মানব পাচারের শিকার হওয়া এক নারীর লোমহর্ষক বর্ণনা by নুরুজ্জামান লাবু

স্বামী মাদকাসক্ত। ঘরে দুই সন্তান। আর্থিক টানাপড়েনে চলছিল যাপিত জীবন। একদিন প্রতিবেশী এক দালালের প্রলোভনে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন তিনি। গৃহকর্মী হিসেবে বিদেশে যাওয়ার প্রলোভন দেখায় সেই দালাল। থাকা-খাওয়া বাদে মাসে ২০ হাজার টাকা উপার্জন হবে। একটু সচ্ছলতার আশায় সেই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান তিনি। তাকে পাঠানোর কথা ছিল লেবাননে। কিন্তু দালাল চক্র তাকে পাঠায় সিরিয়ায়। কিন্তু বিদেশ গিয়ে অভাব ঘোচানো তো দূরের কথা, ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হন তিনি। ছয় ছয়টি মাস তার কাছে মনে হয়েছে যেন অন্ধকার যুগে ফিরে গিয়েছেন তিনি। তাকে দিয়ে করানো হতো পতিতাবৃত্তি। রাজি না হলেই চলতো রাত-দিন নির্যাতন, তিন বেলার বদলে জুটতো এক বেলা খাবার, ছোট্ট একটি কক্ষে গাদাগাদি করে ৩০-৩৫ জন থাকা। ইলেকট্রিক শকড দেয়া হতো তাকে। মেরে হাতও ভেঙে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কিছুই করার ছিল না তার। চাপা কান্না গিয়ে ঠেকতো কেবল চার দেয়ালে। ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় তাকে দিয়ে আর ‘কোন কাজ’ হবে না বলে দালালরাই তাকে ফেরত পাঠায় দেশে। দেশে ফিরে ঢাকা মেডিক্যালে দীর্ঘ দিন চিকিৎসা নিয়েছেন। এর আগেই দেশীয় দালালের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন র‌্যাবের কাছে। গত রোববার র‌্যাব-৩ সেই দালাল চক্রকে গ্রেপ্তার করেছে। র‌্যাব কার্যালয়ে বসেই কথা হয় হতভাগা এই নারীর সঙ্গে। নির্যাতনের শিকার ওই নারী জানান, যাত্রাবাড়ীর জনপথ এলাকায় মায়ের সঙ্গে থাকতেন তিনি। প্রায় এক যুগ আগে তৈয়বুর নামে এক যুবকের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। ঘরে আসে দুটি সন্তান। কিন্তু স্বামী তৈয়বুর ছিল মাদকাসক্ত। সংসারের কোন খরচ চালাতো না সে। থাকতেন মা খাদিজা বেগমের সঙ্গেই। মা অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। মায়ের ওপর বোঝা হয়ে কতদিন আর থাকা যায়, এসব যখন ভাবছিলেন তখনই সিরাজ নামে এক প্রতিবেশী যেন স্বপ্নদূত হয়ে আসে। সিরাজ তাকে কাতার কিংবা লেবাননে পাঠানোর কথা বলে। খরচ হবে মাত্র ৫০ হাজার টাকা। মাসে ২০ হাজার টাকা বেতন। থাকা-খাওয়া ফ্রি। সংসারে সচ্ছলতা ফিরে আসার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন তিনি। সিরাজের কথায় রাজি হয়ে পাসপোর্ট তৈরি করে তার হাতে তুলে দেন। সঙ্গে দেন ৫০ হাজার টাকাও। গত বছরের প্রথমদিকে সিরাজ তাকে কাতারে পাঠায়। কাতার গিয়ে এক বাসায় কাজও শুরু করেন। কিন্তু বাসার পুরুষ মানুষ তাকে যৌন নির্যাতনের চেষ্টা করে। বিষয়টি সঙ্গে সঙ্গে দালালকে জানান তিনি। দালাল সিরাজ তাকে বুদ্ধি দেয় বাসা থেকে পালিয়ে পুলিশের কাছে যাওয়ার জন্য। বলে ফিরে এলে তাকে বিনা খরচে লেবাননে পাঠাবেন। সেখানে এমন কোন সমস্যা হবে না। ওই নারী তাই করেন। রাস্তা থেকে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যায়। পনের দিন থাকতে হয় কারাগারে। পরে দূতাবাসের মাধ্যমে ফিরে আসেন দেশে। এরপর গত বছরের ১৪ই সেপ্টেম্বর আরও ৪০ হাজার টাকার বিনিময়ে দালাল তাকে লেবাননে পাঠানোর জন্য তুলে দেয় বিমানে। কিন্তু দুবাই থেকে দালালরা তাকে নিয়ে যায় সিরিয়ায়। আর পরের বার যেন গিয়ে পড়েন সাক্ষাত নরকের আগুনে। কিসের গৃহকর্মীর কাজ, তাকে পাঠানো হয়েছে পতিতা হিসেবে