ভোটের হার সঙ্কটের কারণ by মাসুদ মজুমদার
জাতীয়
নির্বাচন কখন হবে, এখনো অনিশ্চিত। তবে জাতীয় রাজনীতিতে ভোটের আমেজ
লক্ষযোগ্য হয়ে উঠেও উঠল না। রাজনৈতিক সমঝোতার অভাব সব কিছুকে অনিশ্চিত করে
রেখেছে। সাধারণত জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে এলে রাজনীতিতে নতুন করে মেরুকরণের
তোড়জোড় শুরু হয়। এই সময়টিতে নীতিস্খলিত রাজনীতি ভোট-মাতালের মতো আচরণ করে।
রাজনৈতিক শত্রু বন্ধু হয়ে যায়। এই মেরুকরণের সময়টিতে নানা উপসর্গ দেখা দেয়।
কোনো কোনো উপসর্গ প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতিকে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে
দেয়।
আদর্শিক মেরুকরণ স্থায়ী হলেও ভোটের রাজনীতির মেরুকরণ স্থায়ী হয় না,
অনেক ক্ষেত্রে নতুন আপদ ডেকে আনে। যেমন, ভোটের গন্ধে রাজনীতিতে
সংখ্যাতত্ত্বের বিরোধ সঙ্কটাপন্ন গণতন্ত্রের জন্য নতুন বিপদ ডেকে এনেছে।
ক্ষমতাসীনদের মনে এখন আসল ভীতি সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে। সুষ্ঠুভাবে জাতীয়
নির্বাচন না হলে শুধু বৈধতার সঙ্কট নয়, সাংবিধানিক জটিলতা বেড়ে যাবে। চার
দিক থেকে ধেয়ে আসা বহুমাত্রিক সমস্যা আরো গ্রাস করতে থাকবে। সব কিছুর পরও
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সহাবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করে বসেছে সংখ্যাতত্ত্বই।
বিএনপি-জামায়াত জোটকে রাজনৈতিক মোকাবেলা না করে শক্তি প্রয়োগের নীতি
বাস্তবায়ন ও অসহ্য বিবেচনার কারণও তাই। জেল-জুলুম, হামলা-মামলা, গুম-অপহরণ ও
ধরপাকড় করা হয় ভাগ-বিভাজনের জন্য এবং প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করার বদ নিয়তে।
কল্যাণরাষ্ট্রের ধারণা লালন এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে দেশ পরিচালনার
প্রতিন্ধকতাও তৈরি হয় একই রোগের উপসর্গ থেকে। পড়শি ও বিদেশীদের অভ্যন্তরীণ
রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ, এরশাদকে অনুগত বিরোধী দলে বসানোর নাটকসহ অনেক
অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার কারণ সংখাতত্ত্বের ভীতি। ভোট অঙ্কের যোগ-বিয়োগের এই
খেলা সহজে বন্ধ হওয়ার নয়। কিছু দিন আগে জাসদ রাজনীতি নিয়ে তোলপাড় হয়েছে।
অবশেষে সব কিছু হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ মনে করে ছোট দলের বড়
নেতাদের প্রয়োজন আছে। আবার জাসদও জানে, নিজেদের একবার ক্ষমতায় তুলে এখন
মাটিতে বিচরণ করা কঠিন। তাই দুটো মন্দ কথা হজম করে হলেও ক্ষমতার কোলবালিশ
হওয়ার মধ্যেই লাভ বেশি। এখানেও সংখ্যাতত্ত্ব অঙ্ক মিলিয়ে দিয়েছে। পৃথিবীতে
কয়েকটি দেশে সংখ্যাতত্ত্বের ভীতির কারণে ডেমোগ্রাফি পাল্টে দেয়ার অভিযোগ
রয়েছে। যেমন কাশ্মির, জিনজিয়াং, পূর্ব তিমুর, সুদান, ফিলিস্তিনের পশ্চিম
তীর, ইন্দোনেশিয়ার কিছু দ্বীপাঞ্চলসহ আরো কিছু দেশে জনমিতি পাল্টে দেয়ার
অভিযোগ পুরনো। এসব স্থানে মুসলিম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমিয়ে দেখানোর জন্য
অমুসলিম বসতি বাড়ানো হয়। এর ফলাফল সবার জানা।
একসময় বাংলাদেশের পার্বত্য
জেলায় একই ধরনের অভিযোগ তুলেছিল পাহাড়িরা। চুক্তির পর সেই অভিযোগ কমেছে।
তারপরও পাহাড়ে বাঙালিরা পরবাসীর মতো জীবন যাপন করে একই অভিযোগ মাথায় নিয়ে।
ডেমোগ্রাফি পাল্টে দেয়ার কাতারে সর্বশেষ নাম তুলল ভারতের আসাম। তার আগে
মিয়ানমার তো ডাইরেক্ট অ্যাকশন চালিয়ে ১০ লাখ মানুষকে বাংলাদেশে ঠেলে দিলো।
সংখ্যাতত্ত্বের রাজনীতিটা সহজ সমীকরণের বিষয়। বিএনপির সাথে জামায়াতের
মেলবন্ধন হলে মোট ভোটের যে সংখ্যা দাঁড়ায়, সেটি আওয়ামী লীগের সাথে
বামপন্থীদের সম্মিলিত ভোটের চেয়ে বেশি। জাতীয় পার্টির ভোট যে দিকে ঝুঁকে
যায়, সে দিকের পাল্লা একটু ভারী হতে কোনো ‘কিন্তু’ থাকে না। ভোটব্যাংকের
অন্যান্য শক্তির ভোট ভাগ হয় কয়েক ভাগে। এক ভাগ যায় নেগেটিভ ভোট হিসেবে
বিএনপির পক্ষে। অন্য ভাগ মন্দের ভালো বাছাই করতে গিয়ে আধিপত্যবাদবিরোধী
হিসেবে চিহ্নিত বিএনপির ‘নম্র’ রাজনীতি ও ‘মৃদু’ ভারতবিরোধিতার জন্য ধানের
শীষের দিকে ঝুঁকে থাকে। আবার বিপরীত চিত্রও আছে। বিএনপি-জামায়াত ঠেকাতে
নৌকায় ওঠার মতো লোকও কম নেই। বাংলাদেশে অনেক ছোট দল আছে দু-একজন করে বড়
নেতার আমব্রেলার নিচে; কিন্তু তাদের দেশজুড়ে ভোট নেই। তেমন কোনো ভোটব্যাংকও
সৃষ্টি হয়নি। এ ধরনের নেতারা সংখ্যায় অনেক নয়- কিন্তু যে ক’জন আছেন, তারা
সরব এবং পরিচিত মুখ। এরা ক্ষমতার রাজনীতির কোলবালিশ হতে মোটেও দু’বার ভাবেন
না। তাই ভোটের রাজনীতির কারণে ভোট মওসুমে এদেরও বাজারমূল্য বেড়ে যায়।
গণবিচ্ছিন্ন কেউ কেউ পতাকাবাহী গাড়ি পেয়ে যান। সব ছোট দলের বড় নেতা
সম্পর্কে এমন ঢালাও মন্তব্য করা উচিত নয। জাতীয়পর্যায়ে ক’জন নেতা রয়েছেন
যাদের ভাবমর্যাদা ভালো। তবে তারা ভোটের রাজনীতির জন্য লাগসই হন না।
কিন্তু
জাতীয় রাজনীতিতে ভারসাম্য এনে দিতে তাদের অনেক বক্তব্য-বিবৃতি জনমত গঠনে
সহায়ক ভূমিকা রাখে। এ কাতারে দু’চারজন আছেন যাদের জাতির বিবেকের কণ্ঠস্বর
বলা সম্ভব। একটা কথা উল্লেখ না করলেই নয়; হেফাজতকে বামপন্থীরা প্রীতির নয়,
ভীতির চোখে দেখেন। কারণ এরা যা না ভোট ব্যাংক, তার চেয়ে ঢের বেশি প্রভাবক
সামাজিক শক্তি। ভোটের মাঠে তাদের উপস্থিতি গৌণ, কিন্তু তাদের অবস্থানটা এমন
যে, সেই অবস্থানের সুফল পায় বিএনপি জোট। ভোটের রাজনীতিতে মন্দের ভালো
বাছাই করার প্রবণতাটা সব সময় বেশি দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়। অনেক ভোটার বিএনপিকে
