সময় গেলে সাধন হবে না by মুস্তাফা জামান আব্বাসী
সাধনের
দিকে এগোচ্ছে এমন লোক চোখে পড়ছে না। ধরা যাক, একজন গীদাল। তার সবচেয়ে বড়
সম্মান সে গান গাইতে পারে। কখনো দোতারা বাজিয়ে। সে হয়তো কৃষক, দোকানদার,
ফেরিওয়ালা, ঠেলাগাড়িওয়ালা, কিন্তু গীদালের সম্মানই আলাদা। একবার ঢাকার
পুরানা পল্টনের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি। সামনেই মণি সিং, সেই নামকরা
কমিউনিস্ট পার্টির নেতা। একজন আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন-ইনি আব্বাসউদ্দীনের
ছেলে। উনি জিজ্ঞেস করলেন, কোন আব্বাসউদ্দীন? যিনি গীদাল? তখন বুঝিনি, ওটাই
আব্বাসউদ্দীনের আসল পরিচয়। পরে তাঁকে লোকসংগীত সম্রাট, ভাওয়াইয়া সম্রাট বলে
লোকের মনে ভয় খাইয়ে দেওয়া হয়েছে। উনি তা কোনো দিন চাননি। জীবদ্দশায় কারও
কাছ থেকেই একটি ফুলের মালাও পাননি। অন্তত আমি দেখিনি। সৈয়দ শামসুল হক বললেন
[উনি তখন চিত্রালীতে রিপোর্টার], তোমার বাবাকে আমি লোকসংগীত সম্রাট হিসেবে
চিহ্নিত করেছি। এই চিহ্ন মুছে যাবে না। আমি শুধু বললাম, এটা তাঁর প্রতি
আপনার ভালোবাসা। আমি যখন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক হলাম, একটি
প্রতিষ্ঠান ‘সংগীত মহারত্নাকর’ টাইটেল দিতে চাইল। বললাম, সংগীতের কিছুই
শিখিনি। এটি দিয়ো না। সম্প্রতি উদ্যোগ এসেছে আমাকে আরেকটি টাইটেল দিতে।
বাধা দিলাম না। বললাম, এটি কালোত্তীর্ণ হবে না। আমি গীদাল, গীদালই থাকব।
গীদাল থাকবেন তাঁর দোতারা নিয়ে। আমার তিনটি দোতারা। একটি ভাটিয়ালির, একটি
ভাওয়াইয়ার, আরেকটি সাধার জন্য। মন খারাপ থাকলে আমি দোতারা বাজাই।
সাধনার
দিকে কেউ নেই। অথচ জি বাংলার নতুন গায়ক-গায়িকাদের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়াবিষ্ট
আমি। কারণ, ওদের দিন-রাত রিহার্সাল দিয়ে সত্যিকারের শিল্পী বানানো হচ্ছে।
আমাদের টিভির প্রয়োজন: ফিনিশড প্রোডাক্ট। তা তারা কোনো দিনই পাবে না, যদি
সাধনার ব্যবস্থা না করে। একাডেমিগুলো চলছে না। টাকাপয়সা নেই। শিক্ষকদের
বেতন নেই। আমার বোন একটি একাডেমি চালান। জায়গা নেই। কেউ ভাড়া দিতে চায় না।
এটিই হলো সংগীত সাধনার অন্তরায়। আমরা চলে গেলে খুবই ভালো হবে। তখন আর
আমাদের কথা শুনতে হবে না। উচ্চাঙ্গসংগীতের চর্চা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে।
আমার নতুন বইটি উৎসর্গ করলাম এমন একজনকে, যিনি বাংলাদেশের সংগীতচর্চায় নতুন
দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। উনি নিজে গান করেন না, কিন্তু গানের সমঝদার। তাই
বছরের পর বছর উচ্চাঙ্গসংগীত সম্মেলনের ব্যবস্থা করেছেন আবুল খায়ের। সাধনা
হবে ঘরে। মা-বাবা উৎসাহ দেবেন। লেগে থাকবেন। তা না হলে সাধনা হবে না।
সাধনার একটা পর্যায় দেখে এলাম শান্তিনিকেতনে। বড় বড় বিল্ডিংয়ের প্রয়োজন হবে
না। গাছতলা হলেই হবে। প্রয়োজন রবীন্দ্রনাথের, প্রয়োজন শিক্ষকের, প্রয়োজন
এমন মানুষের, যাঁরা সাধনার অর্থ জানেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যার সনদ পেলেই
চাকরি হবে না। চাকরি হলেই পদোন্নতি হবে না। জীবনের সর্বক্ষেত্রে সাধনাকে
এড়িয়ে আমাদের চর্চা। তাই পদে পদে ঠকে যাচ্ছি। রেলগাড়ি সময়মতো চলে না। প্লেন
সব সময় লেট। রাস্তায় সব সময় গাড়ি ভর্তি। এমনকি আমার বাড়ির সামনে যে গলি,
সেখানেও গাড়ি নিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। এ কেমন পরিকল্পনা বিভাগ? কারা
পরিকল্পনাকারী? পরিসংখ্যান কত ভুল, কে হিসাব রাখবে? তাহলে দেখা যাচ্ছে,
শিক্ষার মূল হলো সাধনা। সবচেয়ে বড় দরকার স্কুলের শিক্ষা, বাড়ির শিক্ষা।
সেগুলো ঠিকমতো হচ্ছে কি? তা না হলে সব গোলমাল হয়ে যাবে। খবরের কাগজে আমরা
লিখেই চলেছি। কিন্তু সেগুলো পড়বে কে? পড়ে মানবে কে? এই মানার ওপরই তো চলছে
দুনিয়া। যারা মানবে না, তারা কি ওপরে উঠতে পারবে? পারবে না। শৃঙ্খলা সবচেয়ে
বড়। এটা মানতেই হবে। আমি যে স্কুলে পড়তাম, সেখানে আমেরিকান পাদরিরা
পড়াতেন। বলতেন, এক মিনিট দেরি করে এলে ক্লাসে ঢুকতে পারবে না। সারা দিন
বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। তিন দিন এ রকম হলে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হবে।
একটি ইংরেজি বাক্য মুখস্থ করানো হলো, সেটি এখনো মনে আছে, সেটি হলো:
Punctuality is the politeness of kings. অর্থাৎ সময়ানুবর্তিতা হচ্ছে
রাজাদের নম্রতা। আমরা সবাই রাজা। তাই দেরি করে অফিসে আসি। কেউ সময়মতো আসি
না। যখন কোনো কাজে কোনো অফিসে যাই, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয়। কোনো কাজ
সময়মতো হয় না। এক ঘণ্টার কাজ এক মাসেও হয় না। সময়ের প্রতি আমাদের এতটুকু
আকর্ষণ নেই। চীন দেশে গিয়েছিলাম। তারা ধর্মের ধার ধারে না। কিন্তু বলে একটি
কথা, যা কোনো দিন ভুলিনি। বলে: সময়ই ধর্ম। যে সময় চেনে না, তার জীবনে
কিছুই হবে না।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব
No comments