‘রথ ভাবে আমি দেব, পথ ভাবে আমি মূর্তি ভাবে আমি দেব by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
বুড়ো বয়সে বিপত্নীক হওয়া যে কী দুঃসহ যাতনার ব্যাপার এখন তা আমি মর্মে মর্মে অনুভব করছি। বুড়ো বয়সে মানুষ এমনিতেই নিঃসঙ্গ, একাকী হয়ে যায়, তারপর স্ত্রী হারানোর ফলে যে একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতা সৃষ্টি হয় সে যাতনা, সে বেদনা সহ্যাতীত।
১৮ ডিসেম্বর মঙ্গলবার আমার স্ত্রী সেলিমা আফরোজ চৌধুরী লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পর ম্যাথুয়েন রোডের এই শূন্য বাড়িটাতে ফিরে এসে যে একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতার বেদনা, শোক ও যাতনা বহন করছি, তা কাউকে বুঝিয়ে বলার মতো নয়।অসহ যাতনায় জগৎ সংসার থেকে প্রায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি। দেশে গিয়ে মিরপুর বুদ্ধিজীবী গোরস্তানে স্ত্রীকে সমাহিত করে লন্ডনে ফিরে আসার পর সেই যে নিজের ঘরে দম আটকানো শোক ও দুঃখের মধ্যে নিজেকে সমর্পণ করেছি, তা থেকে কবে মুক্ত হব তা জানি না। আমার প্রিয় অভ্যাসগুলোর মধ্যে রোজ কলাম লেখা, বই পড়া, টিভি দেখা, বেড়াতে ও আড্ডা দিতে বাইরে যাওয়া সব বর্জন করেছি। এমনকি খবরের কাগজের পাতা পর্যন্ত উল্টাইনি। লিখতে বসার কথা ভাবাও ছিল অকল্পনীয়।
কিন্তু স্ত্রীর মৃত্যুর কুড়ি দিন না যেতেই আমাকে আবার লেখার টেবিলে ফিরে আসতে হয়েছে। এ জন্য আমার এক ল-নী বন্ধুকে কৃতিত্ব দেই। আমাকে দিনের পর দিন ঘরে একা বসে শোক ও বিষাদে মগ্ন থাকতে দেখে তিনি আমার কাছে এলেন। বললেন, তোমায় এভাবে ভেঙ্গে পড়লে তো চলবে না। এই দুঃসহ শোক থেকে মনকে ফেরাবার জন্য তোমাকে দুটো কাজ করার পরামর্শ দিই। এক. আবার লেখালেখি শুরু কর। তাতে এই বিষণ্ণতা ভুলে থাকবে। দুই. ঢাকার কাগজগুলো পড়া আরম্ভ করে দাও।
তার প্রথম পরামর্শটি বোধগম্য। কিন্তু দ্বিতীয় পরামর্শটির অর্থ বোধগম্য হলো না। জিজ্ঞাসা করলাম, ঢাকার কাগজ পড়লে কি হবে? বন্ধু বললেন, কোন খবর পড়লে তুমি আনন্দিত হবে। কোনটা পড়লে উত্তেজিত হবে। কোনটা পড়লে রাগান্বিত হবে। কিছুক্ষণের জন্য হলেও এই দুঃসহ শোক ও যাতনা থেকে তোমার মনকে ভুলিয়ে রাখবে।
বলেই ঢাকায় একটি দৈনিকের সাম্প্রতিক সংখ্যার দু’টি খবরের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। একটি খবরের শিরোনাম হলো, ‘চলমান সঙ্কট থেকে দেশ ২০১৪ সালে মুক্তি পাবে।’ ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন ড. কামাল হোসেন। তিনি বলেছেন, ২০১৪ সালের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অনেককেই দেশের মানুষ আর ক্ষমতায় দেখতে চাইবে না। শুধু এই ভবিষদ্বাণী করেই ড. কামাল হোসেন ক্ষান্ত হননি। তিনি দেশের তরুণদের ’৭১ সালের মতো হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর পরামর্শটি বিশ্লেষণ করলে মনে হয়, তিনি এখন মনে করছেন দেশে ’৭১ সালের মতো পরিস্থিতি বিরাজ করছে এবং হাসিনা সরকার ওই সময়ের পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ভূমিকা গ্রহণ করেছে।
