সংখ্যালঘু ও আদিবাসী: উচ্ছেদের ঘণ্টাধ্বনি by মিজানুর রহমান খান
গণতন্ত্র
‘রক্ষা’ কিংবা গণতন্ত্র ‘উদ্ধার’ প্রচেষ্টার আড়ালে দেশে সংখ্যালঘুদের
মধ্যে যারা সবচেয়ে অনগ্রসর অংশের মানুষ, তারা বাস্তুভিটা হারাচ্ছে। এর
সর্বশেষ শিকার বরগুনার ১৪টি দলিত হিন্দু পরিবার। এর আগে খাগড়াছড়ির
বাবুছড়ায় ২১টি পাহাড়ি পরিবার উচ্ছেদের শিকার হয়। সেখানে বিজিবির নতুন
ব্যাটালিয়ন প্রতিষ্ঠার জন্য পরিচালিত উচ্ছেদ অভিযানটি ছিল অসাংবিধানিক ও
বেআইনি।
বাবুছড়ার ২১টি চাকমা পরিবার, দিনাজপুরের পার্বতীপুরের ৬৫টি সাঁওতাল পরিবার ও বরগুনার ১৪টি হিন্দু পরিবার আক্রান্ত হওয়ার একটা অভিন্ন কারণ হলো ভূমি। এখানে আওয়ামী লীগ-বিএনপি ভাই ভাই, উভয়ের প্রতিপক্ষ হলো ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও আদিবাসী। এ বিষয়ে অর্ধডজন সাংসদ নিয়ে গঠিত সংসদীয় ককাসের দুটি প্রতিবেদন আমাকে আশ্বস্ত করেছে।
অন্তত তাদের পর্যবেক্ষণ পুলিশি বা সরকারি সাফাই বক্তব্য থেকে আলাদা। সত্য উদ্ঘাটনের জন্য ককাসকে ধন্যবাদ জানাই।
পার্বতীপুরের সাঁওতাল গ্রাম চিরাকুটায় যেটা লক্ষণীয়, চিরচেনা ভূমিবিরোধ অতি দ্রুত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় রূপান্তরিত হলো। তিরের আঘাতে এক বাঙালি নিহত হলে সুযোগসন্ধানী কিছু বাঙালি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়ে গ্রামটাই পুড়িয়ে খাক করে দিয়েছে। ২৪ জানুয়ারি ২০১৫ চিরাকুটা গ্রামের ৬৫টি সাঁওতাল পরিবারের ভিটেমাটিতে ধ্বংসযজ্ঞ চলেছে। প্রায় আড়াই মাস পেরোনোর পর জানা গেল আত্মসমর্পণ করা ১৯ আদিবাসী অবিরাম কারাবাস করছেন। শুধু কিশোর এন্টা লুইস টুডু এসএসসি পরীক্ষার্থী হওয়ায় জামিন পেয়েছে। আর বাঙালি লুণ্ঠনকারীর দল কোথায়?
আমাদের দিনাজপুর সংবাদদাতা আসাদুল্লাহ জানালেন, ৭৪ আসামির বিপরীতে গ্রেপ্তার হওয়া ১০ বাঙালির সবাই জামিনে। তার চেয়েও বড় কথা, তারা বড়দল গ্রামে থাকা আদিবাসীদের বিরোধপূর্ণ প্রায় ৪২ একর জমিতে চাষাবাদ চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ ওই এলাকারই সাংসদ ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান আদিবাসীদের আশ্বস্ত করেছিলেন যে আদালতে নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এই জমি আদিবাসীদের ভোগদখলে থাকবে।
৬ এপ্রিল হাইকোর্টে দেওয়া আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তদন্ত প্রতিবেদন দেখাচ্ছে, বরগুনার চন্দনতলার গ্রামের মানুষের পরিচয় কেবল হিন্দু নয়, ওরা জেলে, ধোপা, কাঠমিস্ত্রি, ওরা ভারতীয় সংবিধানের গুরু ড. আম্বেদকার চিহ্নিত কাস্ট বা দলিত। চন্দনতলার দলিতদের রাষ্ট্র যদি কমিশন বসিয়ে কাগজপত্র দেখে তাদের জমিজমা চিহ্নিত করে না দেয়, তাহলে কিছুদিন বাদে সেখানে একটি পরিবারকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