সক্ষম দল ভাবে না, কিন্তু আওয়ামী লীগকে পছন্দ করে না। নেগেটিভ ভোটটা দিয়ে
অপছন্দের দলকে ঠেকাতে চায়। ঠেকায়ও। ’১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে
ক্ষমতাসীন দল জবরদস্তিমূলক ও চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়ার কারণও সংখ্যাতত্ত্বের
এই যোগ-বিয়োগ। আদালতের রায়ে আরো দু’বার তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা অনুশীলনের
সুযোগ থাকার পরও আওয়ামী লীগ জনমতকে অগ্রাহ্য করে তড়িঘড়ি করে তত্ত্বাবধায়ক
ব্যবস্থা উপড়ে ফেলে। এটারও মূল কারণ- ভোটের সংখ্যাতত্ত্বের ভীতি। আওয়ামী
লীগ যখন জামায়াতকে নিয়ে কর্মসূচির সমঝোতার ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা
প্রবর্তনের দাবিতে ধনুকভাঙা পণ করে আন্দোলন করেছে, তখন তাদের মগজে
সংখ্যাতত্ত্বের ধারণা স্পষ্ট ছিল না। যখন এ সংখ্যাতত্ত্বের বিষয়টি মগজে
ঢুকেছে, তখন থেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতি ট্র্যাকের বাইরে চলতে শুরু করেছে।
তাই আওয়ামী লীগ এখন আনপ্রেডিক্টেবল দল। দলটির সব আচরণ ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার
লক্ষ্যে পরিচালিত হচ্ছে, যা অনেক শুভাকাক্সক্ষীও পছন্দ করছেন না।
সুবিধাভোগীদের কথা আলাদা। ধর্মনিরপেক্ষ ধারার কথা বললেও আওয়ামী লীগ বাস্তবে
কখনো ধর্মনিরপেক্ষ নীতির অনুসরণ করে না, কখনো ভোট ব্যাংকের লোভে
সংখ্যালঘুদের পিঠ চাপড়ায়, তোষামোদ করে। আবার সুযোগ মতো ইউ টার্ন করে বসে।
মৌলবাদের গন্ধে যে দলের অরুচি তারাই আবার শুধু ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে না;
কখন যে ধর্মব্যবসায়ও জড়িয়ে যায়, সেটা বুঝাও যায় না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
রহমানের ওপর যতটুকু লেখাপড়া করেছি, কাছে থেকে তার রাজনীতিকে অন্তত টানা সাত
বছর বুঝবার সুযোগ পেয়েছি। তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’
পড়ে তাকে যতটা চিনেছি, বঙ্গবন্ধুর ছাত্রজীবন থেকে জাতির স্থপতি হয়ে ওঠা
পর্যন্ত বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তাকে যারা দেখেছেন, তাকে নিয়ে লিখেছেন,
গবেষণা করেছেন- সব কিছুর সাথে গভীরভাবে একাত্ম হয়ে বুঝেছি; বঙ্গবন্ধু
পূর্বাপর একজন বাঙালি মুসলিম জননেতা। জাতীয় নেতা তো বটেই। তার শ্রেণী
চরিত্রে এবং বাস্তবে ধর্মনিরপেক্ষতার ঠাঁই ছিল না। বাম রাজনীতিতে তার কোনো
বাড়তি রুচি ও দুর্বলতা ছিল না। তবে বামপন্থীরা কয়েকবারই তাকে ব্যবহার
করেছেন; তার ওপর ভর করেছেন। এখনো সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে। এখন অবশ্য
