এই বোশেখ সেই বোশেখ by আমিরুল আলম খান
আবেগপ্রবণ
বাঙালির আবেগ বন্যায় ভাসে বোশেখে—পয়লা ও পঁচিশে। এমন সব মানুষের অনুষ্ঠান
দ্বিতীয়টি নেই বাঙালির। তবে ভেদ আছে কিছুটা, তা এপার আর ওপার বাংলার
বাঙালির মধ্যে। এপারে আমরা প্রতিষ্ঠা করেছি এক স্বাধীন রাষ্ট্র, সশস্ত্র
যুদ্ধ করে। আবেগ তাই বেশি আমাদের। নতুন বছর উদ্যাপনে আমরা প্রবল বন্যায়
ভাসি, ঘর ছেড়ে আসি পথে, দিনমান। আনন্দ-উল্লাসে, নাচে-গানে ভরিয়ে দিই পুরো
দিন। রাত গভীর হয়, আনন্দ থামতে চায় না। পোশাকে, আহারে এবং বিহারেও বটে,
আমরা এক রঙিন জীবন উপভোগ করি।
এই বোশেখ এমন উচ্ছ্বাসময় ছিল না মাত্র দশক তিনেক আগেও। দ্বিধা যেন ছিল সবার মনে। ধর্মের গন্ধ খুঁজত। বোশেখ কি বাঙালির উৎসব? বোশেখ কি মুসলমানেরও? এমন বিতর্ক ছিল এই সেদিন পর্যন্ত। বাঙালির হবে কেন বোশেখ? খাজনা আদায়ের ফিকিরে তা চালু করেছে মুসলমান বাদশাহ আকবর। আকবর মোগল, বাঙালি নন। তাই বোশেখ কিছুতেই বাঙালির হচ্ছিল না। আবার বোশেখ কি মুসলমানের? মুসলমানের তো নওরোজ, যেমন তা আছে ইরানে। কিংবা হিজরি, আরবের। মুসলমান কেন বোশেখে আনন্দ করবে? বোশেখের গায়ে কাফিরের গন্ধ!
পণ্ডিতের মাথা ঘামল। বোশেখকে হতে হবে বাঙালির, বোশেখকে হতে হবে মুসলমানেরও। তাবৎ কেতাব ঘেঁটে বের করো যুক্তি। তাতেও সুরাহা মেলে কই? বিবাদ থেকেই গেল। রাজনীতি তার সমাধান দিল, একেবারে আলাদা আদলে।
পাকিস্তানি আমলে নিষেধের বেড়াজালে বেঁধে বাঙালিদের ‘পাকিস্তানি’ বানানোর যুক্তিহীন কোশিশ হলো। ফুঁসে উঠল বাঙালি। নিজের সুলুক সন্ধানে। আইয়ুবি নিষেধের বেড়া টপকাতে ছায়ানট আয়োজন করল বোশেখ। ঢাকায়, রমনার বটমূলে। ষাটের দশকে সেই শুরু। তারপর পদ্মা-যমুনায় গেল কত পানি। ভেঙে গেল পাকিস্তান। বৈষম্যের প্রতিবাদে, ধনে-মানে এবং ভাষার বৈষম্যে। তখনো বোশেখ পুরোপুরি আপন হতে পারেনি সবার। দ্বিধা ছিল তখনো, কারও কারও।
জিয়ার সেনাশাসনের প্রতিবাদে আবার বোশেখের খোঁজ পড়ল। এবার উদীচী। যশোরে। কিন্তু ঠিকমতো মাটি পাচ্ছিল না। এল এরশাদী আমল। এবার শাসনের রং আরও পাকা। এরশাদ শুধু সেনাশাসকই নন, নাকি কবিও। তাঁর পাশে ভিড় জমল কবিদের। সংস্কৃতির একেবারে অন্দরমহলে হানা পড়ল। অবাক সবাই। শঙ্কিতও। ১৩৯৪ সন। চারুপীঠ আর যশোর ইনস্টিটিউট মিলে পৌর পার্কের ঘেরাটোপ থেকে মুক্ত করল বোশেখকে। শহরজুড়ে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। সামনে মুখোশ পরা যুবক-যুবতী। ঢাক-ঢোল-কাঁসারির বাদ্যি। নাচে-গানে একাকার। কী বলতে চায় এরা? শোভাযাত্রা যত এগোয়, শামিল হয় হাজারো মানুষ। অবাক আয়োজকেরাই।
