যত নতুন সিঁড়ি, নেপথ্যে জয়নুলের প্রিয়তমা স্ত্রী জাহানারা আহমেদ। শিল্পচার্যের সমগ্র জীবনের সুখ দুঃখের সারথী। ভরসার স্থল, শিল্পচার্যকে ছায়ার মতো আগলে রেখেছিলেন সারাটা জীবন। প্রতিমার মত সুন্দর এই মহিয়সীর রয়েছে অন্যরকম একটা স্ট্রং পারসোনালিটি। তাই জয়নুলের শিল্পাচার্য হয়ে ওঠার পেছনে জাহানারা আহমেদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। অসম্ভব মেধাবি। স্কুল জীবনে ফার্স্ট গার্ল ছিলেন। অংক শাস্ত্রে তুখোড় ছিলেন বলে বোধকরি জীবনের অংকেও সাফল্য পেয়েছিলেন।
তিন পুত্রের জননী জাহানারা। সন্তানদের পড়াশুনার ব্যাপারে ছিলেন সচেতন। তাই প্রতিটি ছেলেই পড়াশুনায় অসাধারণ সাফল্যের স্বাক্ষর রাখতে পেরেছিলেন। জয়নুল সন্তানদের ভীষণ ভালো বাসতেন। প্রচ- স্নেহকাতর ছিলেন সন্তানদের ব্যাপারে। জাহানারা আহমেদ যদি কখনও ছেলেদের বকাঝকা করতেন শিল্পচার্য ভীষণ রাগ করতেন। এমনও হয়েছে রাগ করে দু’তিন দিন বাসাতেই ফেরেননি। আর্ট কলেজে থেকে গেছেন। শেষে জাহানারা মান ভাঙ্গিয়ে সঙ্গে নিয়ে বাসায় ফিরতেন। অসাধারণ এক রসায়ন ছিলো জয়নুল জাহানারা সম্পর্কে। দু’জন দু’জনকে বেশ বুঝতে পারতেন। এতো বড় সংসারের বড় বউ। অনেক দায়িত্ব। সবার সঙ্গে মানিয়ে চলা। বিশেষ করে জয়নুলের দিকে খেয়াল রাখা। শিল্পাচার্য তখন প্রচ- ব্যস্ত। ছবি আঁকা, আর্ট কলেজ, পানাম নগরীতে লোক শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলার স্বপ্ন, নানামুখি ব্যস্ততা। তাই সাংসারিক কোন ঝামেলা যাতে শিল্পাচার্যের কাছে বাঁধা হয়ে না দাঁড়ায় সেদিকে জাহানারা খুবই সজাগ থাকতেন। আর জয়নুলও বেশ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন জাহানারার প্রতি। বেতনের টাকা। ছবি বিক্রির টাকা সব তুলে দিতেন জাহানারার হাতে। শেষে কলেজে যাওয়ার রিকশা ভাড়া চেয়ে নিতেন বউয়ের কাছ থেকে। জয়নুল সিগারেট খেতেন খুব। পান খেতেন। আর খেতেন চা। প্রচুর সিগারেট খেতেন বলে জাহানারা এক সঙ্গে দুই তিন কার্টন সিগারেট কিনে রাখতেন। জয়নুল বেড়াতে পছন্দ করতেন। স্ত্রী সন্তানদের নিয়েই বেড়াতেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ বেড়িয়েছেন তিনি সস্ত্রীক। একবার শিল্পাচার্য পাকিস্তান গিয়েছেন। ফেরার সময় সবার জন্য কেনাকাটা করে এনেছেন। প্রিয় জাহানারার জন্য এনেছেন শাড়ি। শাড়ি দেখেতো ক্ষেপে আগুন। বললেন এটা কি এনেছো? এটা কোন শাড়ি হলো। আর রং? বিচ্ছিরি। তোমারতো দেখছি রঙের কোন আইডিয়াই নেই। এমন মজার খুনশুটি ছিলো দুজনার। তবে জয়নুলের ছবি আঁকার ব্যাপারে জাহানারা ছিলেন অসম্ভব যতœবান। তাঁর রং তুলি গুছিয়ে রাখা, জয়নুলের লোকজ সব কালেকশন সযতেœ রাখা এমনকি সংসারের কোন সঙ্কটের কথাও জানাতেন না। পাছে শিল্পাচার্যের কাজে ব্যাঘাত ঘটে। কৈ মাছ জয়নুলের ভীষণ পছন্দ ছিলো আর পছন্দ শুঁটকি। কৈ মাছ রান্না হলে সবার জন্য একটি বরাদ্দ থাকলেও জাহানারা জয়নুলের জন্য তুলে রাখতেন তিনটি। এখানেও কি এক পরম মমতার গন্ধ মেলেনা?
ফিরে দেখা
জাহানারা আহমেদ। জন্ম ১৯৩১। ৪০/২ আব্দুল হাদি লেনের বাসিন্দা তৈয়ব উদ্দিন আহমেদের কন্যা ১৯৪৬ সালের ৮ই অক্টোবর পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের সঙ্গে। জাহানারা আহমেদের জ্যেষ্ঠ বোন রহিমা খাতুনের বিয়ে হয়েছিলো জয়নুল আবেদিনের সতীর্থ শফিকুল আমীনের ভাই নূরুল আমিনের সঙ্গে। এভাবে একটি যোগাযোগ সৃষ্টি হয়েছিলো এবং সে অনুযায়ী জয়নুল আবেদিন ১৯৪৬ সালের প্রথমার্ধ্বে জাহানারা আহমেদকে গোপনে তাঁর স্কুলে দেখে যান। এ বিয়ের আনুষ্ঠানিক মধ্যস্থতাকারী ছিলেন সাংবাদিক-সাহিত্যিক আবু জাফর শামসুদ্দিন। অক্টোবরের শুরুতে জয়নুল ময়মনসিংহ এসেছেন শুনে আবু জাফর শামসুদ্দিন কন্যাপক্ষের অনুমতি নিয়ে তাকে আনতে ময়মনসিংহ যান। কিন্তু জয়নুল তখন ধানিখোলায় বোনের বাড়িতে থাকায় আবু জাফর শামসুদ্দিন ফিরে আসছিলেন, কিন্তু পথে কালিরবাজার রেল স্টেশনে জয়নুলের দেখা পেয়ে সেখান থেকেই তাঁকে নিয়ে ঢাকায় পৌঁছান। জয়নুল ওই স্টেশন থেকেই ভাইয়ের খবর পাঠালে জাহিদুর রহিম ঢাকায় আসেন। আবু জাফরের পোশাক পরেই জয়নুল ১৯৪৬ সালের ৭ই অক্টোবর আব্দুল হাদি লেনের বাসায় আনুষ্ঠানিকভাবে জাহানারা আহমেদকে দেখতে যান। সঙ্গে আবু জাফর শামসুদ্দিন ও জাহিদুর রহিম ছিলেন। কনে দেখার পর দিনই আক্দ ও রেজিস্ট্রি সম্পাদিত হয়। অতঃপর ১৯৪৬ সালের ২৬শে ডিসেম্বর জাহানারা আবেদিনকে শ্বশুরগৃহে নিয়ে যাওয়া উপলক্ষে ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে ময়মনসিংহ থেকে জয়নুলের আত্মীয়-স্বজন উপস্থিত ছিলেন। পরদিন ২৭শে ডিসেম্বর নববধূকে নিয়ে বরযাত্রীরা ট্রেনযোগে ময়মনসিংহ প্রত্যাবর্তন করেন। এভাবেই ময়মনসিংহের আকুয়া মাদ্রাসা কোয়ার্টারের শ্বশুরগৃহে নববধূর প্রবেশ ঘটে। বিয়ের সময় জাহানারা আহমেদ ছিলেন ইডেন স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্রী। ঢাকায় ফিরে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ শেষে জাহানারা আবেদিন জানুয়ারির শেষদিকে শ্বশুরগৃহ হয়ে জয়নুলের সঙ্গে কলকাতা চলে যান। ১৯৪৬ সালের ২৭শে ডিসেম্বর শুক্রবার। যেদিন জাহানারা আবেদিন নববধূ হিসেবে প্রথম শ্বশুরগৃহে যান। সেদিন কলকাতায় জয়নুলের গুণগ্রাহীরা এই নববধূকে অভিনন্দিত করে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। কলকাতায় মোহাম্মদী প্রেস থেকে মুদ্রিত এই পুস্তিকার শিরোনাম: জাহানারা জয়নুলকে। ‘আগের কথা’ নামে এর ভূমিকা লেখেন কবি আহসান হাবীব, মোহাম্মদ নাসির আলী, সৈয়দ সাদেকুর রহমান এবং আরও কয়েকজন। এরাই ছিলেন এই পুস্তিকার উদ্যোক্তা প্রকাশক। সম্পূর্ণ লাল-কালিতে ছাপা এ পুস্তিকায় নবদম্পতিকে শুভেচ্ছা জানিয়ে আঠারো জনের কবিতা এবং দুজনের গদ্য স্থান পায়। কবিতা লেখেন সুফিয়া কামাল, বেনজীর আহমদ, কাজী আফসার উদ্দিন আহমেদ, আব্দুল কাদির, শওকত ওসমান, মণীন্দ্রভূষণ গুপ্ত, এবনে গোলাম নবী, কাদের নওয়াজ, মঈনুদ্দিন, আব্দুল মওদুদ, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, সৈয়দ আলী আহসান, গোলাম কুদ্দুস, অবন্তী সান্যাল, মতিউল ইসলাম, মোতাহার হোসেন, ইবনে বতুতা ও ফররুখ আহমদ। গদ্য লেখেন মুজীবুর রহমান খাঁ ও শেফাউল মূলক, ছদ্মনামের একজন। আরবী-ফার্সি উর্দু মিশ্রিত ভাষায় দ্বিতীয় গদ্যটি কৌতুকপূর্ণ ঢংয়ে লেখা। জয়নুল আবেদিন তৎকালীন কলকাতার কবি সাহিত্যিক ও শিল্পী মহলে কতটা আদরণীয় ও শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন তা এ পুস্তিকা থেকে অনুধাবন করা যায়।
ওই পুস্তিকা থেকে নবদম্পতির উদ্দেশে গদ্য-পদ্যে রচিত জয়নুল আবেদিনের শুভানুধ্যায়ী বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কিছু আশীর্বচনের অংশবিশেষ নিচে উদ্ধৃত করলে আবেদিন সে সময়ে কতটা সম্মান ও স্নেহের পাত্র ছিলেন, তা উপলব্ধি করা সহজ হবে। জয়নুলের শিক্ষক শিল্পী মণীন্দ্রভূষণ গুপ্ত (১৮৯৮-১৯৬৮) লেখেন : ‘তুমি নূতন জীবনে প্রবেশ করিতে যাইতেছ, তোমার শিল্পসৃষ্টির মতই তাহা আনন্দপূর্ণ এবং কণ্টকহীন হউক; তোমার শিল্পের মধ্যে যে মানবপ্রেম নিহিত আছে, তাহা তোমার ব্যক্তিগত জীবনে প্রতিফলিত হউক।’ (পৃ.পাঁচ)। কবি খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন (১৯০১-৮১)-এর রচনা : ‘নব-বাঙলার বন্ধুরা শোন হিন্দু-মুসলেমীন,/ শিল্পী চোলেছে দোসর খুঁজিতে-জয়নাল আবেদিন ।/...প্রাণ পেলো যাঁর বদৌলতে,-দি-ই মোবারক বাদ,/ লভুক আজিকে নোতুন করিয়া নবজীবনের স্বাদ।’ (পৃ. সাত)। কবি বেনজীর আহমেদ (১৯০৩-৮৩) লেখেন : ‘সোনার ফসল-আশা জেগেছে মনের কোণে-কোণে/ তামাটে আকাশ ছেয়ে নেমেছে কাজল মেঘ-মায়াÑ/ কঠোর মাটির বুকে খেয়ালী আবার স্বপ্ন বোনে,/ প্রেমের মধুর রসে সে স্বপ্ন লভুক রূপ-কায়া।’ কবি আবদুল কাদির (১৯০৬-৮৪) রচিত সনেটের শেষ চরণ: ‘সেই রেখাময়ী কিগোর ধরা দেয় বাহু-আলিঙ্গনে,/বাসর-প্রাঙ্গণে তোলে ব্যাকুলিয়া হাসির বিদ্যুতে?/প্রথম আষাঢ়ে কাঁদে পাঠাইয়া মর্ত্তো মেঘদূতে,/চিত্তের তমসা-তলে ফিরে পুনঃ স্বপ্নে সংগোপনে?/এবার জাগিয়া র’বে তা’রি নূপুর নিক্বণে; বসন্ত-সঙ্গীত বাজে তাই তব জীবন-তন্তুতে॥’ কবি কাদের নেওয়াজের (১৯০৯৬-৮৩) জিজ্ঞাসা: ‘অনেক ছবি ত’ এঁকেছ শিল্পী।/ আজিকে কাহার ছবি,/আঁকিতেছ হৃদে, মানবী কিম্বা/দেবী সে, শুধায় কবি।’ সাংবাদিক ও সাহিত্যিক মুজীবুর রহমান খাঁ (১৯১০-৮৪) বলেন: ‘কিন্তু সেই চির-পুরাতন ও চির-নূতন প্রশ্নÑযা ছিল শিল্পীর তুলিকায় এতদিন, আজ এল নেমে তেমনই জিজ্ঞাসা নিয়ে তার জীবনের পাতায়। আশা করি, তার প্রতিভা-দীপ্ত তুলির আঁকা ছবিটির মত জীবনের পাতায়ও এই মিলন-মধুর প্রশ্নের জওয়াব তার সুন্দর হবে, বিচিত্র হবে, হবে নিপুণ ও অনিন্দনীয়Ñ।’ কবি সুফিয়া কামালের (১৯১১-৯৯) কবিতা: ‘যে-দিগন্ত শূন্য ছিল সেথা হল আঁকা? একটি তারকা,/ঈষৎ কম্পিত, ভীরু হৃদ-স্পনন্দন সম/স্নিগ্ধ মনোরম।/সে আলোর অনির্বাণ শিখাহীন জ্যোতি/পূর্ণ পরিণতি/লভিবে সম্মুখে এলে চন্দ্রহীন রাতি,/সেই-ই হবে সাথী।