দাতাদের মনোভাব- 'তলাবিহীন ঝুড়ি' থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর বিস্ময় by বিনায়ক সেন

বাংলাদেশের এ চিত্র পাশ্চাত্যের অনেকের কাছে রীতিমতো গণ্য হতে থাকে 'সাউথ এশিয়ান সারপ্রাইজ' হিসেবে। এখানে দুর্নীতির লাগাম টানা যাচ্ছে না। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ধারণা সূচকে বাংলাদেশ বছরের পর বছর দুর্নীতিতে এক বা দুই নম্বরে অবস্থান করছে।
কিন্তু একই সময়ে আমরা দেখি আরেক চিত্র। মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ ভালো করছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রী পড়াশোনার জন্য হাজির হয়। জেন্ডার ভারসাম্য সেখানে বজায় থাকছে। মা ও নবজাত শিশুর মৃত্যুর হার কমানো সম্ভব হচ্ছে। এ ধরনের কিছু ক্ষেত্রে এমনকি ২০১৫ সালের জন্য জাতিসংঘ নির্ধারিত মিলেনিয়াম গোল বাংলাদেশ আগেভাগেই পূরণ করে ফেলতে পারে

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পরবর্তী কয়েকটি বছর বাংলাদেশকে নিয়ে উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থাগুলোর মধ্যে নৈরাশ্য ছিল যথেষ্ট। তাদের এ মনোভাব এক কথায় প্রকাশ ঘটেছে যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন প্রশাসনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের সেই বহুল ব্যবহৃত উক্তিতে_ 'বাংলাদেশ : এ বাস্কেট কেস'। এর আভিধানিক অর্থ হতে পারে, 'বাংলাদেশ ভিখারির দেশ'। কিন্তু বহু দশক ধরেই ব্যবহার হয়ে আসছে 'বাংলাদেশ এ বটমলেস বাস্কেট বা তলাবিহীন ঝুড়ি'। একাত্তরের আগে আমাদের এ ভূখণ্ড অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল ছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ব্যাপক গণহত্যা এবং ৯ মাসের যুদ্ধের কারণে তা আরও বিপর্যস্ত হয়। দাতাদের অনেকেই মনে করেছেন, জনসংখ্যার চাপে পিষ্ট মুসলিমপ্রধান এ দেশে নারীসমাজ আরও বহুকাল থেকে যাবে অন্তঃপুরে, যেহেতু তারা পর্দা মেনে চলতে বাধ্য হচ্ছিল। ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ঊর্ধ্ব হারে লাগাম টানা যাবে, এমন সম্ভাবনাও অনেকে দেখছিলেন না। তা ছাড়া ঝড়-বন্যাসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ বারবার হানা দিচ্ছিল। এ ধরনের পরিস্থিতিতে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে উদ্যোক্তারা উৎসাহ দেখান না। আধুনিক যুগে উন্নয়নের ক্ষেত্রে দেখা যায়, কৃষির স্থান গ্রহণ করতে থাকে শিল্প। শ্রমশক্তিও কৃষিতে কমতে থাকে এবং উদ্বৃত্তরা শিল্পে ভিড় করে। বাংলাদেশে তার লক্ষণ তেমন দেখা যাচ্ছিল না। এমন অবস্থায় প্রথাগতভাবে উদ্যোক্তারা মনোযোগী হয় স্বল্পমেয়াদে লাভ মেলে এমন ধরনের বিনিয়োগে। বাংলাদেশ অর্থনীতিতে ঘুরে দাঁড়াবে_ এমন আশাবাদ দাতাদের অনেকেই পোষণ করতে পারছিল না। তবে তারা বাংলাদেশে খাদ্য, প্রকল্প ও পণ্য সহায়তা প্রদানের পক্ষে সওয়াল করতে থাকে। এর মূল কারণ মানবিক। এ সহায়তা ব্যাপক মাত্রায় না এলে বিপুলসংখ্যক লোককে এমনকি কোনো রকমে টিকিয়ে রাখাও কঠিন বলে অভিমত প্রকাশ করা হতে থাকে। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের অভিজ্ঞতার পর এমনটাই ভাবা স্বাভাবিক ছিল।
