আইএসের জিম্মায় থাকা সাকেরের মা-বাবার আকুতি: ‘মৃত্যুর পূর্বে তোমাদের দেখা পাবো কি’ by হাসান চৌধুরী

সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে আন্তর্জাতিক উগ্র জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) জিম্মায় পাওয়া গেল বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ১২ সদস্যের বৃটিশ পরিবারটিকে। আইএস কর্তৃক বিবিসির কাছে পাঠানো ওই পরিবারের কর্তা আবদুল মান্নান ও রাজিয়া খাতুনের ছবি এখন এমনটাই জানান দিচ্ছে। বিষয়টি কোনভাবেই মেনে নিতে পারছেন না সিরিয়ায় যাওয়া ওই দলের অন্তর্ভুক্ত আবুল কাশেম সাকেরের মা-বাবা। মাত্র ৮ বছর আগে বড় ভাই আব্দুল মান্নানের মেয়ের সঙ্গে সাকেরের বিয়ে দিয়েছিলেন। সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাঁও গ্রামের বাড়িতে পুত্র শোকে বৃদ্ধ বয়সে ফ্রেমে বাঁধা ছেলের ছবি হাতে নিয়ে তারা নির্বাক হয়ে অপলক নয়নে তাকিয়ে থাকেন ছোটকালে তোলা সেই ছবির দিকে। আহাজারির সুর শোনা যায়। তারা বলেন, ‘বাবারে মৃত্যুর পূর্বে তোমাদেরকে কি দেখে যেতে পারবো? নাকি আমাদের মৃত্যুর খবরে তোমরা ছুটে আসতে পারবে। কোন ইসলাম, কোন বেহেস্ত পাবার আশায় মা-বাবাকে না বলে এমন কাজ করতে গেলে।’ সিরিয়ায় যাওয়া আবদুল মান্নানের ছোট ভাই আবদুল লতিফ লুলু মিয়া ও তার স্ত্রী-পুত্র ও স্বজনদের শোকে কাতর হয়ে পড়েছেন। ২০০৭ সালে চাচাতো বোনকে বিয়ে করার সুবাদে যুক্তরাজ্য গিয়েছিল আবুল কাশেম সাকের। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে জন্মদাতা মা-বাবা, ভাইবোন ও আত্মীয়স্বজন এবং লন্ডনের সুশৃঙ্খল ও আয়েশি জীবনের সকল মায়াজাল ছিন্ন করে সিরিয়ার ওই জঙ্গি গোষ্ঠীতে যোগ দেয়া কেউই তা মানতে পারছেন না।  ফেঞ্চুগঞ্জ, সিলেট তথা যুক্তরাজ্য জুড়ে বাঙালি কমিউনিটিতে এখন আলোচনার মুখ্য বিষয় এটি। সাজানো, গোছানো ও স্বাচ্ছন্দ্যে ভরপুর ১২ সদস্যের ওই পরিবারটিকে বিপদগামী করার মূল হোতা হিসেবে আব্দুল মান্নানের যুবতী মেয়ে রাজিয়া খাতুনের নাম উচ্চারিত হচ্ছে। যুক্তরাজ্যের লুটন শহরে বসবাসকারী নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই পরিবারের এক প্রতিবেশী জানান, তাদের চলাফেরায় কোন ত্রুটি ছিল না। শুধু রাজিয়া খাতুনের অতিরিক্ত পর্দা এবং দলবদ্ধ মেয়েদের নিয়ে চলাচল কিছুটা ব্যতিক্রম মনে হতো। তিনি জানান, গত ৪ বছর আগে রাজিয়াকে লন্ডন পুুুলিশ আটক করেছিল উগ্র ইসলামী কর্মকাণ্ডে যুক্ত সন্দেহে। পুলিশ তখন তাকে ভাল করে শাসিয়ে মা-বাবার কাছে ফেরত দেয় এই বলে, ভবিষ্যতে যেন এমনটি আর না হয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায় রাজিয়া সিরিয়া যাওয়ার আগে লন্ডনে তথাকথিত ইসলামী কর্মকাণ্ডের একজন লেকচারার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিল। মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে যুক্তরাজ্য যাবার পথে তুরস্ক থেকে নিখোঁজ হয় ১২ সদস্যের ওই পরিবারটি। এই খবরে লন্ডনে ও বাংলাদেশে বসবাসকারী তাদের নিকট আত্মীয়রা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। কয়েকদিনের মধ্যেই দেশীয় স্বজনদের পরামর্শে লন্ডনের পুলিশকে বিষয়টি অবগত করার জন্য বলা হয়। আইএসে যোগ দেয়া ওই পরিবারের কর্তা আব্দুল মান্নানের প্রথম স্ত্রীর ছেলেমেয়েরা লন্ডন পুলিশকে বিষয়টি জানায়। লন্ডন পুলিশ বিষয়টি শুনে প্রথমে এব্যাপারে মুখ খুলতে বারণ করে। ঘটনাটি প্রচার হলে যুক্তরাজ্য সরকারের দুর্নাম হবে এমনটি ভেবেই পুলিশ তাদের নিষেধ করে। কারণ আইএসে যোগ দেয়া একুশ বছর বয়সী যুবতী রাজিয়া জন্মসূত্রে বৃটিশ নাগরিক। অবস্থা বেগতিক দেখে অবশেষে বিবিসি’র মাধ্যমে বিষয়টি জানাজানি হয়।
আবদুল মান্নানের ছোট ভাই আবদুল লতিফ লুলু মিয়া এই প্রতিবেদককে জানান, ঘটনা যাই ঘটুক ভাতিজি রাজিয়া না আসলেও তার ভাই, ভাবী, ভাতিজি এবং পুত্র ফিরে আসতে পারে। তাদেরকে ফিরিয়ে আনার জন্য তিনি বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্য সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন। তাদেরকে এনে দেশীয় জেলে পুঁতে রাখলেও সান্ত্বনা মিলবে এই ভেবে যে মৃত্যুর সংবাদে তারা অন্তত প্যারোলে মুক্তি পেয়ে শেষবারের মতো দেখে যেতে পারবে। তার ভাই আবদুল মান্নান ও অন্য সদস্যরা স্বেচ্ছায় সিরিয়া গেছেন তা বিশ্বাস করেন না। তিনি বলেন, যাবার কয়েকদিন আগে ৮০ বছর বয়স্ক আবদুল মান্নান আবদুল লতিফকে তার রুমে ডেকে এনে বলেন, ‘ভাইরে তোমারও বয়স হয়েছে। আমরা কখন মারা যাব ঠিক নেই। এখনই জমিজমাগুলো আমরা থাকতেই ভাগবাটোয়ারা করে দেয়া ভাল, নইলে ছেলেমেয়েরা ওসব পারবে না। তখনকার কথায়ও তিনি তাদের এমন চলে যাবার কোন ইঙ্গিত পাননি। গত ১১ই মে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের গ্রামের বাড়ি থেকে যুক্তরাজ্য যাবার পথে তুরস্ক থেকে ১২ সদস্যের বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত এই বৃটিশ পরিবারটি নিখোঁজ হন। অবশেষে সম্প্রতি জানা যায় তারা সিরিয়ার জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের জিম্মায় আছে।

No comments

Powered by Blogger.