পেয়ারা গাছের নিচে by মঈন আহমেদ
ই সভাপতি কাকে করবি? কেন! আমি তো আগেই বলেছি/ স্যার সভাপতিত্ব করবেন/ উনি ছাড়া আর কে আছেন। কিন্তু স্যারতো কথাই বলতে পারেন না।
তা না পারম্নক/ কিন্তু এমন দিনে তাঁকে সভায় ডেকে না আনলে শুধু তাঁকে অমর্যাদাই করা হবে না, সদ্য স্বাধীনতার বুকে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে।
তা না পারম্নক/ কিন্তু এমন দিনে তাঁকে সভায় ডেকে না আনলে শুধু তাঁকে অমর্যাদাই করা হবে না, সদ্য স্বাধীনতার বুকে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে।
কয়েকজন
ছাত্র মুক্তিযোদ্ধার কথোপকথন/ তারা কলেজ প্রাঙ্গণে এক সভার আয়োজন করেছে/
সেদিন ছিল শুভ্রতার/চবি্বশে ডিসেম্বর/সাল উনিশশ একাত্তর/বিকেল
তিনটা/স্বাধীনতার উৎসব অনুষ্ঠান/যত্রতত্র বিজয়ের আনন্দে রাইফেলে খই ফুটছে।
মুক্তিযুদ্ধের সূর্ঘসৈনিকরা তাদের প্রাণপ্রিয় অধ্যৰকে নিয়ে এসে সভাপতির
আসনে বসিয়েছে। প্রধান অতিথি এ অঞ্চলের কমান্ডার ক্যাপ্টেন রশীদ। স্যার কথা
বলতে পারেন না। চুপচাপ বসে আছেন। আর চারদিকে শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে
তাকাচ্ছেন। সভায় কোন সাজসজ্জা নেই। আর থাকবেই বা কী করে। সব তো ভেঙ্গে চুরে
জ্বালিয়ে পুড়ে শেষ। কোন রকমে দুটো চেয়ার আর একটা টেবিল জোগাড় হয়েছে।
টেবিলটার আবার একটা পায়া নেই। তাই কে যেন একটা বাঁশের ডগা এনে জুড়ে দিয়েছে।
কোথা থেকে দুটো ফুলের মালাও জোগাড় করে এনেছে ছেলেরা।
যে ছেলে ছিল কলেজের খেলার মাঠে হিরো ছাত্র হিসেবে জিরো। সেই ছেলে এখন বীর মুক্তিযোদ্ধা। দুঃসাহসী যোদ্ধা হিসেবে ভীষণ তার নামডাক। প্রধান অতিথির ভাষণের পর সেই ফারম্নক উঠে দাঁড়ালো কিছু বলার জন্য। প্রথমেই স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা আত্মাহুতি দিয়েছে সেসব শহীদ ভাইবোনদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির আশু কামনা করে মাননীয় অতিথির অসীম বীরত্বপূর্ণ সাহসিকতা বর্ণনা করে একটু থামলো।
তারপর চারদিক তাকিয়ে নিয়ে : ভাইসব আজ এই সভার যিনি সভাপতি তিনি সকলের সুপরিচিত। এই কলেজের অধ্যৰ_ আমাদের শ্রদ্ধেয় স্যার। তিনি আজ মূক। কণ্ঠ তাঁর রম্নদ্ধ হয়ে গেছে। তাই তাঁর হয়ে তাঁর সম্পর্কে দুটো কথা চলতে চাই। স্বাধীনতা যুদ্ধচলাকালীন এই নয়টি মাস ঘরে বসে থেকে তিনি আমাদের জন্য যা করেছেন তারই দু চারটি দিক মাত্র তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
ভায়েরা আমার, তিনি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেননি বটে কিন্তু তিনি ছিলেন এই মুক্তিযুদ্ধের একজন সারথী। কুরম্নৰেত্রের যুদ্ধের কৃষ্ণ যেমন অজর্ুনের রথের সারথী ছিলেন। যুদ্ধ শুরম্নর প্রথম থেকেই তাঁর বাসায় দল বেঁধে কতবার এসেছি তার হিসেব নেই। আবার আমি কখনো রাতের অন্ধকারে একাই এসেছি। প্রয়োজনীয় কত টুকিটাকি জিনিসপত্র নিয়েছি। এমন কী মাঝে মাঝে তিনি টাকা পয়সাও দিয়েছেন।
