৭ই মার্চের ভাষণ ছিল সামরিক জান্তার মৃত্যু পরোয়ানা by নূরে আলম সিদ্দিকী
৭ই
মার্চের ভাষণটিকে বিভিন্ন আঙ্গিকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। কবিরা ভাষণটিকে
মহাকাব্য বলেছেন। কেউ কেউ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ কবিতা বলে বর্ণনা করেছেন।
চিত্রশিল্পীরা এটিকে পিকাসো’র আঁকা ছবির সঙ্গে তুলনা করেছেন।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা একে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বক্তৃতা বলে উদ্ধৃত করেছেন।
মনস্তাত্ত্বিকরা ভাষণটিকে দেখেছেন তার দগ্ধীভূত হৃদয়ের বিস্ফোরিত দাবানল
হিসেবে। আমরাও বলি- ৫২-এর বর্ণমালা আর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাঙালি
জাতীয়তাবাদের চেতনার উন্মেষ, বিকাশ, ব্যাপ্তি ও সফলতার এটি কেবল পূর্ণ
বহিঃপ্রকাশই নয়, ভাষণটি পাকিস্তানি সামরিক জান্তার পরাজয়কেই কেবল নিশ্চিত
করেনি, সমস্ত মানুষের মননশীলতা ও প্রতীতীকে প্রত্যয়ে উজ্জীবিত করে নি, একটা
অদৃশ্য রাখীবন্ধনে সমগ্র জাতিকে শুধু আবদ্ধই করেনি, লড়াকু, অকুতোভয় একটি
সত্তাকে কুশলী রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। শব্দচয়ন- তার
বহিঃপ্রকাশ লক্ষ লক্ষ মানুষের মননশীলতাকে এমনভাবে শানিত করেছে যে,
সর্বশ্রেণি ও পেশার আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার সকলেই যা শুনতে এসেছিলেন, ঠিক তাই
শ্রবণ করে স্বাধীনতার দৃপ্ত শপথে উজ্জীবিত হয়ে সেদিন ঘরে ফিরেছেন।
৭ই মার্চের ভাষণের পূর্বে ৩২ নম্বরের বাসায় প্রচণ্ড বিতর্কের ঝড় উঠেছিল। এটা সর্বজ্ঞাত- একদল চেয়েছিলেন নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা যখন পেয়েছি তখন কেন্দ্রীয় ক্ষমতা দখল করে ২৩ বছরের শোষণের হিসাব পাই পাই করে বুঝে নেব। তারপর আমরাই পশ্চিমাদের গলাধাক্কা দিয়ে বিদায় করে দেব। অন্য একটি অভিমত ছিল, রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধু সরাসরি যেন জনগণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ঘোষণা প্রদান করেন। আমরা যারা নির্বাচনের ম্যান্ডেটে বিশ্বাস করতাম- বন্দুকের নল নয়, জনগণের বুকনিঃসৃত নিশ্বাসকেই যারা সমস্ত শক্তির উৎস ভাবতাম। পেন্টাগন, ক্রেমলিন, দিল্লি অধিষ্ঠিত ক্ষমতাসীনদের দিকে তাকিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালনায় তাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে অনুপ্রেরণার উৎস মনে করতাম না। আমাদের সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি ছিল- স্বাধীনতার ঘোষণা বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকে অবশ্যই বজ্রনির্ঘোষে ঘোষিত হবে, কিন্তু বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযোগে বাংলার স্বাধীনতাকামী ও বিশ্বের জাগ্রত জনতাকে আদৌ যেন বিভ্রান্ত করতে না পারে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, বঙ্গবন্ধুই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন, কিন্তু সকল চিন্তার অভিব্যক্তিতে ধৈর্যসহকারে সবার অভিমত শ্রবণ করার অনন্যসাধারণ বৈশিষ্ট্য তার ছিল। ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি শুধু পাকিস্তানের পরাজয়কে সুনিশ্চিতই করে নি, বরং তার ব্যক্তিত্ব ও স্টেটস্ম্যানশিপকে ভিন্ন উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করেছে। ৭ই মার্চের ভাষণটি কৌশলগত দিক থেকে এতই নিখুঁত ও নিষ্কলুষ ছিল যে, আজও আমি চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই- দিগন্ত বিস্তৃত আকাশ থেকে বৃষ্টির মতো তার উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হচ্ছে। ৭ই মার্চের ভাষণে স্বাধীনতার নির্দেশনাটি এতই সুস্পষ্ট ছিল যে, (আমি যদি হুকুম দিতে নাও পারি) ২৫শে মার্চ রাতে ওদের পৈশাচিক আক্রমণের পর আর নতুন করে কোনো নির্দেশনার অপেক্ষা রাখে না।