/সে দীপ্তি শাশ্বত অচঞ্চলÑ/জীবনের পথের সম্বল॥’ কবি ও সঙ্গীতশিল্পী জ্যোতিরিন্দ্র নাথ মৈত্র (১৯১১-৭৭) লিখেছেন: ‘শিল্পীর প্রাণাবেগ মূর্ত্ত হল পূর্ণ প্রতিমায়।/তিলে তিলে গড়ে তুলো দ্বৈত সুরে গাঁথা/জীবনের সুর-সৌধ। তোমার বিধাতা/জানি আমি একমাত্র তুমি।/কারণ তুমি যে শিল্পী দীপ্ত জীবনের।/পূর্ণ হও, প্রীত হও, শুদ্ধ মহিমায়॥’ শিল্পীর উদ্দেশে কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমানের (১৯১৭-৯৮) কয়েকটি পঙ্ক্তি: ‘নীড় আর আকাশের ডাক/মাঝখানে থাকে যত ফাঁকÑ/শিল্পী, পূর্ণ করে দাও তুমি,/তারি সুরে জেগে উঠে চিত্ত-বন-ভূমি।’ কবি ফররুখ আহমদ (১৯১৮-৭৪) রচিত সনেটের শেষ ছয় পঙক্তি; ‘তুমি এলে সে আঁধারে তারপর দ্যুতি নিয়ে একা,/যে নীল ছিল না শূন্যে মায়াঞ্জনে এল সেই নীল,/তিমির শেখর ঊর্ধ্বে আলোকের দীপ্ত ত্যোজির্লেখা/নিমিষে মুছিয়া নিল আঁধারের উদ্দাম ফেনিল/সংখ্যাহীন ঘূর্ণাবর্ত, সংশয়ের ঘন-কৃষ্ণ রেখা,/স্বপ্নহীন নভাঙ্গন হ’ল মোর স্বপ্নময় নীল॥’ কবি ও গদ্যকার সৈয়দ আলী আহসান (১৯২২-২০০২) লেখেন: ‘অঞ্জন দাও নয়নে এবার জাগো বিচিত্রালোকে/তোমাদের প্রাণ প্রদীপ্ত হোক্ নব মাধুর্যে আজ॥’
১৯৪৬ সালের নভেম্বর ডিসেম্বরে ইউনেসকোর উদ্যোগে প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয় একটি আন্তর্জাতিক আধুনিক চিত্রকলা প্রদর্শনী (এক্সপোজিশন ইন্টারন্যাশনাল দি আর্ট মডার্ন, মুসেক দি আর্ট মডার্ন (ইউনেসকো, প্যারিস)। এ প্রদর্শনীতে ভারত থেকে যাঁদের ছবি স্থান পায় তাঁরা হলেন: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, যামিনী রায়, রামকিঙ্কর বেইজ, অমৃতা শেরগিল, শৈলজ মুখার্জি, জ্যোতিরিন্দ্র রায়, সুনীল মুখার্জি, সুশীল সরকার, অমূল্য সেন, ওয়াই কে শুক্লা, সতীশ সিনহা, জয়নুল আবেদিন, সফিউদ্দীন আহমেদ, বঙ্কিমচন্দ্র ব্যানার্জি, মুক্তিপদ ব্যানার্জি, নগেন ভট্টাচার্য ও ফণীভূষণ।
১৯৪৭ সালের শেষ জানুয়ারিতে জয়নুল আবেদিন তাঁর নববধূ জাহানারা আবেদিনকে সঙ্গে নিয়ে ময়মনসিংহ থেকে ট্রেনে করে কলকাতায় যান। আগেই নতুন বাসা ভাড়া করা ছিল, কিন্তু পৌঁছাতে রাত হয়ে যাওয়ায় নবদম্পতি কলকাতায় তাঁদের প্রথম রাত কাটান ১৪ নম্বর সার্কাস রো-র পুরোনো বাসায়। পরদিন তাঁরা ৩৬ নম্বর তারক দত্ত রোডের নতুন বাসায় গিয়ে ওঠেন। বাসাটি ভাড়া করা হয়েছিল জাহানারা আবেদিনের বড় পরিবারের (রহিমা খাতুন ও নুরুল আমীনের পরিবার) সঙ্গে একত্রে। ভাড়া ছিল ৮০ টাকা। দুই পরিবার সমানভাবে মেটাবে বলে স্থির হয়েছিল। জয়নুলের তখন মাসিক বেতন ছিল ২০০ টাকার কম। এছাড়া ইত্তেহাদ পত্রিকায় প্রতি সপ্তাহে নিয়মিতভাবে ড্রয়িং ও ইলাস্ট্রেশন করে মাসে ১০০ টাকা পেতেন। জাহানারা আবেদিন গার্হস্থ্যকর্মে ছিলেন অনভ্যস্ত ও অপটু। জয়নুলের বিবাহপূর্ব জীবনের পরিচারক সফি রান্নার ব্যাপারে প্রথমাবস্থায় সাহায্য করে। আবার জয়নুলও কিছুদিন রান্না করেন। মার্চের দিকে একবার জাহানারা আবেদিন তাঁর মায়ের সঙ্গে ঢাকা ঘুরে যান। এবং ১৯৪৭-এর জুলাই মাসে বোন রহিমা খাতুনের পরিবারের সঙ্গে চূড়ান্তভাবে ঢাকা চলে আসেন। জয়নুল জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে কলকাতা ছাড়লেও ময়মনসিংহ হয়ে ঢাকা আসেন আগস্টে। কলকাতায় এই কয়েক মাসের অবস্থানকালে জয়নুল, দাঙ্গাবিধ্বস্ত কলকাতার নিরাপত্তাহীন পরিবেশের কারণে নববধূকে নিয়ে বেশি বেড়াতে পারেননি। এই নবদম্পতি ডেন্টিস্ট আর আহমেদ ও শিল্পী আনোয়ারুল হকের বাসায় নিমন্ত্রিত হয়েছেন। কিছু আত্মীয়-স্বজনের বাসায় বেড়িয়েছেন। তা ছাড়া গেছেন শিল্প প্রদর্শনীতে, যেখানে জয়নুলের ছবিও ছিল; সেখানে শিল্পী অতুল বসু ও তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে, একাডেমি অব ফাইন আর্টের লেডি রানু মুখার্জির সঙ্গে দেখা হয়েছে। জ্যোতির্ময় রায় পরিচালিত উদয়ের পথে শীর্ষক চলচ্চিত্রের প্রেস শোতে গেছেন। জ্যোতির্ময় রায়ের স্ত্রী বিনতা রায় ছিলেন ওই ছবির নায়িকা, নায়ক ছিলেন রাধামোহন সেন। ওই শোতে দেখা হয় যামিনী রায়ের সঙ্গে। যামিনী রায় জাহানারা আবেদিনকে দেখে জয়নুলকে বলেন: ‘কোথা থেকে এই পটের ছবি নিয়ে এলে?’ অতুল বসু ও যামিনী রায় দুজনই জাহানারা আবেদিনকে বলেছিলেন, ‘জয়নুলকে তোমার দেখে রাখতে হবে, যাতে ওর ছবি আঁকায় বিঘœ না ঘটে।’ ওই কয়েক মাসে জাহানারা আবেদিনের মনে হয়েছে: জয়নুল বোধ হয় কোনো শৃঙ্খলে আটকে পড়েছেন, সে জন্য ছটফট করছেন। বিকেলে বা ছুটির দিনগুলোতে জয়নুল তাঁর স্ত্রীর একটু খোঁজ নিয়ে আবার বেরিয়ে যেতেন। বেরিয়ে গিয়ে কিছু একটা কিনে ফিরে এসে আবার বেরিয়ে পড়তেন। এ সময় কলকাতা আর্ট স্কুলের শিক্ষক বলাইচন্দ্র দাস প্রতিদিন স্কুল ছুটির আগে বাগান থেকে একটি করে ফুল তুলে এনে জয়নুল আবেদিনের হাতে দিতেন। জয়নুল আবেদিন তাঁর শিক্ষকের এই আশীর্বাদপুষ্ট স্নেহের দানটি অতি যত্নে স্ত্রীর উদ্দেশে বাসায় নিয়ে যেতেন।
