ত্রিপুরার নির্বাচনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তাটি কী? by আলতাফ পারভেজ

এক. ভারতের জাতীয় কংগ্রেস সম্পর্কে পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় একটা ধারণা রয়েছে যে দলটির সাংগঠনিক নেতৃত্ব ও সমর্থক ভিত্তি সেক্যুলার ধাঁচের এবং বিজেপির হিন্দুত্ববাদের রাজনীতির বিপক্ষে এটাই ভারতবাসীর (এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ারও) ভরসা। ভারতের প্রগতিশীল সমাজের একাংশ বরাবরই এই ধারণার বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করে থাকেন। কিন্তু তাতে দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে কংগ্রেসের ওই ইমেজের ব্যত্যয় ঘটেনি। তবে সম্প্রতি ত্রিপুরার নির্বাচনী পরিসংখ্যান কংগ্রেসের ওই ঐতিহাসিক সেক্যুলার আবেদন ও ইমেজকে মোটাদাগে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে; যা দেশটিতে জাতীয়ভাবে কংগ্রেসের নেতৃত্বে বিজেপিকে প্রতিরোধের লক্ষ্যে জোট গঠনের মরিয়া চেষ্টাকেও বড় মুশকিলে ফেলেছে। ছোট্ট ত্রিপুরার নির্বাচনী ফলের তাৎক্ষণিক এবং বৃহৎ প্রতিক্রিয়া পড়েছে ভারতজুড়ে। তারই চুম্বক অংশটুকু এখানে তুলে ধরা হচ্ছে।
দুই. অনেকেই জানেন, ভারতে সাধারণভাবে পাঁচ বছর পরপর রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন হয়। ত্রিপুরায় ২০১৩ সালের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস ভোট পেয়েছিল প্রদত্ত ভোটের ৩৭ শতাংশ (আট লাখ চার হাজার)। ২০০৮ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস ভোট পায় প্রদত্ত ভোটের ৩৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ (৬ লাখ ৮৪ হাজার)। এই দুই নির্বাচনী ফল থেকে এটা স্পষ্ট, ত্রিপুরায় কংগ্রেসের মোটামুটিভাবে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ভোট ভিত্তি রয়েছে। কিন্তু কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য হলো এবারের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস পেয়েছে প্রদত্ত ভোটের ১ দশমিক ৮ শতাংশ মাত্র (৪১ হাজার ভোট)। স্বভাবত প্রশ্ন উঠেছে, হঠাৎ রাতারাতি এই রাজ্যে কংগ্রেসের ভোটব্যাংক কোথায় উধাও হলো। এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে আমাদের যেতে হবে বিজেপির ভোটের পরিসংখ্যানে।
তিন. যদিও ত্রিপুরায় ২০১৮-এর আগে হিন্দুত্ববাদী বিজেপির কোনো প্রার্থী কখনো জেতেনি কিন্তু বহুকাল ধরেই তারা সেখানে নির্বাচন করে যাচ্ছে। ২০০৮-এর বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি মনোনীত প্রার্থীরা পান প্রদত্ত ভোটের ১ দশমিক ৪৯ শতাংশ (২৮ হাজার ভোট)। ২০১৩ সালের নির্বাচনে একই দল পায় ১ দশমিক ৫ শতাংশ ভোট (৩৩ হাজার ৮০৮)। অর্থাৎ রাজ্যে দলটির ভোটব্যাংক এক লাখের নিচে ছিল বরাবর। কিন্তু ২০১৮ সালের সর্বশেষ নির্বাচনে তারা পেল প্রায় ৪৩ শতাংশ ভোট (১০ লাখ)! অর্থাৎ বিজেপির ভোট যখন ত্রিপুরায় এক লাখ থেকে দশ লাখে উঠছে (এর মধ্যে কিছু ভোট রয়েছে আদিবাসীদের), ঠিক তখনই কংগ্রেসের ভোট ৭-৮ লাখ থেকে ৪১ হাজারে নেমে আসছে। এই দুই দলের ভোটের এই অবিশ্বাস্য উত্থান-পতনের রহস্যটি অনুমান করা কঠিন নয়। তবে পাঠককে সেই অনুমানে সাহায্য করার জন্য আমরা পরিসংখ্যানের আরও নিবিড় চিত্র বিশ্লেষণে যাব। যাতে উল্লিখিত রহস্যটি একেবারেই রহস্যমুক্ত হয়ে যাবে।
