ব্যবস্থাপনা দক্ষতার জাদুকাঠি by ড. গাজী মো: আহসানুল কবীর
মাথাভারী
প্রশাসন আর অব্যবস্থাপনা কোনো ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠান বা একটি
জাতির জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলতে পারে। হয়ে উঠতে পারে জাতীয় অগ্রগতির পথে
অন্তরায়। রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনা জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তৈরি করে এক
অসহনীয় দায়। এ প্রসঙ্গে জীবন সায়াহ্নে মনে পড়ে ৩৩ বছর আগের কথা। আমি তখন
সহকারী অধ্যাপক। ১৯৮৫ সালে পোস্টডক্টরেট ফেলোশিপ নিয়ে ভিজিটিং সায়েন্টিস্ট
হিসেবে গিয়েছিলাম টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে। টোকিও নেমেই পরদিন ভোরে Roppongi
campus এর কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে বিশ্বখ্যাত প্রফেসর তোশিয়ুকি উরিউ’র
ল্যাবে গেলাম।
প্রথম পরিচয়ে শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর আমার হাতে একটি বড় খাকি
রঙের মোটামুটি ভারী খাম তুলে দিয়ে বললেন, এতে তোমার পুরো বছরের ফেলোশিপ এবং
আসা-যাওয়ার বিমান ভাড়ার টাকা আছে, পুরো ক্যাশ। ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলে
টাকাটা রেখে দাও। ব্যাংক কর্মকর্তার কাছে গিয়ে বলতেই তিনি একটি ফরম দিলেন।
সর্ব সাকুল্যে ১৫টি তথ্য দিয়ে ছোট্ট এক পৃষ্ঠার ফরমটি পূরণ করে পাসপোর্টের
কপি ও ছবিসহ দিলাম। তিনি পাঁচ মিনিটে কাজ সেরে আমাকে একটি ATM কার্ড দিয়ে
বললেন, হয়ে গেল। অবাক হয়ে গেলাম। কারণ এভাবে one stop সিস্টেমে মাত্র ৫
মিনিটে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা আমার কাছে রীতিমতো অষ্টম আশ্চর্য। আমাদের
দেশে হলে অন্তত আধা কেজি ওজনের কাগজে মুদ্রিত বেশ কয়েকটি ফরম ২-৩ ঘণ্টা ধরে
পূরণ করে জমা দিলে চার-পাঁচ দিন ধরে non stop পদ্ধতিতে বহু টেবিল ঘুরে যদি
অ্যাকাউন্টটি খোলার সৌভাগ্য হয়। আরো বিস্ময়ের সাথে আরেকটি বিষয় লক্ষ করেছি
জাপানে অবস্থানকালে। সরকারি-বেসরকারি চাকরি-ব্যবসায় যে কাজই হোক না কেন,
বেতনভাতা/সম্মানী যা-ই বলি না কেন, যেকোনো payment দেয়ার সময়ই তার ইনকাম
ট্যাক্স কেটে রাখা হয় এবং যথারীতি সরকারি কোষাগারে তা জমা হয়ে যায়। কাউকে
আমাদের মতো ইনকাম ট্যাক্স রিটার্ন জমা দিতে হয় না। কিন্তু আমাদের দেশে এ
কাজটি বছরান্তে রীতিমতো একটি ‘খণ্ডযুদ্ধ’। কারণ লোকজন হয়রানির ভয়ে ট্যাক্স
