ত্রিপুরায় বিজেপির জয়জয়কার by বদরুদ্দীন উমর
ভারতের
ত্রিপুরা রাজ্যে ২৫ বছরের সিপিএম শাসনের অবসান হয়েছে। ত্রিপুরার
মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার একজন সৎ ও যোগ্য মুখ্যমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও তার
পরাজয়ের প্রধান কারণ, ভারতে সাধারণভাবে সিপিএমের করুণ অবস্থা। নানা ধরনের
অপকর্ম এবং আমলাতান্ত্রিক কার্যকলাপের ফলে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে সিপিএমের যে
অবস্থা দাঁড়িয়েছে, তার প্রভাব থেকে কোনো রাজ্য যে মুক্ত থাকবে, এটা সম্ভব
নয়। ত্রিপুরার সিপিএম সরকার পূর্ববর্তী নির্বাচন খুব ভালোভাবে উতরে যাওয়া
সত্ত্বেও এটা সদ্য অনুষ্ঠিত নির্বাচনে প্রমাণিত হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে ভালো
মানুষ হলেই যে রাজনৈতিকভাবে কোনো পার্টি বিপদমুক্ত হবে, এটা চিন্তা করা ঠিক
নয়। যদিও ব্যক্তিগত সততা ও ভালোমানুষির মূল্য খাটো করে দেখার বিষয় নয়।
আসলে ভারতে সিপিএমের রাজনৈতিক গ্যাস ফুরিয়ে গেছে। তার সুযোগ নিয়েই বিজেপি
বা আরএসএস এখন ত্রিপুরায় তাদের ঘাঁটি গাড়তে সক্ষম হয়েছে। আরএসএস এবং বিজেপি
নেতা ভারতের প্রধানমন্ত্রী ত্রিপুরায় তাদের বিজয়কে এক টুইটবার্তায়
আখ্যায়িত করেছেন তাদের 'আদর্শের জয়' হিসেবে! কিসের আদর্শ? ২০১৪ সালের
সাধারণ নির্বাচনের আগে অনিতা আম্বানিসহ ভারতের নিকৃষ্ট পুঁজি মালিকদের
টাকার জোরে নির্বাচনে যারা জয়লাভ করে শাসন ক্ষমতা দখল করেছেন, তাদের আবার
আদর্শ কী? আদর্শের কথা বলে তারা টাকার জোরে প্রচারমাধ্যম ভাসিয়ে দিয়ে এবং
হিন্দুত্বের জঘন্য সাম্প্রদায়িক প্রচারণা চালিয়ে নানাভাবে ভারতের জনগণকে
বিভ্রান্ত করে নির্বাচনে জয়লাভ করেছিলেন। বিজেপি ও নরেন্দ্র মোদির
হিন্দুত্ববাদের সঙ্গে হিন্দুধর্মের সম্পর্ক কী- এ নিয়ে ভাবনা-চিন্তার কোনো
অবকাশও তারা রাখেননি। কংগ্রেসের দীর্ঘদিনের নানা অপকর্ম ও দুস্কৃতির
বিরুদ্ধে দেশে যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দানা বেঁধেছিল, সে প্রতিক্রিয়াকে
হিন্দুত্বের নাম ভাঙিয়ে তারা প্রচার কাজে ব্যবহার করেছিল। কাজেই ত্রিপুরায়
নির্বাচন বিজয়কে তাদের হিন্দুত্বের আদর্শের জয় বলে প্রচার করা এক মহামিথ্যা
এবং অবাস্তব ব্যাপার ছাড়া অন্য কিছু মনে করার উপায় নেই। এ ক্ষেত্রে তাদের
আদর্শের একটা দিক অবশ্যই উল্লেখ করা দরকার। উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটি
রাজ্যে খ্রিষ্টান এবং আদিবাসীদের প্রাধান্য। তারা সকলেই গোমাংস খায়। উত্তর
ভারতের হিন্দিবলয়ের সঙ্গে এদিক দিয়ে তাদের বড় রকম পার্থক্য। এ কারণে উত্তর
ভারতে নরেন্দ্র মোদি ও তাদের সংগঠন আরএসএস, বিজেপি এবং সংঘ পরিবারের দলগুলো
'গোরক্ষা' এবং 'গোমাংস ভক্ষণ' নিষিদ্ধকরণের দাবি জোরেশোরে করেছিল। ক্ষমতায়
আসার পর মুসলমান, খ্রিষ্টান ও আদিবাসীদের গোমাংস ভক্ষণের অপরাধে অথবা
গোমাংস খাওয়ার মিথ্যা অভিযোগ এনে অনেক জায়গায় হত্যা পর্যন্ত করা হয়েছে।
এখনও তাদের সেই অভিযান অব্যাহত আছে 'আদর্শিকভাবে'। কিন্তু মজার ব্যাপার এই
যে, 'হিন্দুত্বের' এই আদর্শ বিষয়ে তাদের প্রচারণায় কিছুই দেখা যায়নি