ভাইসব, এ ঋণ কোনদিন শোধ হবার নয়। এ কাজ তাঁর পরিবার তাঁর জীবনের জন্য কতবড় ঝুঁকিপূর্ণ ছিল তা আপনারা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন। কেননা আজ যেখানে আমরা দাঁড়িয়ে আছি তা হলো কলেজের মাঠ। অথচ কয়েকদিন আগেও এটা ছিল নিষিদ্ধ এলাকা। একটা দানবিক ভয়ংকর স্থান গোটা শহরের ত্রাসভূমি ছিল এ অকুস্থান। এই মাঠের উত্তর-পূর্ব দিকে বিল্ডিং। এখানেই পাকিসত্মান সৈন্যরা আসত্মানা স্থাপন করে। এর চারদিকে পরিখা আর কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে স্থায়ী ক্যাম্প গড়ে তোলে। তারই একটু দূরে দৰিণ পশ্চিম দিকে স্যারের বাসা।
কী অদ্ভূত দুঃসাহস। সবাই পালিয়ে গেল। শুধু স্যার ও তাঁর সহধর্মিণী থেকে গেলেন। আমরা তাঁকে বহুবার বলেছি স্যার চলে যান। অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। তিনি ততবারই হাসিমুখে জবাব দিয়েছেন তাহলে তোমাদের সাহায্য করবে কে। তাছাড়া আমি তো বুড়ো মানুষ আমাকে কে কী বলবে। অথচ মাত্র দেড় দুশ গজ দূরে হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প। শুধু ক্যাম্প হলেও একটা কথা ছিল। এটা তারা সুপরিকল্পিতভাবে বাঙালি নিধন বধ্যভূমি সৃষ্টি করেছিল। আপনারা জানেন পশ্চিমদিকে স্যারের বাড়ির লাইনে ঐ যে পেয়ারা গাছটা দেখছেন_ নীরব কালের সাৰী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেখানেই একটা ডোবা ছিল। ছিল এজন্যই বলছি এখন প্রায় ভরাট। মানুষ মেরে মাটিচাপা দিতে দিতে প্রায় ভরে এসেছে। চারদিকে ঘন ঝোপ ঝাড়। নির্জন স্থান। হত্যার আদর্শ লীলাভূমি। সে খালটাই হলো বাঙালি-নিধন খাল।
প্রতিদিন তারা সেখানে কিছু না কিছু মানুষ হত্যা করতো। প্রথম তারা গুলি করে মারতো। অনেকটা চাঁদমারি করার মতো। পরের দিকে গুলি খরচ করতো না। বেয়নেট খুঁচিয়ে বা কুপিয়ে হত্যা করতো। আর রাজাকার আলবদর বাহিনীর লোকেরা জবাই করে বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কুচি কুচি করে কেটে আনন্দ উলস্নাসে ফেটে পড়তো। সে দৃশ্য স্যারকে প্রতিদিন দেখতে হতো। আসলে স্যারের তখন পালাবার পথও খোলা ছিল না। তবু আমরা কেউ না কেউ চুপিচুপি রাতের অন্ধকারে এসে ঘটনা শুনে যেতাম। নানা রকম খবর পেতাম। আর অদ্ভুত ব্যাপার, কোনদিন তিনি না খাইয়ে আমাদের ছেড়ে দিতেন না।
