ছাত্রলীগের লাগাম কার হাতে? by বিশ্বজিৎ চৌধুরী
চট্টগ্রামের
বোয়ালখালী উপজেলায় প্রথম আলোর পাঠক সমাবেশে ছাত্রলীগের নেতৃস্থানীয় এক
তরুণ প্রশ্ন করেছিলেন, সংবাদপত্রে ছাত্রলীগ সম্পর্কে এত নেতিবাচক সংবাদ
প্রকাশ করা হয়, কিন্তু এই সংগঠনের ভালো কাজগুলো তুলে ধরা হয় না কেন? তাঁকে
পাল্টা প্রশ্ন করা হয়েছিল, তিনি নিজে সাম্প্রতিক কালে ছাত্রলীগের কোনো একটি
ভালো কাজের উদাহরণ দিতে পারবেন কি না। চৌকস তরুণটি তাৎক্ষণিক একটি
দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন: চট্টগ্রামের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অতিরিক্ত
ভর্তি ফি ও মাসিক বেতন আদায়ের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগ আন্দোলন করেছিল। এতে
প্রশাসন তৎপর হয়েছে, এসব স্কুল-কলেজের তালিকা তৈরি করে, কর্তৃপক্ষের সঙ্গে
আলাপ-আলোচনা করে বর্ধিত ফি আদায়ের ব্যবস্থা বন্ধ করতে পেরেছে। শিক্ষার্থী ও
অভিভাবকেরা উপকৃত হয়েছিলেন এই আন্দোলনে। সমাবেশে উপস্থিত সবাই স্বীকার
করেছিলেন, এটি ভালো একটি দৃষ্টান্ত। ছাত্রসংগঠনের কাছে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও
অভিভাবকেরা তো এ ধরনের উদ্যোগ ও তৎপরতাই প্রত্যাশা করেন। কিন্তু দলীয়
কোন্দল থেকে সতীর্থ-সহকর্মীকে খুন, নির্মাণকাজের টেন্ডারের বখরা নিয়ে
প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অফিসকক্ষ ভাঙচুর থেকে নিরীহ
নগরবাসীর যানবাহন বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ওপর হামলা-এহেন অসংখ্য ঘটনার নিচে
চাপা পড়া ছাত্রলীগের ইতিবাচক কর্মকাণ্ডকে তুলে আনা তো আতশ কাচের নিচে রাখা
ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুর অস্তিত্ব শনাক্ত করার শামিল। সুদীপ্ত বিশ্বাসের
বাবার আহাজারি আর দিয়াজ ইরফানের মায়ের শোক ও ক্ষোভের অভিব্যক্তি যখন
পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত হয়, তখন তো ‘ছাত্রলীগ’ নামটির সঙ্গে সন্ত্রাস,
ভীতি, আতঙ্ক, দৌরাত্ম্য, দাপট প্রভৃতি শব্দ একাকার হয়ে পড়ে। এর প্রতিকার বা
দায় মোচনের কোনো উদ্যোগ কি ছাত্রলীগের নীতিনির্ধারক মহল বা তাদের মুরব্বি
সংগঠন আওয়ামী লীগ নিয়েছে? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, আদৌ উচ্ছৃঙ্খল এই কর্মীদের
নিয়ন্ত্রণের ইচ্ছা বা সামর্থ্য কি তাদের আছে? নিয়ন্ত্রণের সামর্থ্য আছে কি
না-এই প্রশ্ন উঠছে সম্প্রতি চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের দুটি অনুষ্ঠানের চিত্র
দেখে। নগরের লালদীঘির মাঠে প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিন চৌধুরীর
স্মরণসভার আয়োজন করেছিল মহানগর ছাত্রলীগ। শোকে-শ্রদ্ধায় চট্টগ্রামের এই
জনপ্রিয় নেতাকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা স্মরণ করবেন, এটাই ছিল স্বাভাবিক।
কিন্তু দলে-উপদলে বিভক্ত ছাত্রলীগের কর্মীরা নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়িয়ে
শুধু অনুষ্ঠানের গাম্ভীর্যই নষ্ট করেননি, উপরন্তু মঞ্চে উপবিষ্ট নেতাদের শত
অনুরোধ-উপরোধ সত্ত্বেও বিভিন্ন নেতার নামে স্লোগান দিয়ে, চেয়ার ছোড়াছুড়ি
করে, হাতাহাতি-মারামারি করে নিজেদের ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেছেন। আদর্শ-উদ্দেশ্য
দূরে থাক, দলের প্রতি বিন্দুমাত্র আনুগত্য এই উচ্ছৃঙ্খল কর্মীদের মধ্যে
ছিল না। নেতৃত্বের চেইন অব কমান্ড নিয়েও তাঁদের ধারণা বা সমীহ আছে বলে মনে
হয় না। বরং এই অন্ধ অনুসারীদের কাছে উপদলের ‘বড় ভাই’ই সর্বেসর্বা। এ ঘটনার
মাত্র এক দিন পর নগরের ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে উত্তর জেলা
ছাত্রলীগের সম্মেলনের চিত্রটি ছিল আরও করুণ। আট বছর পর এই সম্মেলনে নতুন
কমিটি নির্বাচনের কথা ছিল। কিন্তু স্লোগান ও পাল্টা স্লোগান, চেয়ার
ছোড়াছুড়ি, এমনকি ককটেল বিস্ফোরণের পর পণ্ড হয়ে যায় সম্মেলন। মঞ্চে বসা
আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ নিতান্ত অসহায় অবস্থায়