মনে হচ্ছে বাস্তুভিটা থেকে উপড়াতে চন্দনতলায় নারী নিগ্রহকে পদ্ধতিগত হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তাই বরগুনা প্রশাসনের তরফে নয়টি পরিবারের জন্য নতুন বাড়িঘর তুলে পুনর্বাসন করার খবর আমাদের আশ্বস্ত করে না। গত দুই বছরে সেখানে তিন দফায় ১৪টি দলিত পরিবার নির্যাতনের মুখে বাস্তুচ্যুত হওয়ার সংকটে পড়ে।
আমি বরগুনার ঘটনায় ৬ এপ্রিলে হাইকোর্টের দেওয়া বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশকে গুরুত্ব দিচ্ছি। কারণ, আসকের আইনজীবী জেড আই খান আদালতে শুনানিকালে (যা তিনি আমাকে বলেছেন) অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে দুটি দলিত মেয়ে তাদের মা-বাবার, এমনকি অর্ধশতাধিক মানুষের সামনে ধর্ষিত হওয়ার যে ভয়ংকর তথ্য তুলে ধরেছেন, তার সত্যাসত্য যাচাই হওয়া দরকার। কিছুদিন আগে চন্দনতলাতেই আরেক দলিত গৃহবধূকে তুলে নিয়ে গণধর্ষণ শেষে ফিরিয়ে দেওয়ার একটি অভিযোগও মিডিয়ায় আসেনি।
সংখ্যালঘুদের নির্যাতিত হওয়ার এ রকম কত খবর চাপা পড়ে থাকে। দেশের ৭৫ লাখ দলিত মানুষের নিপীড়িত হওয়ার ঘটনা খুব কমই নজরে আসে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরে নির্বাচিত আদিবাসী প্রতিনিধি বিচিত্রা তিরকিতকে ধর্ষণের যে অভিযোগ, তার পেছনেও কথিত ভূমিদস্যুতা। ধর্ষণ প্রমাণিত হয়নি, এ কথা স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সংসদে উল্লেখ করেও বলেছিলেন, তিনি নির্যাতিত হয়েছিলেন। কিন্তু তাতে লাভ কী?
ককাস সদস্য ফজলে হোসেন বাদশার ভাষায়, ‘আনন্দের কথা হলো আসামিরা জামিনে বেরিয়ে গেছেন।’ খাগড়াছড়ির ২১ পরিবারের ৮৪ জন উদ্বাস্তু প্রায় ১০ মাস ধরে (অনেকে ২২ দিন করে জেল খেটেছেন) একটি পরিত্যক্ত কৃষি অফিসে আছেন। খাগড়াছড়ির ডিসি ওয়াহিদুজ্জামান গত বুধবার জানালেন, অধিগ্রহণ করা ২৯ একর জমির মধ্যে মাত্র দুই একর দুই ব্যক্তির। তাঁরা বরাদ্দ করা টাকা নেবেন না, জমি ফেরত নেবেন। ককাসের প্রতিবেদনে দেখি, ধর্ষণ ও ধ্বংসযজ্ঞের পটভূমিতে তাঁরা শরণার্থী হয়ে ভারতে গিয়েছিলেন, পার্বত্য চুক্তির পরে তাঁরা ফিরে আসেন।
ওই উচ্ছেদের ২৮ বছর ও পার্বত্য চুক্তির ১৭ বছর পরে ‘মাতৃভূমি’ কিংবা ‘বাস্তুভিটা’ থেকে দ্বিতীয় (কাপ্তাই বাঁধের কারণে ১৯৬০ সালের উচ্ছেদ ধরলে তৃতীয়) দফায় এই চাকমারা উচ্ছেদের শিকার হলো।
জিজ্ঞাসার জবাবে খাগড়াছড়ির ডিসি জানান, ককাস প্রতিবেদনের কথা তাঁর জানা নেই। তাঁর কথায়, ‘হাইকোর্টের একটি রুল অকার্যকর হয়ে গেছে। কারণ, সরকার আদালতের আদেশ মেনেই তর্কিত তফসিলের জমি বাদ দিয়ে অধিগ্রহণ করেছে। হাইকোর্টের আরেক আদেশে গাছগাছালি ও বসতবাড়ির ক্ষতিপূরণ বিষয়ে রুল ছিল। কিন্তু তাঁরা সে টাকাও নেবেন না।’
এই রাষ্ট্র পেট্রলবোমায় দগ্ধদের ক্ষত মুছতে মাথাপিছু ১০ লাখ টাকা, আর বাস্তুভিটা থেকে চিরতরে উচ্ছেদের ক্ষত শুকাতে মাথাপিছু ১২ হাজার ৬৯৮ টাকা ধার্য করছে। এটা এই অর্থে যে ৮৪ জনের বিপরীতে জেলা প্রশাসন গাছগাছালি ও বসতবাড়ির ক্ষতিপূরণ পাওয়ার যোগ্য মনে করেছে মাত্র আটজনকে।