ফারম্নক একটু থামলো। সভা একেবারে নিসত্মব্ধ। সবাই শোনার জন্য উদগ্রীব। সে আবার শুরম্ন করে : যুদ্ধস্নাত ভায়েরা আমার, আমরা যুবক তাই মাঝে মাঝে আঘাত পেয়ে হতাশ হয়ে পড়তাম। কিন্তু স্যার আমাদের হতাশা দেখে নানা রকমভাবে আমাদের উজ্জীবিত করতেন। কী অসম্ভব ছিল তাঁর মনোবল_ ঐ পরিবেশের মধ্যে থেকেও। তিনিই আমাদের বুদ্ধি দিলেন কিভাবে কখন এই ক্যাম্প আক্রমণ করতে হবে। কিন্তু তার আগেই ঘটে গেল এক মর্মন্তুদ ঘটনা। তার ফলেই তিনি হারালেন তাঁর কথা বলার শক্তি। ঐ হিংস্র দানবরা জানতে পেরেছিল তার বাসায় মুক্তিফৌজ আনাগোনা করে। আসলে তাঁর বাসার পেছনে যে জংগল ছিল তার মধ্য দিয়ে আমরা দিব্যি যাওয়া আসা করতাম। কিন্তু কিছুদিন মানুষ চলাচল করলে একটা রাসত্মা তৈরি হয়ে যায়। মিলিটারিরা বুঝতে পেরেছিল_ হঠাৎ জংগলের মধ্যে সুরঙ্গ কেন। এটাই হলো তাঁর কাল। একদিন দুপুর বেলায় কয়েকজন জোয়ান এসে চড়াও হয় তাঁর বাসায়। তাঁকে পিঠমোড়া করে বেঁধে ভীষণ মারে আর বলে, ওই শালে হারামখোর বুঢ্ঢা বেজন্মা বাঙালি, তোর বাড়িতে মুক্তাফৌজ কেন আসে? বুড়ো বয়সে বেদম মার খেয়েও বুকের পাঁজর ভাঙ্গা সত্ত্বেও তিনি স্রেফ অস্বীকার করেন। বরং বলে ঐ মড়া খাওয়ার জন্য শেয়াল কুত্তার আনাগোনায় ঐ রাসত্মা হতে পারে। এমন সময় দুজন জোয়ান আবিষ্কার করে পেয়ারা গাছে দুটো ছোট ছেলে বসে পেয়ারা খাচ্ছে। ওই ছেলে দুটো একটু আগেই এসেছে। শুধু নানা নানীর খবর নিয়ে চলে যাবে। ছেলে মানুষ বুঝতেই পারছেন। গাছে অজস্র পেয়ারা পেকে টসটস করছে। ওরা তো আর জানে না ওটা বধ্যভূমি। গাছে চড়ে মনের সুখে পেয়ারা খাচ্ছে। তাদের নানাও জানতে পারেনি যে ওরা কখন বেরিয়ে গেছে।
দুটো জোয়ান সংগে সংগে চোখের ইশারা করে হেসে ওঠে। হাসতে হাসতেই বলে, আরে ইয়ার, দেখো দো ফাইন টারগেট। তোম বড়াঠো, হাম ছোটা।
তাদের কথা শুনে স্যার জানালা দিয়ে দেখে তারই দুটো নাতি গাছে। বাধা দেবার বা কিছু বলার আগেই শুধু দুটো গুলির শব্দ। পাকা পেয়ারার মতো ছেলে দুটো টুপ করে খালে পড়ে চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেল। সেই দৃশ্য দেখার পর ঐ যে স্যার নীরব নিথর হলেন তারপর থেকে আর কোন কান্না নেই, দুঃখ নেই, কথা নেই। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। আমাদের চিনতে পারেন কিনা তাও জানিনা। এত সব ঘটনা পরে চাচীআম্মার কাছ থেকে শুনেছিলাম।
চারদিক নিশ্চুপ। সবাই যেন এক অজানা রোমাঞ্চকর গল্প শুনছে। যে ফারম্নক ভাল করে কথা বলতে পারতো না সেই ফারম্নক যেন কিসের আবেগে বলে চলছে এক রূপকথার কাহিনী।
ভায়েরা আমার, এর প্রতিশোধ আমরা নিয়েছি। স্যারের নকশানুযায়ী আমরা ক্যাম্প আক্রমণ করি। প্রায় বারো আনা লোককেই হত্যা করেছিলাম। বাকিরা পালিয়ে যায়। আমরা ঐ অকুস্থান ধ্বংস করে জয়ী হয়েছিলাম বটে কিন্তু স্যারের ওই মর্মস্পশর্ী বেদনার শরিক হতে পারিনি।
হঠাৎ সভাপতি থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালেন। ফারম্নককে বসিয়ে দিয়ে ভাঙ্গা স্বরে চিৎকার করে বলে উঠলেন : আজ আমরা স্বাধীন। এই স্বাধীনতার জইন্যো ...
