সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ- একুশের বইমেলা ও কিছু প্রত্যাশা by অসিত মুকুটমণি
বিশ্বের অন্তত ৩০ কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। তাই এ ভাষা আরও গতিময় হবে; কিন্তু সেই গতিময়তা আনয়নের মূল ভূমিকা পালন করতে পারে আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি, শিল্প-সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে যাওয়া
এবার একুশে বইমেলার পরিব্যাপ্তি বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণসহ বাইরের রাস্তারও বেশকিছু অংশজুড়ে। বলতে গেলে দোয়েল চত্বর থেকে টিএসসি মোড় পর্যন্ত। প্রতিদিনই বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সমাগম প্রচুর, যদিও বিকেলের দিকে ভিড় একটু কমই থাকে। ঢুকতেই সাংস্কৃতিক মঞ্চ, যেখানে প্রতিদিন আলোচনা ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনা হতে থাকে। তারপর পুরনো তিনতলা সাদা রঙের বর্ধমান হাউস পূর্ণিমার সি্নগ্ধ আলোতেও বহিরঙ্গের আলোছায়ায় অনেকটা মার্বেল হাউস বলে মনে হয়। অন্যদিকে বটতলায় নজরুল মঞ্চ চারদিকে বাঁধানো। আগত নানা বয়সীদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের আবক্ষ পিতল প্রতিকৃতির দু'পাশে দাঁড়িয়ে নানাভাবে ছবি তোলার মহরত চলে আর সামনে-পেছনে এলোমেলো বসে গল্প-স্বল্প। নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচনও হয় এখানে। হ্যান্ডমাইক নেই। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের কাজ চলতেও দেখেছি। কারও কারও ক্ষেত্রে অনুষ্ঠান জমকালো। টিভি-মিডিয়ার উপস্থিতিও সুন্দর। আবার কখনও কখনও খুবই সাদামাটা আয়োজন।
যতই বইমেলায় যাই মুগ্ধ হই, বিমুগ্ধ হই। মেলার স্টল সংখ্যা যেমন বাড়ছে তেমনি প্রকাশক, লেখক, লোক সমাগম এবং বই বিক্রয়ও বাড়ছে। মাসব্যাপী এ মিলনমেলা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকাশনা শিল্পের মানোন্নয়ন অভূতপূর্ব ও উচ্চমানের। ছোট-বড় সব বয়সী পাঠকের সংখ্যাও বাড়ছে। শুরুর অবস্থার সঙ্গে এখনকার তুলনা করলে বিকাশের হিসাব মেলে না। তবে এটা ঢাকায় সীমাবদ্ধ না রেখে দেশব্যাপী বিকাশের ধারা ছড়িয়ে দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে বিভাগীয় পর্যায়ে ১৬ ডিসেম্বর থেকে ৩১ জানুয়ারির মধ্যে অন্তত ১৫ দিন, জেলা পর্যায়ে ১০ দিন ও উপজেলা পর্যায়ে ৩-৫ দিন বইমেলার আয়োজন করা যেতে পারে। শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার চাপ এ সময় কম থাকে। মোটকথা এ নিটোল-নির্ভেজাল বইমেলা দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে পারলেই দেশের প্রত্যন্ত প্রান্তর পর্যন্ত লেখক ও প্রকাশকদের উজ্জীবন ঘটবে আর তার সুফলও যথা- জ্ঞান, বিদ্যা, বুদ্ধি, প্রকাশ, বোধ, লিখন, পঠন প্রভৃতি ক্ষেত্রে সুবাস সারাদেশে ছড়িয়ে পড়বে। সংস্কৃতিও পাবে বিকশিত গতি, যা অন্ধকার সরিয়ে বিজ্ঞান ও মানবিক ভিত্তি সুদৃঢ় করবে। বাংলা ভাষার ব্যবহার যত বাড়বে, প্রসারিত হবে ভাষার ভিত, ততই গভীর হবে, শক্ত ও উন্নত হবে ভাষাশৈলী। বিকাশ ও ব্যবহারে বিস্তৃতি এলে ক্রমেই সার্বিকভাবে সুসমন্বিত মানোন্নয়ন হবে বাংলা ভাষার।