চার. ত্রিপুরায় এবার যে ৫৯টি বিধানসভা আসনে ভোট হয়েছে, তার একটি হলো পশ্চিম ত্রিপুরা জেলার বামুতিয়া আসন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে এই আসনে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (মার্ক্সবাদী) বা সিপিএমের প্রার্থী ছিলেন হরিচরণ সরকার। তিনি ভোট পান ১৭ হাজার ৩২৪। আর তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেসের প্রকাশ চরণ দাস ভোট পান ১৪ হাজার ৯৪৪। সিপিএম প্রার্থী জেতেন ২ দুই হাজার ৪০০ ভোটে।একই আসনে ২০১৩ সালের ভোটে সিপিএম প্রার্থী ছিলেন যথারীতি হরিচরণ। আর কংগ্রেসেরও প্রার্থী ছিলেন যথারীতি প্রকাশ চরণ। এবারও হরিচরণ জিতেন। তিনি ভোট পান ১৯ হাজার ৭৪৪। আর কংগ্রেসের প্রকাশ চরণ পান ১৬ হাজার ৯৯৪। লক্ষণীয়, কংগ্রেসের যে নির্দিষ্ট দৃঢ় ভোটব্যাংক রয়েছে, তা স্পষ্ট। কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচনে দেখা যায়, সিপিএমের হরিচরণ দাসের ১৯ হাজার ৪২ ভোটের বিপরীতে কংগ্রেসের স্বপনানন্দ দাস পেয়েছেন মাত্র ৪০২ ভোট। কিন্তু বিজেপির কৃষ্ণচন্দ্র দাস পেয়েছেন ২০ হাজার ১৪ ভোট। অবিশ্বাস্য এক ব্যাপার। অর্থাৎ সিপিএমের ভোটব্যাংক এ আসনে অক্ষুণ্নই ছিল। কেবল কংগ্রেসের ভোটগুলো প্রায় পুরোটাই গিয়ে বিজেপির মার্কায় পড়েছে। বামুতিয়ার কেসস্টাডিটি আমরা দৈবচয়ন আকারেই নিয়েছিলাম এবং বামুতিয়ার এই চিত্র ত্রিপুরার কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না এবার। আগরতলার খয়েরপুর আসনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিচ্ছি। সেখানে এবার বিজেপির রতন চক্রবর্তী পেয়েছেন ২৫ হাজার ৪৯৬ ভোট (প্রদত্ত ভোটের ৫৭ শতাংশ)। কংগ্রেসের সুখময় সাহা পেয়েছেন ৪৮২ ভোট (প্রদত্ত ভোটের ১ শতাংশ!)। আর সিপিএম পেয়েছে ১৮ হাজার ৪৫৭ ভোট (প্রদত্ত ভোটের ৪১ শতাংশ)। এই একই আসনে গত নির্বাচনে কংগ্রেস ভোট পেয়েছিল ১৯ হাজার ৬৭৫ এবং বিজেপি পেয়েছিল ৬৯৮ ভোট। লক্ষণীয়, সিপিএমের ভোট প্রায় অপরিবর্তিতই আছে (২০,৯৭২)। কিন্তু কংগ্রেসের পুরো ভোট বিজেপির দিকে গেছে।
পাঁচ. ত্রিপুরার নির্বাচনী এসব পরিসংখ্যানের পুরোটাই নেওয়া হয়েছে ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের ডেটা ব্যাংক থেকে। এসব পরিসংখ্যান স্পষ্ট সাক্ষী দিচ্ছে, ত্রিপুরায় বিজেপির বিজয়ের মূল ভিত্তি গড়ে দিয়েছে কংগ্রেস। অথচ জাতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেস নিজেকে যেকোনো মূল্যে হিন্দুত্ববাদ ও মৌলবাদবিরোধী সংগ্রামের চ্যাম্পিয়ন শক্তি হিসেবে তুলে ধরতে বদ্ধপরিকর। আর কংগ্রেসের এই চেষ্টার পরিণতিতে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতিতেও তার রয়েছে ভিন্ন এক ভাবমূর্তি। কিন্তু ত্রিপুরার নির্বাচনী পরিসংখ্যান বলছে, ভারতের কংগ্রেস সমর্থকদের মৌলবাদ ও হিন্দুত্ববাদবিরোধী অঙ্গীকারের আদর্শিক ভিত্তি অত্যন্ত দুর্বল। পাশাপাশি উপরিউক্ত পরিসংখ্যান এ-ও বলছে, ভারতীয় প্রভাবশালী মিডিয়াগুলো যেভাবে প্রচার করছে যে কর্মসংস্থান সংকটের কারণে দলে দলে সিপিএম সমর্থক তরুণেরা বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন, তা-ও মূল সত্যকে আড়াল করছে মাত্র। সিপিএম এবারের এই ভূমিধসেও যে আসনগুলো রক্ষা করতে পেরেছে, সব কটি প্রান্তিক গরিব এলাকা নিয়ে গঠিত নির্বাচনী আসন। এ ছাড়া প্রদত্ত ভোটে সিপিএমের গড় হিস্যা মাত্র ৪ শতাংশ কমেছে এবং ওপরে বামুতিয়া এবং খয়েরপুরের যে কেসস্টাডি তুলে ধরা হয়েছে, তাতে সিপিএমের ভোট আগের তুলনায় প্রায় অপরিবর্তিত থাকতেই দেখা গেছে।
পুনশ্চ
ত্রিপুরায় কংগ্রেসের এই আত্মসমর্পণ বা রহস্যময় ভূমিকা ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেস-সিপিএম জোট গঠনের সম্ভাবনা এ কারণেও দুরূহ করে তুলবে। ত্রিপুরায় কংগ্রেসের এই আত্মসমর্পণ বা রহস্যময় ভূমিকা ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেস-সিপিএম জোট গঠনের সম্ভাবনা এ কারণেও দুরূহ করে তুলবে। এর কারণ ত্রিপুরার সিপিএম নেতা মানিক সরকার দলের কেন্দ্রীয় নেতা প্রকাশ কারাতের একটি মতের দৃঢ় সমর্থক। সেই মতটি হলো, বিজেপির মতোই কংগ্রেসকেও একইভাবে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে হবে। স্বভাবত কংগ্রেস সিপিএমকে যেভাবে হারিয়েছে, তা মানিক সরকার-প্রকাশ কারাত জোটকে ক্ষুব্ধ করেছে।
আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ের গবেষক

No comments

Powered by Blogger.