জমিজমার কাগজপত্র না রাখা আদিবাসী ঐতিহ্য। এর সুযোগে খাগড়াছড়ি প্রশাসন মাত্র দুই ব্যক্তির নামে ২ একর ২০ শতাংশ জমির প্রকৃত মালিকানা আবিষ্কার করেছে। বাকি ২৭ একর জমিই নাকি খাস। রাষ্ট্রের হৃদয়হীনতার গল্প এখানেই শেষ নয়। ১ শতক নিকৃষ্ট জমিও সেখানে পাঁচ হাজার টাকার কমে বিকোয় না। অথচ শতকের দাম মাত্র ৬২০ টাকা ধরে দুজনকে দুই একরের দাম ১ লাখ ৩৬ হাজার ৫৬৯ টাকা নিতে সাধছে।
এই গুমর ফাঁস না করে প্রশাসন সংবাদ সম্মেলন করে বলছে, ‘ওরা টাকা নেবে না। জমি নেবে!’ এরপরও দেশ শাসনে ‘সামাজিক সুবিচার’ বলতে কি কিছু থাকে?
ককাস প্রতিবেদনে বাবুছড়া ভাইস চেয়ারম্যানের বরাতে বলা আছে: ‘যে মেয়েগুলোকে ধরে নিয়ে গেছে তাদের একজনের গায়ের কাপড় টেনে ছিঁড়ে ফেলেছে। রাইফেল দিয়ে পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দেওয়া হয়েছে।’ আর বিজিবির দাবি, তারা ‘৬ বিজিবি ও ১ পুলিশ সদস্যকে আহত করেছে এবং বিজিবির ২টি রাইফেল ভেঙে ফেলেছে’।
অনগ্রসর মানুষ বিশেষ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাস্তুভিটা থেকে অপসারণে আওয়ামী লীগ-বিএনপি কেউ পিছিয়ে নেই। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর যে নির্যাতন হয়েছে, তার বিচার আজও আওয়ামী লীগ সরকার করেনি। আমরাও মনে করি, এই ব্যাধি আর শুধু প্রশাসনিক পদক্ষেপ দিয়ে সারানোর নয়, কারণ এটা সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। বরগুনার ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া প্রধান পান্ডা রশীদ ২০০১ সালে বিএনপি করতেন, পরে আওয়ামী লীগে নাম লেখান। রশীদের রাহুগ্রাস থেকে বাঁচতে ভুক্তভোগীরা গত বছর শাসকদলীয় সাংসদ ধীরেন্দ্র নাথ শম্ভুর কাছে গিয়েছিলেন। শম্ভু তখন নাকি বলেছিলেন, ‘আমি তো শুনেছি ও (রশীদ) ভালো হয়ে গেছে। মানুষকে ভালো হওয়ার সুযোগ দেওয়া দরকার।’ অতঃপর জামিনে বেরিয়ে রশীদ চন্দনতলায় তাণ্ডব চালান।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানের আশঙ্কা: ‘রাষ্ট্র এখনই যথাযথ ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হলে আগামী ২০ বছরে বাংলাদেশ হিন্দুশূন্য হবে।’ জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উল্লিখিত ১৪, ২১ ও ৬৫ পরিবারের উচ্ছেদের ঘণ্টাধ্বনি কী নির্দেশ করছে? ১৯৫১ সালে থাকা ২৩ দশমিক ৭৮ শতাংশের সংখ্যালঘু হারটা ২০১১ তে ৯ দশমিক ৭ শতাংশে নেমেছে। কেউ কেউ এই সমস্যাকে কেবলই ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক মোড়কে দেখার প্রয়াস পাচ্ছেন। আসলে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় গণতান্ত্রিক অনুশীলনের ঘাটতি গভীরতর হওয়া এবং সেই সুড়ঙ্গপথে ধেয়ে আসা অজগর ধর্মবর্ণ-নির্বিশেষে সমাজের দুর্বলতরদের গিলতে চাইছে। আর চূড়ান্তভাবে তা আইনের শাসনপ্রত্যাশী সংখ্যাগুরু বাঙালির স্বাভাবিক জীবনেও তার অভিঘাত পড়ছে।
