এরশাদ থাকার পক্ষে রওশনের না
সরকারে
থাকা না থাকা প্রশ্নে আবার নতুন মেরুকরণ দেখা দিয়েছে জাতীয় পার্টিতে। এ
নিয়ে পার্টির শীর্ষ দুই নেতা এরশাদ ও তার স্ত্রী বিরোধী দলের নেতা রওশন
এরশাদ এখন দু’মেরুতে অবস্থান নিয়েছেন। তবে তাদের এবারের অবস্থান আগের
সিদ্ধান্তের উল্টো। বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে নানা আলোচনা-সমালোচনা চললেও
রোববার হঠাৎ করেই তৎপর হয়ে উঠেন জাপার নেতারা। সংসদ অধিবেশন চলাকালেই
রোববার বিরোধী দলের নেতা বেগম রওশন এরশাদ এ নিযে দফায় দফায় বৈঠক করেন। তিনি
প্রথম দফায় আওয়ামী লীগের দুই সিনিয়র নেতা আমির হোসেন আমু ও তোফায়েল
আহমেদের সাথে বৈঠক করেন। এর পরই তিনি বৈঠক করেন দলীয় সংসদ সদস্যদের সঙ্গে।
যদিও এ বিষয়ে সরাসরি কেউ মুখ খুলতে রাজি হননি। জাপা সূত্র জানায়, বর্তমান
সরকার গঠনের শুরুতে এরশাদ চেয়েছিলেন জাপার নেতারা মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে
আসুন। আর তখন রওশন চেয়েছিলেন তারা মন্ত্রিসভায় থাকুন। এক বছর পরে পুরো
দৃশ্যপটই পাল্টে গেছে। এখন এরশাদ নিজেই চান তার দলের নেতাদের মন্ত্রিসভায়
থাকার পাশাপাশি আরো দু’জনকে মন্ত্রী করা হোক। আর রওশন চান জাপাকে
সত্যিকারের বিরোধী দলের ভূমিকা পালনের জন্য দলীয় মন্ত্রীদের মন্ত্রিসভা
থেকে বের করে আনতে। এমন এক জটিল আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে এরশাদের জাতীয়
পার্টি। ফলে এরশাদ রওশনের মধ্যকার নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব আবারো প্রকাশ্যে
মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এ নিয়ে দলে নতুন করে সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে বলে পার্টির
একাধিক সিনিয়র নেতা নিশ্চিত করেছেন। আর এরই অংশ হিসেবে রোববার সংসদ ভবনে
আওয়ামী লীগের দুই জ্যেষ্ঠ নেতা আমির হোসেন আমু ও তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে
বৈঠক করে নিজের এই চাওয়ার কথা জানিয়েছেন রওশন। আর এরশাদ এখন শুধু
মন্ত্রিসভায় থাকার পক্ষেই নন, তিনি মন্ত্রিসভায় জাপার সদস্য সংখ্যা তিন
থেকে বাড়িয়ে পাঁচ করতে তৎপর হয়ে উঠেছেন। তিনি পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য
ছোটভাই জিএম কাদের ও দলের মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুকেও মন্ত্রী করতে
প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি পাঠিয়েছেন। রোববার সংসদের অধিবেশন চলাকালেই সংসদ ভবনে
বিরোধী দলের লবিতে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল
আহমেদের সঙ্গে বৈঠক করেন রওশন । এই বৈঠকে জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী
ফিরোজ রশীদ ও বিরোধী দলীয় নেতার রাজনৈতিক সচিব ফখরুল ইমামসহ দলটির আরও
দু’তিনজন সংসদ সদস্য উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের
এই দুই সিনিয়র নেতাকে রওশন বলেছেন ‘আমরা (জাপা) শুধু বিরোধী দল হিসেবেই
থাকতে চাই। সরকারে থাকা আমাদের ঠিক হচ্ছে না। দেশি-বিদেশি অনেকের সঙ্গে
আমার আলাপ হয়েছে, কেউ বিষয়টিকে ভালোভাবে দেখছে না। আমাদের তো তিনজন
মন্ত্রিসভায় রয়েছেন। আপনারা (সরকার) তাদের পদত্যাগ করতে বলুন। তাহলে বিষয়টি
আপনাদের (সরকারের) জন্যও ভালো হবে, আমাদের জন্যও ভালো হবে। আপনারা
চিন্তা-ভাবনা করুন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও কথা বলুন। আমরাও আমাদের দলের
নেতাদের সঙ্গে কথা বলবো। আমাদের দলও চায় মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে আসতে।”
এসময় রওশনকে আমির হোসেন আমু ও তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, “সরকারের এই পর্যায়ে
এসে মন্ত্রিসভা থেকে জাপার বের হয়ে যাওয়াটা রাজনৈতিকভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত
হবে বলে মনে হয় না। একথা ঠিক, বিষয়টি নিয়ে শুরুতে কিছু কথাবার্তা ছিল,
বিতর্ক ছিল, অনেকে সমালোচনা করেছেন। কিন্তু এতদিনে বিষয়টি স্বাভাবিক হয়ে
গেছে। সুতরাং এখন মন্ত্রিসভা থেকে বের হয়ে আসার প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে
করছি না।” আওয়ামী লীগের এই দুই নেতা রওশনকে এও বলেছেন, মন্ত্রিসভা থেকে
জাপার বের হয়ে আসার সময়ও এখনও আসেনি। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী নিজেও নাকি এখন
চাচ্ছেন না জাপা এই মূহুর্তে মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে যাক। ফলে বিষয়টি নিয়ে
