মাদ্রিদে তিন বাঙাল by মুনতাসীর মামুন
ঘণ্টা খানেক পর থ্রিলারে আর মন বসে না।
থ্রিলার রেখে খাবার ঘরে এসে দেখি হাশেম ভাই এক মনে লেখার চেষ্টা করছেন।
মনির ভাই ভাত নামিয়ে তরকারি বসাবার উদ্যোগ নিচ্ছেন।
বললাম, 'মনির ভাই কফি চলবে নাকি?'
'অফকোর্স' বলে মনির ভাই কফির পানি বসান। আমি কাপ, কফির কৌটো ইত্যাদি বের
করি। পানি গরম হলে নিজেই কফি বানাই। হাশেম ভাইয়ের টেবিলে এক কাপ রাখি। মনির
ভাইকে এক কাপ দিই। তরকারি নেড়ে মনির ভাই কিচেন টেবিলে তাঁর নির্দিষ্ট
চেয়ারে বসে কফির কাপে চুমুক দিয়ে সিগারেট ধরান। আমি বলি, 'থ্রিলারেও মন
বসছে না।'
'ছবিটা আনতে পারছি না', স্টুডিওতে না থাকার ব্যাখ্যা দেন এক বাক্যে।
'আচ্ছা, মনির ভাই,' বলি আমি, 'আপনার স্পেনের গল্পইতো শোনা হলো না।'
'আর কী শুনবেন?' মনির ভাই হাত নেড়ে উড়িয়ে দেন স্পেনে থাকার বিষয়টা।
'আপনি স্পেনে এলেন কবে?'
'১৯৬৯ সালের দিকে, 'একটু ভেবে বললেন মনির ভাই।
'পাকিস্তান সরকারের স্কলারশিপে। চিত্রকলা লেখার একটা স্কলারশিপ ছিল। পেলাম।'
'স্পেনে তখন বাঙালী ছিল।'
'না, ঠিক জানি না, আমি যখন আইলাম তখন এক বাঙালীর নাম শুনছি কমলা প্রসন্ন রায়। হিপি ছিলেন। এখানকার না [মানে বাংলাদেশের], ওই খানকার। তা মনে হয় ঘুরতে ঘুরতে স্পেন আইসা পড়েন। বিয়াও করছিলেন এক হিপিকে। অবশ্য আমার সঙ্গে তেমন জান পহচান ছিল না।' কথা শেষ করে সিগারেটে টান দেন।
'তা এসে ভর্তি হলেন কোথায়?'
সান ফার্নান্দো বেইয়াস আর্টস। ঢাকা থেকে তো আইসা উঠলাম ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলে। সব বিদেশী, আমিই বাঙালী। আসলে কী শিখব, কোথায় ভর্তি হবো সে সম্পর্কে গৎবাধা নিয়ম ছিল না। সান ফার্নান্দোর কথা বোধ হয় লেখা ছিল তাই সেখানে গেলাম। যাক কাস শুরম্ন হলো। দেখি বিটল লাইফ আঁকতে দিচ্ছে। এদিকে আমিইতো আর্ট কলেজে ছাত্রদের কয়েক বছর স্টিল লাইফ আঁকা শিখাইছি। বিদায় জানাইলাম সান ফার্নান্দোকে'।
এদিকে হাশেম ভাই লেখা ছেড়ে উঠে এসেছেন। জিজ্ঞেস করলাম, 'কী ব্যাপার হাশেম ভাই লেখা শেষ।'
'দূর, দুই পাতা লিখছি। এর থেকে ছবি আঁকা সোজা। কাল দেখা যাবে।' নিশ্চিত সিদ্ধানত্ম দিয়ে কফির কাপ নিয়ে বসে পড়লেন তাঁর নির্দিষ্ট জায়গায়।
'তারপর', জিজ্ঞেস করি মনির ভাইকে।
'কী করি, ঠিক বুঝতাছি না। হোস্টেলে জনা ষাট ছাত্র। তেমন কাউরে চিনি না।
আমার রম্নমমেট ছিল এক ফিলিপিনো। তার সঙ্গে সমস্যা নিয়ে আলাপ করলাম। সে বলল এ্যাপস্নাইড আর্ট স্কুল আছে সেখানে সে এচিং লিখতাছে। 'বুঝলেন মনতাসীর রম্নম মেট ক্যান চেঞ্জ ইয়োর ফুল লাইফ।' কী রকম, জিজ্ঞেস করি আমি।
মনির ভাই বললেন, 'দাঁড়ান', বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে তরকারি নাড়তে গেলেন। নুন চাখলেন। তারপর ফের চেয়ারে এসে বসলেন। সিগারেট ধরালেন একটা। খানিক চুপ থেকে বললেন, 'তারে জিজ্ঞাস করলাম, কী করতাছ। তখন সে দেখাল কয়েকটা এচিং। মনে হইল, এটাই শিখতে হইব।
তা তার সঙ্গে পরদিন গিয়া সে স্কুলে ভর্তি হইলাম। কাজ দেখা শুরম্ন করলাম। আমার টিচার ছিলেন নামকরা, নাম আলফ্রেনসো সানতেস তোলা।'
মনির ভাই ছাড়া সবে যে স্মৃতিচারণ করলেন তাতে যে কাহিনীটা পাওয়া গেল তা' হলো প্রায় নয় মাস তিনি কাজ শেখেন। স্কলারশিপ ছিল নয় মাসের। পেতেন তিন হাজার পেসেতা। টাকার অঙ্কে বিশাল মনে হয়। কিন্তু আসলে তা আজকের ত্রিশ ডলার। এখন এক ইউরো সমান ১৬৫ পেসেতা।
স্কলারশিপ শেষ হয়ে গেলে ভাবলেন আরও কিছুদিন থাকবেন। এদিকে স্কলারশিপ শেষ। ছোটখাটো কাজ করেন। এচিং শেখার পর প্রথম যে কাজটি করেছিলেন তা একটি প্রতিকৃতি নিজের। এরি মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ শুরম্ন হলে দেশে ফেরার পথও বন্ধ হলো।
'যুদ্ধের খবরাখবর পেতে? জিজ্ঞেস করেন হাশেম ভাই। 'পেতাম, খুব একটা না।' বললেন মনির ভাই, 'তখনতো আর কম্পিউটার, মোবাইল নাই। তার ওপর ফ্রাঙ্কোর রাজত্ব। এদিক সেদিক বন্ধুবান্ধব, ট্রানজিস্টারে যা খবর পাইতাম, বাঙালী তো ছিল না।'