এবার প্রতিবাদের রূপ গেল বদলে। ঢাকায় চারুকলার আয়োজনে সেই ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নতুন মাত্রা পেল পরের বছর। তারপর ছড়াল সারা দেশে। মাত্র তিন বছরে। বোশেখ নতুন অর্থ খুঁজে পেল। সংস্কৃতির নামাবলি গায়ে দেওয়া এরশাদের বিরুদ্ধে একটা জ্বলন্ত প্রতিবাদ হয়ে উঠল। এবং সবার অলক্ষ্যে সেই আয়োজন হয়ে গেল বিপ্লবাত্মক। অনুষ্ঠানের ধারা গেল বদলে। কবির মুখোশে এরশাদ সংস্কৃতির মাঠ দখল করতে চেয়েছিলেন; বাঙালি তরুণেরা তা ব্যর্থ করে দিল নাচ-গান-বাদ্যি, রঙ্গ-ব্যঙ্গ-কৌতুকে। না যায় দমানো, না যায় মানা। এরশাদ ভেসে গেল সাংস্কৃতিক প্রতিবাদের জোয়ারে। তিন বছরেই গণেশ উল্টোল এরশাদের!
এখন বোশেখ মানে খাজনা শোধ নয়। আবার বোশেখ মানে কৃষকের ঘরে অভাবের হামাগুড়িও নয়। এখন বোশেখে কৃষকের গোলাভরা সোনার ধান। পকেট ভর্তি টাকা। তাই বদলে গেল বোশেখের রং। ফুর্তি করতে পয়সা লাগে। ফেলো কড়ি, মাখো তেল। ইরি-বোরো কৃষকের হাতে সেই নগদ পয়সা দিয়েছে। আগের বোশেখ আর নতুন এই বোশেখ আলাদা হয়ে গেল। কৃষক শামিল এই বোশেখের আনন্দে। মুটে-মজুরও। নারী ও পুরুষে।
বাণিজ্যের পোদ্দাররা বুঝে গেল বদলে গেছে বোশেখ। চাষার হাতে টাকা। বিদেশ-বিভুঁইয়ে রক্ত পানি করে টাকা পাঠাচ্ছে বাঙাল পোলারা। সে টাকা লগ্নি হওয়ার জায়গা খুঁজে পাচ্ছে না। গার্মেন্টসে রক্ত পানি করে দুই পয়সা কামাচ্ছে মেয়েরাও। ‘ঋণ করে ঘি খাওয়া’ তত্ত্বে দুনিয়া মেতেছে। হাভাতের হাতেও টাকা। তার শখ ‘ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী’ মেখে ফরসা হওয়া। মিনি শ্যাম্পুতে চুলে ঝিলিক বাড়ানো। কাজেই ব্যবসা করো বোশেখ নিয়ে। মিঠাই মন্ডা, ইলিশের ব্যবসা আগেই ছিল। এবার যোগ করো ‘কোমল পানীয়’। সঙ্গে জুটে গেল মোবাইল ফোন। মেতে উঠল ফ্যাশন হাউস। পর্যটনওয়ালাও মওকা পেল ব্যবসার। সংগতে মিডিয়া। ষোলোকলা পূর্ণ। বাঙালির প্রাণের উৎসবে মাতাল বোশেখ। দিকে দিকে যেমন সোনালু কাঞ্চন কৃষ্ণচূড়ার বন্যা, তেমনি রঙিন পোশাক, ঢাক-বাদ্যি, মাইকের কানফাটা কুর্দন। সকালে যদিবা
বাংলা গানের আসর, দিন গড়াতে আনন্দের প্রধান অনুষঙ্গ হিন্দির সদম্ভ প্রবেশ। বোশেখ তাই শুধু আনন্দের নয়, বাণিজ্যেরও।
তবু বোশেখে আনন্দ হোক। বাংলার সব ধর্মের মানুষের একটি মাত্র পার্বণ বোশেখ। বোশেখ হলো সব বাঙালির, সব ধর্মের মানুষের উৎসবের দিন।
আর বোশেখি আনন্দ শোভাযাত্রার শুরু যে যশোরে। ওদের দেওয়া নাম ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ আজ সারা বাংলায়। যশোরবাসী বোশেখের নতুন ব্যাখ্যাকার। সে গৌরব তো যশোরবাসীর থাকলই।
মঙ্গল হোক সবার।
আমিরুল আলম খান: শিক্ষাবিদ।
