ব্যাক ক্যালকুলেশন by গৌতম দাস
‘ব্যাক
ক্যালকুলেশন’। ব্যাপারটার মানে হলো, দু’টি সংখ্যার যোগফল আর ওই সংখ্যা
দু’টির একটা জানা থাকলে; বিয়োগ করে অপর সংখ্যাটি বের করা যায়। অর্থাৎ ফলাফল
থেকে শুরুর উপাদান কী ছিল, তা জানার চেষ্টা। অথবা রান্না খেয়ে রেসিপি কী
ছিল তা বোঝার চেষ্টা। গত ১৯-২১ ফেব্রুয়ারি হোটেল র্যাডিসনে তিন দিনব্যাপী
‘বাংলাদেশ-ভারত মিডিয়া ডায়ালগ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। ভারতের প্রধান
ধারার প্রিন্ট মিডিয়ার বেশির ভাগই অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর পর্যায়ের
ব্যক্তিরা (যুগান্তরের রিপোর্ট অনুযায়ী, তারা কমপক্ষে আটজন) এতে যোগ
দিয়েছিলেন।
যুগান্তরের রিপোর্ট থেকে আরো জানা যাচ্ছে, ‘বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া
মিডিয়া ডায়ালগ-২০১৮-এর আহ্বায়ক শ্যামল দত্ত। যিনি বাংলাদেশের দৈনিক ভোরের
কাগজের সম্পাদক। কিন্তু কেন এই অপ্রচলিত আয়োজন? এর একটি জবাব খুঁজে পাওয়া
যায় আনন্দবাজার পত্রিকার অনামিত্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা রিপোর্ট থেকে। তিনিও
একজন অংশগ্রহণকারী ছিলেন। তিনি লিখছেন, দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়নে সরকারি
স্তরে তৎপরতা তো রয়েছেই। তার পাশাপাশি মানুষে মানুষে যোগাযোগ বাড়াতে দুই
দেশের সাংবাদিকদের মতবিনিময়ের মতো ‘ট্র্যাক টু’ কূটনীতির একটি উদ্যোগ নজর
কেড়েছে ঢাকার একটি পরিচিত ‘থিংক ট্যাংক’ ইনস্টিটিউট অব কনফ্লিক্ট, ল
অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (আইসিএলডিএস) উদ্যোগে। তার মানে, বোঝা
যাচ্ছে, এটি চিন্তাভাবনা করে আয়োজন করা।
কিন্তু আনন্দবাজারের ‘ট্র্যাক টু’
কথাটা যেন অনেক কিছু বলে দিচ্ছে, যা বলা হয়নি, কোথায় নাই। ব্যাক
ক্যালকুলেশন করা যাক। মাস কয়েক আগে সাবেক রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রণব
মুখার্জির বাংলাদেশ সফরের সময়ও আনন্দবাজার এই শব্দটা ব্যবহার করেছিল।
অর্থাৎ ‘কাকাবাবু’ যেন আমাদের প্রধানমন্ত্রীর হয়ে কিছু একটা মোদি সরকারের
কাছে পৌঁছে দেন, সুপারিশ করেন বা মতভিন্নতায় মধ্যস্থতা করেন ইত্যাদি।
কিন্তু সে বিষয় কী, তা কোথাও লিখিত ছিল না, তবে অনুমানে ছিল। আসলে ঘটনার
শুরু বা গুঞ্জন অনেক পুরনো; শেখ হাসিনার সর্বশেষ ২০১৭ সালের এপ্রিলে ভারত
সফরের সময় থেকে। ওদিকে, চীনের বেল্ট-রোড উদ্যোগের (৬৫ রাষ্ট্রকে একই সড়ক ও
সামুদ্রিক যোগাযোগের সম্পর্কে আনার এক ট্রিলিয়ন ডলারের চীনা প্রকল্প) প্রথম
সামিট ডাকা হয়েছিল পরের মাসে মানে, ২০১৭ সালের মে মাসে। চীন-ভারতের
সম্পর্কের মধ্যে সহযোগিতা আছে; পণ্য বিনিময়ের ক্ষেত্রে ৯০ শতাংশই হলো চীনের