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও তিনি ফিরলেন না। তখন ভাষা শিখেছেন, স্পেনীয় জীবনে অভ্যসত্ম হয়ে পড়ছেন। নিজে কিছু কাজ করতে চান।
'ভিসার ব্যাপার সামলালেন কীভাবে?' জিজ্ঞেস করি আমি। সেইটা কোন ঝামেলার ব্যাপার ছিল না। তারিখ শেষ হইলে যাইতাম। বাড়াইয়া দিত। তারপর একদিন বলল, কী মিয়া বার বার সময় বাড়াইয়া লাভ কী। পাসপোর্ট লইয়া লও। তা নিয়ে নিলাম।'
স্পেনে থাকা মনস্থ করার পর কাজ নিলেন তিনি এক ওয়ার্কশপে যেখানে প্রিন্ট করা হতো, হাতে কলমে আরও অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য, ওয়ার্কশপে বিখ্যাত পেইন্টাররা আসতেন। নিজেও কাজ শুরম্ন করলেন। এক্সপেরিমেন্ট শুরম্ন করলেন। অনেকগুলিতে সফল হলেন। এভাবে স্পেনীয় শিল্পীদের সঙ্গে পরিচিত হতে লাগলেন। গ্যালারির সঙ্গে যোগাযোগ হলো।
'পরিচিতিটা হতে লাগল কী ভাবে' জিজ্ঞেস করলেন হাশেম ভাই।
'পরিচিতি কী আর এমনে হয় হাশেম ভাই' হেসে বললেন মনির ভাই, 'পরিশ্রম করতে হয়। তা পরিশ্রম করছি। যে ছাড়া ঐ সময় দুইজন প্রিন্টমেকার আমারে খুব হেল্প করছেন। দুইজনই বিখ্যাত। একজন হলেন এ্যান্থনি সওরা, আরেকজন ফার্নান্দো সোবেল। হয়ত আমার কাজ ভাল লাগছিল। দাঁড়ান। বলে তিনি উঠে তরকারিটা আবার নেড়ে চেড়ে দেখলেন। বললেন, 'কমপিস্নট। কিন্তু মুনতাসীর আপনার ডাইল তো রান্ধি নাই।'
'ডাইল ছাড়াতো আবার মুনতাসীরের মুখে কিছু রোচে না', যোগ করলেন হাশেম ভাই।
'একদিন ডাইল না হইলে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না', আত্মরৰার ভঙ্গিতে আমি বলি্
'তা' হইলে ডিনার সারি', বললেন মনির ভাই।
'বাজে কয়টা?' জানতে চান হাশেম ভাই।
'দশটার বেশি।'
'বলেন কী?' বলি আমি, 'সময়ের যে কিছু তাল পাইতেছি না।'
'খালি তরকারি.' একটু খুঁত খুঁত করেন মনির ভাই, 'সালাদ কাটি।'
মনির ভাই সালাদ তৈরিতে লেগে গেলেন। আমি আর হাশেম ভাই পেস্নট গস্নাস পানির বোতল সাজাতে লাগলাম। সালাদ তৈরি শেষ হলে খাবার বাড়তে থাকেন মনির ভাই। সবশেষে ভিনুর একটা বোতল বের করেন। 'ভিনু না হইলে ডিনার জমে না।' বলে তিনটে আলাদা গস্নাস বের করে ভিনু ঢালেন।
মনোযোগ সহকারে তিনজনই খেতে থাকি। তিনজনই যে ৰুধার্ত ছিলাম তা আগে বুঝিনি।
তা প্রিন্টের দাম কেমন ছিল, 'পুরনো কথার সূত্র ধরে জিজ্ঞেস করি।'
'তখন তো প্রিন্ট করতাম সাদা কালোয়। সেই ১৯৭২-৭৩ সালের কথা কইতাছি। নর্মালি রীতি অনুযায়ী ৭৫ টার এডিশন হইত', ভিনুর গস্নাসে চুমুক দিয়ে বলেন তিনি, 'দাম প্রতিটার ১৫/২০ ডলার। তো বিক্রি হইতে লাগল। বিভিন্ন জায়গায় দেখলাম, আমার প্রিন্ট-লাগানো।'
সেই শুরম্ন জয়যাত্রার। তারপর আর তাকে পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি। এক সময় আমেরিকান গ্যালারিও তার প্রিন্ট নেয়। আর্ট ম্যাগাজিনে প্রচুর বিজ্ঞাপনও দেয়। আসলে এভাবে একজন শিল্পীকে তারা বেছে নিয়ে আসত্মে আসত্মে তার ইমেজ গড়ে তোলে। স্পেনেও বিদেশে তাঁর প্রিন্ট পুরস্কার পেতে থাকে। এভাবে মনিরম্নল ইসলাম স্পেনে পরিচিত ও থিতু হলেন।
এরপর তিনি নিজেই ওয়ার্কশপ করলেন। তাঁর এখানেও নবীন শিল্পীরা কাজ করতে লাগল যেমনটি তিনিও এক সময় করেছিলেন। শহীদ কবিরও প্রথমে স্পেনে গিয়ে তাঁর ওয়ার্কশপে কাজ করেছেন। এখন আর এচিংয়ে তার তেমন মনোযোগ নেই।
খাওয়া শেষ হতে রাত এগারোটার কাছাকাছি। টেবিল পরিষ্কার করে আমরা আবার বসি। মনির ভাই হাশেম ভাই কিছুৰণ আর্ট কলেজের গল্প বলেন। তারপর ঘণ্টা আধেক পর মনির ভাই বলেন, 'চলেন ঘুইরা আসি।'
'এতো রাতে কোথায়?' জিজ্ঞেস করি আমি।
'রাত কোথায়। মাত্র সাড়ে এগারো, রাতের তো শুরম্ন। নেন কাপড় পরেন।'
টেবিল ছেড়ে আমরা তৈরি হতে যাই। ঝটপট তৈরি হয়ে নিই। তৈরি হওয়া আর কি? জুতোটা পরা আর জ্যাকেটটা গায়ে লাগানো। আমরা তিনজন নৈশ অভিযানে বেরম্নই।
(১৮)
ক্যালে আলকালা ধরে গ্রানভিয়ার দিকে অগ্রসর হই। রাতে মাদ্রিদের এদিকটা একেবারে অন্য রকম। রাসত্মাঘাট প্রায় খালি। মাঝে মাঝে চওড়া রাসত্মায় ছুটছে গাড়ি। এ্যাভেনিউর ফুটপাথে এক তরম্নণ স্কেটিং করছে। এক বেঞ্চিতে বসে আছে প্রেমিক প্রেমিকা। একজন জগিং করতে বেরিয়েছে। মাঝে মাঝে অলস পথচারী। নিরাপত্তা মানে ছিনতাই, হাইজ্যাক নিয়ে কেউ চিনত্মিত নয়।
