চালকবিহীন ট্রেন এবং by সাজেদুল হক

আনোয়ার হোসেনকে অভিনন্দন। তার বুদ্ধিমত্তা আর প্রচেষ্টার ফলে রক্ষা পেয়েছে ফরিদপুর এক্সপ্রেস। চালকবিহীন ট্রেনটি ২৬ কিলোমিটার উল্টোপথে চলার পর তা থামাতে সক্ষম হন তিনি। একদিকে চালক ও তার সহকারীর খামখেয়ালিপনা। অন্যদিকে, টিকিট পরীক্ষক আনোয়ার হোসেনের সাহস ও বুদ্ধিমত্তা। একশ’র মতো যাত্রীর বেঁচে যাওয়া।
এ নিয়ে আলোচনা চলছে সর্বত্র। বিস্মিত সবাই। চালক ছাড়া কিভাবে উল্টোদিকে চলতে পারে ট্রেন? এর চেয়েও বড় প্রশ্ন আলোচিত হচ্ছে বাংলাদেশে এখন আর কী কী জিনিস এমন চালক ছাড়া উল্টোপথে চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির  রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক আলী রীয়াজ যেমনটা লিখেছেন, ‘একটি ট্রেন চালকবিহীন অবস্থায় রাজবাড়ী থেকে ফরিদপুরের দিকে না গিয়ে পেছনের দিকে কুষ্টিয়ার দিকে যাত্রা শুরু করলে ২৬ কিলোমিটার পথ যাবার পর ট্রেনটিকে থামানো গেছে। আর কী কী জিনিস চালকবিহীন অবস্থায় উল্টোপথে যাচ্ছে কে জানে। যাত্রীরা টের পাচ্ছেন কিনা তাই বা বুঝি কী করে?’
বাংলাদেশে কী কী জিনিস এমন উল্টো দিকে চলেছে, চলছে তার ফর্দ তৈরি করা কঠিন। বিশ্লেষকরা একটি ব্যাপারে একমত মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে গত চার দশকে কোন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেনি। এসব প্রতিষ্ঠান ক্রমশ উল্টোদিকেই যাত্রা করেছে। আর প্রতিষ্ঠানহীনতার কারণেই রাজনীতিতে তৈরি হয়েছে অবিশ্বাস আর হিংসা। দুই দশক আগে সংসদীয় গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করেছিল দেশ। সে যাত্রা মসৃণ ছিল না। কিন্তু গণতন্ত্র হয়তো উল্টোপথের যাত্রীও ছিল না। এখনকার অবস্থা অবশ্য বলা সম্ভব নয়। কিন্তু উল্টোপথের ট্রেন থামানোর জন্য আনোয়ার হোসেনের মতো কেউ কি আছেন? নাকি ট্রেনটি কিলোমিটারের পর কিলোমিটার উল্টোপথেই চলতে থাকবে?
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এখানে আনোয়ার হোসেনের মতো কেউ নেই। বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে বসে উইলিয়াম বি মাইলামও বুঝতে পারছেন, বাংলাদেশ ক্রমশ একটি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে। আর গত তিন মাসে বাংলাদেশে বিরোধী শক্তির আরও দুর্বল হয়ে পড়ার চিত্র স্পষ্ট হচ্ছে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০দলীয় জোটেও টানাপড়েন বেড়েছে। পর্দার আড়ালে বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে জামায়াতের। বিএনপির নেয়া সর্বশেষ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলোতে জামায়াতের কোন অংশীদারিত্ব নেই বলে দলটির একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। পশ্চিমা দুনিয়ার একটি অংশ এরআগে বিএনপিকে জামায়াত ত্যাগের পরামর্শ দিয়েছিল। সরকারও জামায়াত ত্যাগ করার জন্য নানাভাবে বিএনপির ওপর চাপ প্রয়োগ করে আসছে। এ অবস্থায় বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া বারবার বলে আসছিলেন, জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির কোন আদর্শিক মিল নেই। এটি একটি নির্বাচনী জোট। জামায়াতের সঙ্গে সরকারের ভেতরে ভেতরে সমঝোতা নিয়েও এরআগে একাধিকবার বিএনপির পক্ষ থেকে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছিল। সর্বশেষ সরকারবিরোধী আন্দোলনে জামায়াত পুরো শক্তি নিয়ে রাস্তায় ছিল না বলেও মনে করেন বিএনপির কেউ কেউ। তবে এখন জামায়াতের অনেকে মনে করেন, সরকারের সঙ্গে বিএনপির এক ধরনের সমঝোতা হয়েছে। যেখানে জামায়াতকে পুরোপুরি অন্ধকারে রাখা হয়েছে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থী নিয়েও দল দু’টির মধ্যে কোন ধরনের আলোচনা হয়নি।
সর্বশেষ মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর জামায়াতের অভ্যন্তরেও নতুন করে নানা আলোচনা চলছে। কামারুজ্জামান একাধিকবার সংস্কারের জন্য জামায়াতকে পরামর্শ দিলেও দলটি সে পরামর্শ গ্রহণ করেনি। অনেকে তার বিরুদ্ধে দলভাঙার চেষ্টার অভিযোগও এনেছিলেন। কিন্তু জামায়াতের তরুণ নেতৃত্বের ওপর কামারুজ্জামানের একধরনের প্রভাব রয়েছে। দলটির ওই অংশ এখন মনে করে, বিএনপির সঙ্গে জোট করে জামায়াতের আদতে কোন লাভ হচ্ছে না। এমনকি জাতিসংঘ থেকেও জামায়াতের ব্যাপারে বিএনপি নীরব ভূমিকা পালন করছে। সব কুল রক্ষা করতে গিয়ে জামায়াত কোন কুলই রক্ষা করতে পারছে না বলে মনে করেন ওই অংশের নেতারা। এ অবস্থায় সামনের দিনগুলোতে জামায়াতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং বিএনপির সঙ্গে দলটির সম্পর্ক আরও জটিল হবে বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা।
সাজেদুল হক
১৩ই এপ্রিল ২০১৫
ঢাকা

No comments

Powered by Blogger.