অন্ধকারে আলোর রেখা by তুহিন ওয়াদুদ

মুক্তির আনন্দ ছিটমহলের ঘরে ঘরে, উল্লাস
দীর্ঘ ৬৮ বছর ধরে ছিটমহলের বাসিন্দারা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছে, তাদের পার্শ্ববর্তী দেশের মানুষ অসুস্থ হলে সরকারি চিকিৎসা নিয়েছে, বন্যা-খরায় সম্পদ নষ্ট হলে সরকারি কিংবা বেসরকারি সংস্থা পাশে দাঁড়িয়েছে। ছিটমহলের বাইরের শিশুরা স্কুলে যেতে পারে, ছিটমহলের মানুষ নিজেদের সন্তানকে স্কুলে দিতে হলে তার জন্য মিথ্যা ঠিকানা ব্যবহার করতে হয়েছে। ছিটমহলের ভেতরে বিদ্যুৎ নেই, সড়ক নেই। নিজ দেশের মুদ্রার প্রচলন নেই। ছিটমহল থেকে বাইরে বেরোলেই ছিটমহলবাসী দেখে, পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের নাগরিকের জন্য পাকা রাস্তা, বিদ্যুৎ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল—সবই আছে। তারা বিপদে পড়লে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতাও আছে। ছিটমহলের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে অসহায়ের মতো শুধু চেয়ে চেয়ে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের মানুষের আনন্দময় জীবন দেখেছে আর নিজেদের কষ্টের রংকে আরও গাঢ় করে তুলেছে।
গত ১৬ জুন আবারও গিয়েছিলাম কুড়িগ্রামের দাসিয়ারছড়া ছিটমহলে। সেখানে কালির হাটের একটি চায়ের দোকানে বসে কথা হচ্ছিল ফুলবাড়ী সদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির বাংলাদেশ অংশের সভাপতি মইনুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফাসহ অনেকের সঙ্গে। চিকিৎসাসেবাবঞ্চিত জীবনের কথা বলতে গিয়ে ছিটমহলবাসী মুনির হোসেনের চোখ ছলছল করে উঠল। তিনি জানালেন, তাঁর স্ত্রীকে ফুলবাড়ী হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়নি ছিটমহলের মানুষ হওয়ায়। লালমনিরহাট হাসপাতালে নেওয়ার পথেই তিনি মারা যান।
মিথ্যাচার, নিজ দেশে পরবাসী জীবন, অভিভাবকহীনতা—সবকিছুর অবসান ঘটতে যাচ্ছে ছিটমহলবাসীর। আগামী ৩১ জুলাই মধ্যরাত থেকে কার্যকর হবে ছিটমহল বিনিময়। সে কারণে ছিটমহলগুলোয় আনন্দের বন্যা বইছে। চারদিকে স্বস্তির সুবাতাস। বাংলাদেশ সরকার এরই মধ্যে ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে তাদের জন্য। সরকারের এই উদ্যোগে তারা উল্লসিত। দাসিয়ারছড়ার নীলকমল নদের পাশে দাঁড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধা জেবের আলী বলছিলেন, ‘আমি ছিলাম শেখ মুজিবের সৈনিক। একাত্তরে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করছি, কিন্তু তখন স্বাধীনতা পাই নাই। এখন হামার মুক্তি হলো।’ ৩১ জুলাইয়ের পর তাঁরা যখন বাংলাদেশি হবেন, তখন যেন তাঁরা যোগ্যতা অনুসারে চাকরি পান, সেই দাবি তাঁদের। এ প্রসঙ্গে মোজাফফর নামের একজন বললেন, ‘যোগ্যতা অনুযায়ী আমাদের জন্য সরকারের কাছে বিশেষ কোটায় চাকরির জন্য আবেদন জানাচ্ছি।’
ছিটমহলে সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দেবে ভূমি ব্যবস্থাপনা। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের মোট ১১১টি ছিটমহলের মধ্যে ৪২টিতে কোনো মানুষ বাস করে না। আবার অনেক জমি বিক্রি হয়েছে মৌখিক কিংবা সাদা কাগজে লিখে। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা জরুরি।