হাঁটতে হাঁটতে কালকো গ্রাফিয়া পেরম্নলাম। সোন ক্রস করে বাঁ দিকে এসে পড়লাম এক বিশাল পস্নাজায়। বললাম, 'এর ছবি তো দেখেছি।' 'পস্নাজা মেয়র,' জানালেন মনির ভাই।
চারকোনা বিশাল চত্বর। চার সীমানায় অট্টালিকা। তিনতলা। পস্নাজা মেয়রের ইতিহাসটা জানা ছিল কিন্তু আচমকা দেখা হয়ে যাবে ভাবিনি। এই পস্নাজা মেয়র নির্মাণে দু'এক শতক লেগেছে। এর পরিকল্পনা করেছিলেন সেই বিখ্যাত দ্বিতীয় ফিলিপ (১৫৫৬-১৫৯৮)। কোথাও লেখা নেই, তবে, অনুমান করে নিচ্ছি, টলেডো থেকে যখন রাজধানী মাদ্রিদে সরিয়ে আনেন ফিলিপ তখন মাদ্রিদকে নতুনভাবে সাজানোর জন্যই হয়ত পস্নাজা মেয়রের পরিকল্পনা করেছিলেন।
এখানে পনের শতকে মাদ্রিদকে ঘিরে একটি প্রাচীর ছিল, ফটকও ছিল একটি যার নাম গুয়াদালাজারা ফটক। এসকোরিয়াল মঠের সেরা ক্রাফটসম্যান হুয়ান দ্য হেরবেরার ওপর ভার দেয়া হয়েছিল পরিকল্পনার। ১৫৯০ সালে স্থপতি হুয়ান গোমেজ দ্য মোরা নির্মাণ কাজ শুরম্ন করেন, শেষ হয় তৃতীয় ফিলিপের (১৬১৭-২০) রাজত্বের শেষ দিকে। তৃতীয় ফিলিপ চেয়েছিলেন এর নামকরণ হোক দ্বিতীয় ফিলিপের নামে। পস্নাজায় আছে বাঁকানো আর্টের ফটক সংবলিত ন'টি প্রবেশ পথ। তিন সারিতে চারশ' ব্যালকনি যা রট-আয়রণে ঘেরা। পস্নাজার যে রূপ আমরা এখন দেখছি তা নিশ্চয় আগে ছিল না। বিভিন্ন সময় পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। যেমন ১৬৭১ ও ১৬৭২ সালে আগুনে দৰিণ ও উত্তর দিক পুড়ে গিয়েছিল। পরে তা আবার নির্মিত হয়। অষ্টাদশ শতকে হুয়ান দ্য ভিলানুয়েভা নিউকাসিক্যাল পদ্ধতিতে খানিকটা সংস্কার করেন।
পস্নাজার শোভাবর্ধন করছে দ্বিতীয় ফিলিপের একটি মূর্তি। তুসকানির ভাস্কর পিয়েত্রো তাক্কা এর মডেল নির্মাণ করেন। পরে ফোরেন্সে জিয়ামবোলোনা তা নির্মাণ করেন। ১৬১৬ সালে তা ফোরেন্স থেকে মাদ্রিদ নিয়ে আসা হয়। প্রথমে ভাস্কর্যটি বিয়াল কাসা দ্য কাম্পোতে স্থাপন করা হয়েছিল। ১৮৪৮ সাল পর্যনত্ম তা সেখানেই ছিল। তারপর দ্বিতীয় ইসাবেলা তা স্থানানত্মর করেন পস্নাজা মেয়রে।
পস্নাজা মেয়রে এই গভীর রাতেও মেলা মানুষজন ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমার কাছে গভীর রাত মনে হলেও এদের কাছে রাত হয়ত নবীন। প্রেমিক-প্রেমিকা বেঞ্চিতে আধো আলো আধো অন্ধকারে নিমগ্ন। পর্যটকরা দল বেঁধে ছবি তুলছে। কেউ একা পায়চারি করছে। যে যার মতো সময় উপভোগ করছে।
আমরা খানিকটা দৰিণে এগোই। দু'টি উঁচু টাওয়ারঅলা ইমারত, নাম বিয়াল কাসা দ্য লা পানাদেরিয়া। এটি শুরম্ন করেছিলেন সিলেস্নরো। শেষ করেছেন গোমেজ দ্য মোরা। নিচ তলায় ছিল বেকারি (সেজন্য এলাম) দ্বিতীয় তলায় বিশেষ রাজনৈতিক, ধমর্ীয় বা সামাজিক উৎসবের সময় সম্রাট থাকতেন। এখানে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সম্রাট বা তার পরিবারের সদস্যরা বুল ফাইট থেকে শুরম্ন করে অপরাধীর শিরশ্ছেদ সবই অবলোকন করতেন। এখন সেই সম্রাটও নেই, সেইসব উৎসবও নেই। নিচ তলায় সব দোকান আর কাফে। রবিবারে সকালে এখানে ডাকটিকিট প্রেমীদের ভিড় জমে। এই দৰিণের পোর্টিকোর নিচে বসে ডাকটিকেটের হাট।
এক চক্কর দেয়ার পর মনির ভাই বলেন, 'চলেন।' তাঁর পিছু হাঁটতে থাকি। বারান্দা যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে একটি ফটক। বারান্দার একপাশে চিত্রশিল্পীরা তাদের পসরা বিছিয়ে বসে আছে। নেড়েচেড়ে কিছু দেখলাম। তারপর বারান্দা পেরিয়ে সরম্ন গলি। দু'পাশে ছোট ছোট কাফে। জায়গাটা উঁচু নিচু। হয়ত টিলার মতো ছিল। গুহার মতো একটি জায়গায় নেমে দেখি অতি পুরনো এক বার। হয়ত দু'তিন শ' বছরের পুরনো। ঠিক যেমনটি ছিল তেমনটি রাখা হয়েছে। উঁচু নিচু গলি পেরিয়ে সমতলে চলে এলাম। ছোটখাটো আরেকটি পস্নাজা_ পস্নাজা সানতোরি। এখানেও তার পাশে রেসত্মরাঁ আর বার। লোকজন কম হলেও প্রতিটি রেসত্মরাঁ বা বারে খদ্দের আছে। সেগুলি দেখতে দেখতে এক প্রানত্মে একবার দেখে মনির ভাই বললেন, 'চলেন, একটু গলা ভেজাই।'