রফতানি আর ১০ শতাংশ ভারতের রফতানি, ভারতের চীনের বিনিয়োগ ডেকে আনা আছে,
আবার অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আপারহ্যান্ড বা বড় ভাগটা চীন নিয়ে নিল কি না সে
টেনশন আছে, সেই সাথে অচিহ্নিত সীমান্ত বিতর্কের টেনশন- তা তো আছেই। কিন্তু
২০১৭ সালের মে মাসের আগ পর্যন্ত কখনোই তাদের মধ্যে বড় বা দৃশ্যমান
অসহযোগিতা দেখা যায়নি। এমনকি, এটি এমনই ছিল গত ২০০৫ সাল থেকে আমেরিকার ‘চীন
ঠেকাও’ পলিসিতে ভারতের পিঠে হাত রাখা সত্ত্বেও।
ভারত সে বারই প্রথম চীনের
বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের প্রথম সামিট বয়কটের ঘোষণা দিয়েছিল। তবে
আনুষ্ঠানিকভাবে বলেছে, এই প্রকল্প বিতর্কিত পাকিস্তান অংশের কাশ্মিরের ওপর
দিয়ে গেছে, সেই আপত্তিতে তারা এতে অংশ নিচ্ছে না। তবে ভেতরের কারণও চীনে
ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত অশোক কান্তা বলে দিয়েছেন। আমরা যদি এর আগে ২০১৫
সালের চীনের বিশ্বব্যাংক (অওওই) গড়ার সময়ের ভারত-চীন সহযোগিতার সাথে তুলনা
করি, তাহলে আমরা দেখি- ভারত ভাগাভাগিতে মুড়োটা নিজের পাতে পাওয়ার জন্য
দরাদরি করেছে আর চীন সহানুভূতির সাথে তা দেয়ার চেষ্টা করছে। সব পশ্চিমা
রাষ্ট্রের চেয়েও ভারতকে ভাগের দিক থেকে ওপরে রাখছে চীন। কিন্তু বেল্ট রোড
উদ্যোগের বেলায় ভারতের সার কথা হলো- যেমনটি অশোক কান্তা বলছেন, এই উদ্যোগ
খুবই কাজের; তা সবার দরকার। কিন্তু ভারত এতে যোগ দিলে সে চীনের জুনিয়র
পার্টনার হয়ে যাবে, যেখানে ২০৩০ সালের মধ্যে ভারত ‘প্রথম তিনটি অর্থনীতির
মধ্যে একটি’ হতে যাচ্ছে। তাহলে অর্থ দাঁড়াল, এটা কেবল একটি ইস্যুতে ভারত
বয়কট করছে; তা নয়। এ প্রসঙ্গে ভারতের সিরিয়াসনেস কত গভীরে সেটা বুঝানোর
জন্য একটু বিস্তারিত বলতেই হবে। কিন্তু একটি ডিসক্লেমার দিয়ে রাখতে হয়। মনে
রাখতে হবে, এখানে আমি বলিনি যে, ভারতের বা অশোক কান্তার এই অনুমান-বিশ্বাস
সঠিক। এটা একটা পারসেপশন মাত্র। কেবল বলেছি, ভারত নিজেকে কী মনে করে। আমি
তাতে কিন্তু সায় দেইনি। আর খুব সম্ভবত এই বয়কটের কারণেই ভারতের ট্রেন মিস
হবে। আমরা মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। এরপর থেকেই ভারতের বিদেশনীতিতে নতুন কিছু
হিসেব ‘মুই কী হনু রে’ যোগ হয়েছে। এশিয়ায় ভারতের পড়শি মানে চীনেরও, এমন
রাষ্ট্রের কোনো সরকার যদি চীনের বেল্ট রোড উদ্যোগের (বা ওয়ান বেল্ট ওয়ান
রোড প্রকল্পে) যোগদানে নিজের সম্মতি চীনকে দিয়ে থাকে, তবে সেই পড়শি সরকারের
কপাল খারাপ। কারণ ওই সরকারের সাথে ভারত চরম অসহযোগিতার অবস্থান নেয়। ওই
সরকারের ফেলে দেয়া বিরোধীদের জিতিয়ে আনার চেষ্টা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ,
