বাঙালির ম্যাগনাকার্টা যেভাবে মিলল বিশ্ব স্বীকৃতি by মুসতাক আহমদ
জাতির
জনকের যে ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে বাঙালি প্রাণ বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে
ঝঁপিয়ে পড়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিল, সে ভাষণের বিশ্ব স্বীকৃতি মিলেছে।
ভাষণটি আজ সর্বকালের সেরা ভাষণগুলোর অন্যতম। ঐতিহাসিকরা ভাষণটিকে বাঙালির
ম্যাগনাকার্টা হিসেবে অভিহিত করে থাকেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক
রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) দেয়া সেই ভাষণের বিশ্ব
স্বীকৃতি মিলে গত বছরের ৩০ অক্টোবর। ওইদিন প্যারিসে জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থা
ইউনেস্কোর হেডকোয়ার্টারে এ সংক্রান্ত ঘোষণাটি দেন তৎকালীন মহাপরিচালক ইরিনা
বোকোভা। তবে এজন্য বাংলাদেশকে প্রায় ৯ বছর কাজ করতে হয়েছে। বাংলাদেশ
ইউনেস্কো জাতীয় কমিশনের (বিএনসিইউ) সচিব মো, মনজুর হোসেন যুগান্তরকে বলেন,
‘আমাদের সংস্থা ২০০৯ সালে জাতির জনকের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের বিশ্ব
স্বীকৃতি আদায়ের কার্যক্রম শুরু করে। এ সংক্রান্ত ফাইলের সারসংক্ষেপ ওই বছর
মার্চে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য পাঠানো
হয়। প্রধানমন্ত্রী ৩০ মার্চ সারসংক্ষেপে স্বাক্ষর করেন। এরপর শুরু হয়
পরবর্তী কার্যক্রম। সব ধাপ ও প্রক্রিয়া শেষে ২০১৭ সালের ১৭ এপ্রিল প্যারিসে
নিযুক্ত বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত শহিদুল ইসলাম ইউনেস্কোতে ফাইলটি
দাখিল করেন। এরপর দাফতরিক প্রক্রিয়া শেষে কাঙ্ক্ষিত ঘোষণা আসে। বাঙালি
জাতির ম্যাগনাকার্টা খ্যাত বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্বপ্রামাণ্য
ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘২০০৯ সালের উদ্যোগ কেবল
সারসংক্ষেপ প্রক্রিয়া করার মধ্যেই সীমিত রাখা হয়নি। ইউনেস্কোর বিভিন্ন
ধরনের আন্তর্জাতিক সভা-সেমিনার ও কর্মশালায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ঐতিহাসিক
প্রেক্ষাপট, এর সুদূরপ্রসারী ফল, মর্মার্থ ও তাৎপর্য তুলে ধরা হয়। এরই অংশ
হিসেবে ২০১১ সালে ইন্দোনেশিয়ায় এক কর্মশালায় ভাষণটির ওপর একটি উপস্থাপনা
তুলে ধরেন বিএনসিইউ’র এক কর্মকর্তা। এভাবেই প্রক্রিয়া এগিয়ে যেতে থাকে।’
জানা যায়, ইন্দোনেশিয়ার ওই অনুষ্ঠানে বিএনসিইউ’র পক্ষ থেকে সংস্থাটির
তৎকালীন প্রোগ্রাম অফিসার রোকেয়া খাতুন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ নিয়ে তৈরি একটি
উপস্থাপনা তুলে ধরেন।
বদরুন নেসা সরকারি মহিলা কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ
বিভাগের বর্তমান এই সহকারী অধ্যাপক যুগান্তরকে বলেন, ‘২০১১ সালে
ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় কোরিয়ান ইউনেস্কো আয়োজিত ‘সেকেন্ড রিজিওনাল ট্রেনিং
ওয়ার্কশপ অন দ্য ইউনেস্কো, মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’-এ বাংলাদেশের
প্রতিনিধি হিসেবে আমি যোগ দিয়েছিলাম। সংস্থার পক্ষ থেকে আমাকে দায়িত্ব দেয়া
হয়েছিল। আমার উপস্থাপনায় ছিল কী করে একটি জাদুকরী ভাষণ একটি দেশের
স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে পারে, সেই কথা। সেখানে বঙ্গবন্ধুর অবিস্মরণীয় ৭
মার্চের ভাষণের ওপর আমার উপস্থাপনা প্রশংসা পায়। এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের
