পরিকল্পনা ছাড়াই ট্রানজিট: আনু মুহাম্মদ by সিরাজুস সালেকিন

ভারতকে কোন রকম পরিকল্পনা ছাড়াই সরকার ট্রানজিট দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেছেন, প্রকৃতপক্ষে ট্রানজিটের কারণে বাংলাদেশের কোন লাভ হবে না। ট্রানজিটের মাশুল বা অবকাঠামো উন্নয়নে ভারত কি দেবে সে বিষয়ে কোন চুক্তি বা নীতিমালা হয়নি। পুরো বিষয়টি নিয়ে সরকারের কোন পরিকল্পনা ছিল না। যে কারণে ইতিমধ্যেই ভারত মাশুল ছাড়াই চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার শুরু করেছে।
মানবজমিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। আনু মুহাম্মদ বলেন, কানেক্টিভিটির নামে যে ট্রানজিট দেয়া হচ্ছে তা আসলে ভারতের এক অঞ্চলের সঙ্গে আরেক অঞ্চলের যোগাযোগ। ভারতের জন্য এটা খুব বড় ঘটনা, বড় প্রাপ্তি। ভারতের বড় পুঁজি। তাদের জন্য এটা খুব দরকার। এ অঞ্চলে বিশেষ করে উত্তর-পূর্ব ভারতে খনিজ সম্পদ আরোহণ, বিনিয়োগ কিংবা বাজার এগুলো খুবই কম খরচে, কম পয়সায় করতে পারবে। শতকরা ২৫ ভাগ খরচে তারা করতে পারবে। পুরো জিনিসটার পরিকল্পনা সেভাবেই সাজানো আছে। বাংলাদেশের কোন পরিকল্পনা নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভারত বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে যে সড়ক-রেল ব্যবহার করবে, নৌপথ ব্যবহার করবে। ব্যবহার করতে গেলে বাংলাদেশের কোন অসুবিধা হবে কিনা, কোন ক্ষতি হবে কিনা। কোন লাভ থাকলে কি লাভ? এবিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্ব ছিল স্টাডি করা, সমীক্ষা করা। দায়িত্ব ছিল এটা জনগণকে জানানো। অন্তত পক্ষে সংসদ নামের যে একটা বিষয় আছে সেটা নির্বাচিত হোক আর অনির্বাচিত হোক সেখানে আলোচনা করা। শুল্ক নির্ধারণ নিয়ে মনে হচ্ছে ভারত বা বাংলাদেশ সরকার অপেক্ষা করছে যে ভারত কখন কতটা দিতে রাজি হবে বা সিদ্ধান্ত হবে। বাংলাদেশের নিজের কোন চাওয়ার নেই। কোন পরিকল্পনাও নাই। ডব্লিউটিও মাশুল নির্ধারণ করে দেবে অর্থমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের সমালোচনা করে আনু মুহাম্মদ বলেন, এগুলো হলো লোক ভুলানো কথাবার্তা। একটা বিষয় যখন নির্ধারিত হচ্ছে মানুষের ওপর কর বসানো দেশের জনগণের ওপর কর বসানোর জন্য তো সরকারের কোন দেরি হয় না। সেটা তো চট করে হয়ে যায়। ঘোষণা দেয়ার পরের দিন কার্যকর হয়ে যায়। সেখানে এরকম একটা নীতিমালা তৈরি হচ্ছে সেটার একটা পরিকল্পনা থাকতে হবে। কখন কত কিভাবে হবে। ডব্লিউটিওর নীতিমালা যদি হয় এটা তো বলতে হবে। এতদিন থেকে কথা হচ্ছে। এক উপদেষ্টা একদিন বললেন যে এটা তো চাওয়াই অভদ্রতা। সেটা কি ঠিক কথা। পুরো জিনিসটা নিয়ে তাদের কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয় নেই। মাশুল নির্ধারণের বিষয়টি এখনও অস্বচ্ছ অবস্থায় আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অবিশ্বাস্য মাত্রার একটা ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। এটা দক্ষিণ এশিয়ায় বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। ভারতের বিনিয়োগ, স্থলবিন্যাস, জলবিন্যাস, অর্থনীতির বিন্যাস অনেক কিছুর পরিবর্তন হবে। বাংলাদেশের ভেতরে শুধু অবকাঠামো না, বহু ধরনের প্রভাব পড়বে। তিনি বলেন, কানেক্টিভিটি বলতে যেটা বলা হচ্ছে বাংলাদেশের জন্য নতুন কোন কানেক্টিভিটির কিছু নেই। কারণ আমরা কলকাতার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ, আখাউড়ার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ, কিংবা আগরতলার সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে আমাদের কি সমস্যা হচ্ছে? আমাদের তো সমস্যা নেই। মিয়ানমারের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করছি কোন সমস্যা নাই। ট্রানজিট নিয়ে মন্ত্রীরাও সঠিক তথ্য দিতে পারছে না দাবি করে তিনি বলেন, আমরা দেখি মন্ত্রীরা একেক সময় একেক কথা বলেন। কেউ বলেন চাওয়া ঠিক হবে না। কেউ বলেন ডব্লিউটিও অনুযায়ী হবে। কেউ বলে একেকটা অঞ্চলে যেরকম শুল্ক থাকে সেরকম হবে। এটা তো একটা নির্বোধের মতো কথাবার্তা। এতবড় একটা ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে সেটা তো একটা প্রস্তুতি থাকবে, কাগজপত্র থাকবে, পরিকল্পনা থাকবে, নীতিমালা থাকবে। কোনরকম নীতিমালা ছাড়াই ভারত ট্রানজিট দিতে যাচ্ছে। এর আগে মানবিক কারণ দেখিয়ে গেছে। একসময় বিদ্যুতের কথা বলে গেছে। বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে গেছে। বাংলাদেশ সরকার বলে কোন কিছুর আছে এটাই এখানে বোঝা যাচ্ছে না। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ইতিমধ্যে এটা এভাবে নিয়ে গেছে। বাংলাদেশের নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়তে পারে ইঙ্গিত দিয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ভারত বাংলাদেশে কাঁটাতার দিয়ে রাখছে এই যুক্তিতে যে এই দেশের মধ্য থেকে সন্ত্রাসী যাবে তাদের দেশে। এখন সন্ত্রাসী যে দেশ থেকে যাবে বলে কাঁটাতারের বেড়া দেয়া হয়, সেই দেশের মধ্য দিয়ে পণ্য পরিবহন কি ভরসায় হবে সেটা তো বোঝা মুশকিল। সে নিরাপত্তা কে দেবে, কি হবে ব্যবস্থা। সে নিয়ে ব্যাখ্যা নেই। কাঁটাতারের যুক্তি যে কারণে সেই কারণে তো ট্রানজিট হওয়ার কথা না। আর যদি ট্রানজিট সম্ভব হয় তবে কাঁটাতার হওয়ার কথা না। এ কথাগুলো তো সরকারেরই বলার কথা। ট্রানজিটে বাংলাদেশ লাভবান হবে না দাবি করে তিনি বলেন, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের সরাসরি যোগাযোগের ব্যাপারে আমরা সবসময় আগ্রহী। বাংলাদেশ থেকে এই কথাটা অনেকবার বলা হয়েছে। ভারত একসময় সম্মত হয়েছিল। কিন্তু ৩৪ কিলোমিটার রাস্তার মধ্যে এমন প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে সে সময় যার ফলে বাংলাদেশ-নেপাল যোগাযোগ কার্যকর হয়নি। কিন্তু আমাদের দিক থেকে সবসময় আমরা উন্মুক্ত আছি। ভারতের জন্য এ যোগাযোগটা হয়নি। নেপাল-ভুটানকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে যে এটা বাংলাদেশের বিরাট অর্জন। কিন্তু এটার অনেক আগেই ভারত সম্মতি দিয়েছিল কিন্তু কার্যকর করেনি। পুরো কানেক্টিভিটির মধ্যে নেপাল-ভুটান যোগ হবে খুবই সামান্য। ভারতের তুলনায় খুবই সামান্য হবে। ভারতের এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চল যাওয়া সেটার মাত্রা আর নেপাল-ভুটান যাওয়া সেটার মাত্রা এক না। এখন নেপাল ও ভুটানে ভারতের বিনিয়োগ প্রধান। এখন ভারতের বিনিয়োগই নেপাল ভুটান হয়ে আসবে। বাংলাদেশের ক্ষতির দিক বিবেচনা করা হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, সড়ক ও রেলপথের ওপর বাড়তি বোঝা পড়বে তাতে বাংলাদেশের পণ্য পরিবহনের দশা কি হবে। যাত্রী পরিবহনের কি হবে। নতুন রাস্তা তৈরি করতে গেলে কৃষিজমির কি হবে। কতটা জলাশয় নষ্ট হবে, নদী নষ্ট হবে। সেগুলোর তো হিসাব নিকাশ সরকারের দায়িত্ব ছিল অনেক আগে। কতটা হলে বাংলাদেশের পরিবহনে সমস্যা হবে না। সমস্যা হলে বিকল্প কি ব্যবস্থা থাকবে হিসাবের মধ্যে নিয়ে আসার কথা। দুই রাষ্ট্রের মধ্যে কোন নীতি বা চুক্তি হলে এগুলো বিস্তারিত করা। ১০-১৫ বছর থেকে এসব নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বাংলাদেশ একটা ওয়ার্কিং পেপার তৈরি করতে কয়েক মাসের ব্যাপার। এটা করে ওই অনুযায়ী বাংলাদেশের মানুষকে জানিয়ে বাংলাদেশের মানুষ যদি রাজি হয় তাহলে সরকারের সমস্ত কিছু মানুষকে জানাতে অসুবিধা কোথায়। পুরো ট্রানজিটের বিষয়টি জনসম্মুখে প্রকাশের দাবি জানিয়ে আনু মুহাম্মদ বলেন, এ না জানানো থেকে অস্বচ্ছতা থেকে, গোপনীয়তা থেকে বোঝা যায় যে এখানে বাংলাদেশের জনগণের জন্য বিরাট সমস্যাজনক ঘটনা হতে যাচ্ছে। সেটার মাত্রাটা কত হবে এটা আমরা এখনও বলতে পারি না। কিন্তু এটা বাংলাদেশের মানুষের লাভ যে নাই সেটা তাদের গোপনীয়তা থেকে বোঝা যাচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.