এমনকি সম্ভাব্য সাবভার্সিভ অ্যাক্টসহ দরকার মতো সবকিছু করা পর্যন্ত ভারত
যেতে পারে।
এটা কোনো দলিল দিয়ে প্রমাণ করা যাবে না। তবে খোলা চোখে বাস্তব
তৎপরতা দেখে বোঝা যেতে পারে। বাংলাদেশও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে বলেছে বেল্ট
রোড উদ্যোগের অংশ হয়ে থাকার কথা। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ২০১৭ সালের এপ্রিল
সফরে তিনি বার্তা পেয়েছিলেন- No OBOR, নো চাইনিজ প্রজেক্ট। আমাদের ব্যাক
ক্যালকুলেশন এটাই বলে। এমনকি, এটা কয়েক মাস আগে আমাদের পররাষ্ট্র সচিব ভারত
সফরে গিয়ে প্রকাশ্যে বেল্ট রোড উদ্যোগের অংশ হয়ে থাকার কথা বলে এসেছেন।
ভারত স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে, সে দুনিয়ার এক নম্বর অর্থনীতি হয়েই গেছে।
তবে অন্তত চারটি বড় বড় সার্ভে ও গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে, তাদের
কোনোটিতেই এমন কথা বলা হয়নি। তবু যেন ভারত এক নম্বর অর্থনীতি হয়েই গেছে, এই
বিশ্বাসে আমাদের একটি পত্রিকা কোনো রেফারেন্স ছাড়াই এমন দাবি করে একটি
লেখা ছাপিয়ে ফেলেছে গত মাসে। শেষ বিচারে এখনো এটি সার্ভে ও স্টাডির এক
অনুমিত ফলাফল, বাস্তব নয়। ফলে বহু ‘যদি, কিন্তু’সহ নানা শর্তসাপেক্ষে কথা
হলো, এই অনুমিত ফলাফল বা প্রেডিকশন। কিন্তু ভারত ব্যাপারটাকে অর্থনীতিতে
নিজের প্রথম হওয়ার বিষয়টি ফসকে যাওয়া-না যাওয়া হিসেবের বিষয়টি সিরিয়াস হয়ে
দেখছে। কিন্তু এটা মনে করার কারণ আছে, ভারতের এই প্রেসিং ডিমান্ডকে ‘
ভারতের এত মরিয়া অবস্থা কেন, অথবা ভারত যে এক চরম মাত্রায় পৌঁছে গেছে তা
বুঝেছে’ সেভাবে হাসিনা সরকার নিয়েছে এমন নয়। বরং এটি রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে
স্বাভাবিক রুটিন প্রতিযোগিতার বেশি কিছু বলে দেখেছে মনে হয় না। কারণ,
বাংলাদেশ সরকার এখনো মনে করছেÑ একটা ভালো পারসুয়েশন হলে, একটু তোয়াজ কিংবা
বুঝিয়ে বললে ভারত বুঝে যাবে। অর্থাৎ আমাদেরকে চীনা প্রজেক্ট নিতে দেবে। গত
এক বছর ধরে আমরা দেখেছি সেই পারসুয়েশনের তোয়াজ, বাংলায় যাকে বলে, মন জয়ের
চেষ্টা। যার সর্বশেষ নজির হলো ‘বাংলাদেশ-ভারত মিডিয়া ডায়ালগ-২০১৮’। আসলে
এটা তোষামোদ কি না সেটা ঠিক আমার বলার বিষয় নয়। মূল ব্যাপার হলো, ভারত
ব্যাপারটাকে দেখছে গ্লোবাল অর্থনীতিতে নিজের কথিত প্রথম হওয়া-না-হওয়া
হিসেবে। বাংলাদেশ সরকার এখনো বিষয়টি ভারতের চোখে দেখেনি বা এই
পারস্পেকটিভের নাগালই পায়নি, এটা মনে করার কারণ আছে। কারণ, নাগাল পেলে বা
জানা থাকলে বুঝত, এখানে তো তোয়াজ বা বোঝাবুঝির কিছু নেই। কারণ ভারতের
