শেষ পর্যন্ত ইয়ামিনকে সমর্থন দেবে চীন?
মালদ্বীপের
প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিনের ক্ষমতা টেকাতে ও তাঁর পক্ষে সাফাই গাইতে
সমানে বিকৃত তথ্য ও ডাহা মিথ্যা কথা প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু ইয়ামিনের
হাজার চেষ্টাতে এই বিষয়টি আর ঢেকে রাখা যাচ্ছে না যে তিনি নিজের দেশে চীনের
আদলে স্বৈরতন্ত্র কায়েম করার তালে আছেন। চীনের অর্থনৈতিক শক্তিমত্তা এই
অঞ্চলে কতখানি খবরদারির সামর্থ্য রাখে এবং বিশ্ব সেই খবরদারিকে কীভাবে
নেবে, তার পরীক্ষার ক্ষেত্র হিসেবে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের জন্য
ইয়ামিনের শাসনাধীন মালদ্বীপই এখন আদর্শ জায়গা হয়ে দেখা দিয়েছে। এখন কথা
হচ্ছে, এই বিষয়টি ভারতকে কোথায় নিয়ে যাবে? এর সুনির্দিষ্ট কোনো জবাব নেই।
ভারতের পররাষ্ট্রনীতিও আপাতত এ নিয়ে স্পষ্ট অবস্থানে যাচ্ছে না। অন্যদিকে
চীন এ বিষয়ে খুবই সরব এবং সে ইয়ামিনের পক্ষে স্পষ্ট সমর্থন দিয়েছে। চীন
নিজে স্বৈরতান্ত্রিক হওয়ায় সে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে এমন কিছু
স্বেচ্ছাচারী শাসক দেখতে চায়, যাঁরা নিজেরা ক্ষমতায় থাকার জন্য চীনের
সহায়তা চাইবে এবং বিনিময়ে চীনের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে যাবে। চীন কিছু
সুযোগ-সুবিধা ও অর্থের বিনিময়ে তার সীমান্তসংলগ্ন বা অতি নিকটবর্তী দেশের
ভূখণ্ড দীর্ঘ মেয়াদে ইজারার নামে কিনে ফেলতে চায়। বাইরের একটি দেশ যখন
উন্নয়নের দায়দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে চায়, স্বাভাবিকভাবেই তখন ছোট ছোট
ভূখণ্ডের স্বেচ্ছাচারী শাসকদের সামনে অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকার সুযোগ বেড়ে
যায়। বৃহৎ শক্তিকে পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পাওয়ায় তাঁরা অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে।
প্রাচ্যের দিকে বৃহৎ শক্তির দৃষ্টিপাতের তথাকথিত নীতির এটিই মূল ভিত।
মালদ্বীপসহ দক্ষিণ এশিয়ার সরকারগুলোর নেতারা এই সব সুবিধার পসরা সাজিয়ে
তাদের আকর্ষণ করেন।
চীন যেভাবে দশকের পর দশক গণতন্ত্র অবদমন এবং মানবাধিকার
লঙ্ঘন করা নিয়ে আন্তর্জাতিক উদ্বেগকে রাখঢাক না করেই উড়িয়ে দিয়ে আসছে, ঠিক
একইভাবে বৃহৎ শক্তির ছত্রচ্ছায়ায় থাকা ছোট দেশগুলোর নেতারাও এমন ঔদ্ধত্য
দেখানোর সক্ষমতা পাচ্ছেন। মিয়ানমার থেকে শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ থেকে নেপাল
কিংবা মালদ্বীপ-এই দেশগুলোর যে সরকারই সাম্প্রতিক দশকগুলোতে চীনের সঙ্গে
ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছে, এর সঙ্গে সঙ্গে তারা দমনপ্রবণতার সঙ্গে গাঁটছড়া
বেঁধেছে। চীনের মদদপুষ্ট সেসব সরকার তাদের বিরোধীদের ওপর নির্যাতন
বাড়িয়েছে, আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন কমিয়েছে এবং বিচার বিভাগ,
মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন ও নির্বাচন কমিশনের মতো স্বাধীন
প্রতিষ্ঠানকে সমানে রাজনৈতিকীকরণ করেছে। মালদ্বীপে এর সবকিছুই আমরা দেখেছি।
সেখানে পাতানো নির্বাচন হয়েছে, সংবিধান ছিনতাই করা হয়েছে, ফ্লোর ক্রসিংয়ের
কারণে সেখানে নির্বাচিত এমপিরা সংসদ সদস্য পদ হারিয়েছেন, সরকারবিরোধী
সমাবেশের খবর প্রচার করার জন্য সাংবাদিকদের অপহরণ ও নির্যাতন করা হচ্ছে,
সরকারবিরোধী আইনজীবীদের মামলা পরিচালনা নিষিদ্ধ করা হচ্ছে এবং নির্বাচিত
এমপিরা বিক্ষোভ প্রদর্শনের সময় তাঁদের রাস্তার ওপর ফেলে পুলিশ নির্দয়ভাবে
পেটাচ্ছে। ২০১৩ সালে ক্ষমতায় বসার পর থেকেই উৎপীড়কের ভূমিকায় নামেন ইয়ামিন।