বাংলাদেশ কৃষিভিত্তিক দেশ। কিন্তু সে সময় দাতাদের অনেকের বিবেচনায় বাংলাদেশের কৃষি গতিশীলতা হারিয়ে ফেলেছিল। খাদ্যে দেশটি স্বনির্ভর নয়। এ ক্ষেত্রে ঘাটতি পূরণে নিয়মিত উন্নত দেশ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে সহজ শর্তে এবং এমনকি বিনামূল্যে খাদ্যের জোগান আসতে হবে। সব মিলিয়ে বলা যায়, বাংলাদেশের এমন একটি ভাবমূর্তি ছিল, যা পাশ্চাত্যের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে আশাবাদ জাগাতে পারছিল না।
এই নেতিবাচক প্রভাব কাটতে শুরু করে নব্বইয়ের দশকে। খাদ্য উৎপাদন বাড়তে থাকে। শিল্পায়নের ধারায় যুক্ত হয় তৈরি পোশাক শিল্প। নারী শ্রমিকরা এগিয়ে আসে দলে দলে। তাদের সংখ্যা প্রতিবছর শত শত নয়, বরং লাখের অঙ্কে বেড়ে চলে। এনজিওগুলোর তৎপরতার কারণে গ্রামীণ নারীদের উল্লেখযোগ্য অংশ গৃহকোণের বাইরে আসতে সক্ষম হয়। এ প্রক্রিয়ায় ধর্মান্ধ কিছু মহল বিঘ্ন সৃষ্টির চেষ্টা করেও সফল হয়নি।
পাশ্চাত্যে ওই মহলের ধারণার বিপরীতে আমরা নব্বইয়ের দশকেই দেখতে পাই যে, মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে শিল্পের হিস্যা বাড়ছে। নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে ২০১০ সাল সময়কালে জিডিপিতে শিল্পের অবদান ২০ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৩০ এবং বিপরীতে কৃষি খাতের অবদান নেমে এসেছে বিশ শতাংশের নিচে। সেবা খাত এখন জিডিপির প্রায় অর্ধেক। চলতি শতাব্দীর প্রথম দশকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের হার জিডিপির ২৪ শতাংশে আটকে ছিল, যেখানে আমাদের প্রতিবেশী ভারত পেঁৗছে যায় ৩৩ শতাংশে। আমাদের বেসরকারি বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য গতিতে বাড়ছে না। এর একটি বড় কারণ সুশাসনের ঘাটতি। ঝড়-বন্যা-খরা আঘাত হানছে নিয়মিত। এরপরও বাংলাদেশের এ চিত্র পাশ্চাত্যের অনেকের কাছে রীতিমতো গণ্য হতে থাকে 'সাউথ এশিয়ান সারপ্রাইজ' হিসেবে। এখানে দুর্নীতির লাগাম টানা যাচ্ছে না। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ধারণা সূচকে বাংলাদেশ বছরের পর বছর দুর্নীতিতে এক বা দুই নম্বরে অবস্থান করছে। কিন্তু একই সময়ে আমরা দেখি আরেক চিত্র। মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ ভালো করছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রী পড়াশোনার জন্য হাজির হয়। জেন্ডার ভারসাম্য সেখানে বজায় থাকছে। মা ও নবজাত শিশুর মৃত্যুর হার কমানো সম্ভব হচ্ছে। এ ধরনের কিছু ক্ষেত্রে এমনকি ২০১৫ সালের জন্য জাতিসংঘ নির্ধারিত মিলেনিয়াম গোল বাংলাদেশ আগেভাগেই পূরণ করে ফেলতে পারে। এমনকি দারিদ্র্য দূর করার সূচকেও দেখি পরিবর্তন_ ২০০০ সালে দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল ৪৯.৮ শতাংশ, ২০০৫ সালে ৪০ এবং ২০১০ সালের প্রাথমিক হিসাবে ৩০-৩৫ শতাংশ।
এ দুই ধরনের চিত্র দেখেই বাংলাদেশকে নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে একটি মত_ ডেভেলপমেন্ট পাজল বা উন্নয়ন ধাঁধা। চার দশক আগে যে দেশটির যাত্রা তাদের জন্য যথেষ্ট হতাশার কারণ হয়ে উঠেছিল, এখন কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি দেখে তারা সত্যিই বিস্মিত!