ঢুকলাম বারে। এক পাশে দু'টি ছোট বেঞ্চ আর টেবিল। তাতে খদ্দের। কাউন্টারের সামনে দু' একটি টুল তাতেও খদ্দের। আমরা কাউন্টারের সামনে দাঁড়ালাম। এক পাশে এক বয়েসী ভদ্রলোক ভদ্রমহিলা পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে খুব নিচু গলায় কথা বলছেন। কাউন্টারে তাদের মদের গস্নাস। মাঝে মাঝে গস্নাস তুলে চুমুক দিছেন।
মনির ভাই বললেন, কানত্মিলিয়নে, 'তিন তিনতো।' তিনতো হচ্ছে রক্তিম মদিরা। তিনতো দেয়ার আগে ওয়াটার একটি তস্তুরিতে অলিভ তেলে মাখানো জলপাই দিল। আরবিতে যাকে বলা হয় জাউতুন, স্পেনীয়তে আমাইতুনা। জাইতুন মুখে দিয়ে আবার চারপাশ দেখি। নিঃশব্দেই পান চলছে। পাশে টুলে বসা খদ্দের টাকা মিটিয়ে চলে যায়। এখন আমরা তিনজন আর সেই বয়েসী প্রেমিক-প্রেমিকা। সরাসরি তাকানোটা তো অভদ্রতা তাও মাঝে মাঝে আড়চোখে দেখি। তারা আরও নিমগ্ন। একবার হাতে হাত রেখে চোখে চোখ তাকালো দু'জন দু'জনার।
'মনির ভাই, সময় বোধহয় ফুরিয়ে যায়নি এখনও', বয়সী দুই মানব-মানবীকে ইঙ্গিত করে বললাম। 'আর বয়স! শোনেন তা হলে।' তিনতোয় এক চুমকু দিয়ে বললেন, গেছি_শহরে। আমরা অনেকে আছি, বাঙালি সব নামী শিল্পী ক খ গ ঘ_সব। সারাদিন ছবি অাঁকি। রাতে বসে ফুর্তির আসর। আমাদের ফুর্তি তো বোঝেন, মদ আর সিগারেট। আর মদ খেলে আমাদের অনেক শিল্পীর আবার তাল থাকে না। একদিন সন্ধ্যায়, দু'পেগ খাওয়ার পর ক ভাই বলেন, মনির তোমার বয়স ১০/১১ তখন আমি এসেছিলাম এই শহরে। ভরা যৌবন, ছবি অাঁকি। আর আর্টিস্ট মানেই তো পাসপোর্ট। প্রেমে পড়ে গেলাম ভাই। কেন যে বিয়ে হলো না। চলে এলাম দেশে। আজ ৫০ বছর পর এসেছি এই শহরে মনে বড় বাসনা তার সঙ্গে একবার দেখা হোক।'
'দুই পেগ খেয়ে কি আপনার সব গোলমাল হয়ে গেল?' উত্তর দেন মনির ভাই, ৫০ বছর আগে যার সঙ্গে ভাবসাব হয়েছিল তার এখনও আপনার কথা মনে আছে এ কথা কেন মনে হলো? দেখা হলেই আপনাকে চিনবে এটাই বা ভাবছেন কেন? ইউরোপে কোন তরম্নণী ৫০ বছর একই জায়গায় থাকবে এ ধারণা কীভাবে হলো?'
'না না মনির তুমি জানো না। সে আমাকে খুব ভালোবাসতো, জানালেন ক, পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বের করে মনির ভাইকে দিয়ে বললেন, 'এই তার ফোন নাম্বার। তুমি তাকে ধরে দাও।' 'ক ভাই আপনি কন কী? 'মনির ভাই আর কখনও এতো বিস্মিত হন নি, '৫০ বছর আগের ফোন নাম্বার দিয়া আমি কী করাম? তিনি নাছোড়বান্দা। আমি বললাম, ৫০ বছর বোঝেন? ৫০ বছর আগে আমি বালক ছিলাম। এখন আমার পোলা বালক। আপনার ঐ মাইয়া মইরা গেছে না বাইচ্চা আছে জানি কেমনে? উনি কন, না বাইচ্চা আছে, ঐ নাম্বারেই আছে। ধর্ম বিশ্বাসের মতোন আর কী! কী আর করমু। কে ফোন খুইজা পাইতা ফোনের চেষ্টা কললাম। তা ৫০ বছর আগের ফোন সিস্টেম তো এখন ডিজিটাল। পাম কেমনে?'
'তার পর?' জিজ্ঞেস করি আমি, 'তা ভাই, এতো পুরানা মানুষটা প্রায় কাইন্দা ফেলেন আর কী। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।'
'এরই নাম প্রেম,' সহাস্যে গস্নাসে চুমুক দিয়ে বলি, 'এই জন্যই প্রবাদ হয়েছে প্রেমের মরা জলে ডুবে না।
এমন সময় লম্বা গাটঅলা কিছু গোলাপ নিয়ে এক বাঙালি যুবক ঢুকল। বেশভূষা মলিন। এরকম ফুলের গোছা হাতে নিয়ে প্রচুর বাঙালি যুবককে আমি ঘোরাফেরা করতে দেখেছি রোমের স্পেনিশ সিড়িতে। যুবকটি ঠিকই বুঝে নিয়েছে আমরা তার মক্কেল না। সোজা সে একটি লম্বা ডাটঅলা গোলাপ বেজে নিয়ে বয়সী মানুষটার কাছে দাঁড়াল। এক ঝলক তাকিয়ে তিনি দু'টি গোলাপ নিলেন। গোলাম অলা চলে গেলে মানবীর দিকে এগিয়ে ছিলেন গোলাপ দু'টি। বিনম্রভাবে গোলাপ গ্রহণ করলেন বোড়া মহিলা। দু'জনের মুখেই স্মিত হাসি। আমরা তিনজন যার যার দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনতোতে চুমুক দিই। খানিকপর তারা বেরিয়ে যান হাসিমুখে। মনির ভাই বলেন, 'চলেন, আমরাও বেরম্নই।
মনির ভাই-র পিছু পিছু আবার বেরোই ভিড় খানিকটা পাতলা হয়ে গেছে। এ গলি সে গলি পেরিয়ে আরেকটি বার দেখিয়ে বললেন, 'বলেন এইটাতে ঢুকি।'
এখানে আমরা বসার জায়গা পেয়ে যাই। ওয়েটার এসে দাঁড়ায়। মনির ভাই বলেন, 'কী খাবেন?'
