পাহাড়ের আলোকিত মানুষ by আজহার হীরা

পাহাড়ের আলোকিত মানুষ ড. মহব্বত উল্লা। তার উদ্ভাবিত পানির প্রযুক্তি ব্যবহার করে সারা বছর চাষাবাদ হচ্ছে পার্বত্য অঞ্চলে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যম-িত বাংলাদেশের এক-দশমাংশ এলাকাজুড়ে রয়েছে পার্বত্যাঞ্চল। এ অঞ্চলের ৬ ভাগ উপত্যকা এবং ৯৪ ভাগই পাহাড়। এখানকার মানুষগুলোর জীবনাচরণও বৈচিত্র্যময়। এক সময় এই মানুষগুলোর জীবন-জীবিকা ছিল জুমনির্ভর। পাহাড়ের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জুমের পাশাপাশি পাহাড়ে সারা বছর বিভিন্ন জাতের ফলমূল ও শস্য উৎপাদনের জাত ও কলাকৌশল উদ্ভাবন করেছে পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, খাগড়াছড়ি। কিন্তু পানির অভাবে এই ফলমূল এবং শস্য উৎপাদন বিঘিœত হচ্ছিল চরমভাবে। পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, খাগড়াছড়ির মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মহব্বত উল্ল্যার আবিষ্কৃত ৭টি পানির প্রযুক্তি পাল্টে দিয়েছে পাহাড়ের চালচিত্র। তার আবিষ্কৃত সেচ পদ্ধতি ব্যবহার করেই সারা বছর চাষাবাদ হচ্ছে পাহাড় ও উপত্যকার জমিতে। ড. মহব্বত উল্ল্যা জানান, যেহেতু পাহাড়ে পুকুর, ডোবা বা নদীর সংখ্যা কম তাই বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ওপরই জোর দিয়েছেন তিনি।
বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে সারা বছর জিরো এনার্জিতে সেচ দেয়া ড. মহব্বত উল্ল্যার আবিষ্কৃত ৭টি প্রযুক্তির মধ্যে অন্যতম। এ পদ্ধতিতে দুই পাহাড়ের মাঝখানে বাঁধ দিয়ে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা হয়। সংরক্ষণাগার থেকে বর্ষাকালে অতিরিক্ত পাহাড়ি ঢলের পানি বের হয়ে যাওয়ার জন্য রাখা হয় রাস্তা বা স্পিলওয়ে। পরবর্তীতে শুষ্ক মওসুমে সংরক্ষণাগার থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে উপত্যকার জমিতে জিরো এনার্জিতে সেচ দিয়ে ধান, পিয়াজ, ভুট্টাসহ সবজি ও রবিশস্য চাষাবাদ করা যায়। এছাড়াও এনার্জি খরচ করে পাম্পের সাহায্যে এই পানি তোলা হয় পাহাড়ের উপরে স্থাপিত ট্যাংকে। ট্যাংক থেকে গ্রাবিডি ফোর্সে ফলের বাগানে সেচ দেয়া হয়। ফলে সারা বছর পাহাড় এবং উপত্যকার জমিতে এখন চাষ করা যাচ্ছে সহজেই। এতে এক ফসলি জমিতে এখন তিন ফসল চাষ হচ্ছে এবং পাহাড় ও উপত্যকার জমিতে ফলনও হচ্ছে দ্বিগুণ। এছাড়া বৃষ্টির পানি সংরক্ষণাগারে হাঁস এবং মাছও চাষ করা যাচ্ছে। তাই পাহাড়ের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ পুষ্টির চাহিদাও পূরণ হচ্ছে। এই বাঁধগুলোর ব্যবহার বহুবিধ। বাঁধগুলো একদিকে পানি সংরক্ষণ করছে; অপরদিকে দুই পাহাড়ে বসবাসরত বাসিন্দারা বাঁধটিকে রাস্তা হিসেবে ব্যবহার করতে পারছে। ফলে দুর্গম পাহাড়ের যোগাযোগ ব্যবস্থাও সুগম হবে।
এছাড়াও সংরক্ষিত পানিতে দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা তৈরি করে পর্যটন খাতকেও সমৃদ্ধ করা সম্ভব হচ্ছে। পাহাড়ি কৃষি গবেষণা খাগড়াছড়িতে এমনি একটি দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা গিরিস্বর্ণা। যা দেখতে প্রতিদিন ভিড় জমাচ্ছেন সৌন্দর্যপিপাসু পর্যটকরা।
