তিন দেশে হামলা- এখন অশুভকে চিহ্নিত করতে হবে by জোনাথন ফ্রিডল্যান্ড

একই দিনে বিভীষিকার পর বিভীষিকা—ফ্রান্স, তিউনিসিয়া ও কুয়েতে। যেন বিভীষিকার নিলাম: প্রতিটি ঘটনা আমাদের আতঙ্কিত করার ক্ষেত্রে নৃশংসতায় আগেরটিকে ছাড়িয়ে গেছে। নিলামে যেমন সবাই আগের দরদাতার চেয়ে বেশি দর হাঁকেন। প্রথম ঘটনাটি ঘটে লিয়ঁর এক কারখানায়। এর চেয়ে মর্মঘাতী ব্যাপার হচ্ছে সেই কারখানার ফটকের ওপর একটি কাটা মাথা পাওয়া গেছে, আর তার পাশেই পাওয়া গেছে একটি মাথাবিহীন ধড়। ফরাসি প্রেসিডেন্ট বলেছেন, সেই লাশের গায়ে খোদাই করে বার্তা লেখা ছিল।
তিউনিসিয়ার সুছা এলাকায় অবকাশ যাপন করতে যাওয়া লোকজন ব্যারিকেড দেওয়া হোটেল থেকে বীভৎস ছবি টুইটারে তুলে দিয়েছেন। সৈকতে শব্দ শুনে তাঁরা মনে করেছিলেন, দিনের বেলায় কোথাও আতশবাজি শুরু হয়েছে। কিন্তু সেটা যে হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্যে ছোড়া গুলির শব্দ, তা বোঝার পরই তাঁরা সৈকত থেকে পালিয়ে কীভাবে হোটেলে এসেছেন, সে বর্ণনা দিয়েছেন। আর কুয়েত সিটিতে হত্যাকারী যেন আগের দুটি ঘটনাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার অভিপ্রায়ে গায়ে বোমা বেঁধে দুই হাজার মানুষভর্তি এক মসজিদে ঢুকে পড়ে বোতাম চেপে দেয়। এতে বহু মানুষ পরপারে চলে যাবে, তার এ রকমই আশা ছিল।
প্রতিটি ঘটনাই আমাদের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নিয়েছে। এই তিনটি ঘটনা যারা ঘটিয়েছে, তারা নিশ্চিতভাবেই আশা করেছিল, তারা যা করেছে, তা সবকিছুকে ছাড়িয়ে যাবে। গত মঙ্গলবারে আইএস যে ভিডিও ছেড়েছে, তাতে দেখা যায় গুয়ানতানামো কারাগার স্টাইলের লাল জাম্পসু৵ট পরিহিত পাঁচজন মুসলমান নাগরিককে খাঁচায় ভরে সুইমিংপুলে নামানো হচ্ছে। খুবই উন্নত প্রযুক্তির আন্ডারওয়াটার ক্যামেরা এসব মানুষের মারা যাওয়ার মুহূর্ত ধারণ করেছে, তাঁদের ডুবে যাওয়ার ছলাৎ ছলাৎ শব্দও রেকর্ড করেছে।
এসব ঘটনা থেকে আমরা কী বুঝব? যা দেখেছি, সে বিষয়েই বা কী করব? ঘটনাগুলো সাধারণভাবে একই গোষ্ঠী ঘটিয়েছে, বিশেষজ্ঞরা এমন যোগসূত্র খুঁজবেন। কেউ কেউ এর দায়িত্বও নিতে পারে। ইসলামিক স্টেট (আইএস) ইতিমধ্যে কুয়েতের হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে। আইএসের অবস্থান নিয়ে প্রচুর বিশ্লেষণ পাওয়া যাবে। এ বিষয়ে বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া ও সাম্প্রতিক সন্ত্রাসবাদ নিয়েও অনেক বিশ্লেষণ পাওয়া যাবে।
কিন্তু একটি সাধারণ ঘটনা এই ভয়াবহ ঘটনাগুলোর মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করেছে। এর সূত্র পাওয়া গেছে এক নীরব মুহূর্তে। ৭০ বছর আগে মুক্ত হওয়া নাৎসিদের নির্যাতন শিবির বারজেন-বেলসেন পরিদর্শন করেছেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। এই শিবিরে অবর্ণনীয় নির্যাতনের কারণে ৫০ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে রাজনৈতিক তাত্ত্বিক হানাহ আরেন্ট লিখেছিলেন: ‘যুদ্ধোত্তর ইউরোপের বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের সবচেয়ে মৌলিক প্রশ্ন হবে অশুভের সমস্যা।’ তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, বিশ্বযুদ্ধের প্রাণহানি দেখার পর ইউরোপীয়রা এই ভেবে উদ্বিগ্ন হবে, কতটা বিভীষিকা সম্ভব। কারণ, তারা ইতিমধ্যে দেখে ফেলেছে, তারা কতটা করতে পারে। বাস্তবে হলোকস্টের পরিকল্পনা তাৎক্ষণিকভাবে হয়নি, আবার সব জায়গাতেও তা আসেনি। কিন্তু হলোকস্ট ঘটেছিল।
এই প্রক্রিয়ায় ‘অশুভের সমস্যা’ বিশ্বাসী মানুষের কাছে সুনির্দিষ্ট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। পৃথিবীটা এত বেশি বদমায়েশিতে পরিপূর্ণ হলে কীভাবে দয়ালু ও সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ধারণায় বিশ্বাস রাখা যায়? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসিরা ৬০ লাখ ইহুদিকে হত্যা করেছে, তাদের মধ্যে ১০ লাখের বেশি ছিল শিশু। কিন্তু আজ আমরা যা দেখছি, তাতে এটা নিশ্চিত যে ‘অশুভর সমস্যা’ কোনো ঐতিহাসিক প্রশ্ন নয়; এটা বর্তমানের সমস্যা। আবার সেটা ধর্মবিশ্বাসীদের চ্যালেঞ্জও করে না। নিশ্চিতভাবেই সেটি আমাদের সবাইকে পীড়িত করে। কারণ, আমরা এমন এক বিশ্বের কল্পনা করি, যেখানে এমন নিষ্ঠুরতা ঘটা সম্ভব। তা সে গত সপ্তাহে চালর্সটনে ধর্মবিশ্বাসীদের গুলি করে মারা হোক বা কুয়েতে বোমা মেরে ধর্মবিশ্বাসীদের উড়িয়ে দেওয়া হোক।
আমি জানি, এসব ঘটনার সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যাখ্যা আছে। ঐতিহাসিক জের, ভূরাজনৈতিক শক্তি, স্থানীয় বিষয়—এসবই প্রাসঙ্গিক। কিন্তু এগুলো দিয়ে খুব বেশি দূর যাওয়া যায় না। এগুলো সমস্যার কেন্দ্র, অর্থাৎ এমন বিভীষিকা কীভাবে সম্ভব?—এই প্রশ্ন পর্যন্ত পৌঁছায় না।
পানির তলে ডুবিয়ে মারার দৃষ্টান্তটাই নেওয়া যাক, যা খুব সতর্কতার সঙ্গে সাজানো হয়েছে, সেই দৃশ্য ধারণ করা হয়েছে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। শিয়াবিরোধী গোষ্ঠীগত বিভেদের ব্যাপারটি বুঝলে খুনিদের ঘৃণা ও অভিপ্রায় সম্পর্কে জানা যাবে। ২০০৩ সালে ইরাক আগ্রাসনের মাধ্যমে খুনিদের সক্ষমতা সম্পর্কে বোঝা যাবে, তারা কী মাত্রায় তেমন সহিংসতা করতে পারে। তারা শুধু নিনিভাতেই শাসন করতে পারে, কারণ মার্কিন নেতৃত্বাধীন শক্তিগুলো ইরাক ধ্বংস করে দিয়েছিল। কিন্তু পুরো ব্যাপারটিতে যে নৃশংসতাপ্রীতি রয়েছে, তা এটা দিয়ে বোঝা যাবে না: মানুষ হয়ে তারা কীভাবে অন্য মানুষকে শুধু খুনই করতে পারে তা নয়, কতটা যন্ত্রণা দিয়ে অবমাননাকরভাবে তা করতে পারে।
একটি বিকল্প হলো এটাকে আদৌ বিস্ময়কর মনে না করা। উডি অ্যালেনের ছবি হানাহ অ্যান্ড হার সিস্টারস-এর চরিত্রটির কথা স্মরণ করুন। আরেন্টের ‘অশুভর সমস্যা’-প্রশ্নে তার উত্তর হচ্ছে মানুষ যখন জিজ্ঞেস করে হলোকাস্ট কীভাবে হয়েছে, তখন তারা আসলে ভুল প্রশ্ন করে। “‘মানুষের যা স্বভাব তাতে প্রশ্নটি হবে এমন, ‘হলোকাস্ট কেন প্রায়ই হয় না?’”
