‘দুইআনি’ ভাউচারে লন্ডনে যান সিরিয়ায় থাকা মান্নান by ওয়েছ খছরু
পাকিস্তানি শাসন চলছে। তখন ১৯৬২ সাল। ওই সময় ‘দুইআনি’ ভাউচারে লন্ডন যাওয়ার সুযোগ পান সিলেটের মানুষ। লন্ডন যাওয়ার সুর ওঠে সিলেটে। ঘরে ঘরে পড়ে লন্ডন যাওয়ার সাড়া। আর ওই সময় ‘দুইআনি’ ভাউচারে লন্ডন পাড়ি জমিয়েছিলেন ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাঁও গ্রামের আবদুল মান্নান। প্রায় ৫৪ বছর ধরে আবদুল মান্নান বাড়িছাড়া। সবকিছুই তাদের লন্ডনে। দেশে বলতে কেবল আছে পৈতৃক বাড়ি ও আত্মীয়স্বজন। তবে দেশের প্রতি অগাদ টান সব সময়ই ছিল আবদুল মান্নানের। প্রতি দুই বছর অন্তর অন্তর তিনি বাড়ি চলে আসতেন। সঙ্গে নিয়ে আসতেন পরিবারের সদস্যদের। আর এই আবদুল মান্নান পরিবারের আরও ১১ সদস্য নিয়ে চলে গেছেন সিরিয়ার রণাঙ্গনে। সেখানেই উত্তাপ-উত্তেজনায় কাটছে তাদের দিন। আর ওদিকে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠায় কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছেন দেশে থাকা স্বজনরা। লন্ডন প্রবাসী আবদুল মান্নানের পরিবার নিয়ে এখন শুধু ফেঞ্চুগঞ্জই নয় গোটা সিলেট, গোটা দেশে চলছে জল্পনা। কৌতূহলের অন্ত নেই তাদের স্বজনদের ঘিরেও। সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাঁও রেলওয়ে স্টেশন। এই স্টেশন থেকে গ্রামের ভেতর দিয়ে একটি সড়ক গেছে নদীর তীরবর্তী ফেঞ্চুগঞ্জ শহরে। এই শহরে একটু এগোলেই বাম পাশে পড়ে আবদুল মান্নানের বাড়ি। টিলাময় বাড়িতে গাছ-গাছালি ঘেরা। আছে পুকুর, শান বাঁধানো ঘাট। ওই বাড়ি হচ্ছে প্রবাসী আবদুল মান্নানের। আবদুল মান্নানের বয়স প্রায় ৮৫ বছর। বয়সের ভারে তিনি বেশ কাহিল। ৫ ভাইয়ের মধ্যে আবদুুল মান্নান সবার বড়। দ্বিতীয় ভাই এখলাছ মিয়া মারা গেছে অনেক আগে। তৃতীয় ভাই আবদুল লতিফ লুলু মিয়া ও চতুর্থ ভাই লেবুল মিয়া বাড়িতে বসবাস করেন। আর পঞ্চম ভাই আবদুল মতিন এখন পরিবারপরিজন নিয়ে বসবাস করেন যুক্তরাষ্ট্রে। তারা সব ভাইয়েরা এখনও একান্নবর্তী। একসঙ্গে এক চুলোয় রান্না হয় বাড়িতে। ৫০ সদস্যের খাবার-দাবার সব হয় একসঙ্গে। এলাকায় রয়েছে তাদের বিশাল সম্পত্তি। আবদুুল মান্নান দুই বিয়ে করেছেন। বড় স্ত্রী মারা গেছেন। আর ছোট স্ত্রী মিনারা খানমকে নিয়ে তিনি সিরিয়ায় রয়েছেন। বর্তমানে যারা সিরিয়ায় আছেন তারা সবাই মিনারা খানমের সন্তান। বড় স্ত্রীর সন্তানরা লন্ডনে পৃথক বসবাস করেন। মেয়ের জামাই মো. আবুল কাশেম হচ্ছেন আবার বাড়িতে থাকা আবদুুল লতিফের ছেলে। এর ফলে আবদুল লতিফের পরিবারে আরও বেশি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। এ ব্যাপারে মানবজমিন-এর সঙ্গে কথা বলেন দেশে থাকা আবদুল মান্নানের ভাই আবদুুল লতিফ ও লেবুল মিয়া। তারা জানান, যুক্তরাজ্যের বেডফোর্ডশায়ারের লুটন শহরে বসবাসকারী বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মোহাম্মদ আবদুুল মান্নান গত ৯ই এপ্রিল বাংলাদেশে আসেন। সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মাইজগাঁওয়ে গ্রামের বাড়িতে ছেলেমেয়ে, স্ত্রী ও নাতি-নাতনিসহ আবদুল মান্নান ১২ সদস্য নিয়ে প্রায় এক মাস ছুটি কাটিয়ে গত ১১ই মে যুক্তরাজ্যের উদ্দেশে বাংলাদেশ ত্যাগ করেন। ওই পরিবারে আবদুল মান্নান ছাড়াও