'খেয়ে তো এলাম, 'হাশেম ভাই জানান।
'আরে ঐটাতো বাসার খাবার,' তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন তিনি, 'পরে বইসা কিছু খাওয়ন লাগব না?' তিনি এরি মাঝে ওয়েটারের সঙ্গে কথা অব্যাহত রেখেছেন। মিনিট খানেক দু'জনের কথোপকথন চলে। মনির ভাই তারপর বলেন, 'ইকোরত্তের পোলা। সামারে কাজের জন্য আইছে।'
(চলবে)
'ছবিটা আনতে পারছি না', স্টুডিওতে না থাকার ব্যাখ্যা দেন এক বাক্যে।
'আচ্ছা, মনির ভাই,' বলি আমি, 'আপনার স্পেনের গল্পইতো শোনা হলো না।'
'আর কী শুনবেন?' মনির ভাই হাত নেড়ে উড়িয়ে দেন স্পেনে থাকার বিষয়টা।
'আপনি স্পেনে এলেন কবে?'
'১৯৬৯ সালের দিকে, 'একটু ভেবে বললেন মনির ভাই।
'পাকিস্তান সরকারের স্কলারশিপে। চিত্রকলা লেখার একটা স্কলারশিপ ছিল। পেলাম।'
'স্পেনে তখন বাঙালী ছিল।'
'না, ঠিক জানি না, আমি যখন আইলাম তখন এক বাঙালীর নাম শুনছি কমলা প্রসন্ন রায়। হিপি ছিলেন। এখানকার না [মানে বাংলাদেশের], ওই খানকার। তা মনে হয় ঘুরতে ঘুরতে স্পেন আইসা পড়েন। বিয়াও করছিলেন এক হিপিকে। অবশ্য আমার সঙ্গে তেমন জান পহচান ছিল না।' কথা শেষ করে সিগারেটে টান দেন।
'তা এসে ভর্তি হলেন কোথায়?'
সান ফার্নান্দো বেইয়াস আর্টস। ঢাকা থেকে তো আইসা উঠলাম ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলে। সব বিদেশী, আমিই বাঙালী। আসলে কী শিখব, কোথায় ভর্তি হবো সে সম্পর্কে গৎবাধা নিয়ম ছিল না। সান ফার্নান্দোর কথা বোধ হয় লেখা ছিল তাই সেখানে গেলাম। যাক কাস শুরম্ন হলো। দেখি বিটল লাইফ আঁকতে দিচ্ছে। এদিকে আমিইতো আর্ট কলেজে ছাত্রদের কয়েক বছর স্টিল লাইফ আঁকা শিখাইছি। বিদায় জানাইলাম সান ফার্নান্দোকে'।
এদিকে হাশেম ভাই লেখা ছেড়ে উঠে এসেছেন। জিজ্ঞেস করলাম, 'কী ব্যাপার হাশেম ভাই লেখা শেষ।'
'দূর, দুই পাতা লিখছি। এর থেকে ছবি আঁকা সোজা। কাল দেখা যাবে।' নিশ্চিত সিদ্ধানত্ম দিয়ে কফির কাপ নিয়ে বসে পড়লেন তাঁর নির্দিষ্ট জায়গায়।
'তারপর', জিজ্ঞেস করি মনির ভাইকে।
'কী করি, ঠিক বুঝতাছি না। হোস্টেলে জনা ষাট ছাত্র। তেমন কাউরে চিনি না।
আমার রম্নমমেট ছিল এক ফিলিপিনো। তার সঙ্গে সমস্যা নিয়ে আলাপ করলাম। সে বলল এ্যাপস্নাইড আর্ট স্কুল আছে সেখানে সে এচিং লিখতাছে। 'বুঝলেন মনতাসীর রম্নম মেট ক্যান চেঞ্জ ইয়োর ফুল লাইফ।' কী রকম, জিজ্ঞেস করি আমি।
মনির ভাই বললেন, 'দাঁড়ান', বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে তরকারি নাড়তে গেলেন। নুন চাখলেন। তারপর ফের চেয়ারে এসে বসলেন। সিগারেট ধরালেন একটা। খানিক চুপ থেকে বললেন, 'তারে জিজ্ঞাস করলাম, কী করতাছ। তখন সে দেখাল কয়েকটা এচিং। মনে হইল, এটাই শিখতে হইব।
তা তার সঙ্গে পরদিন গিয়া সে স্কুলে ভর্তি হইলাম। কাজ দেখা শুরম্ন করলাম। আমার টিচার ছিলেন নামকরা, নাম আলফ্রেনসো সানতেস তোলা।'
মনির ভাই ছাড়া সবে যে স্মৃতিচারণ করলেন তাতে যে কাহিনীটা পাওয়া গেল তা' হলো প্রায় নয় মাস তিনি কাজ শেখেন। স্কলারশিপ ছিল নয় মাসের। পেতেন তিন হাজার পেসেতা। টাকার অঙ্কে বিশাল মনে হয়। কিন্তু আসলে তা আজকের ত্রিশ ডলার। এখন এক ইউরো সমান ১৬৫ পেসেতা।
স্কলারশিপ শেষ হয়ে গেলে ভাবলেন আরও কিছুদিন থাকবেন। এদিকে স্কলারশিপ শেষ। ছোটখাটো কাজ করেন। এচিং শেখার পর প্রথম যে কাজটি করেছিলেন তা একটি প্রতিকৃতি নিজের। এরি মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ শুরম্ন হলে দেশে ফেরার পথও বন্ধ হলো।
'যুদ্ধের খবরাখবর পেতে? জিজ্ঞেস করেন হাশেম ভাই। 'পেতাম, খুব একটা না।' বললেন মনির ভাই, 'তখনতো আর কম্পিউটার, মোবাইল নাই। তার ওপর ফ্রাঙ্কোর রাজত্ব। এদিক সেদিক বন্ধুবান্ধব, ট্রানজিস্টারে যা খবর পাইতাম, বাঙালী তো ছিল না।'
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও তিনি ফিরলেন না। তখন ভাষা শিখেছেন, স্পেনীয় জীবনে অভ্যসত্ম হয়ে পড়ছেন। নিজে কিছু কাজ করতে চান।
'ভিসার ব্যাপার সামলালেন কীভাবে?' জিজ্ঞেস করি আমি। সেইটা কোন ঝামেলার ব্যাপার ছিল না। তারিখ শেষ হইলে যাইতাম। বাড়াইয়া দিত। তারপর একদিন বলল, কী মিয়া বার বার সময় বাড়াইয়া লাভ কী। পাসপোর্ট লইয়া লও। তা নিয়ে নিলাম।'
