'সুপ্রভাত' মেসেজের জেরে নাজেহাল ভারতীয়রা
সকালবেলায়
প্রথম দেখা হলে শুভেচ্ছা জানানোর চল নতুন কিছু নয়। কেউ বলেন সুপ্রভাত,
কেউ শুভ সকাল, কেউবা গুড মর্নিং। সামাজিক মাধ্যম বা তারও পরে
হোয়াটসঅ্যাপের মতো মেসেজিং সার্ভিসের মাধ্যমে এই সুপ্রভাত বা গুড মর্নিং
মেসেজ পাঠানোর চল অবশ্য খুব বেশি দিনের নয় - বড়জোর বছর তিন চারেকের। সকাল
হলেই হোয়াটসঅ্যাপ বন্ধুদের কাছ থেকে চলে আসে একটা সুন্দর কোনো ছবি -
বেশিরভাগ সময়েই সূর্যোদয়ের, অথবা এক কাপ গরম চা বা একরাশ ফুলের ছবি -
সাথে লেখা নানা উদ্ধৃতি বা শুধুই 'গুড মর্নিং' বা 'সুপ্রভাত'। প্রথম প্রথম
ভালই লাগত আমার নিজেরও। উত্তরও দিতাম যথাসাধ্য, একজনের পাঠানো সুন্দর ছবিসহ
মেসেজ অন্যদের পাঠিয়ে দিয়ে জানাতাম শুভেচ্ছা। কিন্তু সেই শুভেচ্ছা
বিনিময়ই ইদানীং আমার মতোই অনেকের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে ভারতে।
"ভোরে ঘুম থেকে উঠে মোবাইলে ইন্টারনেট কানেকশানটা অন করতেই টুং টুং শুরু
হয়ে যায়। মুহূর্তের মধ্যেই হোয়াটস্অ্যাপে জমে যায় প্রচুর মেসেজ,"
বলছিলেন কলকাতার বাসিন্দা এক হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহারকারী। এত সুপ্রভাত বা গুড
মর্নিং মেসেজ পাঠাচ্ছেন ভারতীয়রা একে অন্যকে, যাতে মোবাইল ফোনের স্টোরেজ
উপচে পড়ছে আক্ষরিক অর্থেই। এক সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে যে প্রতি
তিনজন ভারতীয় অ্যান্ড্রয়েড ফোন ব্যবহারকারীর মোবাইলের স্টোরেজ শেষ হয়ে
যাচ্ছে প্রতিদিন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোবাইল ব্যবহারকারীদের ক্ষেত্রে
প্রতিদিন স্টোরেজ স্পেস ভরে যাওয়ার সংখ্যাটা প্রতি দশ জনে একজন। ভারতে যে
৬৫ কোটি মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন, তাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক - ৩০
কোটি মানুষের কাছেই রয়েছে স্মার্টফোন।
নতুন বছরের শুরুতে শুধু ভারতেই
প্রায় দুই হাজার কোটি 'নিউ ইয়ার' শুভেচ্ছা পাঠানো হয়েছিল হোয়াটসঅ্যাপের
মাধ্যমে - যা এক রেকর্ড। হোয়াটস্অ্যাপের মাধ্যমে নিয়মিত 'সুপ্রভাত'
মেসেজ পাঠান কলকাতার প্রবীণ সাংবাদিক নবেন্দু গুহ। তার কথায়, "কন্ট্যাক্ট
লিস্টে থাকা সবার সাথে তো নিয়মিত কথা হওয়ার সুযোগ হয় না। তাই সকালবেলায়
একটা মেসেজ পাঠাই। বছর দেড়েক ধরে এটা আমার নিয়মিত অভ্যেস হয়ে গেছে।"
"শুরু করেছিলাম ১০-১২ জনকে দিয়ে, এখন মোটামুটি ৬০ থেকে ৭০ জনকে সুপ্রভাত
মেসেজ পাঠাই। সকালবেলায় আধঘণ্টা থেকে ৪৫ মিনিট সময় দিয়ে বন্ধুদের সাথে