অপরাজনীতির কারণে দেশে এখন প্রায় হিরের চেয়েও দামি হলো জমি, আর সবচেয়ে সস্তা হলো মানুষের প্রাণ। শাসক ও ধনিক গোষ্ঠীর লুটপাটকে বৈধ করার যে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এখন গণতন্ত্রের নামে চেপে বসেছে, সেটাই জমি ও জীবনের দরদাম ঠিক করছে। ওপরে উল্লেখিত প্রতিটি ঘটনার অভিন্ন বৈশিষ্ট্য হলো সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর দুর্বৃত্ত অংশ দলিতদের জমি লুটে নিচ্ছে। তাহলে দলিত ও অনগ্রসররা কোথায় যাবে?
আমি গত ২৮ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরসি মজুমদার হলে জাতপ্রথা বিলোপবিষয়ক একটি সেমিনারে অংশ নিই। সেখানে আমি দলিত ও আদিবাসীদের বাঁচাতে ভারতীয় সাংবিধানিক ব্যবস্থা অনুসরণের কথা বলেছি। বাহাত্তরের ভুলের পরে পাহাড়িদের যে স্বীকৃতি সম্প্রতি সংবিধানে এসেছে, তা অপ্রতুল।
গান্ধীজির সঙ্গে ১৯৩১ সালে ভারতীয় সংবিধানের মূল রূপকার ও গণপরিষদের সভাপতি ড. আম্বেদকারের প্রথম দেখা। গান্ধীজি বললেন, আপনি কংগ্রেসের প্রতি কেন এত রুষ্ট? আম্বেদকার বললেন, আমি অস্পৃশ্য। আমার তো কোনো মাতৃভূমি নেই। আম্বেদকারের সেই চেতনার মতো বাংলাদেশি সংখ্যালঘু ও দলিতদেরও যেন মাতৃভূমি নেই। সংসদীয় ককাসও আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি চায়। ভারত ও পাকিস্তানের মতো দলিত ও আদিবাসীকে সংসদে অনতে হবে।
আম্বেদকারের পথে স্পষ্ট বিধান করতে হবে: উপজাতি, তফসিলি জাতিসহ অনগ্রসর অংশের জন্য একজন মন্ত্রী থাকবেন। এই রকম রক্ষাকবচ পাকিস্তানে না হলেও ভারতসহ বিভিন্ন দেশে সুফল দিয়েছে।
আদিবাসীবিষয়ক সংসদীয় ককাসের কোনো সুপারিশের বাস্তবায়ন ঘটেনি বলে ককাস সদস্য সাংসদ ফজলে হোসেন বাদশা নিশ্চিত করেন। তাঁর সঙ্গে কথোপকথনের পর আমার আর সন্দেহ রইল না যে পেশিশক্তিধারী বাঙালি এখন দলিত ও অনগ্রসর শ্রেণির জীবনে ভূমিজঙ্গি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
বরগুনার যে এলাকাটিতে তাণ্ডব ঘটল, ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত সেই আসনের সাংসদ হতেন রাখাইনরা। নির্বাচনী রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় রাখাইনদের ধরে রাখলে হয়তো তারা বিলুপ্তির পথে যেত না। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনেও ৩০৯টি আসনের মধ্যে দলিত ও উপজাতির জন্য ৩৭টি আসন সংরক্ষিত ছিল। আমাদের মগজে এসব ঢোকে না। তাই দেখার বিষয়, ধর্মনিরপেক্ষতার বুলিটা রেখে রাষ্ট্রধর্মটা জিইয়ে রাখার আসল বার্তা পাঠে মুসলিম ভূমিজঙ্গিদের কোনো অসুবিধা হয়নি।
ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও আদিবাসী ক্রমেই একাত্তরপূর্ব বাঙালি, আর বাঙালিরা সেই বলদর্পী পাঞ্জাবির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। অথচ দেশটা এ জন্য স্বাধীন হয়নি।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com