কি অদ্ভুত কৌশলী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বক্তব্য ছিল সেটি। পাকিস্তানি জান্তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। একদিকে তিনি সেনাবাহিনীকে উদ্দেশ্য করে বলছেন, “তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিচ্ছু বলবে না।” অন্যদিকে বলছেন- “আর যদি একটি গুলি চলে- যদি আমার লোককে হত্যা করা হয় তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইলো- প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।” একদিকে তিনি ইয়াহিয়া খানকে ৪টি শর্ত ছুড়ে দিলেন। অন্যদিকে তিনি নির্দেশনা দিলেন- “আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি...।” “যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ।” এই উচ্চারণটি এতটাই সুদূরপ্রসারী ছিল যে, প্রতিটি মানুষ নিষ্কলুষ চিত্তে উজ্জীবিত হলো- শুধুমাত্র শত্রুর আক্রমণকে প্রতিহত করা নয়, শত্রুর যেকোনো সশস্ত্র আক্রমণকে পরাভূত করতে হবে। ক্ষমতার দম্ভে অন্ধ পাকিস্তানি পৈশাচিক জান্তা এই ভাষণটির মর্মার্থ উপলব্ধি করতে পারেনি বলেই তারা ধরে নিয়েছিল, কোনো একটি সময়ে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালালে, বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করলে- আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে যাবে, মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত ও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে। স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ৪ নেতাসহ আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের শীর্ষস্থানীয় ২০/২৫ জন ব্যক্তিত্বকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে তারা তালিকা প্রস্তুতও করেছিল।
অনেক তর্ক-বিতর্কের পর ৭ই মার্চে ৩২ নম্বরের বাসায় সাব্যস্ত হলো- স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সে উপস্থিত হওয়ার আগেই উপস্থিত জনতাকে উজ্জীবিত করবে এবং আগ্নেয়গিরির গলিত লাভার মতো বিস্ফোরিত করবে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুসরণ করার জন্য প্রতিটি মানুষকে ইস্পাতকঠিন প্রতীতির আওতায় নিয়ে আসবে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই এক থেকে সোয়া ঘণ্টা আগে এসেই আমরা মূল মাইকের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করি। খণ্ড খণ্ড অগ্নিঝরা বক্তৃতা ও স্লোগানে রেসকোর্সকে প্রকম্পিত করে তুলি, তাদের চেতনাকে শানিত করে অবশ্যম্ভাবী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করি। মণি ভাই, রাজ্জাক ভাই, তোফায়েল সাহেব, জাতীয় ৪ নেতাসহ বেশকিছু নেতা মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন।
এই উজ্জীবিত জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি আজকে প্রতিটি মানুষের হৃদয়বন্দরে গ্রথিত রয়েছে। কিন্তু স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সেদিনের ভূমিকাটি কেন জানি না কেউই উল্লেখ করেন না। বঙ্গবন্ধু মঞ্চে পা রেখেই উদ্বেলিত জনসমুদ্রকে দেখে এতটাই উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন যে, আজকের ছাত্রলীগ নেতৃত্ব এই অন্তর্নিহিত সত্যটি কল্পনার আবর্তে আনতে পারবেন না। ১লা মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত তার প্রদত্ত সকল নির্দেশ ছাত্রলীগের লক্ষ লক্ষ কর্মী অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। শাসনতান্ত্রিক ও সংসদীয় রাজনীতির বাধ্যবাধকতায় যে কথাগুলো বঙ্গবন্ধুর পক্ষে সরাসরি উচ্চারণ করা সম্ভব হতো না- তারই নির্দেশে তার উত্তরাধিকার হিসেবে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সেই নির্দেশনাগুলো সংবাদপত্র, সভা-সমাবেশ ও মিছিলের মাধ্যমে সারা বাংলার বাতাসে ছড়িয়ে দিতো এবং পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে সেটি পালিত হতো।
১৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রেখেছেন- আমরা (স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ) সর্বশেষ রাজনৈতিক অবস্থা ঘোষণার জন্য ডাকসু কার্যালয়ে একটি সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করি। স্থান সংকুলান না হওয়ায় সংবাদ সম্মেলনটি বটতলায় স্থানান্তরিত হয়। সেটিও যেন একটি জনসভায় পরিণত হয়। ৭ই মার্চের ভাষণের রেশ ধরে সাংবাদিকরা আমাদের প্রশ্ন করছিলেন। হঠাৎ করে সাংবাদিক মার্ক টালী প্রশ্ন করলেন (ইংরেজিতে) আপনাদের নেতা রেসকোর্স থেকে যে ৪টি শর্ত দিয়েছেন ইয়াহিয়া খান তা সম্পূর্ণ মেনে নিলে তো পাকিস্তানের অস্তিত্ব থাকে না। তখন কি আপনারা স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারা পরিবর্তন করবেন, তার নেতৃত্বে আন্দোলন স্তিমিত করে দেবেন, নাকি নেতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে চলমান আন্দোলনকে অব্যাহত রাখবেন? এই প্রশ্নের প্রেক্ষিতে অতি ক্ষিপ্রগতিতে আল্লাহর অশেষ রহমতে সেদিন আমি উত্তরটি দিতে পেরেছিলাম যে, বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো- তিনি বাংলার মানুষের নাড়ির স্পন্দন, হৃদয়ের অনুরণন স্পষ্ট অনুধাবন করতে পারেন এবং তারই আঙ্গিকে সিদ্ধান্ত দিতে পারেন বলেই তিনি আমাদের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা- আমাদের চলমান স্বাধীনতা সংগ্রামের মুকুটহীন সম্রাট। সময় আসলে আপনিও বুঝতে পারবেন সংকট উত্তরণে তার সিদ্ধান্ত কত নির্ভূল ও সুদূরপ্রসারী। আর সে কারণেই নেতা আমাদের চেতনার মূর্ত প্রতীক। আরেকজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন- পাকিস্তানি সামরিক শক্তি সম্পর্কে আপনারা কতটুকু ওয়াকিবহাল? ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করেছেন যে, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করো। তাহলে আপনাদের অস্ত্রভাণ্ডারটি কোথায়? আমরা জবাব দিয়েছিলাম- বাংলার প্রত্যেকটি মানুষের হৃদয় একেকটি অস্ত্রাগার। আমরা সকলকে আন্দোলনের স্রোতধারায় বঙ্গবন্ধুর একক নেতৃত্বে একটি মিলনের মোহনায় এনে দাঁড় করিয়েছি। প্রতিটি মানুষ আজ জীবন দেয়ার জন্য প্রস্তুত। নারী অথবা পুরুষ একটি মানুষও বেঁচে থাকলে স্বাধিকার আদায়ের এই অসহযোগ আন্দোলনকে মোকাবিলা করার শক্তি ওদের নেই। বিজয় নিয়ে আমাদের বিন্দুমাত্র দ্বিধা বা সংশয় নেই। ১৬ই ডিসেম্বরের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে সেই সত্যটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। ৭ই মার্চ বাঙালির জাতীয় চেতনার সফলতা, সার্থকতা এবং তাদের চেতনাকে ঐতিহাসিক বাস্তবতায় রূপান্তরিত করার অনন্যসাধারণ দৃষ্টান্ত।
আজ জীবন সায়াহ্নে এসে ৭ই মার্চের বিশ্লেষণে আমার দগ্ধীভূত হৃদয়ের জিজ্ঞাসা ’৭১-এর ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু গোটা জাতিকে যে অদৃশ্য বন্ধনে আবদ্ধ করতে পেরেছিলেন, আমরা সমগ্র জাতিকে তারই নেতৃত্বে একটি সমুদ্রের মোহনায় এনে দাঁড় করিয়েছিলাম, যে প্রেরণায় মা তার সন্তানকে রণাঙ্গনে পাঠিয়েছিল, যে বোন অকাতরে বৈধব্যের যন্ত্রণাকে মেনে নিয়েছিল, সতীত্ব হারানো যে বোনটি তার মুখের উপর ছড়ানো থু-তু স্বাধীনতায় সূর্যস্নাত হয়ে মুছে ফেলার আশাবাদ বুকে লালন করেছিল- তাদের বেদনাহত চিত্তের অনেকগুলো জিজ্ঞাসা আজ ইথারে ভাসছে। সেদিনের ৭ই মার্চ ছিল জাতীয় মহামিলনের মাহেন্দ্রক্ষণ। সেই জাতি আজকে নির্মম বিভাজনের শিকার। সেদিনটি ছিল স্বাধীনতাপ্রাপ্তির নিশ্চিত বিশ্বাসের। আর আজ আতঙ্ক, সন্ত্রাস, অনিশ্চয়তা, এমনকি অস্তিত্ব হারানোর আশঙ্কা আর অন্ধকার অমানিশায় ঘেরা। সেদিনের ৭ই মার্চ ছিল অর্জনের- সম্মিলনের। আজকের ৭ই মার্চ বিভাজনের। সেদিন মননশীলতায় প্রতীতি ছিল- স্বাধীনতা আসবেই; আজকে সকলের হৃদয় দোদুল্যমান।