এখন নতুন প্রশ্ন তুলছেন কোনো কোনো বিশ্লেষক_ বাংলাদেশ কতটা এগোতে পারবে? অর্থনীতির তত্ত্বে উন্নয়নের জন্য সঞ্চয় ও বিনিয়োগের অনুপাতের হিসাব গুরুত্বপূর্ণ। বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য অবশ্যই সঞ্চয় বাড়াতে হবে এবং এ জন্য নির্দিষ্ট হার বজায় রাখা চাই। বাংলাদেশে এ হার কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নেই। এ অবস্থায় অনেকের অভিমত, গত দুই দশকে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ৪ থেকে ৬ শতাংশে উন্নীত হওয়ার চিত্র দারুণ উৎসাহব্যঞ্জক এবং তা ৮ শতাংশে উন্নীত করতে হলে অবশ্যই সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশকে স্বল্প আয়ের দেশ থেকে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করার স্লোগান দেওয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের দিনবদলের সনদে। এটা প্রকৃতপক্ষে জাতীয় আকাঙ্ক্ষা। একসময় যারা বাংলাদেশকে নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করছিলেন, তাদের একটি অংশ এখন মনে করছেন, বাংলাদেশ এ লক্ষ্য অর্জনে পুরোপুরি না হোক, কাছাকাছি যেতেই পারে। একটি গ্গ্নাসের অর্ধেকে দুধ এবং অর্ধেক খালি বললে এক ধরনের ইতিবাচক চিত্র পাই। আবার এভাবেও বলা যায়, গ্গ্নাসের অর্ধেকটা খালি। কিন্তু এখন বাংলাদেশ সম্পর্কে দাতাদের মনোভাব বিশ্লেষণ করে বলা যায়, তাদের অনেকেই বলতে চাইছে, গ্গ্নাসের চার ভাগের তিন ভাগ পূর্ণ এবং এক ভাগ খালি। বিশেষ করে গত এক দশকের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে অগ্রগতির ধারা থেকেই তারা এমন সিদ্ধান্তে আসতে পারছে। এ নতুন ধারণা সৃষ্টির পেছনে সরকার, এনজিও, ব্যবসায়ী সম্প্রদায়সহ অনেকেরই অবদান রয়েছে। নারীসমাজের অগ্রগতি তারা বিশেষভাবে লক্ষ্য করছে। দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়াসহ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে গত কয়েক দশকে অর্থনৈতিক মিরাকলের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে শ্রমশক্তিতে নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণ। ৬০-৭০ শতাংশ নারী উৎপাদনমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। আমাদেরও প্রবৃদ্ধির উচ্চ হার অর্জনে এ বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।
কিন্তু এ লক্ষ্য কি অর্জন করা সম্ভব হবে? এ নিয়ে সন্দেহ কিন্তু প্রবল। আমরা এক দশকে প্রবৃদ্ধির হার বাড়াতে পেরেছি এক শতাংশ। এভাবে চার থেকে পাঁচ, পাঁচ থেকে উত্তরণ ঘটেছে ছয় শতাংশে। কিন্তু পরের দশকে অর্থাৎ স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর বছরে কি প্রবৃদ্ধি আরও দুই শতাংশ বাড়িয়ে আট শতাংশে নেওয়া সম্ভব? মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হতে হলে এ লক্ষ্য অর্জন কিন্তু করতেই হবে। বিদ্যমান বাস্তবতায় অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশ পরবর্তী দশকে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হার অর্জন করতেই পারে, কিন্তু ৮ শতাংশের সোনালি ফিতা স্পর্শ করা বেশ কঠিন।
বছরে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারলেও কিন্তু সেটা হবে উৎসাহব্যঞ্জক। এ জন্য তৈরি পোশাক শিল্পের বাজার শুধু ধরে রাখা নয়, আরও বাড়াতে হবে। ইউরোপের মতো যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্ক সহায়তা পেলে এ কাজ সহজ হবে। ক্ষুদ্রঋণের ইতিবাচক অর্জনকেও রক্ষা করতে হবে। এ ঋণ গ্রামাঞ্চলের জন্য আশীর্বাদ হয়েছে এবং অর্থের প্রবাহ বাড়িয়েছে। নারীদের সংগঠিত হতেও ভূমিকা রেখে চলেছে। এ ক্ষেত্রে আস্থার সংকট যেন কোনোভাবেই সৃষ্টি না হয়, তার প্রতি নজর থাকা চাই। কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধির হার