বা রিটার্ন দিতে চায় না, আর সংশ্লিষ্ট বিভাগ জটিল প্রক্রিয়ায় তা নেবেই।
আজকাল অবশ্য পদ্ধতি সহজ করার কিছুটা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, যদিও এখনো তা ততটা
পর্যাপ্ত নয়। টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বছর গবেষণার কাজ করেছিলাম। সেখানে
আমার হোস্ট প্রফেসরের অধীনে বেশ কয়েকটি রিসার্চ ল্যাব রেটরি ছিল।
পোস্ট ডক,
পিএইচডি, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট, গ্র্যাজুয়েট, আন্ডার গ্র্যাজুয়েট স্তরের
বিভিন্ন দেশের প্রায় ২৫-৩০ জন গবেষক এসব ল্যাবে কাজ করতাম। এতগুলো ল্যাবের
বিশাল কর্মযজ্ঞের ব্যবস্থাপনায় প্রফেসরকে সাহায্য করতেন মাত্র একজন লোক-
মিসেস ইকেদা, প্রফেসরের পিএ। এ ছাড়া আর কোনো সহায়ক ল্যাবকর্মী ছিলেন না।
এমনকি আমি ভারতের আইআইটি খড়গপুর, আইআইএস-সি ব্যাঙ্গালোর, দিল্লি
বিশ্ববিদ্যালয় বা বোম্বের মেসার্স পলিঅলেফিনস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের
ল্যাবসহ বিদেশে যেখানেই কাজ করেছি, কোথাও গবেষক ছাড়া একজনও বাড়তি কোনো
সহায়ক ল্যাব কর্মী ছিলেন না। জিনিসপত্র ইস্যু করে স্টোর থেকে আনা, কাজকর্ম
করা, গ্লাস সামগ্রী ধোয়া-মোছা, এমনকি সকালে এসে ল্যাবের ফ্লোর ভ্যাকুয়াম
ক্লিনিং করাসহ সব কাজই প্রফেসর, গবেষক আর বিজ্ঞানীদেরই করতে হতো। অথচ
আমাদের দেশে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় যেখানেই পড়ালেখা করেছি বা যেখানেই
পরে চাকরি করেছি সর্বত্রই বহু বয়-বেয়ারা, পিয়ন, ল্যাব-সহকারী, কম্পাউন্ডার,
ডেমন্সট্রেটর থাকে শিক্ষক বা কর্মকর্তাদের কাজে সহায়তা করার জন্য। আর
অফিসে তো পিএস, এপিএস, পিএ, পিআরও, স্টেনো, পিয়ন, অর্ডারলি, টি-বয়, ক্লিনার
প্রভৃতি সহায়ক পদের/লোকের অন্ত নেই। মাথাভারী প্রশাসনের চূড়ান্ত। সর্বত্র
এই পদের diversification। একসময় দেখেছি, দেশের ১৭ জেলার প্রশাসন ১৭ জন
ডিসির হাতে খুব ভালোভাবেই চলত। এখন একই আয়তনের ভূখণ্ডই ৬৪ জেলায় ভাগ হয়ে
প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড চলছে। প্রশাসনের এরকম বিস্তৃতি তৃণমূলের সর্বত্র, সব
বিভাগেই। আগে একেকটি পুলিশ স্টেশনে অর্থাৎ থানায় একজন ওসি ছিলেন। এখন
সেখানে দু’জন-একজন ওসি (প্রশাসন) এবং অন্যজন ওসি (তদন্ত)।
একসময় পুরো দেশের
অবকাঠামো নির্মাণের দায়িত্ব ছিল C&B এর ওপর। সে কাজই এখন PWD, Roads
& Highways, সেতু বিভাগ, LGED, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর ইত্যাদি নানা