দ্বিতীয় খবরটির শিরোনাম হলো, ‘সেদিন যদি আমরা পদত্যাগ না করতাম, তাহলে ওনাদের ক্ষমতায় আসা হতো না।’ কথাটা বলেছেন, ইয়াজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বের গঠিত সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান। তিনি একজন সাবেক আমলা এবং আমলাগিরি থেকে অবসরে যাওয়ার পর ‘ডাকসাইটে বুদ্ধিজীবী’ হিসেবে বাংলাদেশে আবির্ভূত হন। বাংলাদেশে এই ধরনের ‘বৃদ্ধিজীবীর’ সংখ্যাই এখন বেশি।
সৈয়দ মুজতবা আলী লিখেছিলেন, ‘ব্যর্থ সাহিত্যিকরাই পরে শ্রেষ্ঠ সমালোচক রূপে আবির্ভূত হন। ভারত উপমহাদেশেও দেখা গেছে, বহু ব্যর্থ আমলা পরে তথাকথিত বুদ্ধিজীবী সেজেছেন এবং রাজনীতিকদের তুলোধুনো করে ভূয়োদর্শী সেজে রাজনীতিকদের নানা পরামর্শ দিয়েছেন। যে পরামর্শের অধিকাংশই আমলাতান্ত্রিক অহমিকাপ্রসূত এবং গণস্বার্থের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্যুত।
আমলা থাকাকালে ড. আকবর আলী খান যে একজন সফল আমলা ছিলেন তা নয়। কিন্তু আমলার লেবাস ছাড়ার পরেই তিনি একজন ভূযোদর্শী বুদ্ধিজীবী সেজেছেন এবং দেশের মিডিয়ায় ভালই প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন। নাই মামার দেশে কানামামা ভাল। তাই আমাদের দেশে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে হৈ চৈ করার লোকের অভাব হয় না।
আমার লন্ডনী বন্ধু ঠিকই ধরেছিলেন। ঢাকার কাগজে এই দু’টি খবর পাঠ করে আমি কিছুটা কৌতুক মিশ্রিত উত্তেজনা বোধ করেছি। কিছুক্ষণের জন্য হলেও শোকার্ত বাস্তবতা থেকে মুক্তি পেয়েছিলাম। মনে হলো যতই শোকার্ত হই, এই রাজনৈতিক ভাড়ামি সম্পর্কে আমার কিছু লেখা উচিত।
ড. কামাল হোসেনের বক্তব্য সম্পর্কে কিছু লেখা বাহুল্য। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি এক ট্রাজিক ক্যারেকটার। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে রাজনীতিতে এসেছিলেন। যদি গণতান্ত্রিক ও সেকুলার রাজনীতিতে তাঁর স্থির প্রতিজ্ঞ কমিটমেন্ট থাকত, তাহলে তিনি বাংলাদেশে জাতীয় নেতৃত্বের একটা বড় শূন্যতা পূরণ করতে পারতেন। পারলেন না তার কারণ, তাঁর মধ্যে রাজনৈতিক কমিটমেন্টের ও সাহসের অভাব এবং তার গণবিচ্ছিন্ন আত্মকেন্দ্রিকতা। আশির দশকের মাঝমাঝি থেকেই তাঁর রাজনীতি কেবলমাত্র হাসিনা-বিদ্বেষ দ্বারা আচ্ছন্ন ও প্রভাবিত। তাঁর মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মানুষটির রাজনীতি এমন ব্যক্তি বিদ্বেষের আবর্তে তলিয়ে যাবে তা আমি কখনও ভাবিনি।
তিনি রাজনীতিতে ভাল মানুষ খোঁজেন। নিজের পছন্দ করা ভাল মানুষদের নিয়ে দল গঠন করে না পেরেছেন নিজেকে বা তাঁর দলকে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য করতে, না পেরেছেন সেই দলের ঐক্য ধরে রাখতে। কেবল ‘হাসিনা-খেদাও’ সেøাগান তুলে তো জনগণের কাছে পৌঁছানো যায় না। চাই বিকল্প বলিষ্ঠ রাজনৈতিক কর্মসূচী, চাই সাহসী নেতৃত্ব। দেশের প্রতিটি বিপজ্জনক সন্ধিক্ষণে বিদেশে পালিয়ে গিয়ে এবং বিকল্প রাজনৈতিক কর্মসূচী ছাড়া কেবল জনগণের কাছে প্রত্যাখ্যাত ও বিতর্কিত লোকের সঙ্গে আঁতত করে কি দেশবাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়া যায়? ড. কামাল হোসেন তাই দেশবাসীর কাছে কখনও গ্রহণযোগ্য হননি। একটা নির্বাচনেও তাঁর দল বা তিনি নিজে নির্বাচিত হতে পারেননি। ভবিষ্যতেও পারবেন মনে হয় না। ২০১৪ সালেও হাসিনা-নেতৃত্ব জনগণের কাছে প্রত্যাখ্যাত হবে, তার এই খোয়াব সফল হবে তা মনে হয় না।