এইভাবেই যোগাযোগ রাখি। বন্ধনটা দৃঢ় হয়।" অনেকেই আবার 'সুপ্রভাত' মেসেজের
পরিবর্তে কোনো গানের ভিডিয়ো পাঠান - কেউ আবার আরো কিছুটা এগিয়ে
সুপ্রভাতের পরে দুপুরবেলায় 'গুড আফটারনুন' আর রাতে শোয়ার আগে 'গুড নাইট'
বা শুভরাত্রি বলেও মেসেজ পাঠাতে থাকেন। তবে সুপ্রভাত মেসেজেই সবথেকে বেশি
চলছে এখন। গুগল জানাচ্ছে, গত পাঁচ বছরে 'গুড মর্নিং মেসেজ' লিখে সার্চ করা
বেড়ে গেছে প্রায় দশ গুণ। কেউ যেমন গুগল সার্চ করে খুঁজে বের করেন নানা
নতুন ধরণের মেসেজ, তেমনই বেশিরভাগ মানুষই 'রি-সাইকেল' করেন। অর্থাৎ তিনি
যেসব 'সুপ্রভাত' মেসেজ পেয়েছেন কারো কাছ থেকে, সেগুলোকেই অন্যদের কাছে
ফরওয়ার্ড করে দেন। গত পাঁচ ছয় মাস ধরেই বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয়দের একই
রকমভাবে সুন্দর কোনো ছবি দিয়ে সুপ্রভাত মেসেজ পাঠান কলকাতার আরেক বাসিন্দা
দেবাশীষ রায়। কখনও তাতে থাকে রবীন্দ্রনাথের কোনো গানের লাইনও। "আমি
একবারেই সবাইকে একটাই মেসেজ পাঠাই। মিনিট দশেক হয়তো সময় লাগে, কিন্তু
সবার কাছে একটা সুন্দর ছবি বা দুটো সুন্দর কথা পৌঁছিয়ে দিয়ে ভাল লাগে।
তবে অর্ধেকই দেখি মেসেজগুলো খোলে না, তবে কিছু লোক উত্তরও দেয়," বলছিলেন
দেবাশীষ। কেউ বিরক্ত হয় প্রচুর সুপ্রভাত মেসেজ পেয়ে, কেউ সরাসরি বলেই
দেয় যে আর যেন তাকে এরকম মেসেজ না পাঠানো হয়। সস্তার অ্যান্ড্রয়েড ফোন
এবং আরও সস্তা মোবাইল ইন্টারনেট ডেটা প্যাকের ছড়াছড়ি ভারতে। তাই অনেকেই
হয়তো ভেবে দেখেন না যে তার সুপ্রভাত অন্য কারো শির:পীড়ার কারণ হচ্ছে কী
না। কলকাতার বাসিন্দা, এশিয়ান স্পোর্টস প্রেস ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্ট
এস সাবানায়কন বলছিলেন, "এই মেসেজগুলো যারা পাঠান, তাদের অনেকেই ভাবেন না
যে যার কাছে পাঠানো হচ্ছে, তার পছন্দ হচ্ছে কী না!" "যে ব্যক্তি সকালে
নিয়মিত সুপ্রভাত মেসেজ পাঠান, তার সাথেই দিনেরবেলা দেখা হলে কিন্তু তিনি
কোনোরকম শুভেচ্ছাই জানান না! আমার তাই রাগও হয় না, মজাও পাই না, শুধু
করুণা হয় যে কীভাবে এত বুদ্ধির অভাব হতে পারে কোনো মানুষের!" 'সুপ্রভাত'
এর জেরে জেরবার স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের জন্য গুগল অনেক ভাবনা চিন্তা করে
নিয়ে এসেছে একটি নতুন অ্যাপ - যা দিয়ে খুঁজে বার করা যাবে 'গুড মর্নিং'
মেসেজগুলো আর সহজেই সেগুলোকে ডিলিট করা যাবে। গুগলের দাবি, ওই অ্যাপের
মাধ্যমে এক জিবি পর্যন্ত স্টোরেজ স্পেস খালি করা সম্ভব।
No comments