আন্তর্জাতিক নারী দিবস
৮
মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। দিবসটির প্রাক্কালে ৭ মার্চ প্রথম আলোয়
বাল্যবিবাহ ও গণপরিবহনে নারী নিগ্রহ নিয়ে যে দুটি খবর প্রকাশিত হয়েছে, তা
খুবই উদ্বেগজনক। সারা পৃথিবীতে যখন বাল্যবিবাহের হার কমেছে, তখন বাংলাদেশে
বেড়েছে। ইউনিসেফের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার ৫৯
শতাংশ। সারা বিশ্বে আমাদের অবস্থান চতুর্থ আর সংখ্যার দিক দিয়ে ভারতের পরই
দ্বিতীয়। সরকারের পক্ষ থেকে ইউনেসকোর হিসাবকে অতিরঞ্জিত বলে দাবি করা
হয়েছে। তাদের দাবি, বাল্যবিবাহের হার ৫২ শতাংশের বেশি হবে না। হারের
কম-বেশির চেয়েও এখানে যে বিষয়টি আমাদের বিচলিত করে, তা হলো বিয়ের বয়স নিয়ে
সরকারের লুকোচুরি। এমনকি বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনে বয়সের সীমারেখা বিশেষ বিশেষ
ক্ষেত্রে শিথিল করা হয়েছে। আমরা শুরু থেকেই এর বিরোধিতা করে আসছি এবং এখনো
করছি। কোনো অবস্থায় বিয়ের বয়স আঠারোর নিচে হতে পারবে না। দ্বিতীয় খবরটি
হলো গণপরিবহনে ৯৪ শতাংশ নারীই যৌন নিপীড়নের শিকার। সামাজিক কারণে অনেকে
আইনের আশ্রয় নিতেও সাহস পায় না। এর আগে খবর বের হয়েছিল, ৮৭ শতাংশ নারী ঘরে
নিগ্রহের শিকার হয়ে থাকে। নিকটজন পুরুষের দ্বারাই তারা নিগৃহীত হয়ে থাকে।
এই যখন বাস্তবতা, তখন আমরা দাবি করতে পারি না যে সমাজে নারীর নিরাপত্তা
আছে, তারা সমানাধিকার ভোগ করছে। সমাজে নারীরা প্রায় সব ক্ষেত্রে বৈষম্যের
শিকার। সংবিধান নারী-পুরুষের সমানাধিকার স্বীকার করলেও পারিবারিক ও
উত্তরাধিকার আইন সেই সুযোগ অনেকটাই রহিত করে দিয়েছে। বর্তমান সরকার নারী
উন্নয়ননীতি ঘোষণা করলেও তা বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নেই। বরং যে ধর্মান্ধ
গোষ্ঠী নারী উন্নয়ন নীতিমালার বিরোধিতা করেছিল, ইদানীং তাদের সঙ্গে সরকারের
সখ্য লক্ষ করা যাচ্ছে।
সরকারের এই পশ্চাৎপদ অবস্থান বাংলাদেশে নারীদের আশা
জাগায় না, শঙ্কিত করে। অস্বীকার করা যাবে না যে গত ৪৭ বছরে বাংলাদেশে
শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও আর্থসামাজিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। অনেক
গুরুত্বপূর্ণ পদেও তারা অধিষ্ঠিত। স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোতে নারী
প্রতিনিধিত্ব বেড়েছে। কিন্তু আমরা যদি ঘরে-বাইরে তাদের নিরাপত্তাই দিতে না
পারি, তাহলে এই সংখ্যা বৃদ্ধি কিংবা রাজনীতির শীর্ষ পদে নারীর অবস্থান
দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে, আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দৃশ্যমান পরিবর্তন
আনবে না। প্রতিবছরই আন্তর্জাতিক নারী দিবসের একটি প্রতিপাদ্য থাকে। চলতি
বছরের প্রতিপাদ্য হলো, ‘প্রগতিকে দাও গতি’। অন্যদিকে জাতিসংঘের আন্ডার
সেক্রেটারি জেনারেল ফুমজিলে ম্লামবো এনগুকা তাঁর বিবৃতিতে বলেন, ‘টাইম ইজ
নাউ: রুরাল অ্যান্ড আরবান অ্যাকটিভিস্টস ট্রান্সফর্মিং উইমেনস লাইভস’।
অর্থাৎ নারীর জীবন বদলে দিতে গ্রাম ও শহরের স্বেচ্ছাসেবীদের এগিয়ে আসার
এখনই সময়। এসব স্লোগান কেবল মুখে আওড়ালে হবে না, হৃদয় ও মননে ধারণ করতে
হবে। নারীর উন্নয়ন ও অগ্রগতি নিশ্চিত করতে হলে নারীর প্রতি পুরুষের
দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। সেই সঙ্গে সব ধরনের অন্ধত্ব, অনাচার ও কূপমণ্ডূকতা
থেকে সমাজকে মুক্ত করার জন্য চাই সাংস্কৃতিক জাগরণ। নিরন্তর অনুশীলনের
মধ্য দিয়ে সমাজকে এমন স্তরে নিয়ে যেতে হবে, যেখানে নারী-পুরুষের কোনো
বৈষম্য থাকবে না। নারী নিজেকে অসহায় বা দুর্বল ভাববে না। সবশেষে
রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে চাই, নারীকে আপন ভাগ্য গড়ে তোলার সুযোগ দিতে
হবে। কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর/
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ সেই অর্ধেক নারীকে পেছনে ফেলে
কোনো সমাজ বা দেশ এগোতে পারে না। আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে বাংলাদেশসহ
পৃথিবীর সব নারীর প্রতি আমাদের অভিবাদন।
No comments