বিষাদ পর্ব
সুখ দুঃখের দোলাচলে জয়নুল দম্পতির দিনগুলো যখন মধুর আর রঙিন। তখন বিধাতা কেন জানিনা হঠাৎ এর মধ্যে বিষাদের রেখা টানলেন। ১৯৭৫ সালের মধ্য পর্যায় থেকে জয়নুলের শরীর খারাপ হচ্ছিল। মাঝে মধ্যে জ্বর, কাশি হতো। সেপ্টেম্বর অক্টোবর থেকে তিনি প্রায়শঃ অসুস্থবোধ করতে থাকেন। শরীর বেশ খারাপ হয়ে যায়। হাসপাতালে তার নানা রকম পরীক্ষা করা হয়। এক্স-রেতে ধরা পড়লো ফুসফুসে টিউমার। ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী ক্যান্সারের সন্দেহ করলেন এবং বিদেশে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। ১৯৭৬ সালের ১৬ই জানুয়ারি জয়নুল আবেদিন চিকিৎসার জন্য লন্ডনের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। সঙ্গে প্রিয়তমা স্ত্রী জাহানারা। লন্ডনের হ্যামার স্মিথ হাসপাতালে তাকে দেখানো হয়। সেখানে ডা. মরিসন জয়নুলের চিকিৎসা করেন। ব্রঙ্কোসকপি করে ডাক্তাররা নিশ্চিত হন যে, টিউমারটা ম্যালিগন্যান্ট এবং অপারেশনের সুযোগ নেই। ফলে ডাক্তার কেমোথেরাপির কোর্স শুরু করেন। লন্ডনে থাকতেই কেমোথেরাপির দুটো কোর্স সম্পন্ন করা হয়। প্রায় দুই মাস চিকিৎসার পর জয়নুল লন্ডন ত্যাগ করেন। লন্ডনে ডা. মরিসনকে শিল্পচার্য বলেছিলেন, ‘ডাক্তার আমার একটা ব্যবস্থা করো যাতে দু’ বছর বাঁচতে পারি। সোনারগাঁওয়ের লোক শিল্প জাদুঘর ও কারুপল্লী নির্মাণের প্রকল্পটি তিনি শেষ করে যেতে চেয়েছিলেন। যেটি জয়নুলের মতো জাহানাররাও স্বপ্ন ছিলো।
ঢাকায় ফিরে পিজি হাসপাতালে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) চিকিৎসা চলেছে শিল্পাচার্যের। ৭ই মে বিটিভির লোকজন ক্যামেরাসহ জয়নুলের বাসায় গিয়ে তাকে না পেয়ে হাসপাতালে গিয়েছিলেন। হাসপাতালে ওরা তাঁর ছবি তুলেছিলো। ওদের অনুরোধেই শিল্পচার্য ‘দুই মুখ’ শীর্ষক জীবনের শেষ ছবিটি এঁকেছিলেন ওইদিন হাসপাতালে বসেই।
এরপর জয়নুলের শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতির দিকে যেতে থাকে। জাহানারা যেন আর কোন আশার আলো দেখতে পান না। চারদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে আসে।
১৯৭৬ সালের ২৭শে মে সন্ধ্যার দিকে ড. কুদরত-এ খুদা জয়নুলকে দেখতে হাসপাতালে যান। জাহানারা আবেদীনের ভাষায়-‘আবেদিন অতিশয় মমতার সঙ্গে ওঁর হাত ধরলেন। মনে হলো ঘুমিয়ে গেলেন। ঘুম দেখে রাতে আর তাঁকে জাগালাম না। আমরাও ঘুমিয়ে গেলাম। ২৮শে মে সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি ওঁর বিছানা ভিজে গেছে। সব পরিস্কার করে দিলাম। আমি তখনও কিছু বুঝে উঠতে পারিনি। আমি ওর জন্য নাশতা তৈরি করলাম। আবেদিন ঘুমে আছে দেখে আমরা নাশতা খেয়ে নিলাম। সকাল সাড়ে সাতটার দিকে ডাক্তার এলেন। এসেই অক্সিজেনের ব্যবস্থা করলেন। এরপর সকাল সোয়া এগারোটা। জয়নুলের প্রিয়তমা জাহানার জীবনের ছন্দ হারিয়ে গেল। সকল দরজা বন্ধ হয়ে গেল যেনো। বাংলাদেশের এক উজ্জ্বলতম নক্ষত্রের পতন। শিল্পাচার্য চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
‘...আমি চলিলাম/যেথা নাই নাম,/যেখানে পেয়েছে লয়/সকল বিশেষ পরিচয়, নাই আর আছে? এক হয়ে যেথা মিশিয়াছে/যেখানে অখ- দিন/আলোহীন অন্ধকারহীন,/আমার আমির ধারা মিলে যেথা যাবে ক্রমে ক্রমে/পরিপূর্ণ চৈতন্যের সাগর সঙ্গমে।’
জয়নুলের প্রিয়তমা জাহানারা। দিন যায়। বছর গড়িয়ে যুগ। কোন কিছুতেই যেন আর তার মন লাগে না। আবেদিন ছাড়া এই ধরা ধামে সবকিছুই যেন অর্থহীন মনে হয়। চারিদিকে এতো আলো, এতো রং এতো আয়োজন কোন কিছুতেই যেন তিনি আর তাল মেলাতে পারেন না। সর্বত্র আবেদিনের ছায়া লেগে আছে। তিনি ভুলতে পারেন না। তিরতিরে জলের মতো শান্ত আর নীরব আনন্দের মতো জেগে থাকে প্রাণে। জয়নুলের চরণ ধ্বনি কি শুনতে পান জাহানারা? কোন সুদূর থেকে ভেসে আসে সেই ধ্বনি! জাহানারার বুকের ভেতর ইন্দ্র ধনুর মতো আবেশ ছড়ায়। জীবনের এইসব সঙ্গীত থেমে গেলে একদিন মহাকাল এসে হাত ধরে নিয়ে যাবে ঠিক। জাহানারা প্রহর গুনছেন কাক্সিক্ষত সেই শান্তিধামের। কত দূরে আর? আমার ভাবনাও কি সেই দিকেই ধাইছে? ...এ অসম্ভব। নয়!