এখানে গুরুত্বপূর্ণ কথাটা হলো ‘মানুষের যা স্বভাব’। এমন কথার ভিত্তি হচ্ছে মনুষ্যপ্রকৃতি সম্বন্ধে হতাশাব্যঞ্জক দৃষ্টিভঙ্গি। আমরা যদি বিশ্বাস করি যে মানুষ অন্তর্নিহিতভাবেই অসভ্য, তাহলে আইসিসের তরুণদের ধারাবাহিক নৃশংসতা দেখে বিস্মিত হওয়ার কারণ নেই: খাঁচার মধ্যে মানুষকে পুড়িয়ে মারা, শিশুদের মারা, শিশুদের দিয়ে জোর করে প্রাপ্তবয়স্কদের গুলি করানো, আর নৃশংসতাপ্রীতিকে প্রতিযোগিতামূলক ক্রীড়ায় পরিণত করা।
আবার আরেকভাবে দেখলে বলা যায়, আজকের এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড যারা ঘটাচ্ছে, তারা স্রেফ ভারসাম্যহীন ও অস্বাভাবিক মানুষ। এদের সঙ্গে ৮২ বছর বয়সী পালমিরা সিলভার খুনি নিকোলাস সালভাদরের কোনো পার্থক্য নেই।
অথবা আমরা যদি সিদ্ধান্ত নিই খুনিরা মানসিকভাবে সুস্থ, তাহলে আমরা মানুষের গোষ্ঠীগত মনস্তত্ত্বে নজর দিতে পারি। আমরা নিজেদের স্ট্যানলি মিলগ্রামের হলোকাস্ট-পরবর্তী কাজের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে পারি। তিনি মানুষের আদেশ পালনবিষয়ক যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, তাতে দেখা যায়, মানুষ শুধু যতক্ষণ নির্ভরযোগ্য কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মেনে চলে, ততক্ষণ তাদের মধ্যে অন্যকে প্রচণ্ড নির্যাতন করার প্রবণতা দেখা যায়।
ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাসিম কাসাম আমাকে বলেছিলেন, মানুষের সত্তা অখণ্ড হলে ‘সেখানে সবকিছু একসঙ্গে এঁটে যায়। কিন্তু অন্যদের মধ্যে দেখা যায়, সত্তা নানা ভাঙা ভাঙা অংশে গঠিত, সেগুলো সংগতিপূর্ণ নয়।’ এসব মানুষ জীবনের এক ক্ষেত্রে মানবীয় মানদণ্ড অনুসরণ করতে পারে, আবার আরেক ক্ষেত্রে তা না–ও করতে পারে। অর্থাৎ তাদের সত্তা অখণ্ড নয়।
আইএস ভীতি সৃষ্টি করে, তাতে আবার কাজও হয়। আগামী কিছুদিন অন্তত অবকাশযাপনকারীরা সুছায় যাবেন না। কিন্তু এসব অপরাধ যেমন ভীতি সৃষ্টি করে, তেমনি এগুলো প্রতিক্রিয়াও সৃষ্টি করে। সাবেক জিহাদি ও ইসলামি পণ্ডিত উসামা হাসানের সঙ্গে কথা বললাম। তিনি আইসিসের এই কার্যক্রমে খুবই বিরক্তি প্রকাশ করলেন। তিনি বললেন, ইসলামে মৃতদেহকে অপবিত্র করা নিষিদ্ধ।
তিনি বলেন, সভ্যতার যুদ্ধ চলছে। এই যুদ্ধে বিশ্বের মহান সমাজ ও ধর্মগুলোকে আজ এই স্বল্প পরিসরে সংঘটিত কিন্তু বিদ্বেষপূর্ণ খুনের প্রথা বন্ধ করতে একত্র হতে হবে: খ্রিষ্টধর্ম, ইসলাম ধর্ম, হিন্দুধর্ম, ইহুদিধর্মসহ অন্যদের। এই সংগ্রামকে অশুভর বিরুদ্ধে যুদ্ধ আখ্যা দেওয়ার কোনো মানে হয় না। যুদ্ধটা তেমন প্রকৃতির হলে কখনো জয়লাভ করা যাবে না। অশুভ ব্যাপার আমাদের মধ্যেই আছে, আর দৃশ্যত তা সব সময়ই থাকে। কিন্তু এটা সত্যিই কী, তা বলতে আজ ভয় পেলে চলবে না।
ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন; দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া
জোনাথন ফ্রিডল্যান্ড: দ্য গার্ডিয়ানের নির্বাহী সম্পাদক।

No comments

Powered by Blogger.