চেয়ারপারসন রে অ্যাডমন্ডসন আমার উপস্থাপনার ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি
বঙ্গবন্ধুর ভাষণের গুরুত্ব উপস্থাপনে বেশকিছু মতামত ও পর্যবেক্ষণ দেন।’
রোকেয়া খাতুন বলেন, ‘দীর্ঘ ছয় বছর পর বঙ্গবন্ধুর সেই জাদুকরী ভাষণের বিশ্ব
স্বীকৃতির ঘোষণা শোনার পর আমি আনন্দে উদ্বেলিত হই। এত বড় প্রয়াসের একজন
ক্ষুদ্র অংশীদার হতে পেরে নিজেকে গর্বিত মনে করছি।’ সাধারণত আন্তর্জাতিক
তাৎপর্য রয়েছে- এমন বিষয়গুলোকেই বিশ্ব আন্তর্জাতিক রেজিস্টারের মেমোরিতে
(মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার) তালিকাভুক্ত করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্ব আন্তর্জাতিক রেজিস্টারের
মেমোরিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে বেশ কিছু প্রক্রিয়া অনুসৃত হয়। ২০১৭
সালের ১৭ এপ্রিল আবেদন দাখিলের পর সেটি যায় এ সংক্রান্ত ইন্টারন্যাশনাল
অ্যাডভাইজরি কমিটিতে (আইএসি)। ২৪-২৭ অক্টোবর ওই কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকে ৭ মার্চের ভাষণকে ইউনেস্কো স্বীকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বঙ্গবন্ধুর
৭ মার্চের ভাষণ আন্তর্জাতিক দলিলে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে তালিকাভুক্ত
ঐতিহ্যের সংখ্যা দাঁড়াল ৪২৭টিতে। ১৮ মিনিট স্থায়ী এ ভাষণটি একাধিক ভাষায়
অনুবাদ হয়েছে। ‘নিউজউইক ম্যাগাজিন’ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
রহমানকে রাজনীতির কবি হিসেবে অবিহিত করেছে। এর আগে বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ
বৈশ্বিকভাবে একাডেমিক স্বীকৃতিও লাভ করে। খ্রিস্টপূর্ব ৪৩১ থেকে ১৯৮৭
খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় আড়াই হাজার বছরের সেরা ভাষণ নিয়ে ২০১৪ সালে
যুক্তরাজ্য থেকে ২২৩ পৃষ্ঠার একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ‘উই শ্যাল ফাইট অন
দ্য বিচেস- দ্য স্পিচেস দ্যাট ইন্সপায়ার্ড হিস্টোরি’ নামের ওই গ্রন্থ সংকলন
করেছেন জ্যাকব এফ ফিল্ড। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে যুক্তরাজ্যের
প্রধানমন্ত্রী স্যার উইনস্টন চার্চিলের ভাষণ দিয়ে শুরু করা সংকলনের শেষ
ভাষণটি যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের। বইটির ২০১
পৃষ্ঠায় ‘দ্য স্ট্রাগল দিস টাইম ইজ দ্য স্ট্রাগল ফর ইনডিপেনডেনস’ শিরোনামে
স্থান পেয়েছে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি। প্রসঙ্গত, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অনেক
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীই বঙ্গবন্ধুর প্রাজ্ঞ ও কৌশলী ভাষণটিকে গণতন্ত্রের জনক জন
আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গের ভাষণের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তারা বলেছেন,
‘আব্রাহাম লিংকনের ভাষণটি ছিল পূর্বপরিকল্পিত ও লিখিত। আর শেখ মুজিবুর
রহমানের ভাষণটি ছিল অলিখিত এবং তাৎক্ষণিক। সে হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
রহমানের ভাষণটি আব্রাহাম লিংকনের ভাষণটিকেও ছাপিয়ে গেছে। তাই এ ভাষণটি
যুগোত্তীর্ণ।’ উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ দেশের বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠান
চলাকালে প্রচারে বাঙালি জাতির হৃদয় ও মনকে এখনও উৎসাহিত করে। ভাষণটি এ
দেশের মানুষকে এবং পরবর্তী প্রজন্ম গুলোকে অনুপ্রাণিত করে চলছে।
No comments