ড. মহব্বত উল্ল্যার আরও একটি অনন্য উদ্ভাবন বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত পানির পুনঃব্যবহার প্রযুক্তি। এ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত পানির পুনঃব্যবহার করে সারা বছর বাড়ির আঙ্গিনায় সবজি ও ফলমূল চাষ করা হচ্ছে। এ পদ্ধতি শুধু পাহাড়েই নয়, সমতলেও অনুসরণ করা যেতে পারে। এ প্রযুক্তিতে বাসাবাড়ির পানি সংরক্ষণ করার জন্য রান্নাঘরের পিছনে বা সুবিধাজনক স্থানে একটি ট্যাংক স্থাপন করতে হয়। স্থাপিত ট্যাংকের সঙ্গে বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত পানির সব উৎসের সঙ্গে পাইপ লাইনের মাধ্যমে সংযোগ স্থাপন করতে হয়। ফলে এই পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি জমা হবে ট্যাংকে। পরবর্তীকালে ট্যাংক থেকে প্রাভিডি ফোর্সে সবজি ও ফল বাগানে জিরো এনার্জিতে সেচ দেয়া যায়। এছাড়াও তার উদ্ভাবিত পাহাড়ের পাশ দিয়ে ছোট ছোট ছড়া বা ঝিরি দিয়ে অল্প অল্প প্রবাহিত পানিকে ডাইভার্সন বক্সের মাধ্যমে ডাইভার্ট করে জমির মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত করা, ছড়ার পানিতে নিমজ্জিত সাবমারসিবল ড্যাম তৈরি করে পানি সংরক্ষণ করা, ঝরনার পানিকে জিরো এনার্জিতে পাইপের মাধ্যমে লোকালয়ে নিয়ে এসে ব্যবহার উপযোগী করা এবং পাহাড়ের পাদদেশে গভীর নলকূপ স্থাপন করে সাবমারসিবল পাম্পের মাধ্যমে উঁচু পাহাড়ে বসবাসরত মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার প্রযুক্তির সুফল পাচ্ছে দুর্গম পাহাড়ে বসবাসরত পাহাড়ি জনগণ। পার্বত্যাঞ্চলের অধিকাংশ পাহাড় দুর্গম এবং পাথরের পাহাড়। তাই এসব পাহাড়ে যাতায়াত কষ্টসাধ্য এবং নলকূপ স্থাপন করা সম্ভব হয় না। এই দুর্গম অঞ্চলের মানুষের খাবার পানির সমস্যা সমাধানেও একটি অনন্য প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন ড. মহব্বত উল্লা।
এ প্রযুক্তিতে প্রথমে পাহাড়ে বাঁধ দিয়ে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা হয়। সংরক্ষণাগারের পাশেই একটি কূপ করে তাতে স্থাপন করা হয় রিং ওয়েল। এরপর সংরক্ষণাগারের পানিকে একটি পাইপলাইনের মধ্যে কয়লা, বালি, ছোট পাথর এবং সিরামিকের স্তরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করে ফিল্টার করে প্রবেশ করানো হয় কূপের মধ্যে। পরবর্তীতে কূপ থেকে রিং ওয়েলের মাধ্যমে পানি উত্তোলন করে খাবার ও দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করে দুর্গম পাহাড়ের লোকজন। এছাড়াও দরিদ্র কৃষকদের স্বল্পমূল্যে ও বিনামূল্যে উন্নত জাতের ফলের চারা প্রদান, বিদ্যালয়ে পানির চাহিদা পূরণ করতে নলকূপ স্থাপন, গ্রামের মানুষের নষ্ট নলকূপ মেরামত করে দেয়া, দরিদ্র গ্রামবাসীর যাতায়াতের রাস্তার কালভার্ট করে দেয়া, দরিদ্র কৃষকদের কৃষি সরঞ্জাম দেয়াসহ অসংখ্য ভাল কাজ করেছেন নিজ তাগিদেই। এক কথায় যেখানে দরিদ্র পাহাড়বাসীর সমস্যা সেখানেই ছুটে গেছেন ড. মহব্বত উল্ল্যা। কখনো পরামর্শ দিয়ে, ব্যাংক লোন নিতে সহয়তা করে, আবার কখনও ধনাঢ্য ব্যক্তিদের উৎসাহিত করেছেন দরিদ্রদের সহায়তা করতে। তাই তো পাহাড়ে বসবাসরত অসহায় লোকজনও ড. মহব্বত উল্ল্যাকে বসিয়েছেন দেবতার আসনে। এলাকায় খ্যাতি পেয়েছেন সাদা মনের মানুষ হিসেবে।