'লেখক আড্ডা' জায়গাটির ধারণা এভাবে বাস্তবায়ন ভালো উদ্যোগ। ডিজিটাল কৌশলে গড়া তথ্য প্রচার কেন্দ্রটিও ভালো। যদিও মনে হয়েছে তার পরিপূর্ণ ক্ষমতা এখনও ব্যবহার করা যায়নি, যেটা ব্যবহার করা হলে আরও তথ্যসমৃদ্ধ হবে। লেখক বা বইভিত্তিক বিক্রয় প্রতিদিনের তথ্য প্রকাশ করা গেলে তা লেখক, প্রকাশক এবং লেখার মানোন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। কোন স্টল কোথায় এবং কোন স্টলে কী কী বই পাওয়া যাবে তার তথ্য এখান থেকে বড় পর্দায় দেখানো যেতে পারে, যেন বই ক্রয়েচ্ছু সব ক্রেতা তথ্য পেতে পারেন। মেলা চলাকালে প্রতিদিনের অনুষ্ঠানের খণ্ডাংশ বাংলাদেশ টেলিভিশনেও প্রচার করা যেতে পারে, যা মেলায় উপস্থিতির জন্য আগ্রহ বাড়াবে, গ্রাম-গ্রামাঞ্চলের মানুষের আগ্রহ বাড়তে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করবে। শিশু-কিশোর ও বয়স্কদের বই, বিদেশি বইয়ের অনুবাদ গ্রন্থ, সাহিত্য, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ভিত্তিক বইয়ের জন্য ভিন্ন ভিন্ন কর্নার করে দেওয়া যেতে পারে, যাতে করে অল্প সময়ের মধ্যেই ক্রয়েচ্ছু ক্রেতারা সেই এলাকায় গিয়ে বই কিনতে পারেন।
সাংস্কৃতিক মঞ্চের আলোচনা চক্রের সঙ্গে বিশেষ করে স্বরচিত কবিতা আবৃত্তির সুযোগ বেশি থাকলে নবীন-প্রবীণ সব লেখক-কবিরা প্রথমত নিজেরা লেখা পঠন ও আবৃত্তির রূপমাধুরী সৃষ্টির প্রয়াসী হতে পারবেন। এখানেই বানান, উচ্চারণ ও আবৃত্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন হলে বাংলা ব্যবহারের আগ্রহ, ভিত পোক্ত ও শক্ত হবে। তবে তা শিক্ষার্থী ও উন্মুক্ত এই দুই অংশে বিভক্ত করে উপস্থাপনীয় হতে পারে। লেখক-কবি-সাহিত্যিককে মঞ্চে রেখে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলে তাদের মধ্যে পরিচিতি, নৈকট্য ও সহযোগিতা বাড়বে। এসব অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমীর পুরস্কারে ভূষিত ও মহান একুশে পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তিত্বদের আমন্ত্রণ জানিয়ে জনগণের, উঠতি লেখক, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী প্রমুখের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলে সামগ্রিক মূল্যবোধ ও আয়োজনের মূলের গভীরতা আরও বাড়াতে সহযোগিতা করবে।
আরও কিছু বিষয় যেমন একাডেমী, একাডেমী প্রাঙ্গণে সমতলকরণ ও সবুজ ঘাসের চত্বর সৃষ্টি করা গেলে মেলার জন্য আরও উন্নত পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক হবে। বর্তমানে মেলা প্রাঙ্গণের ধুলারোধে ভেতর ও বাইরে সকাল-বিকেলে ভালোভাবে পানি ছিটানো হলে বাতাসে ধুলোর পরিমাণ কমে যাবে যাতে মেলায় আসা লোকজন আরও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন। প্রতিষ্ঠিত নবীন প্রকাশকদের প্রতিষ্ঠিত করা ও উৎসাহ দেওয়ার জন্য স্টল ভাড়া কিছু কমিয়ে দেওয়া যায়। মিডিয়া, চিকিৎসা এবং অগি্ননির্বাপণ ব্যবস্থার সুযোগ বাড়ানো যেতে পারে।