বাবুছড়ার ২১টি চাকমা পরিবার, দিনাজপুরের পার্বতীপুরের ৬৫টি সাঁওতাল পরিবার ও বরগুনার ১৪টি হিন্দু পরিবার আক্রান্ত হওয়ার একটা অভিন্ন কারণ হলো ভূমি। এখানে আওয়ামী লীগ-বিএনপি ভাই ভাই, উভয়ের প্রতিপক্ষ হলো ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও আদিবাসী। এ বিষয়ে অর্ধডজন সাংসদ নিয়ে গঠিত সংসদীয় ককাসের দুটি প্রতিবেদন আমাকে আশ্বস্ত করেছে।
অন্তত তাদের পর্যবেক্ষণ পুলিশি বা সরকারি সাফাই বক্তব্য থেকে আলাদা। সত্য উদ্ঘাটনের জন্য ককাসকে ধন্যবাদ জানাই।
পার্বতীপুরের সাঁওতাল গ্রাম চিরাকুটায় যেটা লক্ষণীয়, চিরচেনা ভূমিবিরোধ অতি দ্রুত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় রূপান্তরিত হলো। তিরের আঘাতে এক বাঙালি নিহত হলে সুযোগসন্ধানী কিছু বাঙালি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়ে গ্রামটাই পুড়িয়ে খাক করে দিয়েছে। ২৪ জানুয়ারি ২০১৫ চিরাকুটা গ্রামের ৬৫টি সাঁওতাল পরিবারের ভিটেমাটিতে ধ্বংসযজ্ঞ চলেছে। প্রায় আড়াই মাস পেরোনোর পর জানা গেল আত্মসমর্পণ করা ১৯ আদিবাসী অবিরাম কারাবাস করছেন। শুধু কিশোর এন্টা লুইস টুডু এসএসসি পরীক্ষার্থী হওয়ায় জামিন পেয়েছে। আর বাঙালি লুণ্ঠনকারীর দল কোথায়?
আমাদের দিনাজপুর সংবাদদাতা আসাদুল্লাহ জানালেন, ৭৪ আসামির বিপরীতে গ্রেপ্তার হওয়া ১০ বাঙালির সবাই জামিনে। তার চেয়েও বড় কথা, তারা বড়দল গ্রামে থাকা আদিবাসীদের বিরোধপূর্ণ প্রায় ৪২ একর জমিতে চাষাবাদ চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ ওই এলাকারই সাংসদ ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান আদিবাসীদের আশ্বস্ত করেছিলেন যে আদালতে নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এই জমি আদিবাসীদের ভোগদখলে থাকবে।
৬ এপ্রিল হাইকোর্টে দেওয়া আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তদন্ত প্রতিবেদন দেখাচ্ছে, বরগুনার চন্দনতলার গ্রামের মানুষের পরিচয় কেবল হিন্দু নয়, ওরা জেলে, ধোপা, কাঠমিস্ত্রি, ওরা ভারতীয় সংবিধানের গুরু ড. আম্বেদকার চিহ্নিত কাস্ট বা দলিত। চন্দনতলার দলিতদের রাষ্ট্র যদি কমিশন বসিয়ে কাগজপত্র দেখে তাদের জমিজমা চিহ্নিত করে না দেয়, তাহলে কিছুদিন বাদে সেখানে একটি পরিবারকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
মনে হচ্ছে বাস্তুভিটা থেকে উপড়াতে চন্দনতলায় নারী নিগ্রহকে পদ্ধতিগত হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তাই বরগুনা প্রশাসনের তরফে নয়টি পরিবারের জন্য নতুন বাড়িঘর তুলে পুনর্বাসন করার খবর আমাদের আশ্বস্ত করে না। গত দুই বছরে সেখানে তিন দফায় ১৪টি দলিত পরিবার নির্যাতনের মুখে বাস্তুচ্যুত হওয়ার সংকটে পড়ে।