এটুকু বলতেই মনে হলো তাঁর গলা চিরে কী যেন বেরিয়ে গেল। তারপর নিজেই ঢলে পড়লেন তেপায়া ভাঙ্গা টেবিলটার ওপর। টেবিলটা ভার সহ্য করতে না পেরে উল্টো পড়লো। তিনিও গড়িয়ে পড়লেন তার সাথে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে ধরে উঠিয়ে বসানো হলো। কিন্তু তখন সব শেষ। তার মুখে শুধু গাঁজলা ওঠার ছাপ। তিনিও নিসত্মব্ধ। উৎসবও নিসত্মব্ধ।
যে ছেলে ছিল কলেজের খেলার মাঠে হিরো ছাত্র হিসেবে জিরো। সেই ছেলে এখন বীর মুক্তিযোদ্ধা। দুঃসাহসী যোদ্ধা হিসেবে ভীষণ তার নামডাক। প্রধান অতিথির ভাষণের পর সেই ফারম্নক উঠে দাঁড়ালো কিছু বলার জন্য। প্রথমেই স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা আত্মাহুতি দিয়েছে সেসব শহীদ ভাইবোনদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির আশু কামনা করে মাননীয় অতিথির অসীম বীরত্বপূর্ণ সাহসিকতা বর্ণনা করে একটু থামলো।
তারপর চারদিক তাকিয়ে নিয়ে : ভাইসব আজ এই সভার যিনি সভাপতি তিনি সকলের সুপরিচিত। এই কলেজের অধ্যৰ_ আমাদের শ্রদ্ধেয় স্যার। তিনি আজ মূক। কণ্ঠ তাঁর রম্নদ্ধ হয়ে গেছে। তাই তাঁর হয়ে তাঁর সম্পর্কে দুটো কথা চলতে চাই। স্বাধীনতা যুদ্ধচলাকালীন এই নয়টি মাস ঘরে বসে থেকে তিনি আমাদের জন্য যা করেছেন তারই দু চারটি দিক মাত্র তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
ভায়েরা আমার, তিনি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেননি বটে কিন্তু তিনি ছিলেন এই মুক্তিযুদ্ধের একজন সারথী। কুরম্নৰেত্রের যুদ্ধের কৃষ্ণ যেমন অজর্ুনের রথের সারথী ছিলেন। যুদ্ধ শুরম্নর প্রথম থেকেই তাঁর বাসায় দল বেঁধে কতবার এসেছি তার হিসেব নেই। আবার আমি কখনো রাতের অন্ধকারে একাই এসেছি। প্রয়োজনীয় কত টুকিটাকি জিনিসপত্র নিয়েছি। এমন কী মাঝে মাঝে তিনি টাকা পয়সাও দিয়েছেন।
ভাইসব, এ ঋণ কোনদিন শোধ হবার নয়। এ কাজ তাঁর পরিবার তাঁর জীবনের জন্য কতবড় ঝুঁকিপূর্ণ ছিল তা আপনারা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন। কেননা আজ যেখানে আমরা দাঁড়িয়ে আছি তা হলো কলেজের মাঠ। অথচ কয়েকদিন আগেও এটা ছিল নিষিদ্ধ এলাকা। একটা দানবিক ভয়ংকর স্থান গোটা শহরের ত্রাসভূমি ছিল এ অকুস্থান। এই মাঠের উত্তর-পূর্ব দিকে বিল্ডিং। এখানেই পাকিসত্মান সৈন্যরা আসত্মানা স্থাপন করে। এর চারদিকে পরিখা আর কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে স্থায়ী ক্যাম্প গড়ে তোলে। তারই একটু দূরে দৰিণ পশ্চিম দিকে স্যারের বাসা।