ড. কামাল হোসেনকে বাহবা দিতাম, যদি তিনি সত্যই সাহসের সঙ্গে দেশবাসীর ভাগ্যোন্নয়নের জন্য একটি বলিষ্ঠ ও বিকল্প রাজনৈতিক কর্মসূচী এবং শেখ হাসিনার চাইতে সাহসী ভূমিকা নিয়ে রাজনীতির মাঠে এগিয়ে আসতেন। তাহলে বঙ্গবন্ধু কন্যার পরিবর্তে বঙ্গবন্ধুর এক যোগ্য উত্তরসূরিকে নেতা হিসেবে গ্রহণ করা যায় কিনা দেশের মানুষ তা নিয়ে হয়ত চিন্তাভাবনা করত। কিন্তু চলমান সঙ্কট থেকে দেশকে বাঁচানোর জন্য ‘সুস্থ রাজনীতি’ ‘ভাল মানুষের রাজনীতি’ ইত্যাদি কিছু রেটোরিক ছাড়া তাঁর রাজনৈতিক কর্মসূচী কী? আর ভাল মানুষের সংজ্ঞা কী তার কাছে? দেশবাসীর দ্বারা প্রত্যাখ্যাত ও বিতর্কিত কাদের সিদ্দিকী, ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী এবং মহসিন মন্টু কি? এদের সঙ্গে নিয়ে তিনি দেশের মানুষকে সুস্থ রাজনীতি ও ফেরেশতা চরিত্রের রাজনীতিক উপহার দেবেন?
আর রাজনৈতিক নেতা হিসেবে ড. কামাল হোসেনের নিজস্ব ক্রেডেনসিয়াল কি? ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা কি বিতর্কিত নয়? বঙ্গবন্ধু তাঁকে ’৭২ সালে নিজের সঙ্গে দেশে নিয়ে না এলে তিনি ফিরতে পারতেন কি? সংসদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু দু’টি আসনে জয়ী হয়ে একটি আসন তাঁকে ছেড়ে না দিলে তিনি সংসদেও নির্বাচিত হতে পারতেন কি? সংসদের পরবর্তী একটি নির্বাচনেও তিনি জয়ী হয়েছেন কি? পঁচাত্তর পরবর্তী কোন ক্রাইসিসে তিনি দেশবাসীকে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এসেছেন? না, বিদেশে পালিয়ে রয়েছেন? ক্রাইসিসের সময় দেশে থাকলেও নানা অজুহাতে বিদেশে চলে গেছেন।
একটা বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের অনেক ত্রুটি বিচ্যুতি আছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বেও অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। ড. কামাল এক সময় আওয়ামী লীগে ছিলেন। ছিলেন শেখ হাসিনার ‘বিগ আঙ্কল।’ তিনি বঙ্গবন্ধুর নিষ্ঠ অনুসারী হলে দলের ত্রুটিবিচ্যুতি, নেতৃত্বের সীমাবদ্ধতা, দুর্বলতা দূর করার জন্য দলের ভেতরে বসেই লড়াই চালাতেন। কিংবা দলত্যাগ করে হলেও দেশকে একটি সঠিক কর্মসূচী দিতেন; সঠিক নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসতেন। আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানাবার সেটাই ছিল সঠিক রাজনৈতিক পন্থা।
কিন্তু তিনি তা করেননি। দলের শৃঙ্খলাবিরোধী অনেক কাজ করা ও কথাবার্তা বলা সত্ত্বেও হাসিনা তাঁকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করেননি। তিনি নিজেই দল ত্যাগ করেছেন। আওয়ামী লীগ ভাঙ্গার চেষ্টা করেছেন। পারেননি। কিছু দলছুট বাম নেতা নিয়ে গণবিহীন গণফোরাম গঠন করেছেন। এরপর স্বৈরাচারবিরোধী, জঙ্গীবাদবিরোধী, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কোন আন্দোলনে কোন সঠিক ভূমিকা না রেখে তিনি ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে কখনও প্রত্যক্ষ ও কখনও পরোক্ষভাবে শামিল হয়েছেন। আশির দশকের শেষ দিক থেকে দেশে হাসিনাবিরোধী এমন একটি ষড়যন্ত্র নেই, যাতে তাঁর কখনও পরোক্ষ সায় অথবা প্রত্যক্ষ মদদ ছিল না।