স্পেনে থাকা মনস্থ করার পর কাজ নিলেন তিনি এক ওয়ার্কশপে যেখানে প্রিন্ট করা হতো, হাতে কলমে আরও অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য, ওয়ার্কশপে বিখ্যাত পেইন্টাররা আসতেন। নিজেও কাজ শুরম্ন করলেন। এক্সপেরিমেন্ট শুরম্ন করলেন। অনেকগুলিতে সফল হলেন। এভাবে স্পেনীয় শিল্পীদের সঙ্গে পরিচিত হতে লাগলেন। গ্যালারির সঙ্গে যোগাযোগ হলো।
'পরিচিতিটা হতে লাগল কী ভাবে' জিজ্ঞেস করলেন হাশেম ভাই।
'পরিচিতি কী আর এমনে হয় হাশেম ভাই' হেসে বললেন মনির ভাই, 'পরিশ্রম করতে হয়। তা পরিশ্রম করছি। যে ছাড়া ঐ সময় দুইজন প্রিন্টমেকার আমারে খুব হেল্প করছেন। দুইজনই বিখ্যাত। একজন হলেন এ্যান্থনি সওরা, আরেকজন ফার্নান্দো সোবেল। হয়ত আমার কাজ ভাল লাগছিল। দাঁড়ান। বলে তিনি উঠে তরকারিটা আবার নেড়ে চেড়ে দেখলেন। বললেন, 'কমপিস্নট। কিন্তু মুনতাসীর আপনার ডাইল তো রান্ধি নাই।'
'ডাইল ছাড়াতো আবার মুনতাসীরের মুখে কিছু রোচে না', যোগ করলেন হাশেম ভাই।
'একদিন ডাইল না হইলে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না', আত্মরৰার ভঙ্গিতে আমি বলি্
'তা' হইলে ডিনার সারি', বললেন মনির ভাই।
'বাজে কয়টা?' জানতে চান হাশেম ভাই।
'দশটার বেশি।'
'বলেন কী?' বলি আমি, 'সময়ের যে কিছু তাল পাইতেছি না।'
'খালি তরকারি.' একটু খুঁত খুঁত করেন মনির ভাই, 'সালাদ কাটি।'
মনির ভাই সালাদ তৈরিতে লেগে গেলেন। আমি আর হাশেম ভাই পেস্নট গস্নাস পানির বোতল সাজাতে লাগলাম। সালাদ তৈরি শেষ হলে খাবার বাড়তে থাকেন মনির ভাই। সবশেষে ভিনুর একটা বোতল বের করেন। 'ভিনু না হইলে ডিনার জমে না।' বলে তিনটে আলাদা গস্নাস বের করে ভিনু ঢালেন।
মনোযোগ সহকারে তিনজনই খেতে থাকি। তিনজনই যে ৰুধার্ত ছিলাম তা আগে বুঝিনি।
তা প্রিন্টের দাম কেমন ছিল, 'পুরনো কথার সূত্র ধরে জিজ্ঞেস করি।'
'তখন তো প্রিন্ট করতাম সাদা কালোয়। সেই ১৯৭২-৭৩ সালের কথা কইতাছি। নর্মালি রীতি অনুযায়ী ৭৫ টার এডিশন হইত', ভিনুর গস্নাসে চুমুক দিয়ে বলেন তিনি, 'দাম প্রতিটার ১৫/২০ ডলার। তো বিক্রি হইতে লাগল। বিভিন্ন জায়গায় দেখলাম, আমার প্রিন্ট-লাগানো।'
সেই শুরম্ন জয়যাত্রার। তারপর আর তাকে পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি। এক সময় আমেরিকান গ্যালারিও তার প্রিন্ট নেয়। আর্ট ম্যাগাজিনে প্রচুর বিজ্ঞাপনও দেয়। আসলে এভাবে একজন শিল্পীকে তারা বেছে নিয়ে আসত্মে আসত্মে তার ইমেজ গড়ে তোলে। স্পেনেও বিদেশে তাঁর প্রিন্ট পুরস্কার পেতে থাকে। এভাবে মনিরম্নল ইসলাম স্পেনে পরিচিত ও থিতু হলেন।
এরপর তিনি নিজেই ওয়ার্কশপ করলেন। তাঁর এখানেও নবীন শিল্পীরা কাজ করতে লাগল যেমনটি তিনিও এক সময় করেছিলেন। শহীদ কবিরও প্রথমে স্পেনে গিয়ে তাঁর ওয়ার্কশপে কাজ করেছেন। এখন আর এচিংয়ে তার তেমন মনোযোগ নেই।
খাওয়া শেষ হতে রাত এগারোটার কাছাকাছি। টেবিল পরিষ্কার করে আমরা আবার বসি। মনির ভাই হাশেম ভাই কিছুৰণ আর্ট কলেজের গল্প বলেন। তারপর ঘণ্টা আধেক পর মনির ভাই বলেন, 'চলেন ঘুইরা আসি।'
'এতো রাতে কোথায়?' জিজ্ঞেস করি আমি।
'রাত কোথায়। মাত্র সাড়ে এগারো, রাতের তো শুরম্ন। নেন কাপড় পরেন।'
টেবিল ছেড়ে আমরা তৈরি হতে যাই। ঝটপট তৈরি হয়ে নিই। তৈরি হওয়া আর কি? জুতোটা পরা আর জ্যাকেটটা গায়ে লাগানো। আমরা তিনজন নৈশ অভিযানে বেরম্নই।
(১৮)
ক্যালে আলকালা ধরে গ্রানভিয়ার দিকে অগ্রসর হই। রাতে মাদ্রিদের এদিকটা একেবারে অন্য রকম। রাসত্মাঘাট প্রায় খালি। মাঝে মাঝে চওড়া রাসত্মায় ছুটছে গাড়ি। এ্যাভেনিউর ফুটপাথে এক তরম্নণ স্কেটিং করছে। এক বেঞ্চিতে বসে আছে প্রেমিক প্রেমিকা। একজন জগিং করতে বেরিয়েছে। মাঝে মাঝে অলস পথচারী। নিরাপত্তা মানে ছিনতাই, হাইজ্যাক নিয়ে কেউ চিনত্মিত নয়।
হাঁটতে হাঁটতে কালকো গ্রাফিয়া পেরম্নলাম। সোন ক্রস করে বাঁ দিকে এসে পড়লাম এক বিশাল পস্নাজায়। বললাম, 'এর ছবি তো দেখেছি।' 'পস্নাজা মেয়র,' জানালেন মনির ভাই।