কী অদ্ভূত দুঃসাহস। সবাই পালিয়ে গেল। শুধু স্যার ও তাঁর সহধর্মিণী থেকে গেলেন। আমরা তাঁকে বহুবার বলেছি স্যার চলে যান। অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। তিনি ততবারই হাসিমুখে জবাব দিয়েছেন তাহলে তোমাদের সাহায্য করবে কে। তাছাড়া আমি তো বুড়ো মানুষ আমাকে কে কী বলবে। অথচ মাত্র দেড় দুশ গজ দূরে হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প। শুধু ক্যাম্প হলেও একটা কথা ছিল। এটা তারা সুপরিকল্পিতভাবে বাঙালি নিধন বধ্যভূমি সৃষ্টি করেছিল। আপনারা জানেন পশ্চিমদিকে স্যারের বাড়ির লাইনে ঐ যে পেয়ারা গাছটা দেখছেন_ নীরব কালের সাৰী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেখানেই একটা ডোবা ছিল। ছিল এজন্যই বলছি এখন প্রায় ভরাট। মানুষ মেরে মাটিচাপা দিতে দিতে প্রায় ভরে এসেছে। চারদিকে ঘন ঝোপ ঝাড়। নির্জন স্থান। হত্যার আদর্শ লীলাভূমি। সে খালটাই হলো বাঙালি-নিধন খাল।
প্রতিদিন তারা সেখানে কিছু না কিছু মানুষ হত্যা করতো। প্রথম তারা গুলি করে মারতো। অনেকটা চাঁদমারি করার মতো। পরের দিকে গুলি খরচ করতো না। বেয়নেট খুঁচিয়ে বা কুপিয়ে হত্যা করতো। আর রাজাকার আলবদর বাহিনীর লোকেরা জবাই করে বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কুচি কুচি করে কেটে আনন্দ উলস্নাসে ফেটে পড়তো। সে দৃশ্য স্যারকে প্রতিদিন দেখতে হতো। আসলে স্যারের তখন পালাবার পথও খোলা ছিল না। তবু আমরা কেউ না কেউ চুপিচুপি রাতের অন্ধকারে এসে ঘটনা শুনে যেতাম। নানা রকম খবর পেতাম। আর অদ্ভুত ব্যাপার, কোনদিন তিনি না খাইয়ে আমাদের ছেড়ে দিতেন না।
ফারম্নক একটু থামলো। সভা একেবারে নিসত্মব্ধ। সবাই শোনার জন্য উদগ্রীব। সে আবার শুরম্ন করে : যুদ্ধস্নাত ভায়েরা আমার, আমরা যুবক তাই মাঝে মাঝে আঘাত পেয়ে হতাশ হয়ে পড়তাম। কিন্তু স্যার আমাদের হতাশা দেখে নানা রকমভাবে আমাদের উজ্জীবিত করতেন। কী অসম্ভব ছিল তাঁর মনোবল_ ঐ পরিবেশের মধ্যে থেকেও। তিনিই আমাদের বুদ্ধি দিলেন কিভাবে কখন এই ক্যাম্প আক্রমণ করতে হবে। কিন্তু তার আগেই ঘটে গেল এক মর্মন্তুদ ঘটনা। তার ফলেই তিনি হারালেন তাঁর কথা বলার শক্তি। ঐ হিংস্র দানবরা জানতে পেরেছিল তার বাসায় মুক্তিফৌজ আনাগোনা করে। আসলে তাঁর বাসার পেছনে যে জংগল ছিল তার মধ্য দিয়ে আমরা দিব্যি যাওয়া আসা করতাম। কিন্তু কিছুদিন মানুষ চলাচল করলে একটা রাসত্মা তৈরি হয়ে যায়। মিলিটারিরা বুঝতে পেরেছিল_ হঠাৎ জংগলের মধ্যে সুরঙ্গ কেন। এটাই হলো তাঁর কাল। একদিন দুপুর বেলায় কয়েকজন জোয়ান এসে চড়াও হয় তাঁর