আমরা কি সেই স্বাধীনতাকে ধরে রাখতে পারবো না? সেদিনের ৭ই মার্চ পাওয়ার চাইতে ত্যাগের আলোয় ছিল দীপ্যমান। আজ দম্ভ আর জেদ সবকিছুই প্রত্যাশা পূরণের অন্তরায়। সেদিন মানুষের চোখে ছিল স্বপ্ন আর সম্ভাবনা; আজ সবার মনে আতঙ্ক আর আশঙ্কা। এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার ফরিয়াদ আমার আল্লাহর কাছে।
৭ই মার্চের ভাষণের পূর্বে ৩২ নম্বরের বাসায় প্রচণ্ড বিতর্কের ঝড় উঠেছিল। এটা সর্বজ্ঞাত- একদল চেয়েছিলেন নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা যখন পেয়েছি তখন কেন্দ্রীয় ক্ষমতা দখল করে ২৩ বছরের শোষণের হিসাব পাই পাই করে বুঝে নেব। তারপর আমরাই পশ্চিমাদের গলাধাক্কা দিয়ে বিদায় করে দেব। অন্য একটি অভিমত ছিল, রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধু সরাসরি যেন জনগণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ঘোষণা প্রদান করেন। আমরা যারা নির্বাচনের ম্যান্ডেটে বিশ্বাস করতাম- বন্দুকের নল নয়, জনগণের বুকনিঃসৃত নিশ্বাসকেই যারা সমস্ত শক্তির উৎস ভাবতাম। পেন্টাগন, ক্রেমলিন, দিল্লি অধিষ্ঠিত ক্ষমতাসীনদের দিকে তাকিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালনায় তাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে অনুপ্রেরণার উৎস মনে করতাম না। আমাদের সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি ছিল- স্বাধীনতার ঘোষণা বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকে অবশ্যই বজ্রনির্ঘোষে ঘোষিত হবে, কিন্তু বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযোগে বাংলার স্বাধীনতাকামী ও বিশ্বের জাগ্রত জনতাকে আদৌ যেন বিভ্রান্ত করতে না পারে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, বঙ্গবন্ধুই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন, কিন্তু সকল চিন্তার অভিব্যক্তিতে ধৈর্যসহকারে সবার অভিমত শ্রবণ করার অনন্যসাধারণ বৈশিষ্ট্য তার ছিল। ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি শুধু পাকিস্তানের পরাজয়কে সুনিশ্চিতই করে নি, বরং তার ব্যক্তিত্ব ও স্টেটস্ম্যানশিপকে ভিন্ন উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করেছে। ৭ই মার্চের ভাষণটি কৌশলগত দিক থেকে এতই নিখুঁত ও নিষ্কলুষ ছিল যে, আজও আমি চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই- দিগন্ত বিস্তৃত আকাশ থেকে বৃষ্টির মতো তার উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হচ্ছে। ৭ই মার্চের ভাষণে স্বাধীনতার নির্দেশনাটি এতই সুস্পষ্ট ছিল যে, (আমি যদি হুকুম দিতে নাও পারি) ২৫শে মার্চ রাতে ওদের পৈশাচিক আক্রমণের পর আর নতুন করে কোনো নির্দেশনার অপেক্ষা রাখে না।
কি অদ্ভুত কৌশলী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বক্তব্য ছিল সেটি। পাকিস্তানি জান্তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। একদিকে তিনি সেনাবাহিনীকে উদ্দেশ্য করে বলছেন, “তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিচ্ছু বলবে না।” অন্যদিকে বলছেন- “আর যদি একটি গুলি চলে- যদি আমার লোককে হত্যা করা হয় তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইলো- প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।” একদিকে তিনি ইয়াহিয়া খানকে ৪টি শর্ত ছুড়ে দিলেন। অন্যদিকে তিনি