এই বোশেখ এমন উচ্ছ্বাসময় ছিল না মাত্র দশক তিনেক আগেও। দ্বিধা যেন ছিল সবার মনে। ধর্মের গন্ধ খুঁজত। বোশেখ কি বাঙালির উৎসব? বোশেখ কি মুসলমানেরও? এমন বিতর্ক ছিল এই সেদিন পর্যন্ত। বাঙালির হবে কেন বোশেখ? খাজনা আদায়ের ফিকিরে তা চালু করেছে মুসলমান বাদশাহ আকবর। আকবর মোগল, বাঙালি নন। তাই বোশেখ কিছুতেই বাঙালির হচ্ছিল না। আবার বোশেখ কি মুসলমানের? মুসলমানের তো নওরোজ, যেমন তা আছে ইরানে। কিংবা হিজরি, আরবের। মুসলমান কেন বোশেখে আনন্দ করবে? বোশেখের গায়ে কাফিরের গন্ধ!
পণ্ডিতের মাথা ঘামল। বোশেখকে হতে হবে বাঙালির, বোশেখকে হতে হবে মুসলমানেরও। তাবৎ কেতাব ঘেঁটে বের করো যুক্তি। তাতেও সুরাহা মেলে কই? বিবাদ থেকেই গেল। রাজনীতি তার সমাধান দিল, একেবারে আলাদা আদলে।
পাকিস্তানি আমলে নিষেধের বেড়াজালে বেঁধে বাঙালিদের ‘পাকিস্তানি’ বানানোর যুক্তিহীন কোশিশ হলো। ফুঁসে উঠল বাঙালি। নিজের সুলুক সন্ধানে। আইয়ুবি নিষেধের বেড়া টপকাতে ছায়ানট আয়োজন করল বোশেখ। ঢাকায়, রমনার বটমূলে। ষাটের দশকে সেই শুরু। তারপর পদ্মা-যমুনায় গেল কত পানি। ভেঙে গেল পাকিস্তান। বৈষম্যের প্রতিবাদে, ধনে-মানে এবং ভাষার বৈষম্যে। তখনো বোশেখ পুরোপুরি আপন হতে পারেনি সবার। দ্বিধা ছিল তখনো, কারও কারও।
জিয়ার সেনাশাসনের প্রতিবাদে আবার বোশেখের খোঁজ পড়ল। এবার উদীচী। যশোরে। কিন্তু ঠিকমতো মাটি পাচ্ছিল না। এল এরশাদী আমল। এবার শাসনের রং আরও পাকা। এরশাদ শুধু সেনাশাসকই নন, নাকি কবিও। তাঁর পাশে ভিড় জমল কবিদের। সংস্কৃতির একেবারে অন্দরমহলে হানা পড়ল। অবাক সবাই। শঙ্কিতও। ১৩৯৪ সন। চারুপীঠ আর যশোর ইনস্টিটিউট মিলে পৌর পার্কের ঘেরাটোপ থেকে মুক্ত করল বোশেখকে। শহরজুড়ে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। সামনে মুখোশ পরা যুবক-যুবতী। ঢাক-ঢোল-কাঁসারির বাদ্যি। নাচে-গানে একাকার। কী বলতে চায় এরা? শোভাযাত্রা যত এগোয়, শামিল হয় হাজারো মানুষ। অবাক আয়োজকেরাই।
এবার প্রতিবাদের রূপ গেল বদলে। ঢাকায় চারুকলার আয়োজনে সেই ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নতুন মাত্রা পেল পরের বছর। তারপর ছড়াল সারা দেশে। মাত্র তিন বছরে। বোশেখ নতুন অর্থ খুঁজে পেল। সংস্কৃতির নামাবলি গায়ে দেওয়া এরশাদের বিরুদ্ধে একটা জ্বলন্ত প্রতিবাদ হয়ে উঠল। এবং সবার অলক্ষ্যে সেই আয়োজন হয়ে গেল বিপ্লবাত্মক। অনুষ্ঠানের ধারা গেল বদলে। কবির মুখোশে এরশাদ সংস্কৃতির মাঠ দখল করতে চেয়েছিলেন; বাঙালি তরুণেরা তা ব্যর্থ করে দিল নাচ-গান-বাদ্যি, রঙ্গ-ব্যঙ্গ-কৌতুকে। না যায় দমানো, না যায় মানা। এরশাদ ভেসে গেল সাংস্কৃতিক প্রতিবাদের জোয়ারে। তিন বছরেই গণেশ উল্টোল এরশাদের!