>>>বিশেষ কৃতজ্ঞতা: ময়নুল আবেদিন ও কোহিনূর আবেদিন। এবং সৈয়দ আজিজুল হক রচিত জয়নুল আবেদিন: সৃষ্টিশীল জীবন সমগ্র
আকাশ ওড়ে না।
আকাশের দিকে।
উড়েছে নতুন সিঁড়ি।
জয়নুলের সাফল্যের যত নতুন সিঁড়ি, নেপথ্যে জয়নুলের প্রিয়তমা স্ত্রী জাহানারা আহমেদ। শিল্পচার্যের সমগ্র জীবনের সুখ দুঃখের সারথী। ভরসার স্থল, শিল্পচার্যকে ছায়ার মতো আগলে রেখেছিলেন সারাটা জীবন। প্রতিমার মত সুন্দর এই মহিয়সীর রয়েছে অন্যরকম একটা স্ট্রং পারসোনালিটি। তাই জয়নুলের শিল্পাচার্য হয়ে ওঠার পেছনে জাহানারা আহমেদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। অসম্ভব মেধাবি। স্কুল জীবনে ফার্স্ট গার্ল ছিলেন। অংক শাস্ত্রে তুখোড় ছিলেন বলে বোধকরি জীবনের অংকেও সাফল্য পেয়েছিলেন।
তিন পুত্রের জননী জাহানারা। সন্তানদের পড়াশুনার ব্যাপারে ছিলেন সচেতন। তাই প্রতিটি ছেলেই পড়াশুনায় অসাধারণ সাফল্যের স্বাক্ষর রাখতে পেরেছিলেন। জয়নুল সন্তানদের ভীষণ ভালো বাসতেন। প্রচ- স্নেহকাতর ছিলেন সন্তানদের ব্যাপারে। জাহানারা আহমেদ যদি কখনও ছেলেদের বকাঝকা করতেন শিল্পচার্য ভীষণ রাগ করতেন। এমনও হয়েছে রাগ করে দু’তিন দিন বাসাতেই ফেরেননি। আর্ট কলেজে থেকে গেছেন। শেষে জাহানারা মান ভাঙ্গিয়ে সঙ্গে নিয়ে বাসায় ফিরতেন। অসাধারণ এক রসায়ন ছিলো জয়নুল জাহানারা সম্পর্কে। দু’জন দু’জনকে বেশ বুঝতে পারতেন। এতো বড় সংসারের বড় বউ। অনেক দায়িত্ব। সবার সঙ্গে মানিয়ে চলা। বিশেষ করে জয়নুলের দিকে খেয়াল রাখা। শিল্পাচার্য তখন প্রচ- ব্যস্ত। ছবি আঁকা, আর্ট কলেজ, পানাম নগরীতে লোক শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলার স্বপ্ন, নানামুখি ব্যস্ততা। তাই সাংসারিক কোন ঝামেলা যাতে শিল্পাচার্যের কাছে বাঁধা হয়ে না দাঁড়ায় সেদিকে জাহানারা খুবই সজাগ থাকতেন। আর জয়নুলও বেশ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন জাহানারার প্রতি। বেতনের টাকা। ছবি বিক্রির টাকা সব তুলে দিতেন জাহানারার হাতে। শেষে কলেজে যাওয়ার রিকশা ভাড়া চেয়ে নিতেন বউয়ের কাছ থেকে। জয়নুল সিগারেট খেতেন খুব। পান খেতেন। আর খেতেন চা। প্রচুর সিগারেট খেতেন বলে জাহানারা এক সঙ্গে দুই তিন কার্টন সিগারেট কিনে রাখতেন। জয়নুল বেড়াতে পছন্দ করতেন। স্ত্রী সন্তানদের নিয়েই বেড়াতেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ বেড়িয়েছেন তিনি সস্ত্রীক। একবার শিল্পাচার্য পাকিস্তান গিয়েছেন। ফেরার সময় সবার জন্য কেনাকাটা করে এনেছেন। প্রিয় জাহানারার জন্য এনেছেন শাড়ি। শাড়ি দেখেতো ক্ষেপে আগুন। বললেন এটা কি এনেছো? এটা কোন শাড়ি হলো। আর রং? বিচ্ছিরি। তোমারতো দেখছি রঙের কোন আইডিয়াই নেই। এমন মজার খুনশুটি ছিলো দুজনার। তবে জয়নুলের ছবি আঁকার ব্যাপারে জাহানারা ছিলেন অসম্ভব যতœবান। তাঁর রং তুলি গুছিয়ে রাখা, জয়নুলের লোকজ সব কালেকশন সযতেœ রাখা এমনকি সংসারের কোন সঙ্কটের কথাও জানাতেন না। পাছে শিল্পাচার্যের কাজে ব্যাঘাত ঘটে। কৈ মাছ জয়নুলের ভীষণ পছন্দ ছিলো আর পছন্দ শুঁটকি। কৈ মাছ রান্না হলে সবার জন্য একটি বরাদ্দ থাকলেও জাহানারা জয়নুলের জন্য তুলে রাখতেন তিনটি। এখানেও কি এক পরম মমতার গন্ধ মেলেনা?
ফিরে দেখা
জাহানারা আহমেদ। জন্ম ১৯৩১। ৪০/২ আব্দুল হাদি লেনের বাসিন্দা তৈয়ব উদ্দিন আহমেদের কন্যা ১৯৪৬ সালের ৮ই অক্টোবর পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের সঙ্গে। জাহানারা আহমেদের জ্যেষ্ঠ বোন রহিমা খাতুনের বিয়ে হয়েছিলো জয়নুল আবেদিনের সতীর্থ শফিকুল আমীনের ভাই নূরুল আমিনের সঙ্গে। এভাবে একটি যোগাযোগ সৃষ্টি হয়েছিলো এবং সে অনুযায়ী জয়নুল আবেদিন ১৯৪৬ সালের প্রথমার্ধ্বে জাহানারা আহমেদকে গোপনে তাঁর স্কুলে দেখে যান। এ বিয়ের আনুষ্ঠানিক মধ্যস্থতাকারী ছিলেন সাংবাদিক-সাহিত্যিক আবু জাফর শামসুদ্দিন। অক্টোবরের শুরুতে জয়নুল ময়মনসিংহ এসেছেন শুনে আবু জাফর শামসুদ্দিন কন্যাপক্ষের অনুমতি নিয়ে তাকে আনতে ময়মনসিংহ যান। কিন্তু জয়নুল তখন ধানিখোলায় বোনের বাড়িতে থাকায় আবু জাফর শামসুদ্দিন ফিরে আসছিলেন, কিন্তু পথে কালিরবাজার রেল স্টেশনে জয়নুলের দেখা পেয়ে সেখান থেকেই তাঁকে নিয়ে ঢাকায় পৌঁছান। জয়নুল ওই স্টেশন থেকেই ভাইয়ের খবর পাঠালে জাহিদুর রহিম ঢাকায় আসেন। আবু জাফরের পোশাক পরেই জয়নুল ১৯৪৬ সালের ৭ই অক্টোবর আব্দুল হাদি লেনের বাসায় আনুষ্ঠানিকভাবে জাহানারা আহমেদকে দেখতে যান। সঙ্গে আবু জাফর শামসুদ্দিন ও জাহিদুর রহিম ছিলেন। কনে দেখার পর দিনই আক্দ ও রেজিস্ট্রি সম্পাদিত হয়। অতঃপর ১৯৪৬ সালের ২৬শে ডিসেম্বর জাহানারা আবেদিনকে শ্বশুরগৃহে নিয়ে যাওয়া উপলক্ষে ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে ময়মনসিংহ থেকে জয়নুলের আত্মীয়-স্বজন উপস্থিত ছিলেন। পরদিন ২৭শে ডিসেম্বর নববধূকে নিয়ে বরযাত্রীরা ট্রেনযোগে ময়মনসিংহ প্রত্যাবর্তন করেন। এভাবেই ময়মনসিংহের আকুয়া মাদ্রাসা কোয়ার্টারের শ্বশুরগৃহে নববধূর প্রবেশ ঘটে। বিয়ের সময় জাহানারা আহমেদ ছিলেন ইডেন স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্রী। ঢাকায় ফিরে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ শেষে জাহানারা আবেদিন জানুয়ারির শেষদিকে শ্বশুরগৃহ হয়ে জয়নুলের সঙ্গে কলকাতা চলে যান। ১৯৪৬ সালের ২৭শে ডিসেম্বর শুক্রবার। যেদিন জাহানারা আবেদিন নববধূ হিসেবে প্রথম শ্বশুরগৃহে যান। সেদিন কলকাতায় জয়নুলের গুণগ্রাহীরা এই নববধূকে অভিনন্দিত করে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। কলকাতায় মোহাম্মদী প্রেস থেকে মুদ্রিত এই পুস্তিকার শিরোনাম: জাহানারা জয়নুলকে। ‘আগের কথা’ নামে এর ভূমিকা লেখেন কবি আহসান হাবীব, মোহাম্মদ নাসির আলী, সৈয়দ সাদেকুর রহমান এবং আরও কয়েকজন। এরাই ছিলেন এই পুস্তিকার উদ্যোক্তা প্রকাশক। সম্পূর্ণ লাল-কালিতে ছাপা এ পুস্তিকায় নবদম্পতিকে শুভেচ্ছা জানিয়ে আঠারো জনের কবিতা এবং দুজনের গদ্য স্থান পায়। কবিতা লেখেন সুফিয়া কামাল, বেনজীর আহমদ, কাজী আফসার উদ্দিন আহমেদ, আব্দুল কাদির, শওকত ওসমান, মণীন্দ্রভূষণ গুপ্ত, এবনে গোলাম নবী, কাদের নওয়াজ, মঈনুদ্দিন, আব্দুল মওদুদ, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, সৈয়দ আলী আহসান, গোলাম কুদ্দুস, অবন্তী সান্যাল, মতিউল ইসলাম, মোতাহার হোসেন, ইবনে বতুতা ও ফররুখ আহমদ। গদ্য লেখেন মুজীবুর রহমান খাঁ ও শেফাউল মূলক, ছদ্মনামের একজন। আরবী-ফার্সি উর্দু মিশ্রিত ভাষায় দ্বিতীয় গদ্যটি কৌতুকপূর্ণ ঢংয়ে লেখা। জয়নুল আবেদিন তৎকালীন কলকাতার কবি সাহিত্যিক ও শিল্পী মহলে কতটা আদরণীয় ও শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন তা এ পুস্তিকা থেকে অনুধাবন করা যায়।
ওই পুস্তিকা থেকে নবদম্পতির উদ্দেশে গদ্য-পদ্যে রচিত জয়নুল আবেদিনের শুভানুধ্যায়ী বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কিছু আশীর্বচনের অংশবিশেষ নিচে উদ্ধৃত করলে আবেদিন সে সময়ে কতটা সম্মান ও স্নেহের পাত্র ছিলেন, তা উপলব্ধি করা সহজ হবে। জয়নুলের শিক্ষক শিল্পী মণীন্দ্রভূষণ গুপ্ত (১৮৯৮-১৯৬৮) লেখেন : ‘তুমি নূতন জীবনে প্রবেশ করিতে যাইতেছ, তোমার শিল্পসৃষ্টির মতই তাহা আনন্দপূর্ণ এবং কণ্টকহীন হউক; তোমার শিল্পের মধ্যে যে মানবপ্রেম নিহিত আছে, তাহা তোমার ব্যক্তিগত জীবনে প্রতিফলিত হউক।’ (পৃ.পাঁচ)। কবি খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন (১৯০১-৮১)-এর রচনা : ‘নব-বাঙলার বন্ধুরা শোন হিন্দু-মুসলেমীন,/ শিল্পী চোলেছে দোসর খুঁজিতে-জয়নাল আবেদিন ।/...প্রাণ পেলো যাঁর বদৌলতে,-দি-ই মোবারক বাদ,/ লভুক আজিকে নোতুন করিয়া নবজীবনের স্বাদ।’ (পৃ. সাত)। কবি বেনজীর আহমেদ (১৯০৩-৮৩) লেখেন : ‘সোনার ফসল-আশা জেগেছে মনের কোণে-কোণে/ তামাটে আকাশ ছেয়ে নেমেছে কাজল মেঘ-মায়াÑ/ কঠোর মাটির বুকে খেয়ালী আবার স্বপ্ন বোনে,/ প্রেমের মধুর রসে সে স্বপ্ন লভুক রূপ-কায়া।’ কবি আবদুল কাদির (১৯০৬-৮৪) রচিত সনেটের শেষ চরণ: ‘সেই রেখাময়ী কিগোর ধরা দেয় বাহু-আলিঙ্গনে,/বাসর-প্রাঙ্গণে তোলে ব্যাকুলিয়া হাসির বিদ্যুতে?/প্রথম আষাঢ়ে কাঁদে পাঠাইয়া মর্ত্তো মেঘদূতে,/চিত্তের তমসা-তলে ফিরে পুনঃ স্বপ্নে সংগোপনে?/এবার জাগিয়া র’বে তা’রি নূপুর নিক্বণে; বসন্ত-সঙ্গীত বাজে তাই তব জীবন-তন্তুতে॥’ কবি কাদের নেওয়াজের (১৯০৯৬-৮৩) জিজ্ঞাসা: ‘অনেক ছবি ত’ এঁকেছ শিল্পী।/ আজিকে কাহার ছবি,/আঁকিতেছ হৃদে, মানবী কিম্বা/দেবী সে, শুধায় কবি।’ সাংবাদিক ও সাহিত্যিক মুজীবুর রহমান খাঁ (১৯১০-৮৪) বলেন: ‘কিন্তু সেই চির-পুরাতন ও চির-নূতন প্রশ্নÑযা ছিল শিল্পীর তুলিকায় এতদিন, আজ এল নেমে তেমনই জিজ্ঞাসা নিয়ে তার জীবনের পাতায়। আশা করি, তার প্রতিভা-দীপ্ত তুলির আঁকা ছবিটির মত জীবনের পাতায়ও এই মিলন-মধুর প্রশ্নের জওয়াব তার সুন্দর হবে, বিচিত্র হবে, হবে নিপুণ ও অনিন্দনীয়Ñ।’ কবি সুফিয়া কামালের (১৯১১-৯৯) কবিতা: ‘যে-দিগন্ত শূন্য ছিল সেথা হল আঁকা? একটি তারকা,/ঈষৎ কম্পিত, ভীরু হৃদ-স্পনন্দন সম/স্নিগ্ধ মনোরম।/সে আলোর অনির্বাণ শিখাহীন জ্যোতি/পূর্ণ পরিণতি/লভিবে সম্মুখে এলে চন্দ্রহীন রাতি,/সেই-ই হবে সাথী।