বাহারি নামের প্রতিষ্ঠানের তদারকিতে ভাগ হয়ে চলছে। অর্থাৎ মাথাভারী
প্রশাসনের ‘মাথার ভার’ শুধু বেড়েই চলেছে। জানি না এর শেষ কোথায়। মাথাভারী
প্রশাসনের মতো অব্যবস্থাপনাও আজ একটি প্রকট সমস্যা। এ সমস্যার কথা উঠলেই
সবার আগে উঠে আসে শিক্ষা এবং ব্যাংকিং খাতের নৈরাজ্যকর অবস্থার চিত্র। ঘুষ,
দুর্নীতি, প্রশাসনিক অদক্ষতা, পদায়নে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন, স্বজনপ্রীতি
প্রভৃতির খবর পত্রিকার পাতায় যেন লেগেই আছে। বিদ্যালয় পরিদর্শনে ডিআইএ’র
অর্থ লেনদেন, শিক্ষা ভবনে বদলি-পদায়নে অস্বচ্ছতা, দুর্নীতির দায়ে শিক্ষা
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা গ্রেফতার, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে আর্থিক অনিয়মের
খবর ইত্যাদির পরও বহালতবিয়তে কর্তাব্যক্তিদের দায়িত্বে বহাল থাকা,
কারমাইকেল কলেজে অধ্যক্ষের অপসারণ দাবিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ
আন্দোলনসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশৃঙ্খলা নিত্যকার ঘটনা হয়ে
দাঁড়িয়েছে। আর পরীক্ষার অব্যবস্থাপনা? সে তো সর্বকালের সব রেকর্ড ইতোমধ্যেই
ভেঙে ফেলেছে। ঊউঊঢঈঊখ/ইৎরঃরংয ঈড়ঁহপরষ কী চমৎকার ব্যবস্থাপনায় সাত সমুদ্র
তের নদীর ওপার থেকে ক্যামব্রিজ কর্তৃপক্ষের তৈরি করা প্রশ্নপত্র এনে
বিশ্বব্যাপী হাজার হাজার ও-লেভেল এবং এ-লেভেল পরীক্ষার্থীর বিশাল আয়োজনের
পরীক্ষা পরিচালনা করছে। কখনো তো তাদের প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিন্দুমাত্র
অভিযোগ শোনা যায়নি। অথচ আমাদের এদেশে পরীক্ষা হলেই প্রশ্নপত্র ফাঁস। এখানেই
ব্যবস্থাপনা কৌশলের পার্থক্য। শুধু প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনাই নয়। অন্যান্য
ক্ষেত্রেও বিভিন্ন ধরনের অব্যবস্থাপনা মানুষের কী ভোগান্তি ঘটাতে পারে, তা
কয়েকটি ঘটনা লক্ষ করলেই বোঝা যায়। ছোট্ট একটি উদাহরণ দিচ্ছি। ঢাকায় আমার
প্রিয় অষসধ সধঃবৎ এর আঙ্গিনায় সম্প্রতি গিয়েছিলাম একটি অনুষ্ঠানে। দুপুরে
জুমার নামাজ পড়তে মসজিদে যাওয়া-আসার পথে কয়েকটি বিভাগের সামনে ও চার পাশে
ময়লা-আবর্জনার যে ছড়াছড়ি দেখলাম তাতে অবাক না হয়ে পারিনি। কেন? বিভাগীয়
কর্তৃপক্ষের নজরে কি এসব পড়ে না বিল্ডিং এ ঢোকা ও বেরুনোর সময়? আর নজরে
পড়লে দু’জন লেবার দিয়ে সপ্তাহে অন্তত একবার পরিষ্কার করানো কি খুবই কষ্টকর?