এখন বোশেখ মানে খাজনা শোধ নয়। আবার বোশেখ মানে কৃষকের ঘরে অভাবের হামাগুড়িও নয়। এখন বোশেখে কৃষকের গোলাভরা সোনার ধান। পকেট ভর্তি টাকা। তাই বদলে গেল বোশেখের রং। ফুর্তি করতে পয়সা লাগে। ফেলো কড়ি, মাখো তেল। ইরি-বোরো কৃষকের হাতে সেই নগদ পয়সা দিয়েছে। আগের বোশেখ আর নতুন এই বোশেখ আলাদা হয়ে গেল। কৃষক শামিল এই বোশেখের আনন্দে। মুটে-মজুরও। নারী ও পুরুষে।
বাণিজ্যের পোদ্দাররা বুঝে গেল বদলে গেছে বোশেখ। চাষার হাতে টাকা। বিদেশ-বিভুঁইয়ে রক্ত পানি করে টাকা পাঠাচ্ছে বাঙাল পোলারা। সে টাকা লগ্নি হওয়ার জায়গা খুঁজে পাচ্ছে না। গার্মেন্টসে রক্ত পানি করে দুই পয়সা কামাচ্ছে মেয়েরাও। ‘ঋণ করে ঘি খাওয়া’ তত্ত্বে দুনিয়া মেতেছে। হাভাতের হাতেও টাকা। তার শখ ‘ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী’ মেখে ফরসা হওয়া। মিনি শ্যাম্পুতে চুলে ঝিলিক বাড়ানো। কাজেই ব্যবসা করো বোশেখ নিয়ে। মিঠাই মন্ডা, ইলিশের ব্যবসা আগেই ছিল। এবার যোগ করো ‘কোমল পানীয়’। সঙ্গে জুটে গেল মোবাইল ফোন। মেতে উঠল ফ্যাশন হাউস। পর্যটনওয়ালাও মওকা পেল ব্যবসার। সংগতে মিডিয়া। ষোলোকলা পূর্ণ। বাঙালির প্রাণের উৎসবে মাতাল বোশেখ। দিকে দিকে যেমন সোনালু কাঞ্চন কৃষ্ণচূড়ার বন্যা, তেমনি রঙিন পোশাক, ঢাক-বাদ্যি, মাইকের কানফাটা কুর্দন। সকালে যদিবা
বাংলা গানের আসর, দিন গড়াতে আনন্দের প্রধান অনুষঙ্গ হিন্দির সদম্ভ প্রবেশ। বোশেখ তাই শুধু আনন্দের নয়, বাণিজ্যেরও।
তবু বোশেখে আনন্দ হোক। বাংলার সব ধর্মের মানুষের একটি মাত্র পার্বণ বোশেখ। বোশেখ হলো সব বাঙালির, সব ধর্মের মানুষের উৎসবের দিন।
আর বোশেখি আনন্দ শোভাযাত্রার শুরু যে যশোরে। ওদের দেওয়া নাম ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ আজ সারা বাংলায়। যশোরবাসী বোশেখের নতুন ব্যাখ্যাকার। সে গৌরব তো যশোরবাসীর থাকলই।
মঙ্গল হোক সবার।
আমিরুল আলম খান: শিক্ষাবিদ।
No comments