জনগণের নিরাপত্তা গেট দিয়ে প্রবেশের পথে লক্ষ্য রাখার কাজটি পরিপূর্ণ সতর্কতার সঙ্গে সার্বক্ষণিক পালন ও প্রয়োজনে দ্বিস্তরবিশিষ্ট গেটওয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থাও নেওয়া যেতে পারে। বাইরের বই বিক্রির দোকানের সংখ্যা কমানো যায়। ক্রেতারা বাইরের বইগুলো কিনলে নতুন লেখক ও প্রকাশকদের নতুন বইগুলোর বিক্রি কমে তাদের হতোদ্যম করতে পারে। এছাড়াও খাবার, খেলনা, মিষ্টি, বাদামের দোকান সরিয়ে পার্ক এলাকা বা দোয়েল চত্বরের দিকে বইমেলার নিটোল সৌন্দর্য সংরক্ষণে পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। না বললেই নয়, সবচেয়ে কষ্টকর অধ্যায়টি যত্রতত্র প্রস্রাব করার ফলে মেলার ভাবগাম্ভীর্য ও সুন্দর পরিবেশ বিঘি্নত হচ্ছে, যার বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রতি বছরই জরুরি বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন।
হতাশা নেই, আশা আছে। বিশ্বের অন্তত ৩০ কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। তাই এ ভাষা আরও গতিময় হবে; কিন্তু সেই গতিময়তা আনয়নের মূল ভূমিকা পালন করতে পারে আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি, শিল্প-সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে যাওয়া। এ ক্ষেত্রে একুশের চেতনা মাথা নত না করা এবং এগিয়ে যাওয়ার শপথ অনুসরণই হবে আমাদের বিকাশের মূল মন্ত্র। তবে একই সঙ্গে প্রয়োজন, আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার জন্য ভাষান্তরণ কর্মাবলি বৃদ্ধি করা। অর্থনীতিতে একটি সূত্র আছে ঝঁঢ়ঢ়ষু পৎবধঃবং রঃ ড়হি ফবসধহফ. তাই আমাদের পরিবেশনা যদি ভালো হয় তাহলে তা সমাদৃত ও গৃহীত হবেই। এ ক্ষেত্রে অবশ্য বিশ্ব বাস্তবতা অনুধাবন করা ও কূপমণ্ডূকতা পরিত্যাগ করারও প্রয়োজন আছে। বাংলা ভাষার উৎকর্ষ সাধনে একুশের চেতনাই (যা বর্তমানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্বব্যাপী ব্যাপ্ত, পরিচিত ও আদৃত) হতে পারে আমাদের প্রেরণার দীপশিখা। মাতৃভাষাকে আরও গভীরভাবে ভালোবেসে, সম্পর্ক সঠিক-সুন্দরভাবে ব্যবহার করে এবং আপন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি বিশ্বস্ত থেকেই নিজ ভাষাকে জানানো এবং অন্য ভাষাকেও জানা আমাদের সুগভীর বিকাশের মাপকাঠি হতে পারে। সে পথ বেয়েই পেঁৗছে যাওয়া যেতে পারে উন্নতির সুউচ্চ মিনারে। তাহলেই সামগ্রিক চেতনা ও বোধের বিকাশ মানুষে মানুষে মৈত্রীর বন্ধনের সঙ্গে সঙ্গে ভাষার মৌলিক ও প্রকৃষ্ট উত্তরণ নিশ্চিত হবে। শ্রদ্ধেয় মহান শহীদদের আত্মা আমাদের কাছে সেই দেশপ্রেমসমৃদ্ধ চেতনার বাস্তবায়নই প্রত্যাশা করেন।
অসিত মুকুটমণি : প্রাবন্ধিক
যতই বইমেলায় যাই মুগ্ধ হই, বিমুগ্ধ হই। মেলার স্টল সংখ্যা যেমন বাড়ছে তেমনি প্রকাশক, লেখক, লোক সমাগম এবং বই বিক্রয়ও বাড়ছে। মাসব্যাপী এ মিলনমেলা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকাশনা শিল্পের মানোন্নয়ন অভূতপূর্ব ও উচ্চমানের। ছোট-বড় সব বয়সী পাঠকের সংখ্যাও বাড়ছে। শুরুর অবস্থার সঙ্গে এখনকার তুলনা করলে বিকাশের হিসাব মেলে না। তবে এটা ঢাকায় সীমাবদ্ধ না রেখে দেশব্যাপী বিকাশের ধারা ছড়িয়ে দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে বিভাগীয় পর্যায়ে ১৬ ডিসেম্বর থেকে ৩১ জানুয়ারির মধ্যে অন্তত ১৫ দিন, জেলা পর্যায়ে ১০ দিন ও উপজেলা পর্যায়ে ৩-৫ দিন বইমেলার আয়োজন করা যেতে