আমি বরগুনার ঘটনায় ৬ এপ্রিলে হাইকোর্টের দেওয়া বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশকে গুরুত্ব দিচ্ছি। কারণ, আসকের আইনজীবী জেড আই খান আদালতে শুনানিকালে (যা তিনি আমাকে বলেছেন) অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে দুটি দলিত মেয়ে তাদের মা-বাবার, এমনকি অর্ধশতাধিক মানুষের সামনে ধর্ষিত হওয়ার যে ভয়ংকর তথ্য তুলে ধরেছেন, তার সত্যাসত্য যাচাই হওয়া দরকার। কিছুদিন আগে চন্দনতলাতেই আরেক দলিত গৃহবধূকে তুলে নিয়ে গণধর্ষণ শেষে ফিরিয়ে দেওয়ার একটি অভিযোগও মিডিয়ায় আসেনি।
সংখ্যালঘুদের নির্যাতিত হওয়ার এ রকম কত খবর চাপা পড়ে থাকে। দেশের ৭৫ লাখ দলিত মানুষের নিপীড়িত হওয়ার ঘটনা খুব কমই নজরে আসে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরে নির্বাচিত আদিবাসী প্রতিনিধি বিচিত্রা তিরকিতকে ধর্ষণের যে অভিযোগ, তার পেছনেও কথিত ভূমিদস্যুতা। ধর্ষণ প্রমাণিত হয়নি, এ কথা স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সংসদে উল্লেখ করেও বলেছিলেন, তিনি নির্যাতিত হয়েছিলেন। কিন্তু তাতে লাভ কী?
ককাস সদস্য ফজলে হোসেন বাদশার ভাষায়, ‘আনন্দের কথা হলো আসামিরা জামিনে বেরিয়ে গেছেন।’ খাগড়াছড়ির ২১ পরিবারের ৮৪ জন উদ্বাস্তু প্রায় ১০ মাস ধরে (অনেকে ২২ দিন করে জেল খেটেছেন) একটি পরিত্যক্ত কৃষি অফিসে আছেন। খাগড়াছড়ির ডিসি ওয়াহিদুজ্জামান গত বুধবার জানালেন, অধিগ্রহণ করা ২৯ একর জমির মধ্যে মাত্র দুই একর দুই ব্যক্তির। তাঁরা বরাদ্দ করা টাকা নেবেন না, জমি ফেরত নেবেন। ককাসের প্রতিবেদনে দেখি, ধর্ষণ ও ধ্বংসযজ্ঞের পটভূমিতে তাঁরা শরণার্থী হয়ে ভারতে গিয়েছিলেন, পার্বত্য চুক্তির পরে তাঁরা ফিরে আসেন।
ওই উচ্ছেদের ২৮ বছর ও পার্বত্য চুক্তির ১৭ বছর পরে ‘মাতৃভূমি’ কিংবা ‘বাস্তুভিটা’ থেকে দ্বিতীয় (কাপ্তাই বাঁধের কারণে ১৯৬০ সালের উচ্ছেদ ধরলে তৃতীয়) দফায় এই চাকমারা উচ্ছেদের শিকার হলো।
জিজ্ঞাসার জবাবে খাগড়াছড়ির ডিসি জানান, ককাস প্রতিবেদনের কথা তাঁর জানা নেই। তাঁর কথায়, ‘হাইকোর্টের একটি রুল অকার্যকর হয়ে গেছে। কারণ, সরকার আদালতের আদেশ মেনেই তর্কিত তফসিলের জমি বাদ দিয়ে অধিগ্রহণ করেছে। হাইকোর্টের আরেক আদেশে গাছগাছালি ও বসতবাড়ির ক্ষতিপূরণ বিষয়ে রুল ছিল। কিন্তু তাঁরা সে টাকাও নেবেন না।’
এই রাষ্ট্র পেট্রলবোমায় দগ্ধদের ক্ষত মুছতে মাথাপিছু ১০ লাখ টাকা, আর বাস্তুভিটা থেকে চিরতরে উচ্ছেদের ক্ষত শুকাতে মাথাপিছু ১২ হাজার ৬৯৮ টাকা ধার্য করছে। এটা এই অর্থে যে ৮৪ জনের বিপরীতে জেলা প্রশাসন গাছগাছালি ও বসতবাড়ির ক্ষতিপূরণ পাওয়ার যোগ্য মনে করেছে মাত্র আটজনকে।
জমিজমার কাগজপত্র না রাখা আদিবাসী ঐতিহ্য। এর সুযোগে খাগড়াছড়ি প্রশাসন মাত্র দুই ব্যক্তির নামে ২ একর ২০ শতাংশ জমির প্রকৃত মালিকানা আবিষ্কার করেছে। বাকি ২৭ একর জমিই নাকি খাস। রাষ্ট্রের হৃদয়হীনতার গল্প এখানেই শেষ নয়। ১ শতক নিকৃষ্ট জমিও সেখানে পাঁচ হাজার টাকার কমে বিকোয় না। অথচ শতকের দাম মাত্র ৬২০ টাকা ধরে দুজনকে দুই একরের দাম ১ লাখ ৩৬ হাজার ৫৬৯ টাকা নিতে সাধছে।
