বাংলাদেশ তার পরিচয় খোঁজার বৃথা চেষ্টা করছে -দ্য স্টেটসম্যানের সম্পাদকীয়
স্বাধীনতা
অর্জনের ৪৫ বছর পরও বাংলাদেশ তার পরিচয় খোঁজার বৃথা চেষ্টা করছে। এখনও এ
দেশটি দু’ভাগে বিভক্ত। দেশে যে অবস্থা বিরাজমান তা দেশটির অভ্যন্তরীণ
বিবাদ। এটা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ের জন্যই ভীতিকর। গত শনিবার রাতে
যুদ্ধাপরাধীর সাজা কার্যকর করার মাধ্যমে সরকার খালেদা জিয়া ও তার
পাকিস্তানপন্থি মিত্রকে নিষ্ক্রিয় করতে পারবে কিনা তা নির্ভর করে পরবর্তী
ঘটনাপ্রবাহের ওপর। গতকাল ভারতের দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকার এক সম্পাদকীয়তে
এসব কথা বলা হয়। ‘ইউফোরিয়া অ্যান্ড ব্যাকল্যাশ’ শীর্ষক ওই সম্পাদকীয়তে আরও
বলা হয়, শনিবার মধ্যরাতের দিকে ঘড়ির কাঁটা যখন এগিয়ে যেতে থাকে তখন ঢাকা
প্রত্যক্ষ করেছে একটি মৃত্যুতে উল্লাস করতে। ঐতিহাসিকভাবে নির্মম বিদ্রূপ
দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন কিছু নয়। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধে পাকিস্তানের
‘সহযোগী’ মুহম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে শনিবার রাতে।
তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঢাকার প্রাণকেন্দ্র শাহবাগ
চত্বরে স্বস্তির অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে। এতে ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা নিশ্চিত
হয়ে দেখা দিয়েছে। ‘মিরপুরের কসাই’ খ্যাত আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর
করার পর কার্যকর করা হলো কামারুজ্জামানের ফাঁসি। এর মাধ্যমে কামারুজ্জামান
হলেন জামায়াতে ইসলামীর দ্বিতীয় নেতা, যাকে ফাঁসির মঞ্চে তোলা হলো। ১৯৭১
পরবর্তী প্রজন্ম মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখায় তাদের নৈতিক বিজয় দেখতে পেয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের রায় ও কার্যক্রমের সুস্থতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সংশয় সন্দেহ
প্রকাশ করার পাশাপাশি গত ৪৮ ঘণ্টা ধরে যে ধারা চলছে তাতে জামায়াতের
আন্দোলনের হুমকি মোকাবিলা করতে হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারকে। এটা
ধারণা করা যায় যে, ১৯৭১ সালে ‘বিধবা-মেকার’কে ফাঁসি দেয়ার মাধ্যমে
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ও তার মিত্র জামায়াতের সরকারবিরোধী আন্দোলনের গতি
ভোঁতা হয়ে যাবে। সোহাগপুরে গণহত্যার ৪০ বছরেরও বেশি সময় পরেও সেই স্মৃতি
এখনও জাগরূক। সেখানে কমপক্ষে ১২০ জন মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। এর
মূল হোতা কামারুজ্জামান। যেখানে ওই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তার নামকরণ হয়েছে
বিধবাদের পল্লী। শাহবাগ চত্বরের আন্দোলনকারীদের দাবির প্রতি নত হয়েছেন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু শনিবার রাতে যে যোগ্য সাজা দেয়া হয়েছে
তাতে বেগম খালেদা জিয়া ও তার মিত্রদের নিষ্ক্রিয় করা যাবে কিনা তা নির্ভর
করছে পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের ওপর। এর প্রতিক্রিয়ায় গত কয়েক সপ্তাহে আতঙ্কজনক
কিছু ঘটনা ঘটেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, শেখ হাসিনা ধর্মনিরপেক্ষতার
পক্ষে। তার এ ধারণার সঙ্গে সহমত এমন দুজন ব্লগারকে হত্যা করেছে
কট্টরপন্থিরা। স্বাধীনতা যুদ্ধের কঠিন দিনগুলোতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে
ব্যাপকভাবে বিভক্ত করেছিল, তা এখনও আছে। সেই বিভক্ত ইতিহাসে এখনও বিস্মৃত।
একটি সার্বভৌম দেশের জন্য এটা একটি অভ্যন্তরীণ বিবাদ। এটা আওয়ামী লীগ ও
বিএনপি উভয়ের জন্যই সমান বিপদের কারণ হতে পারে। এ উপমহাদেশের বাকি অংশে যখন
একজন জঙ্গির মৃত্যু হয় সেখানে দুজন জঙ্গির জন্ম হয়। সোমবার জামায়াতের যে
হরতাল হয়েছে তা শুধু সম্ভাব্য আন্দোলনের একটি পূর্বাভাস। ঘাতক দালাল
নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির কামারুজ্জামানকে দাফন করার
আগেই বলেছেন, ফাঁসিই যথেষ্ট নয়। তাকে যারা সৃষ্টি করেছে সেই জামায়াতে
ইসলামীর ইতি চাই আমরা। তার বলার এ ভঙ্গির সঙ্গে কম সহমত পোষণ করলেও
‘ধর্মনিরপেক্ষতার আবরণ’ সারা দেশে বিপদজনকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। ১৯৭১ সালের
ডিসেম্বরের পর থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাই ব্যাপকভাবে আশা করা হয়েছে। আরও
সঠিকভাবে বলা যায়, স্বাধীনতা অর্জনের প্রায় ৪৫ বছর পরেও বাংলাদেশ তার
নিজস্ব পরিচয় খোঁজার বৃথা চেষ্টা করছে।
No comments