রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ নিয়ে গভীর উদ্বেগ
রাষ্ট্রায়ত্ত
ব্যাংকগুলোর বিপুল অঙ্কের খেলাপি ঋণ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। অধিক পরিমাণে খেলাপির কারণে লোকসান
কাটিয়ে উঠতে পারছে না সরকারি খাতের কয়েকটি ব্যাংক। মূলত সুশাসন এবং
জবাবদিহিতার অভাবেই ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বাড়ছে বলে মনে করছে সংস্থাটি। ২৮
ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের সঙ্গে আইএমএফের এক রুদ্ধদ্বার বৈঠক
অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের এমডিরা নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হন।
এছাড়া ব্যাংকিং খাতসহ সার্বিক অর্থনীতি নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ
ব্যাংকের সঙ্গেও দফায় দফায় বৈঠক করেছে সফররত আইএমএফ প্রতিনিধি দল। এসব
বৈঠকে উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি এ থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা
পরিচালক (এমডি) যুগান্তরকে বলেন, খেলাপি ঋণ, অবলোপন, লোকসানি শাখা, বারবার
ঋণ পুনঃতফসিল, ঋণ পুনর্গঠন, পুনর্গঠিত ঋণ আবার খেলাপি, খেলাপি ঋণ আদায়ে
অর্থঋণ আদালতে মামলা, প্রভিশন ও মূলধন ঘাটতি নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করেছে
আইএমএফ। আমরা জবাব দেয়ার চেষ্টা করেছি। তিনি বলেন, শুধু আমাদের দোষ দিয়ে
লাভ নেই। সংশ্লিষ্ট সবাইকে দায় নিতে হবে। তিনি প্রশ্ন করেন, দাগি খেলাপিরা
কিভাবে সিআইবি (ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো) পার হয়? এটি দেখার দায়িত্ব কার?
বড় বড় খেলাপিরা সিআইবি থেকে নাম মুছে দিচ্ছে। সে কারণে এক ব্যাংকের বড়
খেলাপি অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে। যদিও নিয়মানুযায়ী খেলাপি থাকা অবস্থায়
কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু সিআইবিতে খেলাপি
না হলে তাকে ঋণ নেয়া থেকে আটকানো যায় না। এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার
অনুরোধ করেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের
সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করেছে ১ লাখ ৩১ হাজার
৬৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ৩৮ হাজার ৫১৭ কোটি টাকা- যা মোট
বিতরণকৃত ঋণের ২৯ দশমিক ২৫ শতাংশ। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর
শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত মাত্র তিনটি ব্যাংকের প্রভিশন (বিপুল পরিমাণ খেলাপির
বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি) ঘাটতি ৭ হাজার ৫৬৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে বেসিক
ব্যাংকের ৩ হাজার ৪২২ কোটি, সোনালী ব্যাংকের ২ হাজার ৯০১ কোটি এবং রূপালী
ব্যাংকের ১ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে। জানা গেছে, আর্থিক
খাতে সুশাসনের অভাবসহ খেলাপি ঋণ ও মূলধন ঘাটতির বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে ২৫
ফেব্রুয়ারি থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক শুরু
করেছে আইএমএফ। এছাড়া বাংলাদেশের অর্থনীতির সর্বশেষ অবস্থাসহ আর্থিক খাতের
সংস্কার কর্মসূচির অগ্রগতি জানতে অর্থ মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড
(এনবিআর), সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দফতরের উচ্চপদস্থ
কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে আইএমএফ প্রতিনিধি দল। এসব বিষয় নিয়ে আজ সংবাদ
সম্মেলন করবে সংস্থাটি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আইএমএফের এক শীর্ষ
কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, চলমান বৈঠকে আইএমএফ প্রতিনিধি দল বাংলাদেশের
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ
করেছে। মূলত সরকারি ব্যাংকে সুশাসনের ঘাটতির কারণে এমনটি হচ্ছে। তিনি বলেন,
দীর্ঘদিন খেলাপি ঋণ আদায় করতে না পেরে করা হচ্ছে অবলোপন। খেলাপির বিপরীতে
নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। এতে প্রভিশন খেয়ে ফেলছে
লাভের অংশ। সে কারণে সরকারি বেশ কিছু ব্যাংক লোকসানের ঘানি টেনে যাচ্ছে
দীর্ঘদিন। এছাড়া মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে কয়েকটি সরকারি ব্যাংক। এসব সমস্যার
সর্বশেষ অবস্থা জানতে চেয়েছে আইএমএফ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এসব বিষয়
ছাড়াও ব্যাংক কোম্পানি আইন পরিবর্তনের বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে। যেখানে
বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে একই পরিবারের চারজন সদস্য এবং টানা ৯ বছর
পরিচালক থাকার বিধান রাখা হয়েছে। ঋণ ও আমানতের সুদহার, আমানত সংগ্রহে
সঞ্চয়পত্রের চেয়েও বেশি সুদ দেয়া হচ্ছে কিনা, ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট,
আর্থিক খাতের সংস্কার, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে এ
সফরের আগেই সংস্থাটির পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্টদের কাছে বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট
প্রশ্ন পাঠানো হয়েছিল। আইএমএফের অপর একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন,
বাংলাদেশের পুরো ব্যাংকিং খাতের সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাওয়া হয়েছে। বিশেষ
করে ব্যাপক তারল্য সংকট বিরাজমান এমন ব্যাংকের আমানতকারীদের কী হবে সে
বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়। এদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ওপর একটি মূল্যায়ন
প্রতিবেদন তৈরি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে বিভিন্ন ব্যাংকের নাজুক
পরিস্থিতি উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে সরকারি ব্যাংকগুলোর বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ
শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- ব্যাংকে ব্যাসেল-৩ এর শর্তানুসারে
ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণ, সম্পদের গুণগত মান ও খেলাপি ঋণ কমানো, বিপুল পরিমাণ
খেলাপি ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন সংরক্ষণ করা, বড় ঋণ
গ্রহীতাদের প্রতি নজরদারি বাড়ানো, কোর রিস্ক ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইন অনুসরণ
এবং ফোর্সড লোন কমানো। এসব চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে ওঠার পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ
ব্যাংক।
No comments