/সে দীপ্তি শাশ্বত অচঞ্চলÑ/জীবনের পথের সম্বল॥’ কবি ও সঙ্গীতশিল্পী জ্যোতিরিন্দ্র নাথ মৈত্র (১৯১১-৭৭) লিখেছেন: ‘শিল্পীর প্রাণাবেগ মূর্ত্ত হল পূর্ণ প্রতিমায়।/তিলে তিলে গড়ে তুলো দ্বৈত সুরে গাঁথা/জীবনের সুর-সৌধ। তোমার বিধাতা/জানি আমি একমাত্র তুমি।/কারণ তুমি যে শিল্পী দীপ্ত জীবনের।/পূর্ণ হও, প্রীত হও, শুদ্ধ মহিমায়॥’ শিল্পীর উদ্দেশে কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমানের (১৯১৭-৯৮) কয়েকটি পঙ্ক্তি: ‘নীড় আর আকাশের ডাক/মাঝখানে থাকে যত ফাঁকÑ/শিল্পী, পূর্ণ করে দাও তুমি,/তারি সুরে জেগে উঠে চিত্ত-বন-ভূমি।’ কবি ফররুখ আহমদ (১৯১৮-৭৪) রচিত সনেটের শেষ ছয় পঙক্তি; ‘তুমি এলে সে আঁধারে তারপর দ্যুতি নিয়ে একা,/যে নীল ছিল না শূন্যে মায়াঞ্জনে এল সেই নীল,/তিমির শেখর ঊর্ধ্বে আলোকের দীপ্ত ত্যোজির্লেখা/নিমিষে মুছিয়া নিল আঁধারের উদ্দাম ফেনিল/সংখ্যাহীন ঘূর্ণাবর্ত, সংশয়ের ঘন-কৃষ্ণ রেখা,/স্বপ্নহীন নভাঙ্গন হ’ল মোর স্বপ্নময় নীল॥’ কবি ও গদ্যকার সৈয়দ আলী আহসান (১৯২২-২০০২) লেখেন: ‘অঞ্জন দাও নয়নে এবার জাগো বিচিত্রালোকে/তোমাদের প্রাণ প্রদীপ্ত হোক্ নব মাধুর্যে আজ॥’
১৯৪৬ সালের নভেম্বর ডিসেম্বরে ইউনেসকোর উদ্যোগে প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয় একটি আন্তর্জাতিক আধুনিক চিত্রকলা প্রদর্শনী (এক্সপোজিশন ইন্টারন্যাশনাল দি আর্ট মডার্ন, মুসেক দি আর্ট মডার্ন (ইউনেসকো, প্যারিস)। এ প্রদর্শনীতে ভারত থেকে যাঁদের ছবি স্থান পায় তাঁরা হলেন: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, যামিনী রায়, রামকিঙ্কর বেইজ, অমৃতা শেরগিল, শৈলজ মুখার্জি, জ্যোতিরিন্দ্র রায়, সুনীল মুখার্জি, সুশীল সরকার, অমূল্য সেন, ওয়াই কে শুক্লা, সতীশ সিনহা, জয়নুল আবেদিন, সফিউদ্দীন আহমেদ, বঙ্কিমচন্দ্র ব্যানার্জি, মুক্তিপদ ব্যানার্জি, নগেন ভট্টাচার্য ও ফণীভূষণ।
১৯৪৭ সালের শেষ জানুয়ারিতে জয়নুল আবেদিন তাঁর নববধূ জাহানারা আবেদিনকে সঙ্গে নিয়ে ময়মনসিংহ থেকে ট্রেনে করে কলকাতায় যান। আগেই নতুন বাসা ভাড়া করা ছিল, কিন্তু পৌঁছাতে রাত হয়ে যাওয়ায় নবদম্পতি কলকাতায় তাঁদের প্রথম রাত কাটান ১৪ নম্বর সার্কাস রো-র পুরোনো বাসায়। পরদিন তাঁরা ৩৬ নম্বর তারক দত্ত রোডের নতুন বাসায় গিয়ে ওঠেন। বাসাটি ভাড়া করা হয়েছিল জাহানারা আবেদিনের বড় পরিবারের (রহিমা খাতুন ও নুরুল আমীনের পরিবার) সঙ্গে একত্রে। ভাড়া ছিল ৮০ টাকা। দুই পরিবার সমানভাবে মেটাবে বলে স্থির হয়েছিল। জয়নুলের তখন মাসিক বেতন ছিল ২০০ টাকার কম। এছাড়া ইত্তেহাদ পত্রিকায় প্রতি সপ্তাহে নিয়মিতভাবে ড্রয়িং ও ইলাস্ট্রেশন করে মাসে ১০০ টাকা পেতেন। জাহানারা আবেদিন গার্হস্থ্যকর্মে ছিলেন অনভ্যস্ত ও অপটু। জয়নুলের বিবাহপূর্ব জীবনের পরিচারক সফি রান্নার ব্যাপারে প্রথমাবস্থায় সাহায্য করে। আবার জয়নুলও কিছুদিন রান্না করেন। মার্চের দিকে একবার জাহানারা আবেদিন তাঁর মায়ের সঙ্গে ঢাকা ঘুরে যান। এবং ১৯৪৭-এর জুলাই মাসে বোন রহিমা খাতুনের পরিবারের সঙ্গে চূড়ান্তভাবে ঢাকা চলে আসেন। জয়নুল জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে কলকাতা ছাড়লেও ময়মনসিংহ হয়ে ঢাকা আসেন আগস্টে। কলকাতায় এই কয়েক মাসের অবস্থানকালে জয়নুল, দাঙ্গাবিধ্বস্ত কলকাতার নিরাপত্তাহীন পরিবেশের কারণে নববধূকে নিয়ে বেশি বেড়াতে পারেননি। এই নবদম্পতি ডেন্টিস্ট আর আহমেদ ও শিল্পী আনোয়ারুল হকের বাসায় নিমন্ত্রিত হয়েছেন। কিছু আত্মীয়-স্বজনের বাসায় বেড়িয়েছেন। তা ছাড়া গেছেন শিল্প প্রদর্শনীতে, যেখানে জয়নুলের ছবিও ছিল; সেখানে শিল্পী অতুল বসু ও তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে, একাডেমি অব ফাইন আর্টের লেডি রানু মুখার্জির সঙ্গে দেখা হয়েছে। জ্যোতির্ময় রায় পরিচালিত উদয়ের পথে শীর্ষক চলচ্চিত্রের প্রেস শোতে গেছেন। জ্যোতির্ময় রায়ের স্ত্রী বিনতা রায় ছিলেন ওই ছবির নায়িকা, নায়ক ছিলেন রাধামোহন সেন। ওই শোতে দেখা হয় যামিনী রায়ের সঙ্গে। যামিনী রায় জাহানারা আবেদিনকে দেখে জয়নুলকে বলেন: ‘কোথা থেকে এই পটের ছবি নিয়ে এলে?’ অতুল বসু ও যামিনী রায় দুজনই জাহানারা আবেদিনকে বলেছিলেন, ‘জয়নুলকে তোমার দেখে রাখতে হবে, যাতে ওর ছবি আঁকায় বিঘœ না ঘটে।’ ওই কয়েক মাসে জাহানারা আবেদিনের মনে হয়েছে: জয়নুল বোধ হয় কোনো শৃঙ্খলে আটকে পড়েছেন, সে জন্য ছটফট করছেন। বিকেলে বা ছুটির দিনগুলোতে জয়নুল তাঁর স্ত্রীর একটু খোঁজ নিয়ে আবার বেরিয়ে যেতেন। বেরিয়ে গিয়ে কিছু একটা কিনে ফিরে এসে আবার বেরিয়ে পড়তেন। এ সময় কলকাতা আর্ট স্কুলের শিক্ষক বলাইচন্দ্র দাস প্রতিদিন স্কুল ছুটির আগে বাগান থেকে একটি করে ফুল তুলে এনে জয়নুল আবেদিনের হাতে দিতেন। জয়নুল আবেদিন তাঁর শিক্ষকের এই আশীর্বাদপুষ্ট স্নেহের দানটি অতি যত্নে স্ত্রীর উদ্দেশে বাসায় নিয়ে যেতেন।
