মরলেও শূন্যরেখা ছাড়তে চান না রোহিঙ্গারা
বান্দরবানের
নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তে এখনও অবস্থান করছেন মিয়ানমারের
সেনাসদস্যরা। তবে অন্যদিনের মতো মঙ্গলবার অস্ত্র নিয়ে টহল দিতে দেখা যায়নি
তাদের। বাঙ্কারেই সীমাবদ্ধ ছিল তাদের অবস্থান। তবে টহল অব্যাহত ছিল বিজিপির
(বর্ডার গার্ড পুলিশ)। এ দিনও তারা রোহিঙ্গাদের শূন্যরেখা ছেড়ে দেয়ার জন্য
হুমকি-ধমকি দিয়েছেন। শূন্যরেখায় থাকা রোহিঙ্গারা মঙ্গলবার যুগান্তরকে এ
তথ্য দিয়েছেন। তারা বলছেন, ‘মিয়ানমার সেনা, বিজিপি ও নাটালা বাহিনীর
হুমকি-ধমকিতে আমরা ভীত নই। প্রয়োজনে মরব, কিন্তু এখান থেকে যাব না।’
বৃহস্পতিবার তুমব্রু সীমান্তে কোনারপাড়ার শূন্যরেখায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পের
বিপরীতে সেনা সমাবেশ ঘটায় মিয়ানমার। শুক্র, শনি ও রোববার বাড়াতেই থাকে
সেনাসদস্য। রোহিঙ্গাদের শূন্যরেখা ছেড়ে দেয়ার জন্য মাইকিং করে। ক্যাম্পে
ইটপাটকেল ছুড়ে, ফাঁকা গুলিও চালায়। দেখা দেয় উত্তেজনা। শুক্রবার বিজিবির
(বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) সঙ্গে পতাকা বৈঠকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সেনা সরিয়ে
নেয়ার প্রতিশ্র“তি দেয় মিয়ানমার। এরপর কাঁটাতারের বেড়া থেকে সেনা সরানো
হলেও এখনও সীমান্ত থেকে সরানো হয়নি। বাঙ্কার খুড়ে রোহিঙ্গাদের দিকে অস্ত্র
তাঁক করে আছে তারা। গত বছরের ২৫ আগস্ট রাখাইনে জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে
এপারে আসার সময় বিজিবির বাধার মুখে কোনারপাড়ার শূন্যরেখায় কাঁটাতারের পাশে
অবস্থান নেন ৬ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা। তারা না পারছেন স্বদেশে ফিরতে, না
পারছেন বাংলাদেশে ঢুকতে। তবে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা সেখানে ত্রাণ দিচ্ছে।
শূন্যরেখার অবস্থানকারী রোহিঙ্গা নেতা দিল মোহাম্মদ জানান, কাঁটাতারের
পাশে এসে প্রতিদিন দিনের বেলায় শূন্যরেখা ছেড়ে চলে যেতে হুমকি দিচ্ছেন
বিজিপি সদস্যরা। মঙ্গলবারও দিয়েছেন। মাঝে মাঝে সেনাসদস্যরাও কাঁটাতারের
কাছে এসে হুমকি দিচ্ছেন। দিল মোহাম্মদ বলেন, এর আগে মিয়ানমারের ঢেকিবনিয়ায়
গিয়ে আমাদের একটি গ্রুপের সঙ্গে বৈঠক করার কথা বলেছিল তারা। এতে আমরা সাড়া
দিইনি। কারণ হিসেবে আমরা তাদের বলেছি, জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে
১০ লাখের অধিক রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে অবস্থান নিয়েছে।
এটি আর রোহিঙ্গা
কমিউনিটি ও মিয়ানমার সরকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বাংলাদেশ, জাতিসংঘ ও
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে বৈঠক করে সমস্যার সমাধান করতে হবে। এরপর
তারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। প্রতিনিয়ত দিনে-রাতে কাঁটাতারের কাছে এসে শূন্যরেখায়
অবস্থানরত রোহিঙ্গা ঝুপড়ি লক্ষ্য করে ইট-পাথর ছুড়তে থাকে। আর প্রায়ই ভারি
অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিতে থাকে। ফাঁকা গুলি চালায়। আরেক রোহিঙ্গা নেতা আরিফ
উল্লাহ জানান, দিনের বেলায় বিজিপি ও নাটালা বাহিনী, আবার রাতের বেলায়
সেনাবাহিনী অত্যাচার করে যাচ্ছে। তবুও মাতৃভূমিতে ফিরে যাওয়ার আশায়
শূন্যরেখায় অবস্থান করে যাচ্ছি। হুমকি-ধমকির কারণে আমরা শূন্যরেখা ছাড়ব না।
মরলে এখানে মরব। আর বাঁচলে এখানেই বাঁচব। আবুল শামা নামের এক রোহিঙ্গা
জানান, বর্মি বাহিনীর নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে ৬ মাস আগে এখানে এসেছি।
এখানে নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসা, শিক্ষা ও বাসস্থান। বর্ষার সময় কি যে হবে সে
চিন্তায় অস্থির। সেখানেও আবার মিয়ানমার বাহিনীর অত্যাচার আর গুলির ভয়। তিনি
এ ব্যাপারে বিশ্ববাসীর হস্তক্ষেপ কামনা করে বলেন, শত চেষ্টা করেও বর্মি
সেনারা রোহিঙ্গাদের শূন্যরেখা থেকে তাড়াতে পারবে না। সাবেকুন্নাহার নামে
আরেক নারী বলেন, পরিবার-পরিজন নিয়ে এখানে মানবেতর দিনযাপন করছি। মিয়ানমার
সেনাবাহিনীর গুলির ভয়ে শূন্যরেখা থেকে অনেকে পালিয়ে গেছে। আমি কিন্তু
শূন্যরেখা ছাড়িনি। মরব তবুও শূন্যরেখা ছাড়ব না। যেহেতু মিয়ানমারে বাপ-দাদার
ভিটেমাটি। আমরা বাঙালি না, আমরা রোহিঙ্গা। মিয়ানমারের নাগরিক। অবশ্যই
রাখাইনরা যে অধিকার নিয়ে মিয়ানমারে আছে, আমাদেরও একই অধিকার দিতে হবে। আমরা
আমাদের বাড়িঘরে ফিরে যেতে চাই। এ প্রসঙ্গে ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল
মনঞ্জুরুল হাসান খানের সঙ্গে মুঠোফোনে আলাপ করা হলে তিনি জানান, তুমব্রু
খালের ওপারে নো ম্যানস ল্যান্ডে প্রায় ৬ হাজার রোহিঙ্গা আছে। এরা যাতে
বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে না পারে সে ব্যাপারে বিজিবি সতর্ক রয়েছে।
মিয়ানমারের সেনা, বিজিপি ও নাটালা বাহিনীর টহলের ব্যাপারে তিনি বলেন, এটা
তাদের নিয়মিত কাজ। আর বাঙ্কার খনন তাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য করতে
পারে। তবে সীমান্ত পরিস্থিতি ভালো রয়েছে দাবি করে বিজিবি অধিনায়ক বলেন, এ
নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।
No comments