আসলে এ সবই শুধু বেখেয়াল আর ব্যবস্থাপনার অভাব। এটি একটি-দু’টি ক্ষেত্রে
নয়, সর্বত্র। যাত্রাবাড়ী, জুরাইন, গোরান, মতিঝিল, কমলাপুর এমনকি ধানমন্ডির
সাতমসজিদ রোডের পুরোটাতে রাস্তায়-ফুটপাথে যে হারে ময়লা আবর্জনা জমে থাকে,
তা দেখে মনে হবে না যে, এ শহরে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ আছে। আরো ভয়ঙ্কর
হলো, মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড বা তাজমহল রোডের মতো বিভিন্ন স্থানে রাস্তার
ওপর যেভাবে রাস্তা দখল করে বাসের সারি দাঁড়িয়ে থাকে তা নাগরিক দুর্ভোগকে
কখনো কখনো চরমে পৌঁছে দেয়। মনে হয় যেন এ ব্যাপারগুলো দেখার বা ব্যবস্থা
নেয়ার কেউ নেই। এভাবে অব্যবস্থাপনা রন্ধ্রে রন্ধ্রে। একটু কষ্ট করে দেখে
আসুন না, বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউর শেষপ্রান্তে গুলশান লেক অথবা
গুলশান ১ নম্বর থেকে বাড্ডাগামী সংযোগ সড়কের দুই পাশে বারিধারা লেকের
অবস্থা। কী চমৎকার পরিকল্পনায় বিনোদন বা দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ সৃষ্টির প্রয়াস
শুধুই আমাদের অব্যবস্থাপনার কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে।এরকম
অব্যবস্থাপনার ভূরিভূরি নজির আমাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। আসলে
পরিকল্পনাহীনতা, অব্যবস্থাপনা আর বর্ধিত কলেবরের প্রশাসন শুধু জাতীয় অপচয়ই
বাড়িয়ে চলেছে। প্রয়োজন ছিমছাম প্রশাসন, গোছানো পরিকল্পনা আর সৎ ও সুদক্ষ
ব্যবস্থাপনা। এ বিষয়গুলো যে কী করতে পারে আর কী পারে না, তার জ্বলন্ত
প্রমাণ পৃথিবীর সাম্প্রতিক ইতিহাসে বহু। ইন্দোনেশিয়ার কষ্টার্জিত
স্বাধীনতার নন্দিত মহান স্থপতি ড. আহমেদ শোয়েকার্নো শুধু এ দোষেই শেষ
পর্যন্ত নিন্দিত হয়ে বিদায় নিয়েছেন এবং নীরবে অশ্রুহীন মৃত্যুও বরণ করেছেন।
পাশের দেশ মালয়েশিয়ায় স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান নেতা টেংকু আবদুর রহমানও
দীর্ঘ প্রধানমন্ত্রিত্ব কালে এসব কারণে ছিলেন অনেকটাই নিষ্প্রভ। অথচ তারই
উত্তরসূরি ড. মাহাথির মোহাম্মদ দুই যুগেরও কম সময়ে সেই মালয়েশিয়াকেই ভূতল
থেকে প্রায় গগনস্পর্শী উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন। এটি সম্ভব হয়েছে তার বিস্ময়কর
প্রতিভাদীপ্ত ব্যবস্থাপনা, একনিষ্ঠ প্রশাসনিক দক্ষতা আর বিরল সততার গুণে।
ব্যবস্থাপনা নৈপুণ্য এক জাদুকরী বৈশিষ্ট্য। এ ‘জাদুকাঠি’র ছোঁয়ায় প্রায়
অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলা যায়। তবে এ জন্য প্রয়োজন মেধা, ধারণার স্বচ্ছতা,
নিপুন পরিকল্পনা আর প্রয়োগশৈলীর বিরল সমন্বয়। সাথে অবশ্যই থাকতে হবে
আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা। সবার তা নেই। আর নেই বলেই সবাই এটা পারেন না। একেকজন
বিখ্যাত নেতা, স্বাধীনতা সংগ্রামের অকুতোভয় আপসহীন সংগ্রামী পুরুষ যারা
জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে বিশ্বকাঁপানো রেকর্ডের অধিকারী অথচ ব্যবস্থাপনার
দায়িত্বে গেলে দুঃখজনকভাবে তাদেরই ব্যর্থতার দায়ভারে অভিযুক্ত হতে দেখা
যায়। কারণ সবাই মাহাথির মোহাম্মদ হতে পারেন না। ক’জনইবা লি কুয়ান ইউর জন্ম
হয়েছে এ ধরার বুকে? দুনিয়া কাঁপানো এ কিংবদন্তিতুল্য ব্যক্তিত্বরা নিজ নিজ
দেশে দৃশ্যপট পাল্টে দিয়েছেন শুধু সফল ব্যবস্থাপনা ও পারদর্শিতায়। তাদের
দৃষ্টান্তগুলো সবার জন্যই অনুসরণীয়।
লেখক : প্রফেসর, রসায়ন ও সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড
লেখক : প্রফেসর, রসায়ন ও সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড
No comments