প্রত্যক্ষ করেছেন কর্মীদের এই তাণ্ডব। একপর্যায়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম
সদস্য এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে
অনুনয়-বিনয় করেও শান্ত করতে পারেননি কর্মীদের। নেতাদের এই ‘অসহায়ত্ব’ দেখেই
প্রশ্ন জাগে, ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো সামর্থ্য আদৌ তাঁদের আছে কি
না। ছাত্রলীগের লাগাম তাহলে কার হাতে? লালদীঘির মাঠের সভামঞ্চ থেকে নগর
ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম বলেছেন, ‘যাঁরা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি
করছেন, তাঁরা ছাত্রলীগের কেউ নন। ভিডিও ফুটেজ দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে’
ইত্যাদি। একই কথার প্রতিধ্বনি শোনা গেল পরদিন মন্ত্রী মোশাররফ হোসেনের
বক্তব্যেও। তিনিও বললেন, ‘এরা ছাত্রলীগের কেউ না।’
পত্রিকান্তরে কেন্দ্রীয়
ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগের মুখেও এ রকম কথা শুনেছি বলে মনে
পড়ে। তাহলে এঁরা কারা? ভিডিও ফুটেজ দেখে এঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া
হবে...ইত্যাদি তর্জন-গর্জন অনেকবার শোনা গেছে নেতাদের মুখে। কিন্তু আদৌ কি
কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? দু-একটি ক্ষেত্রে বহিষ্কারের মতো সাংগঠনিক
ব্যবস্থা নেওয়া হলেও এর কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ দূর হয় না। কারণ,
বহিষ্কৃতরা কাগজে-কলমে বহিষ্কৃত হলেও দলের কর্মকাণ্ড থেকে অপাঙ্ক্তেয়
হয়েছেন, এমন নজির নেই। বরং তাঁদের দাপট আরও বেড়েছে, নেতাদের কাছে ‘কদর’ও
কমেনি তাঁদের। মোশাররফ হোসেনের মতো বর্ষীয়ান নেতা হাত জোড় করে অনুরোধ করার
পরও মাত্র দু-দশ গজ দূরে থাকা উচ্ছৃঙ্খল কর্মীদের নিবৃত্ত করতে পারলেন না-এ
ঘটনা বিস্ময়কর! যেকোনো মূল্যে নিজে বা নিজের পছন্দের প্রার্থীকে
ছাত্রলীগের কমিটিতে দেখতে চান এই অবাধ্য কর্মীরা। কমিটিতে থাকার সঙ্গে
‘বৈষয়িক’ লাভালাভের সম্পর্ক কতটা, তা এ ঘটনা থেকেই ধারণা করা যায়। আবার
অন্য দিক থেকে ভাবলে কর্মীরা যে নেতাদের নির্দেশ মানছেন না, তার পেছনেও আছে
তাঁদের প্রতি আস্থাহীনতার প্রকাশ। নেতারা প্রকৃত কর্মীদের কাজের মূল্যায়ন
করার চেয়ে নিজের পছন্দের মানুষকে কমিটিতে আনতে বদ্ধপরিকর। এভাবে পারস্পরিক
আস্থা-শ্রদ্ধার জায়গাটি নষ্ট হয়েছে। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে সহসভাপতি
আছেন ৬০ জন। এই অযৌক্তিক সংখ্যাই প্রমাণ করে, কর্মীদের খুশি করার কী
হাস্যকর পদ্ধতি বেছে নিয়েছে সংগঠনটি। দল যখন ক্ষমতায় থাকে, তখন তার
ছাত্রসংগঠনটির নানা অপকর্ম দল ও সরকারকে বিব্রত করে, যেকোনো সাফল্য ম্লান
করে দেয়। কিন্তু দলের দুর্দিনে ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা আদতে কী কাজে
লাগেন, তা বুঝতে বেশি দূর যাওয়ার প্রয়োজন নেই। বিএনপির ছাত্রসংগঠনের দিকে
তাকালেই তার প্রমাণ মিলবে। ক্ষমতায় থাকাকালে ‘অতি তৎপর’ ছাত্রদলের জন্য
নানাভাবে সমালোচিত হয়েছে বিএনপি। কিন্তু আজ দলের কর্মসূচিতে তাদের কোনো
কার্যকর ভূমিকা প্রায় দেখাই যায় না। ছাত্রলীগের ‘সুখের পায়রাদের’ও দুর্দিনে
দেখা মিলবে না, এ কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়। সারা দেশের মতো চট্টগ্রামেও
এখন বহুধাবিভক্ত ছাত্রলীগ। এই কোন্দল আরও প্রাণহানির শঙ্কা জাগিয়ে রাখছে।
ফেসবুকে পরস্পরকে হুমকি দিচ্ছেন নেতা-কর্মীরা। গত দুই বছরে অন্তঃকোন্দলে
প্রাণ হারিয়েছেন ছাত্রলীগের অন্তত পাঁচজন কর্মী। সুদীপ্ত বিশ্বাস বা দিয়াজ
ইরফানের মৃত্যুর আগেও ফেসবুকে এ রকম অশনিসংকেত পাওয়া যাচ্ছিল। অতীতের
অভিজ্ঞতা থেকে দলীয় হাইকমান্ড এ ব্যাপারে শিক্ষা নেবেন কি না, সেটাই এখন
দেখার বিষয়।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক
bishwabd@yahoo. com
বিশ্বজিৎ চৌধুরী প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক
bishwabd@yahoo. com
No comments