ত্রিপুরা এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্যান্য রাজ্যে। গোমাংস ভক্ষণ নিষিদ্ধ
করা হবে তাদের 'আদর্শের' কারণে- এ কথা প্রচার করার সাহস তাদের হয়নি।
উপরন্তু তারা বলেছে, এসব রাজ্যে গোমাংস ভক্ষণ নিষিদ্ধ করা হবে না। তাহলে
'আদর্শের লড়াই' ত্রিপুরাসহ অন্য রাজ্যগুলোতে কীভাবে হলো? আরএসএসের মূল
প্রচারক সুনীল দেওধর দীর্ঘ দুই বছর ধরে তাদের 'আদর্শ' প্রচার করতে গিয়ে
গোরক্ষার বিষয়টি কেন তারা ধামাচাপা দিয়ে রাখলেন? পাঁচ বছর আগেও ত্রিপুরায়
বিজেপির কোনো পাত্তা ছিল না। পূর্ববর্তী রাজ্য নির্বাচনে তারা ৫০টি আসনে
প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। ভোট পেয়েছিল মাত্র দেড় শতাংশ এবং ৪৯টি আসনেই
তাদের প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। সিপিএম ৫০টি আসনে এবং কংগ্রেস
১০টি আসনে জয়লাভ করেছিল। এবার কংগ্রেস ত্রিপুরায় কোনো আসনেই জয়লাভ করেনি।
এর কারণ, আরএসএসের প্রচারক সুনীল দেওধর ত্রিপুরায় দুই বছর ধরে সেখানে খুব
কৃতিত্বের সঙ্গে নিজেদের প্রচার কাজ করেছেন। অপরিমিত অর্থ ব্যয় করে গড়ে
তুলেছেন এক বিরাট ক্যাডারভিত্তিক কর্মী বাহিনী। সুনীল দেওধর ভারতের বিভিন্ন
রাজ্যে ইতিপূর্বে আদিবাসীদের মধ্যে কাজ করে সেখানে একইভাবে গড়ে তুলেছিলেন
তাদের ক্যাডার বাহিনী এবং সংগঠনকে শক্তিশালী করেছিলেন তাদের 'আদর্শ'
হিন্দুত্ববাদ প্রচার করে। ত্রিপুরায় তাদের এই তথাকথিত আদর্শের প্রচার থেকে
তারা জোর দিয়েছিলেন সিপিএমবিরোধী বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে ঐক্যজোট গঠন করে।
তার মধ্যে প্রধান হলো আদিবাসীদের সংগঠন ইনডিজেনাস পিপলস ফ্রন্ট অব
ত্রিপুরা। ত্রিপুরায় আদিবাসী ও বাঙালিদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ থাকলেও
পূর্ববর্তী নির্বাচন পর্যন্ত সিপিএম এই দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষকে নিয়ন্ত্রণের
মধ্যে রেখে নির্বাচন করেছিল।
কিন্তু এবার সুনীল দেওধর একজন আরএসএস প্রচারক
হিসেবে আদিবাসীদের মধ্যে কাজ করে সে অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন। এ কাজ
করতে গিয়ে তিনি আদিবাসীদের ভাষা 'ককবরক' এবং বাংলা ভাষা উভয়ই আয়ত্ত
করেছিলেন, যা ছিল তার দিক থেকে সংগঠক হিসেবে এক অতি কৃতিত্বপূর্ণ কাজ।
বাঙালি ভোটারদের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে তিনি দুই লাখ রাজ্য সরকারি
কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির জন্য সপ্তম বেতন কমিশন গঠন এবং ১০০ দিনের কাজের
মজুরি দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ত্রিপুরার রাজ্য সিপিএস সরকারের
এই কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির দাবিতে বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি। শ্রমিকদের
মজুরিও বৃদ্ধি করেনি। তাদের মধ্যে এ নিয়ে যে ক্ষোভ ছিল, বিজেপি তাকে
ব্যবহার করেছিল। তাছাড়া যাদের বয়স তিরিশের মধ্যে, তাদের কর্মসংস্থানের
প্রতিশ্রুতির কথা বলেও তারা প্রচার চালিয়েছিলেন। কাজেই আদিবাসী এবং
বাঙালিদের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকলেও এবার বিজেপি সেই দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে
এভাবেই তাদের উভয়কে নিজেদের পেছনে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছিল। এই সাফল্যের পর
আরএসএস নেতা সুনীল দেওধর বলেছেন, তিনি তাদের সংগঠনের কাছে আবেদন জানাবেন
কর্ণাটক ও কেরালায় নির্বাচনী প্রচার সংগঠিত করার জন্য তাকে নিযুক্ত করতে।
কিন্তু শুধু সুনীল দেওধরই নয়, ত্রিপুরার প্রচার কাজে অংশগ্রহণ করেছিলেন
উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। তার রাজ্যের গোরখপুরে যে
বিরাট হিন্দু মঠ আছে, তার প্রভাব আছে ত্রিপুরার নাথ সম্প্রদায়ের মধ্যে। এই
নির্বাচনে এই নাথ সম্প্রদায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আদিত্যনাথ
ত্রিপুরায় ঘন ঘন নির্বাচনী সফর করে নির্বাচনে নাথ সম্প্রদায়ের লোকদের
সিপিএমের বিরুদ্ধে সংগঠিত করেছিলেন। এভাবে বিজেপি যে প্রচার অভিযান
চালিয়েছিল, তার তুলনায় সিপিএমের নির্বাচনী প্রচার ছিল দুর্বল। ত্রিপুরায় যে
পরিবর্তন ঘটছিল তার হিসাব করাও তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। কাজেই তারা অনেকটা
হাত-পা ছেড়ে দিয়েই এবারকার নির্বাচন করেছিল। বিজেপির শক্ত অবস্থানের মুখে
তাদের পরাজয়ের সম্ভাবনা নির্বাচনের কিছুদিনের আগে থেকেই দেখা দিয়েছিল।
কিন্তু তা সত্ত্বেও এই পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি সিপিএমের পক্ষে সম্ভব না
হওয়ার মধ্যে তাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াপনারই পরিচয় ছিল। কাজেই যা তারা ভাবতেই
পারেনি, সেটাই ঘটল সদ্য অনুষ্ঠিত এই রাজ্য নির্বাচনে। লক্ষ্য করার বিষয়
যে, ত্রিপুরাসহ উত্তর-পূর্ব ভারতের যে রাজ্যগুলোতে তারা সরকার গঠনে সক্ষম
হয়েছে, বিজেপি সরকারের 'আদর্শ' বড় পুঁজির খেদমত এবং নিম্নবর্ণের হিন্দুদের
ওপর নির্যাতনের খপ্পরে তারা আগে পড়েনি, যেভাবে এটা ঘটেছে উত্তর ভারতের বড়
বড় রাজ্যগুলোতে। উত্তর ভারতের বিগত নির্বাচনে জয়জয়কারের পর সেগুলোতে এখন
বিজেপির অবস্থা ভালো নয়। গুজরাটে বিজেপি কোনোমতে জয়লাভ করলেও সেখানকার
ভোটাররা বিগত রাজ্য নির্বাচনে তাদের ভালোভাবেই ঘোল খাইয়েছেন। এ ছাড়া অন্য
কয়েকটি রাজ্যে যে উপনির্বাচনগুলো হয়েছে, সেগুলোতে বিজেপি প্রার্থীরা পরাজিত
হয়েছেন কংগ্রেসের প্রার্থীদের কাছে। এর পুনরাবৃত্তি যে ভবিষ্যতে
উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোতে হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা আগামী রাজ্য
নির্বাচনে এবং ২০১৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে, তার সম্ভাবনা যথেষ্ট। কাজেই
আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিজেপির জয়লাভের সম্ভাবনা উড়িয়ে না দিলেও এটা
নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না যে, জয় তাদের নিশ্চিত। নির্বাচনের সময় বড় বড়
প্রতিশ্রুতি এক কথা এবং নির্বাচনের পর তা কার্যকর করা অন্য কথা। সিকিমসহ
গুরুত্বপূর্ণ ভারতের আটটি রাজ্যে লোকসভার আসন সংখ্যা ২৫। কাজেই এই
রাজ্যগুলোতে জয়লাভ যে বিজেপিকে আগামী নির্বাচনে বিপদমুক্ত রাখবে, এটা ভাবার
কোনো কারণ নেই।
সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
No comments