এই গুমর ফাঁস না করে প্রশাসন সংবাদ সম্মেলন করে বলছে, ‘ওরা টাকা নেবে না। জমি নেবে!’ এরপরও দেশ শাসনে ‘সামাজিক সুবিচার’ বলতে কি কিছু থাকে?
ককাস প্রতিবেদনে বাবুছড়া ভাইস চেয়ারম্যানের বরাতে বলা আছে: ‘যে মেয়েগুলোকে ধরে নিয়ে গেছে তাদের একজনের গায়ের কাপড় টেনে ছিঁড়ে ফেলেছে। রাইফেল দিয়ে পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দেওয়া হয়েছে।’ আর বিজিবির দাবি, তারা ‘৬ বিজিবি ও ১ পুলিশ সদস্যকে আহত করেছে এবং বিজিবির ২টি রাইফেল ভেঙে ফেলেছে’।
অনগ্রসর মানুষ বিশেষ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাস্তুভিটা থেকে অপসারণে আওয়ামী লীগ-বিএনপি কেউ পিছিয়ে নেই। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর যে নির্যাতন হয়েছে, তার বিচার আজও আওয়ামী লীগ সরকার করেনি। আমরাও মনে করি, এই ব্যাধি আর শুধু প্রশাসনিক পদক্ষেপ দিয়ে সারানোর নয়, কারণ এটা সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। বরগুনার ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া প্রধান পান্ডা রশীদ ২০০১ সালে বিএনপি করতেন, পরে আওয়ামী লীগে নাম লেখান। রশীদের রাহুগ্রাস থেকে বাঁচতে ভুক্তভোগীরা গত বছর শাসকদলীয় সাংসদ ধীরেন্দ্র নাথ শম্ভুর কাছে গিয়েছিলেন। শম্ভু তখন নাকি বলেছিলেন, ‘আমি তো শুনেছি ও (রশীদ) ভালো হয়ে গেছে। মানুষকে ভালো হওয়ার সুযোগ দেওয়া দরকার।’ অতঃপর জামিনে বেরিয়ে রশীদ চন্দনতলায় তাণ্ডব চালান।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানের আশঙ্কা: ‘রাষ্ট্র এখনই যথাযথ ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হলে আগামী ২০ বছরে বাংলাদেশ হিন্দুশূন্য হবে।’ জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উল্লিখিত ১৪, ২১ ও ৬৫ পরিবারের উচ্ছেদের ঘণ্টাধ্বনি কী নির্দেশ করছে? ১৯৫১ সালে থাকা ২৩ দশমিক ৭৮ শতাংশের সংখ্যালঘু হারটা ২০১১ তে ৯ দশমিক ৭ শতাংশে নেমেছে। কেউ কেউ এই সমস্যাকে কেবলই ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক মোড়কে দেখার প্রয়াস পাচ্ছেন। আসলে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় গণতান্ত্রিক অনুশীলনের ঘাটতি গভীরতর হওয়া এবং সেই সুড়ঙ্গপথে ধেয়ে আসা অজগর ধর্মবর্ণ-নির্বিশেষে সমাজের দুর্বলতরদের গিলতে চাইছে। আর চূড়ান্তভাবে তা আইনের শাসনপ্রত্যাশী সংখ্যাগুরু বাঙালির স্বাভাবিক জীবনেও তার অভিঘাত পড়ছে।
অপরাজনীতির কারণে দেশে এখন প্রায় হিরের চেয়েও দামি হলো জমি, আর সবচেয়ে সস্তা হলো মানুষের প্রাণ। শাসক ও ধনিক গোষ্ঠীর লুটপাটকে বৈধ করার যে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এখন গণতন্ত্রের নামে চেপে বসেছে, সেটাই জমি ও জীবনের দরদাম ঠিক করছে। ওপরে উল্লেখিত প্রতিটি ঘটনার অভিন্ন বৈশিষ্ট্য হলো সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর দুর্বৃত্ত অংশ দলিতদের জমি লুটে নিচ্ছে। তাহলে দলিত ও অনগ্রসররা কোথায় যাবে?