বাসায়। তাঁকে পিঠমোড়া করে বেঁধে ভীষণ মারে আর বলে, ওই শালে হারামখোর বুঢ্ঢা বেজন্মা বাঙালি, তোর বাড়িতে মুক্তাফৌজ কেন আসে? বুড়ো বয়সে বেদম মার খেয়েও বুকের পাঁজর ভাঙ্গা সত্ত্বেও তিনি স্রেফ অস্বীকার করেন। বরং বলে ঐ মড়া খাওয়ার জন্য শেয়াল কুত্তার আনাগোনায় ঐ রাসত্মা হতে পারে। এমন সময় দুজন জোয়ান আবিষ্কার করে পেয়ারা গাছে দুটো ছোট ছেলে বসে পেয়ারা খাচ্ছে। ওই ছেলে দুটো একটু আগেই এসেছে। শুধু নানা নানীর খবর নিয়ে চলে যাবে। ছেলে মানুষ বুঝতেই পারছেন। গাছে অজস্র পেয়ারা পেকে টসটস করছে। ওরা তো আর জানে না ওটা বধ্যভূমি। গাছে চড়ে মনের সুখে পেয়ারা খাচ্ছে। তাদের নানাও জানতে পারেনি যে ওরা কখন বেরিয়ে গেছে।
দুটো জোয়ান সংগে সংগে চোখের ইশারা করে হেসে ওঠে। হাসতে হাসতেই বলে, আরে ইয়ার, দেখো দো ফাইন টারগেট। তোম বড়াঠো, হাম ছোটা।
তাদের কথা শুনে স্যার জানালা দিয়ে দেখে তারই দুটো নাতি গাছে। বাধা দেবার বা কিছু বলার আগেই শুধু দুটো গুলির শব্দ। পাকা পেয়ারার মতো ছেলে দুটো টুপ করে খালে পড়ে চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেল। সেই দৃশ্য দেখার পর ঐ যে স্যার নীরব নিথর হলেন তারপর থেকে আর কোন কান্না নেই, দুঃখ নেই, কথা নেই। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। আমাদের চিনতে পারেন কিনা তাও জানিনা। এত সব ঘটনা পরে চাচীআম্মার কাছ থেকে শুনেছিলাম।
চারদিক নিশ্চুপ। সবাই যেন এক অজানা রোমাঞ্চকর গল্প শুনছে। যে ফারম্নক ভাল করে কথা বলতে পারতো না সেই ফারম্নক যেন কিসের আবেগে বলে চলছে এক রূপকথার কাহিনী।
ভায়েরা আমার, এর প্রতিশোধ আমরা নিয়েছি। স্যারের নকশানুযায়ী আমরা ক্যাম্প আক্রমণ করি। প্রায় বারো আনা লোককেই হত্যা করেছিলাম। বাকিরা পালিয়ে যায়। আমরা ঐ অকুস্থান ধ্বংস করে জয়ী হয়েছিলাম বটে কিন্তু স্যারের ওই মর্মস্পশর্ী বেদনার শরিক হতে পারিনি।
হঠাৎ সভাপতি থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালেন। ফারম্নককে বসিয়ে দিয়ে ভাঙ্গা স্বরে চিৎকার করে বলে উঠলেন : আজ আমরা স্বাধীন। এই স্বাধীনতার জইন্যো ...
এটুকু বলতেই মনে হলো তাঁর গলা চিরে কী যেন বেরিয়ে গেল। তারপর নিজেই ঢলে পড়লেন তেপায়া ভাঙ্গা টেবিলটার ওপর। টেবিলটা ভার সহ্য করতে না পেরে উল্টো পড়লো। তিনিও গড়িয়ে পড়লেন তার সাথে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে ধরে উঠিয়ে বসানো হলো। কিন্তু তখন সব শেষ। তার মুখে শুধু গাঁজলা ওঠার ছাপ। তিনিও নিসত্মব্ধ। উৎসবও নিসত্মব্ধ।
No comments