আমার বলতে দ্বিধা নেই, হাসিনাবিদ্বেষে অন্ধ হয়ে সমস্ত নীতিজ্ঞান হারিয়ে তিনি স্বাধীনতার বিপক্ষ গোষ্ঠীর সঙ্গেও হাত মিলাতে দ্বিধা করেননি। তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা বলেন। কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক আঁতাত বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ঘোরবিরোধী এবং জিয়াবাদের উদ্গাতা ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সঙ্গে। প্রয়াত ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমদ ছিলেন, প্রচ-ভাবে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের আদর্শবিরোধী। জিয়াউর রহমানের সামরিক অভ্যুত্থানের পর তিনি এই সামরিক শাসনের কোলাবরেটর হন। ২০০১ সালের নির্বাচনের সময় এই ইশতিয়াক আহমদ, বদরুদ্দোজা চৌধুরী প্রমুখের সঙ্গে মিলে ড. কামাল হোসেনকে দেখা গেল এক অক্ষজোট গঠন করতে এবং তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের পরামর্শদাতা সাজতে। সেই নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের অশুভ জোটের রাজনৈতিক উত্থানে সবচাইতে বেশি সাহায্য জুগিয়েছে এই ত্রিব্যক্তি-অক্ষজোট। এই সময় আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় দেশে যে ভয়াবহ সন্ত্রাস, দুর্নীতি, অপশাসন শুরু হয়েছিল তার বিরুদ্ধে কোন ভূমিকা গ্রহণ করা দূরের কথা, ড. কামাল হোসেনকে আজকের মতো সোচ্চার হতেও দেখা যায়নি।
ভারতে ও ব্রিটেনে দুই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও মার্গারেট থ্যাচারকে বলা হতো আয়রন লেডি বা লৌহমানবী, বাংলাদেশে শেখ হাসিনা মোটেই লৌহমানবী নন। বরং নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি, স্খলন-পতন সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক শাসনের পন্থাই ধরে রেখেছেন। নির্বাচনে পরাজিত হলে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছেন। তাঁর শাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক পন্থাতেই তো আন্দোলন করা যায়। ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে হাত মেলানো কেন?
ব্রিটেনে মার্গারেট থ্যাচারের টোরি দলের নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তাঁর নেতৃত্বের বিরুদ্ধে দলের ভেতরেই আন্দোলন হয়েছে। ইন্দিরা সরকারের বিরুদ্ধেও জয়প্রকাশের মতো নেতারা রাজপথের আন্দোলনে নেমেছেন; কারাবরণ করেছেন। কিন্তু লৌহমানবী বলে তাঁকে ক্ষমতা থেকে অপসারণের জন্য নেপথ্যে কেউ ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে হাত মেলাননি। গণতান্ত্রিক সুশাসন প্রতিষ্ঠার নামে গণতন্ত্রের ঘোর শত্রু অশুভ শক্তির সঙ্গে ভারতের কোন গণতান্ত্রিক নেতা বা বুদ্ধিজীবী যোগ দেননি।