কৃষকের মাঠে তার প্রত্যেকটি টেকসই প্রকল্পের পিছনেই ছিল কৃষকদের আর্থিক এবং শারীরিক অংশগ্রহণ। যার টাকা আছে সে অর্থ দিয়ে এবং যার টাকা নেই তিনি শ্রম দিয়ে গড়ে তুলেছেন নিজেদের উপার্জনের রাস্তা। তিনি কৃষকদের টেকটিক্যাল সাপোর্ট দিয়েছেন। প্রকল্পের প্রয়োজনে নিজে জামিন হয়ে কৃষি ব্যাংক থেকে কৃষকের লোনের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আবার ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করার জন্যও কৃষককে তাগিদ দিয়েছেন। প্রতিটি প্রকল্প যাতে টেকসই হয় তার জন্য স্থানীয় সুবিধাভোগী কৃষকদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন আলাদা আলাদা সমিতি। এ সমিতি সুবিধাভোগীদের কাজ থেকে মাসিক একটি ফি নেন, যার লেনদেন হয় ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে। সমিতির মাধ্যমেই নিয়োগ দেয়া হয়েছে একজন সার্ভিস প্রভাইডার। যিনি প্রকল্পের তদারকি করেন এবং অন্যের জমিতে সেচ দেন। এর জন্য সমিতি তাকে মাসিক একটি সম্মানী প্রদান করে। ফলে নিজের আয়ের উৎসের কারণেই সার্ভিস প্রভাইডার তার প্রকল্প টিকিয়ে রাখেন।
ড. মহব্বত উল্ল্যা জানান, ২৫শে সেপ্টেম্বর ২০০৮ সালে প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, খাগড়াছড়িতে। পরবর্তীকালে পদোন্নতি পেয়েছেন মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে। যোগদানের পর থেকেই দেখেছেন কৃষি গবেষণার অভ্যন্তরে ২০৩ একর পাহাড়ি এবং প্রায় ৩৬ একর উপত্যকার জমি শুষ্ক মওসুমে অনাবাদি থাকতো শুধু পানির অভাবে। তাছাড়া গবেষণার ভিতরে খাবার পানির সমস্যাও ছিল প্রকট। তখন থেকেই তিনি পানি নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। একপর্যায়ে তিনি পাহাড়ে বাঁধ দিয়ে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে সেচ প্রদান, গভীর নলকূপ স্থাপন করে সাবমারসিবল পাম্পের মাধ্যমে গবেষণার অভ্যন্তরের খাবার পানির চাহিদা পূরণ এবং বাঁধ দিয়ে সংরক্ষিত বৃষ্টির পানিকে কৃত্রিম ফিল্টারের মাধ্যমে খাবার উপযোগীকরণসহ অন্যান্য প্রযুক্তি আবিষ্কার করেন। ফলে কৃষি গবেষণার ভিতরের সব জমিতে এখন সারা বছর চাষাবাদ করা সম্ভব হচ্ছে। ইতিমধ্যে তার এই উদ্ভাবিত প্রযুক্তি গ্রহণ করে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছে কয়েকটি দাতা সংস্থা। এর মধ্যে কেজিএফ, জাপানি দূতাবাস, এফএও, উন্নয়ন বোর্ড, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং জেলা প্রশাসন খাগড়াছড়ি উল্লেখযোগ্য। ২৫শে জুন ২০১৫ তারিখে মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবেই তিনি এলপিআরের জন্য খাগড়াছড়ি ত্যাগ করেন। কিন্তু পাহাড়ের মানুষ সারা জীবন তার আবিষ্কারের সুফল ভোগ করবেন।

No comments

Powered by Blogger.