কবিতার মতো অপরূপ ভাষণ by আনিসুল হক
৭
মার্চের ভাষণটা এতবার শুনি, কখনো পুরোনো হয় না। যখনই শুনি, গায়ে কাঁটা
দেয়। রাস্তাঘাটে যখন চলি, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাজতে থাকলে দাঁড়িয়ে পড়ি, শেষ না
হওয়া পর্যন্ত শুনি, শেষ হয়ে গেলে মনে হয়, আরেকবার বাজায় না কেন?
বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণটাকে যে কবিতা বলা হয়, তার এটাও একটা কারণ হিসেবে
বিবেচিত হতে পারে। ভালো কবিতা কখনো পুরোনো হয় না, বারবার পড়া যায়, ৭
মার্চের ভাষণও পুরোনো হয় না, হবে না। এই গুণ ধ্রুপদি কবিতার গুণ।
নিউজউইক-এর প্রচ্ছদে বঙ্গবন্ধুকে বলা হয়েছিল ‘রাজনীতির কবি’। নির্মলেন্দু
গুণের ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ কবিতায়ও বঙ্গবন্ধুকে কবি
হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যার কবিতা শোনার জন্য অপেক্ষা করছিল লাখ লাখ
ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা। কবি মুহাম্মদ সামাদও লিখেছেন, ‘মুজিব আমার
স্বাধীনতার অমর কাব্যের কবি।’ আহমদ ছফা লিখেছিলেন, ‘বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ
কাব্য চর্যাপদ নয়, বৈষ্ণব গীতিকা নয়, সোনার তরী কিংবা গীতাঞ্জলি কোনোটা নয়,
বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্য গীতি হলো “আর দাবায়া রাখতে পারবা না”।’ ওই
ভাষণকে কবিতা বলার আরও একটা কারণ বিবেচনায় নেওয়া যায়। কবিতার সংজ্ঞায় বলা
হয়, সুন্দরতম শব্দের মহত্তম বিন্যাস। বেস্ট ওয়ার্ডস ইন বেস্ট অর্ডারস। ভালো
কবিতায় একটা শব্দও অতিরিক্ত বা কম ব্যবহার করা হয় না, প্রতিটা শব্দকেই হতে
হয় অনিবার্য। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটিতে যেন একটা কথাও বেশি বলা হয়নি,
একটা কথাও কম বলা হয়নি, একটাও ‘পলিটিক্যালি রং’ বা রাজনৈতিকভাবে ভুল কথা
বলা হয়নি।
জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন, ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।’ কবি, কারণ
কবির মধ্যে বিগত কয়েক শতাব্দীর এবং সমকালের কবিতার ইতিহাসটা ক্রিয়া করে।
সবার ভেতরে করে না। যারা কবি, কেবল তাদের মধ্যে করে। বঙ্গবন্ধু যখন ৭
মার্চের ভাষণ দিচ্ছিলেন, তখনো যেন তাঁর মধ্যে নদীবিধৌত পলি মাটিতে গড়ে ওঠা
এই জনপদের মানুষের হাজার বছরের ইতিহাস ও সমকালের ইতিহাস ক্রিয়া করছিল। তিনি
তো জানতেন, হাজার বছরে এই অঞ্চলের মানুষ একটা স্বাধীন রাষ্ট্র পায়নি।
কিন্তু জীবনভর তিনি স্বপ্ন দেখেছেন, কাজ করেছেন, নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে
রেখেছেন এই দেশটাকে স্বাধীন করবেন বলে। ৭ মার্চের ভাষণের শুরুতে তিনি সেই
ইতিহাসটা অপরূপ কাব্যসুষমান্বিত ভাষায় অতি সংক্ষেপে বর্ণনা করেন, ‘২৩
বৎসরের করুণ ইতিহাস বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩
বৎসরের ইতিহাস মুমূর্ষু নরনারীর আর্তনাদের ইতিহাস।’ এরপর তিনি স্টোরিটেলার
বা গল্পের কথকের মতো করে বর্ণনা করে গেলেন ওই সময়ের প্রেক্ষাপট। আহ! কী
উত্তুঙ্গ পাগলপারা সময় ছিল সেটা। ‘স্বাধীনতা’ ‘স্বাধীনতা’ বলে সারা বাংলা
পাগল হয়ে গেছে। ওই তুঙ্গ মুহূর্তটিতে দেশের মানুষকে নিয়ে যাওয়ার জন্যই তো
শেখ মুজিব ২৩টা বছর সংগ্রাম করেছেন, সংগঠন করেছেন, জেলে গেছেন, ছয় দফা
দিয়েছেন। দেশের মানুষ উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তাঁকে আগরতলা
ষড়যন্ত্র মামলা থেকে নিঃশর্তভাবে মুক্ত করে এনেছে, ভালোবেসে তাঁকে উপাধি
দিয়েছে বঙ্গবন্ধু। আইয়ুব খানের পতন ঘটেছে, জেনারেল ইয়াহিয়া ক্ষমতায় এসেছেন,
মুজিবের একটাই শর্ত ছিল, নির্বাচন দিতে হবে। বঙ্গবন্ধু জানতেন, নির্বাচন
দিলে তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবেন। তিনি পাকিস্তানি সাংবাদিকের সামনে বলেও
ফেলেছিলেন, একবার ভোট হয়ে যাক, তারপর ইয়াহিয়া খানের সব শর্ত তিনি ছিঁড়ে
বাতাসে উড়িয়ে দেবেন। আমেরিকান কূটনীতিকদেরও তিনি বলে দিয়েছিলেন, তাঁর আসল
লক্ষ্য স্বাধীনতা। ১৯৭০ সালের ভোটে পাকিস্তানের উভয় অংশ মিলে আওয়ামী লীগ
একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করল। কিন্তু পাকিস্তানি জেনারেলরা আর রাজনীতিকেরা
মিলে তো গোপন বৈঠক করে ফেলেছেন। বাঙালিকে ক্ষমতা তো তারা দেবেই না, তারা
দরকার হলে তিরিশ লাখ মানুষকে হত্যা করবে। আর বঙ্গবন্ধুরও স্পষ্ট ঘোষণা: আমি