চারকোনা বিশাল চত্বর। চার সীমানায় অট্টালিকা। তিনতলা। পস্নাজা মেয়রের ইতিহাসটা জানা ছিল কিন্তু আচমকা দেখা হয়ে যাবে ভাবিনি। এই পস্নাজা মেয়র নির্মাণে দু'এক শতক লেগেছে। এর পরিকল্পনা করেছিলেন সেই বিখ্যাত দ্বিতীয় ফিলিপ (১৫৫৬-১৫৯৮)। কোথাও লেখা নেই, তবে, অনুমান করে নিচ্ছি, টলেডো থেকে যখন রাজধানী মাদ্রিদে সরিয়ে আনেন ফিলিপ তখন মাদ্রিদকে নতুনভাবে সাজানোর জন্যই হয়ত পস্নাজা মেয়রের পরিকল্পনা করেছিলেন।
এখানে পনের শতকে মাদ্রিদকে ঘিরে একটি প্রাচীর ছিল, ফটকও ছিল একটি যার নাম গুয়াদালাজারা ফটক। এসকোরিয়াল মঠের সেরা ক্রাফটসম্যান হুয়ান দ্য হেরবেরার ওপর ভার দেয়া হয়েছিল পরিকল্পনার। ১৫৯০ সালে স্থপতি হুয়ান গোমেজ দ্য মোরা নির্মাণ কাজ শুরম্ন করেন, শেষ হয় তৃতীয় ফিলিপের (১৬১৭-২০) রাজত্বের শেষ দিকে। তৃতীয় ফিলিপ চেয়েছিলেন এর নামকরণ হোক দ্বিতীয় ফিলিপের নামে। পস্নাজায় আছে বাঁকানো আর্টের ফটক সংবলিত ন'টি প্রবেশ পথ। তিন সারিতে চারশ' ব্যালকনি যা রট-আয়রণে ঘেরা। পস্নাজার যে রূপ আমরা এখন দেখছি তা নিশ্চয় আগে ছিল না। বিভিন্ন সময় পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। যেমন ১৬৭১ ও ১৬৭২ সালে আগুনে দৰিণ ও উত্তর দিক পুড়ে গিয়েছিল। পরে তা আবার নির্মিত হয়। অষ্টাদশ শতকে হুয়ান দ্য ভিলানুয়েভা নিউকাসিক্যাল পদ্ধতিতে খানিকটা সংস্কার করেন।
পস্নাজার শোভাবর্ধন করছে দ্বিতীয় ফিলিপের একটি মূর্তি। তুসকানির ভাস্কর পিয়েত্রো তাক্কা এর মডেল নির্মাণ করেন। পরে ফোরেন্সে জিয়ামবোলোনা তা নির্মাণ করেন। ১৬১৬ সালে তা ফোরেন্স থেকে মাদ্রিদ নিয়ে আসা হয়। প্রথমে ভাস্কর্যটি বিয়াল কাসা দ্য কাম্পোতে স্থাপন করা হয়েছিল। ১৮৪৮ সাল পর্যনত্ম তা সেখানেই ছিল। তারপর দ্বিতীয় ইসাবেলা তা স্থানানত্মর করেন পস্নাজা মেয়রে।
পস্নাজা মেয়রে এই গভীর রাতেও মেলা মানুষজন ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমার কাছে গভীর রাত মনে হলেও এদের কাছে রাত হয়ত নবীন। প্রেমিক-প্রেমিকা বেঞ্চিতে আধো আলো আধো অন্ধকারে নিমগ্ন। পর্যটকরা দল বেঁধে ছবি তুলছে। কেউ একা পায়চারি করছে। যে যার মতো সময় উপভোগ করছে।
আমরা খানিকটা দৰিণে এগোই। দু'টি উঁচু টাওয়ারঅলা ইমারত, নাম বিয়াল কাসা দ্য লা পানাদেরিয়া। এটি শুরম্ন করেছিলেন সিলেস্নরো। শেষ করেছেন গোমেজ দ্য মোরা। নিচ তলায় ছিল বেকারি (সেজন্য এলাম) দ্বিতীয় তলায় বিশেষ রাজনৈতিক, ধমর্ীয় বা সামাজিক উৎসবের সময় সম্রাট থাকতেন। এখানে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সম্রাট বা তার পরিবারের সদস্যরা বুল ফাইট থেকে শুরম্ন করে অপরাধীর শিরশ্ছেদ সবই অবলোকন করতেন। এখন সেই সম্রাটও নেই, সেইসব উৎসবও নেই। নিচ তলায় সব দোকান আর কাফে। রবিবারে সকালে এখানে ডাকটিকিট প্রেমীদের ভিড় জমে। এই দৰিণের পোর্টিকোর নিচে বসে ডাকটিকেটের হাট।
এক চক্কর দেয়ার পর মনির ভাই বলেন, 'চলেন।' তাঁর পিছু হাঁটতে থাকি। বারান্দা যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে একটি ফটক। বারান্দার একপাশে চিত্রশিল্পীরা তাদের পসরা বিছিয়ে বসে আছে। নেড়েচেড়ে কিছু দেখলাম। তারপর বারান্দা পেরিয়ে সরম্ন গলি। দু'পাশে ছোট ছোট কাফে। জায়গাটা উঁচু নিচু। হয়ত টিলার মতো ছিল। গুহার মতো একটি জায়গায় নেমে দেখি অতি পুরনো এক বার। হয়ত দু'তিন শ' বছরের পুরনো। ঠিক যেমনটি ছিল তেমনটি রাখা হয়েছে। উঁচু নিচু গলি পেরিয়ে সমতলে চলে এলাম। ছোটখাটো আরেকটি পস্নাজা_ পস্নাজা সানতোরি। এখানেও তার পাশে রেসত্মরাঁ আর বার। লোকজন কম হলেও প্রতিটি রেসত্মরাঁ বা বারে খদ্দের আছে। সেগুলি দেখতে দেখতে এক প্রানত্মে একবার দেখে মনির ভাই বললেন, 'চলেন, একটু গলা ভেজাই।'
ঢুকলাম বারে। এক পাশে দু'টি ছোট বেঞ্চ আর টেবিল। তাতে খদ্দের। কাউন্টারের সামনে দু' একটি টুল তাতেও খদ্দের। আমরা কাউন্টারের সামনে দাঁড়ালাম। এক পাশে এক বয়েসী ভদ্রলোক ভদ্রমহিলা পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে খুব নিচু গলায় কথা বলছেন। কাউন্টারে তাদের মদের গস্নাস। মাঝে মাঝে গস্নাস তুলে চুমুক দিছেন।