ছিলেন, তার দ্বিতীয় স্ত্রী মিনারা খাতুন (৫৩), তাদের মেয়ে রাজিয়া খানম (২১), ছেলে মো. জায়েদ হুসাইন (২৫), মোহাম্মদ তৌফিক হুসাইন (১৯), ভাতিজা ও মেয়ের জামাই মো. আবুল কাশেম সাকের (৩১) এবং তার স্ত্রী সাইদা খানম (২৭), মোহাম্মদ সালেহ হুসাইন (২৬) তার স্ত্রী রোশনারা বেগম (২৪) এবং তাদের ৩ সন্তান যাদের বয়স ১ থেকে ১১ বছর। ১৪ই মে তারা লন্ডনে পৌঁছার কথা থাকলেও সেখানে যাননি। তুরস্ক থেকেই তারা নিখোঁজ হয়ে যান। এরপর থেকে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে ও যুক্তরাজ্যে লুটন শহরে অবস্থানকারী তার স্বজনদের মধ্যে উৎকণ্ঠা দেখা দেয়। দেড় মাস নিখোঁজ থাকার পর মাঝামাঝি সময়ে সিরিয়া থেকে দেশে থাকা স্বজনদের ফোন করেছিলেন আমিনা খানম। তিনি ফোনে জানিয়েছিলেন, ‘তারা ভাল আছেন। এবং তারা সিরিয়া চলে গেছেন।’ এরপর দেশে থাকা স্বজনরা তাদের বারবার দেশে কিংবা যুক্তরাজ্য যাওয়ার অনুরোধ করলেও আমিনা খানম কারও কথায় নজর দেননি। আবদুল লতিফ জানান, তাদের মেয়ে রাজিয়া খানম হচ্ছে পুরো ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে। রাজিয়া প্রায় দুই বছর ধরে লন্ডনে আইএসের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ রক্ষা করে। বছর খানেক আগে বিষয়টি নজরে আসে বৃটেনের পুলিশের। তাদের ধারণা মতো জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় রাজিয়াকে। ওই সময় বাসায়ও তল্লাশি চালানো হয়। রাজিয়াকে বারবার এ পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করেন মা আমিনা ও ভাই জাহেদ। বছর খানেক আগে রাজিয়া আইএস-এ যোগ দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে মা ও ভাই তাকে থামায়। বলে, ‘যেতে হলে তারা সবাই এক সঙ্গে যাবে। তবুও রাজিয়াকে একা ছাড়া হবে না।’ তাদের কথায় থামে রাজিয়া। এরপর থেকে রাজিয়াকে থামাতে ক্রমান্বয়ে আইএস-এ আসক্তি বাড়ে মা আমিনা খানম ও ছেলে জাহেদের। এরপর থেকে পরিবারের সব সদস্যও ক্রমান্বয়ে দুর্বল ছিল। কিন্তু দুর্বলতার বিষয়টি সরাসরি প্রকাশ করতো রাজিয়া নিজেই। আবদুল লতিফ জানান, দেশে আসার পর তাদের জন্য বাড়ির একটি ভবন ছেড়ে দেয়া হয়। ওই ভবনের বেশ কয়েকটি কক্ষে তারা এক মাস বসবাস করেন। কিন্তু ওই এক মাস বিশেষ করে মহিলারা নিকট আত্মীয়দের মুখোমুখি হননি। ঘরের মধ্যেই তারা বোরকা পরে থাকতেন। হাত ও পায়ে মোজা ব্যবহার করতেন। এর ফলে চাচাতো ভাইয়েরাও তাদের ঘরের দিকে আসতো না। স্বজনরা জানিয়েছেন, এবার আবদুল মান্নান যখন তাদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দেশে আসছিলেন তখনই হিথ্রোতেই তারা বৃটেন পুলিশের বাধার মুখে পড়েন। তাদের দেখেই সন্দেহ জাগে বৃটেন পুলিশের। এজন্য আসার দিন তাদের টানা ৭ সাত ঘণ্টা বিমানবন্দরে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এ কারণে তারা ফ্লাইটও পায়নি। পরে বৃটেন পুলিশ তাদের একটি হোটেলে রেখে বাড়ি তল্লাশি চালায়। প্রায় তিন দিন পর বৃটেন পুলিশ তাদের বাংলাদেশ আসতে দেয়। বাংলাদেশে তারা আসেন তুর্কি ফ্লাইটে ইস্তাম্বুল হয়ে। যাওয়ার সময় তুর্কি ফ্লাইটে তারা তুরস্ক যান। এবং সেখান থেকে সিরিয়া চলে গেছেন। আর সর্বশেষ তারা সিরিয়া থেকে জানান দিয়েছেন সেখানে অবস্থানের কথা।
No comments