নির্দেশনা দিলেন- “আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি...।” “যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ।” এই উচ্চারণটি এতটাই সুদূরপ্রসারী ছিল যে, প্রতিটি মানুষ নিষ্কলুষ চিত্তে উজ্জীবিত হলো- শুধুমাত্র শত্রুর আক্রমণকে প্রতিহত করা নয়, শত্রুর যেকোনো সশস্ত্র আক্রমণকে পরাভূত করতে হবে। ক্ষমতার দম্ভে অন্ধ পাকিস্তানি পৈশাচিক জান্তা এই ভাষণটির মর্মার্থ উপলব্ধি করতে পারেনি বলেই তারা ধরে নিয়েছিল, কোনো একটি সময়ে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালালে, বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করলে- আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে যাবে, মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত ও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে। স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ৪ নেতাসহ আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের শীর্ষস্থানীয় ২০/২৫ জন ব্যক্তিত্বকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে তারা তালিকা প্রস্তুতও করেছিল।
অনেক তর্ক-বিতর্কের পর ৭ই মার্চে ৩২ নম্বরের বাসায় সাব্যস্ত হলো- স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সে উপস্থিত হওয়ার আগেই উপস্থিত জনতাকে উজ্জীবিত করবে এবং আগ্নেয়গিরির গলিত লাভার মতো বিস্ফোরিত করবে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুসরণ করার জন্য প্রতিটি মানুষকে ইস্পাতকঠিন প্রতীতির আওতায় নিয়ে আসবে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই এক থেকে সোয়া ঘণ্টা আগে এসেই আমরা মূল মাইকের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করি। খণ্ড খণ্ড অগ্নিঝরা বক্তৃতা ও স্লোগানে রেসকোর্সকে প্রকম্পিত করে তুলি, তাদের চেতনাকে শানিত করে অবশ্যম্ভাবী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করি। মণি ভাই, রাজ্জাক ভাই, তোফায়েল সাহেব, জাতীয় ৪ নেতাসহ বেশকিছু নেতা মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন।
এই উজ্জীবিত জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি আজকে প্রতিটি মানুষের হৃদয়বন্দরে গ্রথিত রয়েছে। কিন্তু স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সেদিনের ভূমিকাটি কেন জানি না কেউই উল্লেখ করেন না। বঙ্গবন্ধু মঞ্চে পা রেখেই উদ্বেলিত জনসমুদ্রকে দেখে এতটাই উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন যে, আজকের ছাত্রলীগ নেতৃত্ব এই অন্তর্নিহিত সত্যটি কল্পনার আবর্তে আনতে পারবেন না। ১লা মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত তার প্রদত্ত সকল নির্দেশ ছাত্রলীগের লক্ষ লক্ষ কর্মী অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। শাসনতান্ত্রিক ও সংসদীয় রাজনীতির বাধ্যবাধকতায় যে কথাগুলো বঙ্গবন্ধুর পক্ষে সরাসরি উচ্চারণ করা সম্ভব হতো না- তারই নির্দেশে তার উত্তরাধিকার হিসেবে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সেই নির্দেশনাগুলো সংবাদপত্র, সভা-সমাবেশ ও মিছিলের মাধ্যমে সারা বাংলার বাতাসে ছড়িয়ে দিতো এবং পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে সেটি পালিত হতো।
১৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রেখেছেন- আমরা (স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ) সর্বশেষ রাজনৈতিক অবস্থা ঘোষণার জন্য ডাকসু কার্যালয়ে একটি সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করি। স্থান সংকুলান না হওয়ায় সংবাদ সম্মেলনটি বটতলায় স্থানান্তরিত হয়। সেটিও যেন একটি জনসভায় পরিণত হয়। ৭ই মার্চের ভাষণের রেশ ধরে সাংবাদিকরা আমাদের প্রশ্ন করছিলেন। হঠাৎ করে সাংবাদিক মার্ক টালী প্রশ্ন করলেন (ইংরেজিতে) আপনাদের নেতা রেসকোর্স থেকে যে ৪টি শর্ত দিয়েছেন ইয়াহিয়া খান তা সম্পূর্ণ মেনে নিলে তো পাকিস্তানের অস্তিত্ব থাকে না। তখন কি আপনারা স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারা পরিবর্তন করবেন, তার নেতৃত্বে আন্দোলন স্তিমিত করে দেবেন, নাকি নেতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে চলমান আন্দোলনকে অব্যাহত রাখবেন? এই প্রশ্নের প্রেক্ষিতে অতি ক্ষিপ্রগতিতে আল্লাহর অশেষ রহমতে সেদিন আমি উত্তরটি দিতে পেরেছিলাম যে, বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো- তিনি বাংলার মানুষের নাড়ির স্পন্দন, হৃদয়ের অনুরণন স্পষ্ট অনুধাবন করতে পারেন এবং তারই আঙ্গিকে সিদ্ধান্ত দিতে পারেন বলেই তিনি আমাদের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা- আমাদের চলমান স্বাধীনতা সংগ্রামের মুকুটহীন সম্রাট। সময় আসলে আপনিও বুঝতে পারবেন সংকট উত্তরণে তার সিদ্ধান্ত কত নির্ভূল ও সুদূরপ্রসারী। আর সে কারণেই নেতা আমাদের চেতনার মূর্ত প্রতীক। আরেকজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন- পাকিস্তানি সামরিক শক্তি সম্পর্কে আপনারা কতটুকু ওয়াকিবহাল? ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করেছেন যে, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করো। তাহলে আপনাদের অস্ত্রভাণ্ডারটি কোথায়? আমরা জবাব দিয়েছিলাম- বাংলার প্রত্যেকটি মানুষের হৃদয় একেকটি অস্ত্রাগার। আমরা সকলকে আন্দোলনের স্রোতধারায় বঙ্গবন্ধুর একক নেতৃত্বে একটি মিলনের মোহনায় এনে দাঁড় করিয়েছি। প্রতিটি মানুষ আজ জীবন দেয়ার জন্য প্রস্তুত। নারী অথবা পুরুষ একটি মানুষও বেঁচে থাকলে স্বাধিকার আদায়ের এই অসহযোগ আন্দোলনকে মোকাবিলা করার শক্তি ওদের নেই। বিজয় নিয়ে আমাদের বিন্দুমাত্র দ্বিধা বা সংশয় নেই। ১৬ই ডিসেম্বরের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে সেই সত্যটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। ৭ই মার্চ বাঙালির জাতীয় চেতনার সফলতা, সার্থকতা এবং তাদের চেতনাকে ঐতিহাসিক বাস্তবতায় রূপান্তরিত করার অনন্যসাধারণ দৃষ্টান্ত।
আজ জীবন সায়াহ্নে এসে ৭ই মার্চের বিশ্লেষণে আমার দগ্ধীভূত হৃদয়ের জিজ্ঞাসা ’৭১-এর ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু গোটা জাতিকে যে অদৃশ্য বন্ধনে আবদ্ধ করতে পেরেছিলেন, আমরা সমগ্র জাতিকে তারই নেতৃত্বে একটি সমুদ্রের মোহনায় এনে দাঁড় করিয়েছিলাম, যে প্রেরণায় মা তার সন্তানকে রণাঙ্গনে পাঠিয়েছিল, যে বোন অকাতরে বৈধব্যের যন্ত্রণাকে মেনে নিয়েছিল, সতীত্ব হারানো যে বোনটি তার মুখের উপর ছড়ানো থু-তু স্বাধীনতায় সূর্যস্নাত হয়ে মুছে ফেলার আশাবাদ বুকে লালন করেছিল- তাদের বেদনাহত চিত্তের অনেকগুলো জিজ্ঞাসা আজ ইথারে ভাসছে। সেদিনের ৭ই মার্চ ছিল জাতীয় মহামিলনের মাহেন্দ্রক্ষণ। সেই জাতি আজকে নির্মম বিভাজনের শিকার। সেদিনটি ছিল স্বাধীনতাপ্রাপ্তির নিশ্চিত বিশ্বাসের। আর আজ আতঙ্ক, সন্ত্রাস, অনিশ্চয়তা, এমনকি অস্তিত্ব হারানোর আশঙ্কা আর অন্ধকার অমানিশায় ঘেরা। সেদিনের ৭ই মার্চ ছিল অর্জনের- সম্মিলনের। আজকের ৭ই মার্চ বিভাজনের। সেদিন মননশীলতায় প্রতীতি ছিল- স্বাধীনতা আসবেই; আজকে সকলের হৃদয় দোদুল্যমান।
আমরা কি সেই স্বাধীনতাকে ধরে রাখতে পারবো না? সেদিনের ৭ই মার্চ পাওয়ার চাইতে ত্যাগের আলোয় ছিল দীপ্যমান। আজ দম্ভ আর জেদ সবকিছুই প্রত্যাশা পূরণের অন্তরায়। সেদিন মানুষের চোখে ছিল স্বপ্ন আর সম্ভাবনা; আজ সবার মনে আতঙ্ক আর আশঙ্কা। এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার ফরিয়াদ আমার আল্লাহর কাছে।
No comments