স্বপ্ন-বিশ্বাসে পারসেপশনে যেটা তার নিজের মরা-বাঁচা, গ্লোবাল অর্থনীতিতে
নিজের কথিত এক নম্বর হওয়াÑ সেটা কি হাসিনা সরকারের ক্ষমতায় থাকা-না-থাকার
মাধ্যমে নির্ধারিত হতে দিয়ে নিজেকেই দুর্বল-অনিশ্চিত করতে চাইবে? এটা তো
হতে পারে না। ভারতেরÑএই ‘এক নম্বর হয়ে যাচ্ছে’Ñ স্বপ্নটা অনেকের মতে
অবাস্তব ও আগাম কাগুজে অনুমান হতে পারে। সম্ভবত তা আসলেই বাগাড়ম্বরপূর্ণ এক
ভিত্তিহীন স্বপ্ন। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ স্বপ্নটাই ভারতের দেখার দৃষ্টি বা
পারস্পেকটিভ, যেখানে দাঁড়িয়ে সে দেখছেও বিশ্বাস করছে।কিন্তু হাসিনা সরকার
সে পারস্পেকটিভ বুঝে কথা বলছে না। আসলে এই তিন দিন ডায়লগে ক্ষমতাসীন দলের
সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের লেভেল শেষ করা হয়েছিল। পরের দিন ২২
ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎটা ছিল ফাইনাল বয়ানের। চীনের
প্রসঙ্গ কাদেরদের লেভেলে টাচ করা হয়নি। তাই এবার চীন প্রসঙ্গে হাসিনা
বলছেন, ‘বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ নিয়ে ভারতের উদ্বেগের কোনো কারণ নেই।
বাংলাদেশের কাছে ভারত ভারতের জায়গাতেই থাকবে, চীন চীনের জায়গায়। ভারতের
বন্ধুত্ব সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। চীন তো নতুন বন্ধু।’ অর্থাৎ এটা হলো
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ফাইনাল ছাড়, যত বেশি সে বাস্তবে ছাড়তে পারে।
কিন্তু ব্যাপারটা তো তা নয়। কেন?
কারণ এখানে আমাদের দিক থেকে সব কিছু দিয়ে দেয়া হলেও, ভারত যা চাচ্ছে তার ধারেকাছের বিষয়ই নয় এটা। ভারত চাচ্ছে চীনের সাথে সম্পর্কহীন, বিনিয়োগ সম্পর্কহীন এক বাংলাদেশ। অথচ সরকার এটাকে বুঝছে এ মর্মে যে, চীনের থেকে বিনিয়োগ নেয়া ছাড়া আর কোনো সম্পর্ক না রাখলেই বুঝি ভারত সন্তুষ্ট! কারণ ভারতের স্বপ্ন হলো কল্পিত এক চীনের বিকল্প ‘মাজা ভাঙা’ একটা চার দেশীয় বিকল্প হতে পারে কি না তেমন প্রাথমিক আলাপ চলছে এবং পাল্টা বেল্ট-রোড উদ্যোগ তৈরি করা। যেটা অনেকটা ‘গোফে তেল’ ধরনের। তবুও গরিবেরও যেমন অর্থ না থাকলেও স্বপ্ন থাকে, তেমনি। ওই বিকল্প চালু হলে এরপরে ভারত সেই হবু প্রজেক্টের নৌকায় বাংলাদেশকে তুলে নেবে। আর ততদিন বাংলাদেশকে বিনিয়োগহীন বসে থাকতে হবে। বাস্তবে, বাংলাদেশে অবকাঠামোতে যে বিনিয়োগ চাহিদা সেখানে ভারতের কোনো বিনিয়োগই নেই, অবদান নেই। মূল কারণ হলো- ভারত এখনো অন্য রাষ্ট্রের অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করতে পারে, এমন অর্থনীতিই নয়। এমনকি এফডিআই (ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট) হিসেবেও, মানে ব্যবসা বা প্রডাকশনে বিনিয়োগ সক্ষমতাও ভারতের তৈরি হয়নি। দু-চার বিলিয়নের যে কথা শোনা যায় সেটা আসলে ভারতের দুর্বল মান এবং প্রতিযোগিতায় অচল স্টিল ইন্ডাস্ট্রিকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারি ভর্তুকির অর্থ। এজন্য ওই দু-চার বিলিয়ন ডলারের ঋণ দিয়ে মূলত কেবল স্টিল সংশ্লিষ্ট প্রডাক্ট (টাটা বা অন্য ভারতীয় গাড়ি, রেলের যন্ত্রপাতি) কিনতে পারা যায়; যাতে ভারতের অদক্ষ স্টিল ইন্ডাস্ট্রি টিকে থাকে। তাহলে বাংলাদেশ সরকারের মূল সমস্যাটা হলো বাংলাদেশ সরকারে চীনকে বাদ দিলে সে বিনিয়োগ ভারত থেকেও পাচ্ছে না। তাহলে কোথা থেকে পাবে? আর বিনিয়োগ না পেলে- গণতন্ত্র না উন্নয়ন- এ বিতর্কে নিজেকে উন্নয়নের হিসেবে কেমনে প্রচার করবে?
কিন্তু ব্যাপারটা তো তা নয়। কেন?
কারণ এখানে আমাদের দিক থেকে সব কিছু দিয়ে দেয়া হলেও, ভারত যা চাচ্ছে তার ধারেকাছের বিষয়ই নয় এটা। ভারত চাচ্ছে চীনের সাথে সম্পর্কহীন, বিনিয়োগ সম্পর্কহীন এক বাংলাদেশ। অথচ সরকার এটাকে বুঝছে এ মর্মে যে, চীনের থেকে বিনিয়োগ নেয়া ছাড়া আর কোনো সম্পর্ক না রাখলেই বুঝি ভারত সন্তুষ্ট! কারণ ভারতের স্বপ্ন হলো কল্পিত এক চীনের বিকল্প ‘মাজা ভাঙা’ একটা চার দেশীয় বিকল্প হতে পারে কি না তেমন প্রাথমিক আলাপ চলছে এবং পাল্টা বেল্ট-রোড উদ্যোগ তৈরি করা। যেটা অনেকটা ‘গোফে তেল’ ধরনের। তবুও গরিবেরও যেমন অর্থ না থাকলেও স্বপ্ন থাকে, তেমনি। ওই বিকল্প চালু হলে এরপরে ভারত সেই হবু প্রজেক্টের নৌকায় বাংলাদেশকে তুলে নেবে। আর ততদিন বাংলাদেশকে বিনিয়োগহীন বসে থাকতে হবে। বাস্তবে, বাংলাদেশে অবকাঠামোতে যে বিনিয়োগ চাহিদা সেখানে ভারতের কোনো বিনিয়োগই নেই, অবদান নেই। মূল কারণ হলো- ভারত এখনো অন্য রাষ্ট্রের অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করতে পারে, এমন অর্থনীতিই নয়। এমনকি এফডিআই (ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট) হিসেবেও, মানে ব্যবসা বা প্রডাকশনে বিনিয়োগ সক্ষমতাও ভারতের তৈরি হয়নি। দু-চার বিলিয়নের যে কথা শোনা যায় সেটা আসলে ভারতের দুর্বল মান এবং প্রতিযোগিতায় অচল স্টিল ইন্ডাস্ট্রিকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারি ভর্তুকির অর্থ। এজন্য ওই দু-চার বিলিয়ন ডলারের ঋণ দিয়ে মূলত কেবল স্টিল সংশ্লিষ্ট প্রডাক্ট (টাটা বা অন্য ভারতীয় গাড়ি, রেলের যন্ত্রপাতি) কিনতে পারা যায়; যাতে ভারতের অদক্ষ স্টিল ইন্ডাস্ট্রি টিকে থাকে। তাহলে বাংলাদেশ সরকারের মূল সমস্যাটা হলো বাংলাদেশ সরকারে চীনকে বাদ দিলে সে বিনিয়োগ ভারত থেকেও পাচ্ছে না। তাহলে কোথা থেকে পাবে? আর বিনিয়োগ না পেলে- গণতন্ত্র না উন্নয়ন- এ বিতর্কে নিজেকে উন্নয়নের হিসেবে কেমনে প্রচার করবে?