পারে। শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার চাপ এ সময় কম থাকে। মোটকথা এ নিটোল-নির্ভেজাল বইমেলা দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে পারলেই দেশের প্রত্যন্ত প্রান্তর পর্যন্ত লেখক ও প্রকাশকদের উজ্জীবন ঘটবে আর তার সুফলও যথা- জ্ঞান, বিদ্যা, বুদ্ধি, প্রকাশ, বোধ, লিখন, পঠন প্রভৃতি ক্ষেত্রে সুবাস সারাদেশে ছড়িয়ে পড়বে। সংস্কৃতিও পাবে বিকশিত গতি, যা অন্ধকার সরিয়ে বিজ্ঞান ও মানবিক ভিত্তি সুদৃঢ় করবে। বাংলা ভাষার ব্যবহার যত বাড়বে, প্রসারিত হবে ভাষার ভিত, ততই গভীর হবে, শক্ত ও উন্নত হবে ভাষাশৈলী। বিকাশ ও ব্যবহারে বিস্তৃতি এলে ক্রমেই সার্বিকভাবে সুসমন্বিত মানোন্নয়ন হবে বাংলা ভাষার।
'লেখক আড্ডা' জায়গাটির ধারণা এভাবে বাস্তবায়ন ভালো উদ্যোগ। ডিজিটাল কৌশলে গড়া তথ্য প্রচার কেন্দ্রটিও ভালো। যদিও মনে হয়েছে তার পরিপূর্ণ ক্ষমতা এখনও ব্যবহার করা যায়নি, যেটা ব্যবহার করা হলে আরও তথ্যসমৃদ্ধ হবে। লেখক বা বইভিত্তিক বিক্রয় প্রতিদিনের তথ্য প্রকাশ করা গেলে তা লেখক, প্রকাশক এবং লেখার মানোন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। কোন স্টল কোথায় এবং কোন স্টলে কী কী বই পাওয়া যাবে তার তথ্য এখান থেকে বড় পর্দায় দেখানো যেতে পারে, যেন বই ক্রয়েচ্ছু সব ক্রেতা তথ্য পেতে পারেন। মেলা চলাকালে প্রতিদিনের অনুষ্ঠানের খণ্ডাংশ বাংলাদেশ টেলিভিশনেও প্রচার করা যেতে পারে, যা মেলায় উপস্থিতির জন্য আগ্রহ বাড়াবে, গ্রাম-গ্রামাঞ্চলের মানুষের আগ্রহ বাড়তে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করবে। শিশু-কিশোর ও বয়স্কদের বই, বিদেশি বইয়ের অনুবাদ গ্রন্থ, সাহিত্য, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ভিত্তিক বইয়ের জন্য ভিন্ন ভিন্ন কর্নার করে দেওয়া যেতে পারে, যাতে করে অল্প সময়ের মধ্যেই ক্রয়েচ্ছু ক্রেতারা সেই এলাকায় গিয়ে বই কিনতে পারেন।
সাংস্কৃতিক মঞ্চের আলোচনা চক্রের সঙ্গে বিশেষ করে স্বরচিত কবিতা আবৃত্তির সুযোগ বেশি থাকলে নবীন-প্রবীণ সব লেখক-কবিরা প্রথমত নিজেরা লেখা পঠন ও আবৃত্তির রূপমাধুরী সৃষ্টির প্রয়াসী হতে পারবেন। এখানেই বানান, উচ্চারণ ও আবৃত্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন হলে বাংলা ব্যবহারের আগ্রহ, ভিত পোক্ত ও শক্ত হবে। তবে তা শিক্ষার্থী ও উন্মুক্ত এই দুই অংশে বিভক্ত করে উপস্থাপনীয় হতে পারে। লেখক-কবি-সাহিত্যিককে মঞ্চে রেখে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলে তাদের মধ্যে পরিচিতি, নৈকট্য ও সহযোগিতা বাড়বে। এসব অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমীর পুরস্কারে ভূষিত ও মহান একুশে পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তিত্বদের আমন্ত্রণ জানিয়ে জনগণের, উঠতি লেখক, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী প্রমুখের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলে সামগ্রিক মূল্যবোধ ও আয়োজনের মূলের গভীরতা আরও বাড়াতে সহযোগিতা করবে।