বামপন্থী গুণধররা সিআইএর দালাল, ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তির ক্রীড়নক বলে না। সব
নিন্দাবাদের পরও সত্যটা হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর সাহস, আত্মপ্রত্যয় এবং মানসজুড়ে
এক প্রতিবাদী ও লড়াকু মানুষের অস্তিত্ব বিরাজ করছিল- সেখানে শাসক বঙ্গবন্ধু
হয়তো গৌণ, নেতা মুজিব অনেক বড়। এ ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার অবস্থান বোধগম্য
নয়। তার হাতে গড়া দলটিও রাজপথের রাজা, ক্ষমতার মসনদে ম্লান। বঙ্গবন্ধু ভোট
ব্যাংক করায়ত্ত করার জন্য যেসব কৌশল নিয়েছেন, তাতে তিনি সফল হয়েছেন। কিন্তু
বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব এ ব্যাপারে একেবারে অপরিপক্ব। কখনো ভোট
ব্যাংকের টানে হিন্দুত্ববাদে সমর্পিত হয়ে পড়েন, আবার ইসলামপ্রীতি দেখানোর
সময়ও হুঁশ থাকে না কদ্দুর যাওয়া উচিত। একই অবস্থা পররাষ্ট্রনীতির ভারসাম্য
রক্ষার ক্ষেত্রেও। দলটি প্রায়ই ভুলে যায় বিদেশে বন্ধু থাকা সম্ভব, প্রভু
থাকা সঙ্গত নয়।
এসব বেসামাল আচরণ করা হয় ভোটের রাজনীতিতে অস্তিত্ব রক্ষা
কিংবা বাড়তি ফায়দা তোলার জন্য। কারণ মগজ আচ্ছন্ন করে রাখে ক্ষমতা, তাই
ভোটের সংখ্যাতত্ত্ব সতত তাড়া করে বেড়ায়। প্রতিপক্ষকে অসহ্য বিবেচনা করেও
প্রধানমন্ত্রী নৌকায় ভোট চাইতে শুরু করেছেন। সরকারি খরচে ও সুবিধা ভোগ করে
ভোট চাওয়ার এই সুবিধা নেয়ার জন্যই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা উপড়ে ফেলা হয়েছে।
তাই রাজনীতির সব মেরুকরণ ভোটকে কেন্দ্র করে। এ জন্যই সংখ্যাতত্ত্ব আবারো
মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। ভবিষ্যতেও উঠবে। নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে
সংখ্যাতত্ত্বের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো আরো প্রবল হতে থাকবে। সেসব
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ডিঙিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ যতটা নিশ্চিত
হবে- গণতন্ত্রের অধরা সোনার হরিণ ধরা ততটাই নিশ্চিত হবে। ভোটের রাজনীতিতে
এবার নতুন একটি ধারা সৃষ্টি করবে- সেটা ইতোমধ্যে সৃষ্টি হয়ে আছে। গুম,
অপহরণ, বিচারবর্হিভূত হত্যা, রাজনৈতিক হয়রানি ও শোষণ-বঞ্চনার কারণে অনেক
মানুষ সংক্ষুব্ধ হয়ে আছে। জঙ্গিবাদ দমন ও মৌলবাদ ঠেকানোর নামে বাড়াবাড়ির
শিকার হওয়া মানুষ পরিবর্তনের প্রহর গুনছে। দমনপীড়নের শিকার মানুষ একটি
নেগেটিভ ভোট দেয়ার জন্য মুখিয়ে আছে। ভোটাধিকার হারা মানুষও এবার বুলেটের
জবাব ব্যালটে দিতে চাইবে। তাই সংখ্যাতত্ত্ব এবার গুণগত পরিবর্তনের আলামত
সৃষ্টি করতে পারে। জেল-জুলুম সেটা ঠেকিয়ে রাখতে পারবে বলে মনে হয় না।
masud2151@gmail.com
masud2151@gmail.com
No comments