প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, এ দেশের মানুষের অধিকার চাই। এরই মধ্যে স্বাধীন
বাংলাদেশের পতাকা বানানো হয়েছে, বঙ্গবন্ধু সেই পতাকা উত্তোলনও করেছেন।
ঢাকায় শিল্পী-কবিরা মিছিল করছেন, পোস্টারে লেখা: এক দফা, স্বাধীনতা। ৩
মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হঠাৎ স্থগিত ঘোষণা করলে
পুরো বাংলা যেন বারুদে দেশলাইয়ের কাঠি লাগানোর মতো করে জ্বলে উঠেছে। এরই
প্রেক্ষাপটে ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেবেন বাংলার অবিসংবাদিত নেতা
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছাত্রদের দাবি-আজকেই স্বাধীনতা ঘোষণা করুন।
ইয়াহিয়া খান ফোন করেছেন। আমেরিকানরা যোগাযোগ করছে। মাথার ওপর দিয়ে বিমান
চক্কর দিচ্ছে। কী বলবেন আজ বঙ্গবন্ধু? সেই বিকেলের স্মৃতিচারণা করেছেন
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। আমরা জানতে পারি, বেগম মুজিব বললেন, তুমি একটু
বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নাও। তোমার এক দিকে জনতার দাবি, আরেক দিকে বন্দুকের
নল। সারাটা জীবন তুমি বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য নিজেকে সঁপে দিয়েছ।
ঘুমিয়ে নাও। তারপর নিজের হৃদয়ের দিকে তাকাও। কারও কথা শোনার দরকার নাই।
তোমার বিবেক যা বলবে, তুমি তা-ই বলবা। বঙ্গবন্ধু একটুখানি জিরিয়ে নিলেন।
বেগম মুজিবের কপালে চুম্বন করে তিনি বেরোবেন। সচরাচর রুটে না গিয়ে তিনি
অন্য পথে গিয়ে পৌঁছালেন রেসকোর্সে। লক্ষ লক্ষ মানুষের সমুদ্রের সামনে
দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, ভায়েরা আমার...। বল পাঠিয়ে দিলেন ইয়াহিয়ার কোর্টে। ‘আর
যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার মানুষকে হত্যা করা হয়, তোমাদের উপর আমার
অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই
নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।’ বলছিলাম, এর চেয়ে পলিটিক্যালি কারেক্ট বা
রাজনৈতিকভাবে অভ্রান্ত বক্তৃতা আর হয় না। একটিবারও তিনি আক্রমণ করার কথা
বলেননি। একটিবারও তিনি সহিংস পথ বেছে নেওয়ার কথা বলেননি। একবার বলেছিলেন,
‘আমরা ভাতে মারব, পানিতে মারব।’ এক নিঃশ্বাসেই বলেছেন, ‘তোমরা আমার ভাই,
তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না।’ বলে রাখলেন, ‘এই বাংলার
হিন্দু-মুসলিম, বাঙালি-ননবেঙ্গলি যারা আছে তারা আমাদের ভাই, তাদের রক্ষার
দায়িত্ব আপনাদের উপরে, আমাদের উপরে, আমাদের যেন বদনাম না হয়।’ ইঙ্গিত দিয়ে
রাখলেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার না-ও পারি’...বললেন,
‘যদি এ দেশের মানুষকে
খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝেশুনে কাজ করবেন...তোমাদের যার যা
কিছু তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক।’ ‘মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, এ
দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ।’ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের
মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তাঁর ভাষায় পলিমাটির
সৌরভ, তাঁর কণ্ঠে পদ্মা-মেঘনা-যমুনার কল্লোল, মেঘের মতোই মায়া আর বজ্র।
তাঁর তর্জনীতে বাংলার মানুষের গন্তব্যের নির্দেশনা। পৃথিবীতে কত স্বাধীনতা
আন্দোলন ব্যর্থ হলো, কত আন্দোলন বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে ইতিহাসের
দীর্ঘশ্বাস হয়ে রইল, আমাদের হাজার বছরের পুণ্যের ফলে আমরা পেয়েছিলাম শেখ
মুজিবুর রহমানের মতো একজন শালপ্রাংশু বিশাল মাপের নেতাকে, যিনি তাঁর ত্যাগ,
দেশপ্রেম, কারিশমা, শ্রম ও প্রজ্ঞা দিয়ে আমাদের উদ্বুদ্ধ করলেন
স্বাধীনতায়, আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন চরিতার্থতা পেল। ১০ জানুয়ারি দেশে
ফিরে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বললেন, ‘আজ আমার জীবনের সাধ পূর্ণ হয়েছে, বাংলাদেশ
আজ স্বাধীন।’ তাঁর জীবনকাহিনির শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হয়ে রইল ৭ মার্চের ভাষণ।
ইউনেসকো এটাকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা করে সঠিক কাজটাই করেছে। এই
ভাষণ সব দেশের সব নিপীড়িত মানুষকেই প্রেরণা জুগিয়ে যাবে চিরকাল।
আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক
আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক
No comments