কাজ করার জন্য। এটা শুনে যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে তার। ওই নারী বলেন, দালালরা তাকেসহ ২৮ জন বাঙালি নারীকে তাদের অফিসে নিয়ে যায়। সেখানে একটি ঘরে আটকিয়ে রাখে। প্রতিদিন একজন করে এসে গৃহকর্মীর কাজ করানোর কথা বলে বাসায় নিয়ে যায়। কিন্তু বাসায় নিয়েই শুরু করে যৌন নির্যাতন। বাধা দেয়ার চেষ্টা করেন তিনি। কখনো পেরে উঠতেন কখনো না। একারণে দু-একদিন পরই সেই লোক তাকে আবার ফেরত দিয়ে যেতেন দালালদের সেই অফিসে। বাধা দেয়ার কারণে অফিসে চলতো নির্যাতন। হাত-পায়ের তালুতে পেটানো হতো। দেয়া হতো ইলেকট্রিক শক্‌ডও। চিৎকার করতেন, কিন্তু সেই চিৎকারের আওয়াজ বাইরে গিয়ে পৌঁছতো না। ওই নারী বলেন, দালালদের কথামতো কাজ না করায় খাবার দেয়া হতো একবেলা, প্রতিদিন বিকালে। তাই খেয়ে কোন রকম দিন পার করতেন তিনি। বাড়িতে যোগাযোগেরও কোন উপায় ছিল না। অচেনা জায়গা কোথায় গিয়ে কি করবেন, বুঝে উঠতে পারছিলেন না। দু’বার পালিয়ে ছিলেন, পুলিশের কাছে গিয়েছিলেন কিন্তু পুলিশও আবার তাকে দালালদের সেই অফিসে রেখে গেছে। বুঝতে পারেন দালালদের সঙ্গে পুলিশেরও যোগসূত্র রয়েছে।
ওই নারীর ভাষ্য, একটি বাসায় তিনি দিন পনেরোর মতো ছিলেন। ওই বাসার গৃহকর্তা ও তার ছেলে দু’জনই তাকে জোর করে ধর্ষণ করেছে। আরেক বাসায় ছিলেন দিন দশেক। সেই বাসার গৃহকর্তা ভালো ছিল। কিন্তু গৃহকর্তার বৃদ্ধ বাপ তাকে যৌন নির্যাতন করতো। বিষয়টি গৃহকর্তা ও তার স্ত্রীকেও জানিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তারা তার কথাকে পাত্তাই দেয়নি। বৃদ্ধকে যৌন নির্যাতনে বাধা দেয়ায় তাকে আবারো পাঠানো হয় দালালদের সেই অফিসে। সেবার নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায় আরও বেশি। পিটিয়ে হাত ভেঙে ফেলা হয় তার। এসময় পুরোটাই অফিসেই পড়ে থাকেন তিনি। একদিন ইন্দোনেশীয় এক তরুণীর মোবাইল নিয়ে বাথরুমে গিয়ে ফোন করেন মা খাদিজাকে। বলেন, মা, আমাকে বাঁচাও। আমি এখানে মরে যাচ্ছি। মা সব শুনে দৌড়ে যান সেই দালাল সিরাজের কাছে। সিরাজ তাকে ফিরিয়ে আনছি আনছি বলে সময়ক্ষেপণ করে। পল্টন থানায় গিয়ে অভিযোগ করেন মা। কিন্তু পুলিশ কেবল সিরাজকে ডেকে এনে শাসিয়ে দেয়। দিন দিন শাহীনুরের অবস্থা খারাপ হয়ে যাওয়ার একপর্যায়ে সিরিয়ার দালালরাই তাকে ফেরত পাঠায় দেশে। দেশে ফিরে টানা ১৮ দিন ঢাকা মেডিক্যালের ওয়ানস্টপ সার্ভিস সেন্টারে ভর্তি ছিলেন তিনি। মা খাদিজা বেগম বলেন, মেয়েকে নিয়ে তিনি পল্টন থানায় গিয়েছিলেন। কিন্তু ওসি অভিযোগ না নিয়ে ধাক্কা মেরে রুম থেকে বের করে দিয়েছেন। এরপর এসি ও ডিসির অফিসে গিয়েও কাজ হয়নি। পরে তারা র‌্যাবে অভিযোগ করেন।
র‌্যাব-৩ এর সিও লে. কর্নেল সারোয়ার বলেন, অভিযোগটি প্রথমে দেয়া হয়েছিল র‌্যাব-১০ এ। সেটি তাদের কাছে আসলে তারা অনুসন্ধান শুরু করেন। পরে রোববার অভিযান চালিয়ে পুরানা পল্টনের ১১ নম্বর ইব্রাহীম ম্যানশনে অভিযান চালিয়ে সিকদার ওভারসীজের মালিক সিরাজ শিকদার, আল-হাসিব ওভারসীজের মালিক জসিমসহ ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করেন। শিকদারের কোন লাইসেন্স নেই। সে আল-হাসিবের হয়ে কাজ করতেন। এই চক্রটি অসংখ্য নারীকে গৃহকর্মীর কাজ দিয়ে পাঠানোর নাম করে বিক্রি করে দিয়েছে। যাদের দিয়ে বিদেশে পতিতাবৃত্তি করানো হয়। গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে পল্টন থানায় মানবপাচার আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.