কালোত্তীর্ণ ভাষণ by অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান
১৯৭১
সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় এই জনপদে ও বাঙালির ইতিহাসে প্রথম
স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই রাষ্ট্রের স্থপতি।
জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিখ হেগেলের (১৭৭০-১৮৩১) ভাষায়, 'মানুষের
সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হচ্ছে রাষ্ট্র সৃষ্টি করা।' বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ছিল ইতিহাসের অনিবার্যতা। ৭ মার্চ ছিল বঙ্গবন্ধুর
নেতৃত্বের সর্বশ্রেষ্ঠ দিনগুলোর একটি। অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধু
ওইদিন স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন। ৬ মার্চ বিশ্ববিখ্যাত 'দি ডেইলি টেলিগ্রাফ'
পত্রিকার এক নিবন্ধে বলা হয়, শেখ মুজিব একতরফাভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করতে
পারেন। অনেক তথাকথিত বিশ্নেষক তাদের লেখায় ও বক্তৃতায় এখনও বলেন, শেখ মুজিব
যদি ৭ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা দিতেন, তাহলে লাখো জনতা ঢাকা সেনানিবাস
আক্রমণ করত; এতেই অনেক কম মূল্যে আমরা স্বাধীনতা পেয়ে যেতাম। বঙ্গবন্ধুর
ইতিহাস সচেতনতা এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাস্তবতার সম্যক ধারণা এত প্রগাঢ়
ছিল যে, তিনি কোনো অবস্থাতেই একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা করে আমাদের স্বাধীনতার
সংগ্রামকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের তকমা লাগানোর সুযোগ দেননি। বিশ্ব
পরিস্থিতি আমাদের কতটা প্রতিকূল ছিল, তা বোঝার জন্য বলছি- আমাদের স্বাধীনতা
যুদ্ধের সময় আমেরিকা, চীন ও ইসলামিক দেশগুলো বিরোধিতা করেছে। ৭ ডিসেম্বর
(১৯৭১) জাতিসংঘের ভোটাভুটিতে আমাদের বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল ১০৪টি দেশ, পক্ষে
মাত্র ১১টি, ভোটদানে বিরত ছিল ১০টি দেশ। ২৫ মার্চের রাতে বাঙালি যখন
পাকিস্তানিদের একতরফা যুদ্ধের শিকার হলো, তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ৭
মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু সবই বলেছিলেন, শুধু একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণাটি
ছাড়া। '...তোমাদের কাছে অনুরোধ রইল। প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল।
তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা (আক্রমণ নয়) করতে হবে। ...
আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো...।' যেমনটি পাওয়া যায় উইনস্টন
চার্চিলের ৪ জুন ১৯৪০-এর 'উই শ্যাল ফাইট অন দি বিচেস' বক্তৃতায়, '...আমরা
সাগরে লড়ব, মহাসাগরে লড়ব... আমরা অবশ্যই লড়ব... আকাশে, আমরা আমাদের দ্বীপকে
সুরক্ষা দেব... এতে যত ত্যাগই স্বীকার করতে হয়।' বঙ্গবন্ধুর ভাষণ এখন শুধু
বাঙালির নয়,
সারাবিশ্বের তথা মানবসভ্যতার অহঙ্কার। এ ভাষণ কালোত্তীর্ণ
বিশ্ব ক্লাসিক। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে অনেক কিছুই রয়েছে, যা চলমান সমসাময়িক
বিশ্বে খুবই প্রাসঙ্গিক। বিশ্বের দেশে দেশে আঞ্চলিক ও গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব
নিরসনে সমঝোতাকে প্রথমে বেছে নিতে হবে। সমঝোতার সব পথ রুদ্ধ হলেই অন্য পথ
ধরতে হবে। গণতন্ত্র মানেই সংখ্যাগরিষ্ঠের মতকে প্রাধান্য দেওয়া নয়, এটা
হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের অন্যতম একটি শিক্ষা। বেশিরভাগ লোক যা বলবে তাই
গণতন্ত্র, এটা বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক উপলব্ধি ছিল না। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়-
'...যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজন যদিও সে হয় তার
ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।' একটা সমাজের সংখ্যাগুরুদের দায়িত্ব হচ্ছে
ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর হেফাজত করা। যদিও মূলত পাকিস্তানিদের পক্ষাবলম্বনকারী
বিহারিদের উপলক্ষ করেই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, '... এই বাংলায় হিন্দু-মুসলিম,
বাঙালি, অবাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই, তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের
ওপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়।' বঙ্গবন্ধুর ভাষণের এই অংশটুকু কতটা
কালোত্তীর্ণ তা আজকের বিশ্বের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। ইরাক ও তুরস্কের
কুর্দিদের বা মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের দুরবস্থার দিকে তাকালে আরও বেশি
স্মরণে আসবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। রামু, নাসিরনগর বা গাইবান্ধার ঘটনা
পুনরাবৃত্তি রোধেও প্রয়োজন বঙ্গবন্ধুর এই দার্শনিক উক্তির অনুসরণ।
বঙ্গবন্ধু এক বাক্যে বাঙালির ভবিষ্যৎ রচনা করে বলেছিলেন, বাঙালিকে কেউ
দাবায়ে রাখতে পারবে না। তাঁর শুধু একটি উদাহরণ পদ্মা সেতু। দেশি-বিদেশি
ষড়যন্ত্রের কারণে কাল্পনিক দুর্নীতির অভিযোগ এনে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে
বিশ্বব্যাংক যখন সরে গেল, তখন এডিবি, জাইকাসহ আরও নানা উন্নয়ন সহযোগী পদ্মা
সেতুতে অর্থায়ন থেকে সরে যায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা আজকের প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা দৃঢ়ভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু
করবেন অনেকটা যেন বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের বক্তব্যেরই প্রতিফলন, '...৭ কোটি
মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।' ভাষণে 'স্বাধীনতা' শব্দটি একবার উচ্চারিত
হলেও 'মুক্তি' শব্দটি ব্যবহার করেছেন কয়েকবার। স্বাধীনতা লাভের মাধ্যমে
পরাধীনতার অবসান হলেও মানুষ অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি অর্জন করে না।
মুক্তি বলতে সব বঞ্চনা, বৈষম্য, শোষণ, সংকীর্ণতা, কূপমণ্ডূকতা, চেতনার
দীনতা থেকে মুক্তিকে বুঝিয়ে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। অর্থনৈতিকভাবে আমরা দ্রুত
এগোচ্ছি। এ বছরই আমরা অনুন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় নাম
লেখাচ্ছি। ২০৪১ সালে আমরা উন্নত দেশে পরিণত হবো, তবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের
সোনার বাংলা বিনির্মাণের জন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে দৃঢ়ভাবে না ধরলে এ
উন্নয়ন টেকসই হবে না। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা আমাদের মুক্তিসংগ্রামের
নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তার নেতৃত্বে মানুষের মুক্তির সংগ্রাম অব্যাহত থাকুক-
এটাই আজকের প্রত্যাশা।
উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
No comments