তাঁর প্রথম টার্গেট ছিলেন মালদিভিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রধান ও সাবেক
প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদ। এরপর তিনি তাঁর নিজ মিত্রদের মধ্য থেকে একজনের
পর একজনকে গ্রেপ্তার করলেন এবং ফালতু কিছু অভিযোগ এনে তাঁদের দীর্ঘ মেয়াদে
কারাগারে পাঠালেন। সবাই জানে ইয়ামিনের চাপে পড়ে সুপ্রিম কোর্ট এসব
রাজবন্দীর মুক্তি ঠেকিয়ে দিয়েছেন। গত ১ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট তাঁর
স্বাধীন সত্তার ঝলক দেখিয়ে রাজবন্দীদের মুক্তি দেওয়ার আদেশ দেন। এরপরই
ইয়ামিন প্রধান বিচারপতি, অপর এক বিচারপতি এবং নিজের সৎভাই সাবেক
প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল গাইয়ুমকে গ্রেপ্তার করেন। ৫ ফেব্রুয়ারি তিনি ১৫
দিনের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করেন এবং পরে পার্লামেন্ট এই অবস্থা আরও ৩০
দিনের জন্য বাড়ানোর প্রস্তাব অনুমোদন করে। এখানেও সাংবিধানিক লঙ্ঘন ছিল;
কারণ, এটি পাস করতে যতজন এমপির উপস্থিতি থাকা দরকার, ততজন পার্লামেন্টে
ছিলেন না। ভারত ইয়ামিনের এই জরুরি অবস্থা ঘোষণার কড়া সমালোচনা করেছে এবং
দ্রুত সেখানে স্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টির আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু
চীন ইয়ামিনের পক্ষ নিয়ে বলেছে, এগুলো মালদ্বীপের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার।
সেখানকার রাজনীতিকেরা আলোচনায় বসে এর সমাধান করবেন। শ্রীলঙ্কায় নির্বাসিত
অবস্থায় থাকা মোহাম্মাদ নাশিদ ভারতকে হস্তক্ষেপ করার আহ্বান জানানোর পর চীন
পাল্টা হুমকি দিয়েছে। তারা বলেছে, ভারত যদি মালদ্বীপে সামরিক হস্তক্ষেপ
করে, তাহলে ভারতকে থামাতে যা যা দরকার, তার সব করতে চীন প্রস্তুত। চীন এমন
সময় এসব কথা বলছে, যখন সে মালদ্বীপে নৌঘাঁটি গড়ার তৎপরতা চালাচ্ছে।
ইয়ামিনের প্রতি চীনের এই মৌন সমর্থন তাঁকে এটা ভাবতে প্রলুব্ধ করবে যে ‘বড়
ভাই’ যেহেতু তাঁর পাশে আছে, সেহেতু তিনি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে অবলীলায়
দমিয়ে রাখতে পারবেন। কিন্তু দমন-পীড়ন বেড়ে গেলে সেটি চীনের ‘নিরপেক্ষ
অবস্থান’ দাবির বিরুদ্ধে যাবে। বিদেশি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে চীন
সরাসরি হস্তক্ষেপ করবে না বলে প্রথম থেকে তারা দাবি করে এসেছে। এই অবস্থান
থেকে সরে না আসার বিষয়টি প্রমাণ করতে হলে ইয়ামিনকে চীন ক্ষমতা ছাড়তে বলতেও
পারে। আর সেটি হলে ভারত মালদ্বীপের বিষয়ে আগের চেয়ে বেশি মনোযোগী হতে
পারবে। ভারত চীনকে নিরপেক্ষ থাকার চুক্তি মেনে চলার বিষয়ে জোরালো বক্তব্য
দিতে পারবে। ফলে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ইয়ামিনকে চীন সমর্থন দিয়ে যাবে, সেটি
ভাবার কারণ নেই। আর চীন যদি ইয়ামিনের ব্যাপারে ঢিল ছোড়ে, তাহলে ভারত
পূর্ণমাত্রায় ইয়ামিনবিরোধী প্রচারণায় নেমে পড়বে। এতে ইয়ামিনের পক্ষে
দীর্ঘদিন দমন-পীড়ন চালানো কঠিন হবে। মনে রাখতে হবে, চীন ইয়ামিনের পাশে আছে,
এটা ঠিক। আপাতত তারা অবস্থান থেকে সরবে বলেও মনে হয় না। কিন্তু মালদ্বীপের
পরিস্থিতি এতটাই ঘোলাটে হয়ে উঠেছে যে সেখানে যেকোনো সময় দৃশ্যপট বদলাতে
পারে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
আব্বাস ফয়েজ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সাবেক জ্যেষ্ঠ গবেষক
ইংরেজি থেকে অনূদিত
আব্বাস ফয়েজ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সাবেক জ্যেষ্ঠ গবেষক
No comments