মনির ভাই বললেন, কানত্মিলিয়নে, 'তিন তিনতো।' তিনতো হচ্ছে রক্তিম মদিরা। তিনতো দেয়ার আগে ওয়াটার একটি তস্তুরিতে অলিভ তেলে মাখানো জলপাই দিল। আরবিতে যাকে বলা হয় জাউতুন, স্পেনীয়তে আমাইতুনা। জাইতুন মুখে দিয়ে আবার চারপাশ দেখি। নিঃশব্দেই পান চলছে। পাশে টুলে বসা খদ্দের টাকা মিটিয়ে চলে যায়। এখন আমরা তিনজন আর সেই বয়েসী প্রেমিক-প্রেমিকা। সরাসরি তাকানোটা তো অভদ্রতা তাও মাঝে মাঝে আড়চোখে দেখি। তারা আরও নিমগ্ন। একবার হাতে হাত রেখে চোখে চোখ তাকালো দু'জন দু'জনার।
'মনির ভাই, সময় বোধহয় ফুরিয়ে যায়নি এখনও', বয়সী দুই মানব-মানবীকে ইঙ্গিত করে বললাম। 'আর বয়স! শোনেন তা হলে।' তিনতোয় এক চুমকু দিয়ে বললেন, গেছি_শহরে। আমরা অনেকে আছি, বাঙালি সব নামী শিল্পী ক খ গ ঘ_সব। সারাদিন ছবি অাঁকি। রাতে বসে ফুর্তির আসর। আমাদের ফুর্তি তো বোঝেন, মদ আর সিগারেট। আর মদ খেলে আমাদের অনেক শিল্পীর আবার তাল থাকে না। একদিন সন্ধ্যায়, দু'পেগ খাওয়ার পর ক ভাই বলেন, মনির তোমার বয়স ১০/১১ তখন আমি এসেছিলাম এই শহরে। ভরা যৌবন, ছবি অাঁকি। আর আর্টিস্ট মানেই তো পাসপোর্ট। প্রেমে পড়ে গেলাম ভাই। কেন যে বিয়ে হলো না। চলে এলাম দেশে। আজ ৫০ বছর পর এসেছি এই শহরে মনে বড় বাসনা তার সঙ্গে একবার দেখা হোক।'
'দুই পেগ খেয়ে কি আপনার সব গোলমাল হয়ে গেল?' উত্তর দেন মনির ভাই, ৫০ বছর আগে যার সঙ্গে ভাবসাব হয়েছিল তার এখনও আপনার কথা মনে আছে এ কথা কেন মনে হলো? দেখা হলেই আপনাকে চিনবে এটাই বা ভাবছেন কেন? ইউরোপে কোন তরম্নণী ৫০ বছর একই জায়গায় থাকবে এ ধারণা কীভাবে হলো?'
'না না মনির তুমি জানো না। সে আমাকে খুব ভালোবাসতো, জানালেন ক, পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বের করে মনির ভাইকে দিয়ে বললেন, 'এই তার ফোন নাম্বার। তুমি তাকে ধরে দাও।' 'ক ভাই আপনি কন কী? 'মনির ভাই আর কখনও এতো বিস্মিত হন নি, '৫০ বছর আগের ফোন নাম্বার দিয়া আমি কী করাম? তিনি নাছোড়বান্দা। আমি বললাম, ৫০ বছর বোঝেন? ৫০ বছর আগে আমি বালক ছিলাম। এখন আমার পোলা বালক। আপনার ঐ মাইয়া মইরা গেছে না বাইচ্চা আছে জানি কেমনে? উনি কন, না বাইচ্চা আছে, ঐ নাম্বারেই আছে। ধর্ম বিশ্বাসের মতোন আর কী! কী আর করমু। কে ফোন খুইজা পাইতা ফোনের চেষ্টা কললাম। তা ৫০ বছর আগের ফোন সিস্টেম তো এখন ডিজিটাল। পাম কেমনে?'
'তার পর?' জিজ্ঞেস করি আমি, 'তা ভাই, এতো পুরানা মানুষটা প্রায় কাইন্দা ফেলেন আর কী। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।'
'এরই নাম প্রেম,' সহাস্যে গস্নাসে চুমুক দিয়ে বলি, 'এই জন্যই প্রবাদ হয়েছে প্রেমের মরা জলে ডুবে না।
এমন সময় লম্বা গাটঅলা কিছু গোলাপ নিয়ে এক বাঙালি যুবক ঢুকল। বেশভূষা মলিন। এরকম ফুলের গোছা হাতে নিয়ে প্রচুর বাঙালি যুবককে আমি ঘোরাফেরা করতে দেখেছি রোমের স্পেনিশ সিড়িতে। যুবকটি ঠিকই বুঝে নিয়েছে আমরা তার মক্কেল না। সোজা সে একটি লম্বা ডাটঅলা গোলাপ বেজে নিয়ে বয়সী মানুষটার কাছে দাঁড়াল। এক ঝলক তাকিয়ে তিনি দু'টি গোলাপ নিলেন। গোলাম অলা চলে গেলে মানবীর দিকে এগিয়ে ছিলেন গোলাপ দু'টি। বিনম্রভাবে গোলাপ গ্রহণ করলেন বোড়া মহিলা। দু'জনের মুখেই স্মিত হাসি। আমরা তিনজন যার যার দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনতোতে চুমুক দিই। খানিকপর তারা বেরিয়ে যান হাসিমুখে। মনির ভাই বলেন, 'চলেন, আমরাও বেরম্নই।
মনির ভাই-র পিছু পিছু আবার বেরোই ভিড় খানিকটা পাতলা হয়ে গেছে। এ গলি সে গলি পেরিয়ে আরেকটি বার দেখিয়ে বললেন, 'বলেন এইটাতে ঢুকি।'
এখানে আমরা বসার জায়গা পেয়ে যাই। ওয়েটার এসে দাঁড়ায়। মনির ভাই বলেন, 'কী খাবেন?'
'খেয়ে তো এলাম, 'হাশেম ভাই জানান।
'আরে ঐটাতো বাসার খাবার,' তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন তিনি, 'পরে বইসা কিছু খাওয়ন লাগব না?' তিনি এরি মাঝে ওয়েটারের সঙ্গে কথা অব্যাহত রেখেছেন। মিনিট খানেক দু'জনের কথোপকথন চলে। মনির ভাই তারপর বলেন, 'ইকোরত্তের পোলা। সামারে কাজের জন্য আইছে।'
(চলবে)
No comments