বিষাদ পর্ব
সুখ দুঃখের দোলাচলে জয়নুল দম্পতির দিনগুলো যখন মধুর আর রঙিন। তখন বিধাতা কেন জানিনা হঠাৎ এর মধ্যে বিষাদের রেখা টানলেন। ১৯৭৫ সালের মধ্য পর্যায় থেকে জয়নুলের শরীর খারাপ হচ্ছিল। মাঝে মধ্যে জ্বর, কাশি হতো। সেপ্টেম্বর অক্টোবর থেকে তিনি প্রায়শঃ অসুস্থবোধ করতে থাকেন। শরীর বেশ খারাপ হয়ে যায়। হাসপাতালে তার নানা রকম পরীক্ষা করা হয়। এক্স-রেতে ধরা পড়লো ফুসফুসে টিউমার। ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী ক্যান্সারের সন্দেহ করলেন এবং বিদেশে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। ১৯৭৬ সালের ১৬ই জানুয়ারি জয়নুল আবেদিন চিকিৎসার জন্য লন্ডনের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। সঙ্গে প্রিয়তমা স্ত্রী জাহানারা। লন্ডনের হ্যামার স্মিথ হাসপাতালে তাকে দেখানো হয়। সেখানে ডা. মরিসন জয়নুলের চিকিৎসা করেন। ব্রঙ্কোসকপি করে ডাক্তাররা নিশ্চিত হন যে, টিউমারটা ম্যালিগন্যান্ট এবং অপারেশনের সুযোগ নেই। ফলে ডাক্তার কেমোথেরাপির কোর্স শুরু করেন। লন্ডনে থাকতেই কেমোথেরাপির দুটো কোর্স সম্পন্ন করা হয়। প্রায় দুই মাস চিকিৎসার পর জয়নুল লন্ডন ত্যাগ করেন। লন্ডনে ডা. মরিসনকে শিল্পচার্য বলেছিলেন, ‘ডাক্তার আমার একটা ব্যবস্থা করো যাতে দু’ বছর বাঁচতে পারি। সোনারগাঁওয়ের লোক শিল্প জাদুঘর ও কারুপল্লী নির্মাণের প্রকল্পটি তিনি শেষ করে যেতে চেয়েছিলেন। যেটি জয়নুলের মতো জাহানাররাও স্বপ্ন ছিলো।
ঢাকায় ফিরে পিজি হাসপাতালে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) চিকিৎসা চলেছে শিল্পাচার্যের। ৭ই মে বিটিভির লোকজন ক্যামেরাসহ জয়নুলের বাসায় গিয়ে তাকে না পেয়ে হাসপাতালে গিয়েছিলেন। হাসপাতালে ওরা তাঁর ছবি তুলেছিলো। ওদের অনুরোধেই শিল্পচার্য ‘দুই মুখ’ শীর্ষক জীবনের শেষ ছবিটি এঁকেছিলেন ওইদিন হাসপাতালে বসেই।
এরপর জয়নুলের শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতির দিকে যেতে থাকে। জাহানারা যেন আর কোন আশার আলো দেখতে পান না। চারদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে আসে।
১৯৭৬ সালের ২৭শে মে সন্ধ্যার দিকে ড. কুদরত-এ খুদা জয়নুলকে দেখতে হাসপাতালে যান। জাহানারা আবেদীনের ভাষায়-‘আবেদিন অতিশয় মমতার সঙ্গে ওঁর হাত ধরলেন। মনে হলো ঘুমিয়ে গেলেন। ঘুম দেখে রাতে আর তাঁকে জাগালাম না। আমরাও ঘুমিয়ে গেলাম। ২৮শে মে সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি ওঁর বিছানা ভিজে গেছে। সব পরিস্কার করে দিলাম। আমি তখনও কিছু বুঝে উঠতে পারিনি। আমি ওর জন্য নাশতা তৈরি করলাম। আবেদিন ঘুমে আছে দেখে আমরা নাশতা খেয়ে নিলাম। সকাল সাড়ে সাতটার দিকে ডাক্তার এলেন। এসেই অক্সিজেনের ব্যবস্থা করলেন। এরপর সকাল সোয়া এগারোটা। জয়নুলের প্রিয়তমা জাহানার জীবনের ছন্দ হারিয়ে গেল। সকল দরজা বন্ধ হয়ে গেল যেনো। বাংলাদেশের এক উজ্জ্বলতম নক্ষত্রের পতন। শিল্পাচার্য চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
‘...আমি চলিলাম/যেথা নাই নাম,/যেখানে পেয়েছে লয়/সকল বিশেষ পরিচয়, নাই আর আছে? এক হয়ে যেথা মিশিয়াছে/যেখানে অখ- দিন/আলোহীন অন্ধকারহীন,/আমার আমির ধারা মিলে যেথা যাবে ক্রমে ক্রমে/পরিপূর্ণ চৈতন্যের সাগর সঙ্গমে।’
জয়নুলের প্রিয়তমা জাহানারা। দিন যায়। বছর গড়িয়ে যুগ। কোন কিছুতেই যেন আর তার মন লাগে না। আবেদিন ছাড়া এই ধরা ধামে সবকিছুই যেন অর্থহীন মনে হয়। চারিদিকে এতো আলো, এতো রং এতো আয়োজন কোন কিছুতেই যেন তিনি আর তাল মেলাতে পারেন না। সর্বত্র আবেদিনের ছায়া লেগে আছে। তিনি ভুলতে পারেন না। তিরতিরে জলের মতো শান্ত আর নীরব আনন্দের মতো জেগে থাকে প্রাণে। জয়নুলের চরণ ধ্বনি কি শুনতে পান জাহানারা? কোন সুদূর থেকে ভেসে আসে সেই ধ্বনি! জাহানারার বুকের ভেতর ইন্দ্র ধনুর মতো আবেশ ছড়ায়। জীবনের এইসব সঙ্গীত থেমে গেলে একদিন মহাকাল এসে হাত ধরে নিয়ে যাবে ঠিক। জাহানারা প্রহর গুনছেন কাক্সিক্ষত সেই শান্তিধামের। কত দূরে আর? আমার ভাবনাও কি সেই দিকেই ধাইছে? ...এ অসম্ভব। নয়!
>>>বিশেষ কৃতজ্ঞতা: ময়নুল আবেদিন ও কোহিনূর আবেদিন। এবং সৈয়দ আজিজুল হক রচিত জয়নুল আবেদিন: সৃষ্টিশীল জীবন সমগ্র
No comments