আমি গত ২৮ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরসি মজুমদার হলে জাতপ্রথা বিলোপবিষয়ক একটি সেমিনারে অংশ নিই। সেখানে আমি দলিত ও আদিবাসীদের বাঁচাতে ভারতীয় সাংবিধানিক ব্যবস্থা অনুসরণের কথা বলেছি। বাহাত্তরের ভুলের পরে পাহাড়িদের যে স্বীকৃতি সম্প্রতি সংবিধানে এসেছে, তা অপ্রতুল।
গান্ধীজির সঙ্গে ১৯৩১ সালে ভারতীয় সংবিধানের মূল রূপকার ও গণপরিষদের সভাপতি ড. আম্বেদকারের প্রথম দেখা। গান্ধীজি বললেন, আপনি কংগ্রেসের প্রতি কেন এত রুষ্ট? আম্বেদকার বললেন, আমি অস্পৃশ্য। আমার তো কোনো মাতৃভূমি নেই। আম্বেদকারের সেই চেতনার মতো বাংলাদেশি সংখ্যালঘু ও দলিতদেরও যেন মাতৃভূমি নেই। সংসদীয় ককাসও আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি চায়। ভারত ও পাকিস্তানের মতো দলিত ও আদিবাসীকে সংসদে অনতে হবে।
আম্বেদকারের পথে স্পষ্ট বিধান করতে হবে: উপজাতি, তফসিলি জাতিসহ অনগ্রসর অংশের জন্য একজন মন্ত্রী থাকবেন। এই রকম রক্ষাকবচ পাকিস্তানে না হলেও ভারতসহ বিভিন্ন দেশে সুফল দিয়েছে।
আদিবাসীবিষয়ক সংসদীয় ককাসের কোনো সুপারিশের বাস্তবায়ন ঘটেনি বলে ককাস সদস্য সাংসদ ফজলে হোসেন বাদশা নিশ্চিত করেন। তাঁর সঙ্গে কথোপকথনের পর আমার আর সন্দেহ রইল না যে পেশিশক্তিধারী বাঙালি এখন দলিত ও অনগ্রসর শ্রেণির জীবনে ভূমিজঙ্গি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
বরগুনার যে এলাকাটিতে তাণ্ডব ঘটল, ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত সেই আসনের সাংসদ হতেন রাখাইনরা। নির্বাচনী রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় রাখাইনদের ধরে রাখলে হয়তো তারা বিলুপ্তির পথে যেত না। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনেও ৩০৯টি আসনের মধ্যে দলিত ও উপজাতির জন্য ৩৭টি আসন সংরক্ষিত ছিল। আমাদের মগজে এসব ঢোকে না। তাই দেখার বিষয়, ধর্মনিরপেক্ষতার বুলিটা রেখে রাষ্ট্রধর্মটা জিইয়ে রাখার আসল বার্তা পাঠে মুসলিম ভূমিজঙ্গিদের কোনো অসুবিধা হয়নি।
ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও আদিবাসী ক্রমেই একাত্তরপূর্ব বাঙালি, আর বাঙালিরা সেই বলদর্পী পাঞ্জাবির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। অথচ দেশটা এ জন্য স্বাধীন হয়নি।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com
No comments