দীর্ঘ ৬৮ বছর ছিটমহলবাসী যে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট ভোগ করেছে, এর দায় ছিটমহলের মালিকরাষ্ট্রের। উভয় রাষ্ট্র ছিটমহলের মানুষের প্রতি রাষ্ট্রীয় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছিল। বাংলাদেশের অভ্যন্তরের ১১১টি ভারতীয় ছিটমহলের মোট জমির পরিমাণ ১৭ হাজার ১৫৮ একর। তার মধ্যে শুধু দাসিয়ারছড়ার আয়তন প্রায় দুই হাজার একর। এ দুই হাজার একর ছিটমহলের ভেতরে ১০৭ একর জমির একটি বাংলাদেশি ছিটমহল ‘ছিটচন্দ্রখানা’। বাংলাদেশ-ভারত ১৬২টি ছিটমহলের বাইরে এই ছিটমহল। এখানে প্রায় দেড় শ পরিবারের বসবাস। সেখানে একটি বাড়ির উঠানে কয়েকজন নারী বসে গল্প করছিলেন। ওখানেই কথা হলো বৃদ্ধ রাবেয়া, শ্যামলীসহ অনেকের সঙ্গে।
ছিটমহল বিনিময় প্রসঙ্গ তুলতেই অনেকগুলো কথা সবাই একসঙ্গে বলতে শুরু করলেন, ‘হামরা কারেন্ট চাই, রাস্তা চাই, স্কুল চাই, হাসপাতাল চাই।’ একজন জবুথবু বৃদ্ধ নারী নিজের একটি অচল হাত দেখিয়ে বলছিলেন, ‘হামরা কোনো বয়স্ক ভাতাও পাই না, বাবা। হামার একনা ব্যবস্থা করি দেও।’ ছোট কয়েকটি অপুষ্ট শিশুকে দেখিয়ে দিয়ে একজন বলছিলেন, ‘তাদের স্কুল অনেক দূরে। বাচ্চারা যেতে চায় না।’ লেখাপড়া না থাকার কারণে বাল্যবিবাহের প্রবণতা সেখানে প্রকট। ওই উঠানেই দেখা গেল ১৩-১৪ বছরের আবুল হোসেনকে। সে ওই বাড়ির জামাই। বিয়ে করেছে তৃতীয় শ্রেণি পাস করা একটি মেয়েকে। সেখানে পাশাপাশি কয়েকটি বাড়িতে কথা বলে জানা গেল, সেখানকার অনেকেই দিল্লিতে গেছেন কাজের সন্ধানে। তবে তাঁরা এখন ফিরে আসছেন। দিল্লিফেরত দাসিয়ারছড়াবাসী মোফাজ্জলের সঙ্গে কথা হলো। তাঁরা দুই ভাই ছিলেন দিল্লিতে। তাঁদের ছিটমহল বাংলাদেশ হচ্ছে শুনে আনন্দে ভাসতে ভাসতে দেশে ফিরেছেন। যদিও বাংলাদেশ-ভারতের দুই দালালকে দুই ভাই উৎকোচ দিয়েছেন প্রায় ১৬ হাজার টাকা। যে ছিটমহলবাসী ভারতে কাজের সন্ধানে গেছেন, তাঁদের সরকারি উদ্যোগে ফেরাতে পারলে এই দুর্ভোগের শিকার হতে হবে না।
দাসিয়ারছড়া ছিটমহলের উন্নয়নের জন্য ২৩ দফা প্রস্তাব দিয়েছেন ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। গত ৯ মে যখন আমি দাসিয়ারছড়ায় যাই, সেখানে কালির হাট নামক স্থানে ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির একটি সাইনবোর্ড লাগানো কার্যালয় এবং তার কয়েক গজ দূরে ‘ছিটমহল ইউনাইটেড কাউন্সিল’ নামের সাইনবোর্ড লাগানো আরেকটি কার্যালয় দেখেছিলাম। এখন ‘ছিটমহল ইউনাইটেড কাউন্সিলের সাইনবোর্ড নেই। এ বিষয়ে স্থানীয় ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসা করলে তাঁরা অনেকেই বলেন, যেহেতু ছিটমহল বিনিময় হচ্ছে, ছিটমহল ইউনাইটেড কাউন্সিলের দাবি পূরণ হচ্ছে না, তাই তাঁরা তাঁদের সাইনবোর্ড তুলে নিয়ে গেছেন। কিন্তু ছিটমহল ইউনাইটেড কাউন্সিলের দাসিয়ারছড়া ইউনিটের সভাপতি মিজানুর রহমান মুঠোফোনে বলেন, ‘আমরা নিরাপত্তাহীনতা বোধ করছি। বাজারে যেতে পারছি না। কোনো সাংবাদিক এলে কথা বলতে পারি না। আমরা যে ভারতে যাব, সেটাও বলতে পারি না। পুনর্বাসনের সুবিধাও আমরা পাই কি না, সন্দেহ।’ যদি এ অভিযোগ সত্য হয়ে থাকে, তাহলে বাংলাদেশ সরকারের এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে ছিটমহলগুলোয় নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে কোন কোন খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন, তার তালিকা প্রস্তুতকরণ এবং সম্ভাব্য ব্যয়ের পরিমাণ নির্ধারণ করার কাজ চলছে। ছিটমহলবাসীর জীবনের ৬৮ বছরের বঞ্চনা চাইলেও দ্রুত সমাধান করা সম্ভব নয়।
তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
wadudtuhin@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.