বাংলাদেশে সবই ‘উল্টো বুঝিলি রাম!’ আন্দোলনের চাইতে ষড়যন্ত্রই রাজনীতিতে প্রাধান্য পাচ্ছে বেশি। আর বিস্ময়ের কথা, গণতন্ত্রের নামে যাঁরা ভিরমি খান সেই একশ্রেণীর বর্ষীয়ান নেতা ও বুদ্ধিজীবীদেরই এই ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে বেশি সহায়তা যোগাতে দেখা যায়। শেখ হাসিনাকে জব্দ করার জন্য এরা দেশের স্বাধীন ও সেক্যুলার শক্তির বিরোধী সামরিক ও অসামরিক অশুভ চক্রকে পর্যন্ত সহায়তা জোগাতে রাজি। ড. কামাল হোসেন হয়ত বুঝতে পারছেন না, দেশের চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটের এটাই একটা বড় কারণ। দেশের রাজনীতির চরিত্র বদলাতে না পারলে শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে লাভ হবে না, বরং বড় অশুভশক্তিকেই ক্ষমতা দখলে সাহায্য যোগানো হবে।
আমাদের একশ্রেণীর বর্ষীয়ান রাজনৈতিক নেতা ও বুদ্ধিজীবীর যদি এই উপলব্ধি থাকত, তাহলে ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী বিএনপি-জামায়াতের দুঃশাসনের তিক্ত অভিজ্ঞতা ভুলে গিয়ে তারা আবার ২০০৬ সালে এক এগারোর সরকারের ‘মাইনাস টু থিয়োরি’ বাস্তবায়নে বুদ্ধি পরামর্শ যোগাতে নির্লজ্জভাবে এগিয়ে যেতে পারতেন না। দেশের সচেতন নাগরিকদের অনেকেই মনে করেন, সেনা-তাঁবেদার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাইনাস টু থিয়োরির আসল লক্ষ্য ছিল দেশ থেকে হাসিনার নেতৃত্ব ও আওয়ামী লীগ রাজনীতি উচ্ছেদ করা এবং এই থিয়োরির প্রধান রূপকার নাকি ছিলেন ড. কামাল হোসেন এবং এই থিয়োরি বাস্তবায়নে ওই সরকারকে সহযোগিতা দিচ্ছিলেন তাঁর সমর্থিত একটি কথাকথিত সুশীল সমাজ।
ড. কামাল হোসেনের মতো ‘গণতন্ত্রের মানসপুত্র’ এ সময়ে প্রকাশ্যেই এক এগারোর সেনা-তাঁবেদার সরকারের সমর্থক সাজেন এবং শেখ হাসিনা নানা হয়রানিমূলক মামলায় নির্যাতীত এবং সাবজেলে বন্ধী থাকার সময় যেসব উক্তি করেছেন, তা কোন প্রবীণ ও বিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতার মুখে শোভা পায় না। ভারতে ইন্দিরা গান্ধীর জরুরী অবস্থার শাসনকালে সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ নানাভাবে নির্যাতীত হয়েও তাঁর বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্রে সায় দেননি। আন্দোলন করেছেন। তারপর ইন্দিরা গান্ধী নির্বাচনে পরাজিত হলে তাঁর চোখের পানি মোছানোর জন্য জয়প্রকাশই সর্বপ্রথম ‘বিগ আঙ্কেলের’ ভূমিকা নিয়ে ইন্দিরার কাছে ছুটে গিয়েছিলেন। ২০০১ সালে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার ‘বিগ আঙ্কেলের’ ভূমিকা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত।
শুধু ২০০১ সালে কেন, ২০০৮ সালে হাসিনার বিরাট নির্বাচন সাফল্যের পরও ড. কামাল হোসেনের ভূমিকাটা কি? তিনি এবারের হাসিনা সরকারের বড় বড় সাফল্যের কথা একবারও স্বীকার করেন না। কেবল ভুল ত্রুটি ও আসাফল্যগুলো বড় করে দেখান। একই সময়ে প্রতিবেশী ভারত, এমন কি যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশের সরকারগুলোর পারফরমেন্স মিলিয়ে দেখে একটি সৎ ও ইতিবাচক বক্তব্য রাখার সততা তিনি এবং তাঁর সমর্থনপুষ্ট তথাকথিত সুশীল সমাজ দেখাতে পারছেন না। প্রতিটি কাজে হাসিনা সরকারের ছিদ্রান্বেষণতা তাঁর কাজ। এই সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য তাঁর মনের জালার বহির্প্রকাশ নানাভাবে ঘটছে। হাসিনাকে জব্দ করার জন্য তিনি তাঁর যেকোন প্রতিপক্ষের সঙ্গে হাত মেলাতে রাজি। সত্য মিথ্যা জানি না, শোনা যায় গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে মামলা মোকদ্দমা করার ইচ্ছা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ছিল না।