আরও কিছু বিষয় যেমন একাডেমী, একাডেমী প্রাঙ্গণে সমতলকরণ ও সবুজ ঘাসের চত্বর সৃষ্টি করা গেলে মেলার জন্য আরও উন্নত পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক হবে। বর্তমানে মেলা প্রাঙ্গণের ধুলারোধে ভেতর ও বাইরে সকাল-বিকেলে ভালোভাবে পানি ছিটানো হলে বাতাসে ধুলোর পরিমাণ কমে যাবে যাতে মেলায় আসা লোকজন আরও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন। প্রতিষ্ঠিত নবীন প্রকাশকদের প্রতিষ্ঠিত করা ও উৎসাহ দেওয়ার জন্য স্টল ভাড়া কিছু কমিয়ে দেওয়া যায়। মিডিয়া, চিকিৎসা এবং অগি্ননির্বাপণ ব্যবস্থার সুযোগ বাড়ানো যেতে পারে।
জনগণের নিরাপত্তা গেট দিয়ে প্রবেশের পথে লক্ষ্য রাখার কাজটি পরিপূর্ণ সতর্কতার সঙ্গে সার্বক্ষণিক পালন ও প্রয়োজনে দ্বিস্তরবিশিষ্ট গেটওয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থাও নেওয়া যেতে পারে। বাইরের বই বিক্রির দোকানের সংখ্যা কমানো যায়। ক্রেতারা বাইরের বইগুলো কিনলে নতুন লেখক ও প্রকাশকদের নতুন বইগুলোর বিক্রি কমে তাদের হতোদ্যম করতে পারে। এছাড়াও খাবার, খেলনা, মিষ্টি, বাদামের দোকান সরিয়ে পার্ক এলাকা বা দোয়েল চত্বরের দিকে বইমেলার নিটোল সৌন্দর্য সংরক্ষণে পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। না বললেই নয়, সবচেয়ে কষ্টকর অধ্যায়টি যত্রতত্র প্রস্রাব করার ফলে মেলার ভাবগাম্ভীর্য ও সুন্দর পরিবেশ বিঘি্নত হচ্ছে, যার বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রতি বছরই জরুরি বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন।
হতাশা নেই, আশা আছে। বিশ্বের অন্তত ৩০ কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। তাই এ ভাষা আরও গতিময় হবে; কিন্তু সেই গতিময়তা আনয়নের মূল ভূমিকা পালন করতে পারে আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি, শিল্প-সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে যাওয়া। এ ক্ষেত্রে একুশের চেতনা মাথা নত না করা এবং এগিয়ে যাওয়ার শপথ অনুসরণই হবে আমাদের বিকাশের মূল মন্ত্র। তবে একই সঙ্গে প্রয়োজন, আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার জন্য ভাষান্তরণ কর্মাবলি বৃদ্ধি করা। অর্থনীতিতে একটি সূত্র আছে ঝঁঢ়ঢ়ষু পৎবধঃবং রঃ ড়হি ফবসধহফ. তাই আমাদের পরিবেশনা যদি ভালো হয় তাহলে তা সমাদৃত ও গৃহীত হবেই। এ ক্ষেত্রে অবশ্য বিশ্ব বাস্তবতা অনুধাবন করা ও কূপমণ্ডূকতা পরিত্যাগ করারও প্রয়োজন আছে। বাংলা ভাষার উৎকর্ষ সাধনে একুশের চেতনাই (যা বর্তমানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্বব্যাপী ব্যাপ্ত, পরিচিত ও আদৃত) হতে পারে আমাদের প্রেরণার দীপশিখা। মাতৃভাষাকে আরও গভীরভাবে ভালোবেসে, সম্পর্ক সঠিক-সুন্দরভাবে ব্যবহার করে এবং আপন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি বিশ্বস্ত থেকেই নিজ ভাষাকে জানানো এবং অন্য ভাষাকেও জানা আমাদের সুগভীর বিকাশের মাপকাঠি হতে পারে। সে পথ বেয়েই পেঁৗছে যাওয়া যেতে পারে উন্নতির সুউচ্চ মিনারে। তাহলেই সামগ্রিক চেতনা ও বোধের বিকাশ মানুষে মানুষে মৈত্রীর বন্ধনের সঙ্গে সঙ্গে ভাষার মৌলিক ও প্রকৃষ্ট উত্তরণ নিশ্চিত হবে। শ্রদ্ধেয় মহান শহীদদের আত্মা আমাদের কাছে সেই দেশপ্রেমসমৃদ্ধ চেতনার বাস্তবায়নই প্রত্যাশা করেন।
অসিত মুকুটমণি : প্রাবন্ধিক
No comments