আরও চিন্তা-ভাবনা করতে তারা রওশনকে অনুরোধ করেছেন বলে বৈঠক সূত্রের দাবি।
বৈঠকের বিষয়টি জাপার সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ নিশ্চিত করলেও আলোচনার
বিষয়ে কিছু জানাতে রাজি হননি। মন্ত্রিসভায় জাপার থাকা না থাকাসহ অন্যান্য
প্রসঙ্গে আলোচনার বিষয়ে বৈঠকে উপস্থিত থাকা জাপার আরেক সংসদ সদস্য ফখরুল
ইমামের কাছে জানতে চাইলে তিনি ‘হাঁ’ কিংবা ‘না’ কোনো মন্তব্য না করে বলেন
উনারা দু’জন সরকারের সিনিয়র মন্ত্রী ও দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা। উনাদের
সঙ্গে অনেক বিষয়েই আলোচনা হতে পারে। বৈঠক সূত্র জানায়, বৈঠকে রওশন দলীয়
নেতা-কর্মীদের কিছু ক্ষোভের কথাও জানান আমু-তোফায়েলকে। তিনি জানান, যারা
এমপি-মন্ত্রী হতে পারেননি, জাপার এমন নেতাদের সরকারি কিছু সুযোগ-সুবিধা
দেয়ার জন্য আগে প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু সরকার সে বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ
নিচ্ছে না। এ নিয়ে জাপার ভেতরে বেশ অসন্তোষ রয়েছে। আওয়ামী লীগের এই দুই
নেতাকে রওশন বলেছেন, দলের কয়েকজনকে সরকার বিভিন্ন সরকারি ব্যাংকের পরিচালক
করতে পারেন, বিআরটিসিসহ সরকারি ও আধা-সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে
চেয়ারম্যান পদেও আমাদের দলের নেতাদের নিয়োগ দিতে পারে। কিন্তু সরকার তা
করেনি। এছাড়াও সরকারি বিভিন্ন নিয়োগ এবং কার্যক্রমে আওয়ামী লীগসহ অন্যরা
বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পেলেও জাপার নেতা-কর্মীরা বঞ্চিত হচ্ছে বলেও অভিযোগ
জানান তিনি। আমু-তোফায়েলের সঙ্গে রওশনের যখন এই বৈঠক চলছিল, তখন সংসদ
অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৈঠক শেষে তোফায়েল
আহমেদকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার পাশের আসনে বসে দীর্ঘক্ষণ কথা বলতে দেখা
গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, রওশনের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়বস্তু নিয়েই
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন তোফায়েল আহমেদ। এদিকে এই বৈঠক শেষে রওশন
এরশাদ সংসদ ভবনে তার কার্যালয়ে দলের বেশ কয়েক জন সংসদ সদস্যকে নিয়ে প্রায়
আধা ঘণ্টা বৈঠক করেছেন। এই বৈঠকে উপস্থিত থাকা জাপার একাধিক সংসদ সদস্য
জানান, আমির হোসেন আমু ও তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে বৈঠকের আলোচনার বিষয়বস্তু
নিয়ে দলীয় এমপিদের সঙ্গে আলাপ করেন রওশন। সেখানে এমপিদের কাছে নিজ
অবস্থানের পক্ষে যুক্তি ব্যাখ্যা করেন তিনি। এমপিরাও নিজেদের মতামত দেন।
বেশিরভাগ এমপি রওশনের অবস্থানের পক্ষে বললেও কয়েকজন বিষয়টি নিয়ে আরও
গভীরভাবে ভাবার পরামর্শ দেন। প্রসঙ্গত, গত বছরের মাঝামাঝি এবং দুই মাস আগেও
এরশাদ বলেছিলেন-সত্যিকারের বিরোধী দল হিসেবে ভূমিকা রাখতে হলে জাপাকে
মন্ত্রিসভা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তখন জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং পল্লী
উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা বলেছিলেন ‘স্যার (এরশাদ)
নিজেই তো পূর্ণমন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত, তার স্ত্রীও
(রওশন) পূর্ণমন্ত্রীর মর্যাদায় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা। কাজেই আমাদের
মন্ত্রিসভা ছাড়ার কথা বলার আগে এরশাদেরই উচিত মন্ত্রীত্ব ছাড়া।” প্রায়
অভিন্ন কথা বলেছিলেন জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান
প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নুও। মন্ত্রিসভায় থাকা জাপার আরেক সদস্য
পানিসম্পদ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেছেন, “মন্ত্রিসভা
থেকে আমাদের পদত্যাগের বিষয়ে দলের কোনো ফোরামে সিদ্ধান্ত হয়নি।
প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের দায়িত্ব থেকে এরশাদকে ‘মুক্তি’ দেওয়ার জন্য গত
১৬ জুন কাজী ফিরোজ রশীদও জোর দাবি জানিয়েছিলেন। রওশন এখন মন্ত্রিসভায় থাকার
বিরোধিতা করলেও চলতি দশম সংসদের প্রথম অধিবেশনে প্রথম বক্তৃতায় তিনি
বলেছিলেন অনেকে মন্ত্রিসভায় জাপার থাকা নিয়ে সমালোচনা করছেন। এটা একটি নিউ
কনসেপ্ট (নতুন ধারণা)। যেমন আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি ছিল না, তখন
সেটিও আমাদের কাছে নিউ কনসেপ্ট ছিল।
No comments