কিন্তু ড. কামালই তাঁকে মামলা করতে প্ররোচিত করেন। উদ্দেশ্য, শেখ হাসিনাকে জব্দ করা। এটা যদি সত্য হয়, তাহলে বলতে হবে, ব্যক্তি বিদ্বেষে অন্ধ হয়ে একজন প্রবীণ ও প্রাজ্ঞ রাজনৈতিক নেতা চক্রান্তের রাজনীতির কোন তলাতে যেতে পারেন, এই ঘটনা সম্ভবত: তার শ্রেষ্ঠ প্রমাণ।
সাম্প্রতিক হাসিনাবিরোধী অনেক চক্রান্ত একটার পর একটা ব্যর্থ হওয়ায় এখন সামনে (২০১৪) সাধারণ নির্বাচন দেখে ড. কামাল হোসেন আবার আশান্বিত হয়েছেন। আবার থার্ড ফোর্সের নামে দেশে ঘোট পাকানো শুরু হয়েছে। ডা. কামাল হোসেন নিজেই ভবিষ্যদ্বাণী করতে শুরু করেছেন, এবার শেখ হাসিনার আর রক্ষা নেই। দেশবাসী এবার তাঁকে আর ক্ষমতায় রাখবে না। অসহিষ্ণু ও হতাশাগ্রস্ত মনের প্রলাপ ছাড়া এটা আর কিছুই নয়।
গণতন্ত্রে সকল দলের জন্যই জয়-পরাজয় আছে। দেশে আগামী নির্বাচনে শেখ হাসিনার পুনর্নির্বাচনে আমরা অনেকেই আশাবাদী। নইলে দেশে আবার স্বাধীনতাবিরোধী অশুভ শক্তির অভ্যুত্থান ঘটবে। দেশে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটতে পারে। সেসব বিবেচনা ড. কামাল হোসেন এবং তাঁর গোত্রের রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীদের নেই। দেশের সচেতন নাগরিকদের সব প্রত্যাশা ব্যর্থ করে আগামী নির্বাচনে যদি আওয়ামী লীগ না জেতে তাহলে দেশের ক্ষতি। শেখ হাসিনার তেমন ক্ষতিটা কি? তিনি হাসি মুখে ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন। অতীতেও তো দিয়েছেন। তাতে ড. কামাল হোসেন ও তাঁর সুশীল সমাজ ক্ষমতায় আসতে পেরেছেন কি? না, ২০১৪ সালে পারবেন? তিনি সারাদেশ থেকে ভাল মানুষ খুঁজে বের করার কথা বলেছেন। তাঁর আশপাশের মানুষগুলো কি ভাল মানুষ? তিনি দেশবাসীর দ্বারা প্রত্যাখ্যাত, বিতর্কিত কিছু মানুষ নিয়ে চলমান সঙ্কট থেকে দেশকে মুক্তি দিতে চান? অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে হলেও বলতে হয়, এটা কুঁজোর চিৎ হয়ে শোয়ার স্বপ্ন দেখার মতো।
ঢাকার কাগজে যে দু’নম্বর খবরটি দেখে আমার শোকার্ত মন কিছুক্ষণের জন্য হলেও কৌতুক মিশ্রিত উত্তেজনা বোধ করেছে সেটি সাবেক আমলা ড. আকবর আলি খানের। শেখ হাসিনা ইয়াজউদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সদস্য হিসেবে তাদের কয়েকজনকে ব্যর্থ উপদেষ্টা আখ্যা দেয়ায় তিনি চটেছেন। বলেছেন, ‘সেদিন যদি আমরা উপদেষ্টা হিসেবে পদত্যাগ না করতাম ওনাদের (হাসিনাদের) ক্ষমতায় আসা হতো না। তিনি আরও কিছু আত্মম্ভরিতামূলক কথা বলেছেন। যার একমাত্র অর্থ তাদের পদত্যাগেই দেশে ২০০৮ সালের নির্বাচন এবং হাসিনা-সরকারের ক্ষমতায় আসা সম্ভব করেছে। মন্তব্যটি পড়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতার দু’লাইন আমার মনে পড়েছে :
রথভাবে আমি দেব, পথভাবে আমি
মূর্তিভাবে আমি দেব, হাসে অন্তর্যামী।’
(বাকি অংশ আগামীকাল)
লন্ডন, ৮ জানুয়ারি, মঙ্গলবার ॥ ২০১৩।
No comments