কারণ, অবকাঠামো বিনিয়োগ নেই মানে প্রজেক্ট নেই। অর্থাৎ বর্তমান
ক্ষমতাসীনদের চাহিদা পূরণের দিক থেকে ভারত এখনো ‘অপুষ্ট’। আসলে ভারত এখনো
অবকাঠামোতে বিনিয়োগ গ্রহীতার অর্থনীতির রাষ্ট্র। অথচ স্বপ্নে পোলাও খায়।
চীনের রিজার্ভ যেখানে ৩১৮১ বিলিয়নের উপরে ভারতের সেখানে মাত্র ৪১৭ বিলিয়ন।
কিন্তু ভারত এখনই ‘গ্লোবাল অর্থনীতিতে এক নম্বর অর্থনীতি হয়ে গেছে’- এই ভাব
ধরে। এই বিচারে কোনো কোনো প্রভাবশালী পত্রিকাও ব্যাপারটা বুঝেছে মনে হয়
না। তারা একটা আর্টিকেল ছেপেছে, “চীন-ভারতের ‘লড়াই’য়ে বাংলাদেশ জড়িত না” এই
শিরোনামে, এটাও অর্থহীন। কারণ বাংলাদেশ বা শেখ হাসিনা তো জড়াচ্ছেন না।
ভারতই তার অনুমিত ধারণা বা পারসেপশনে জড়িয়ে বাংলাদেশকে দেখছে। আর প্রশ্নটা
আসলে চীনা বিনিয়োগে ভারতের কঠোর আপত্তির। বলছে, শুধু বেল্ট-রোড উদ্যোগে অংশ
নিতে পারবে না তাই নয়; কোনো চীনা বিনিয়োগই নিতে পারবে না হাসিনা সরকার।
অপর দিকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলছেন, ‘বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ নিয়ে
ভারতের উদ্বেগের কোনো কারণ নেই।’ দুটো এক কথা নয়। বরং বাংলাদেশে চীনের
বিনিয়োগই তো ভারতের ‘পারসিভড’ উদ্বেগের কারণ। আসলে ভারত যেন বাংলাদেশকে
বলছে- ‘কোনো কিছু না ছুঁয়ে বসে থাক।’ এ কথার মানে কী পাঠকেরা কল্পনা করে
দেখতে পারেন। কারণ বিনিয়োগের বাজারে, মুরোদে ভারত এখনো বামন, অপুষ্ট। এ
অবস্থায় আস্তে ধীরে হলেও সরকার তাই সপক্ষে কোনো বিদেশীর সমর্থন পাওয়া ছাড়াই
সংসদ নির্বাচনের দিকে আগাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর কথা, ‘বাংলাদেশে চীনের
বিনিয়োগ নিয়ে ভারতের উদ্বেগের কোনো কারণ নেই।’ ‘আমরা মৌলবাদের সাথে আপস করি
নাই’। এই অভিযোগ অথবা এই পয়েন্টে আপত্তি ভারত অনেক আগেই তুলেছিল। সেটাই
২০১৭ সালের এপ্রিলের কথা। এটাই সরকার স্বীকার করছে এখন; কিন্তু অবস্থা এমন
যে, সব ভেঙে বলে, তোয়াজ তুঙ্গে তুলে ধরলেও ভারতকে সন্তুষ্ট করার সুযোগ
সরকারের নেই। ‘বাংলাদেশ-ভারত মিডিয়া ডায়ালগ’ আমাদের বাংলাদেশে চীনা
বিনিয়োগে ভারতের আপত্তির কথাই জানিয়ে গেল।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
No comments