বজায় রাখতে পারা আমাদের জন্য শুভ লক্ষণ। উন্নত দেশগুলোতে দেখা যাচ্ছে, শিল্পায়নের পাশাপাশি কৃষিতেও বড় বড় খামার গড়ে উঠছে। কিন্তু বাংলাদেশে খামারের গড় আয়তন বরং ছোট হচ্ছে। এরপরও বিশেষ করে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়িয়ে চলা সম্ভব হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ক্ষুদ্রঋণ পরোক্ষভাবে হলেও অবদান রাখছে। যেমন_ অনেকে এনজিওদের কাছ থেকে অকৃষি খাতের জন্য ঋণ নিয়ে কার্যত তা ব্যবহার করছে জমি বন্ধক রেখে বা বর্গা নিয়ে। গত দুই দশকের হিসাবে দেখা যায়, কৃষিতে বর্গা চাষ ও বন্ধক রাখা জমির পরিমাণ মোট চাষাধীন জমির ২০ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৪০ শতাংশ। এর সুফল প্রত্যক্ষভাবে পেয়েছে গরিব ও ক্ষুদ্র কৃষক।
আট শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জনের পথে কার্যকর অগ্রগতির জন্য আমাদের কৃষি, পোশাক শিল্পসহ রফতানি বাণিজ্য ও ক্ষুদ্রঋণ_ এ তিনটি খাতের পাশাপাশি প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছ থেকে রেমিটেন্স বা বৈদেশিক মুদ্রার অব্যাহত প্রবাহও ধরে রাখতে হবে।
উন্নয়ন সহযোগীদের অব্যাহত সহায়তাও গুরুত্বপূর্ণ। এটা ঠিক, গত দিন দশকে জিডিপির অনুপাতে বৈদেশিক সহায়তা কমেছে। আশির দশকে এটা ছিল ১০ শতাংশ, নব্বইয়ে ৫ শতাংশ। কিন্তু গত দশকে তা নেমে আসে ১.৯ শতাংশে। এরপরও বলব, প্রবৃদ্ধি অন্তত ৭ শতাংশে নিয়ে যেতে হলে তাদের কাছ থেকে ঋণ ও অনুদানের পাশাপাশি বাজারেও প্রবেশাধিকার দরকার। আমরা এখন দুর্ভিক্ষপ্রবণ দেশ নই। সময় সময় মানবিক সহায়তা আমাদের দরকার হতেই পারে। কিন্তু মূল জোর দিতে হবে আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সহায়তার ওপর। জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন সংস্থা এবং সর্বোপরি বিজ্ঞানী মহল একমত, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বঙ্গোপসাগর তীরের এ দেশটি বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমাদের ভূখণ্ডের উল্লেখযোগ্য অংশ তলিয়ে যেতে পারে_ এটা কেবল শঙ্কার পর্যায়ে নেই। এ ধরনের বিপর্যয়ের আগেই বাংলাদেশকে আরও ঘুরে দাঁড়াতে হবে এবং এ জন্য চাই ব্যাপক সহায়তা। দাতারা একসময় চাইত, তাদের মতামত ও প্রস্তাব হুবহু অনুসরণ হোক। একসময় বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ বলেছিলেন, তাদের ধারণাপত্র নিয়ে জাতীয় সংসদেও আলোচনা হতে পারবে না। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে তারা নিজেরাই অংশীদারিত্বের ধারণা উপস্থাপন করেছে। বড় বড় প্রকল্পে তারা শর্ত উপস্থাপন করে ঠিকই, কিন্তু স্থানীয়ভাবে পরিকল্পনা প্রণয়নের প্রতিও তাদের আগ্রহ বেড়েছে। উন্নয়নের জন্য সুশাসন অপরিহার্য_ এ শর্ত নিয়ে তাদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি রয়েছে। কারণ তারা নিজেরাই বলছে, বাংলাদেশ হচ্ছে ডেভেলপমেন্ট প্যারাডক্স। এখানে চিরাচরিত অনেক শর্ত না মানার পরও উন্নতি ঘটছে এবং সুশাসন থাকলে অবশ্যই আরও এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো। মানবাধিকারের ইস্যুটিও গুরুত্ব পেতে থাকবে। তবে তাদের এ পরিবর্তিত মনোভাব সত্ত্বেও বলতে হয়, এ ধারণার দুর্বলতা হচ্ছে যে তার উৎসও আমাদের দেশের বাইরে। সামগ্রিক উন্নতির জন্য আমাদের পরিকল্পনা পদ্ধতির উন্নতি আবশ্যকীয় শর্ত। কিন্তু আমাদের দেশে এখন পরিকল্পনা কমিশনই নেই। অথচ ভারত ও পাকিস্তান উদারীকরণ ও মুক্তবাজার অর্থনীতির পথে চললেও পরিকল্পনা কমিশনকে শক্তিশালী সংস্থা হিসেবে রেখেছে।
এটা ঠিক, বিশ্ব অর্থনীতিতে ২০০৭-২০০৯ সালের সংকট দাতাদের মনোভাব পরিবর্তনে সহায়ক হয়েছে। নতুন প্রেক্ষাপটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি গুরুত্ব পাচ্ছে। রাষ্ট্রের ভূমিকাকেও ভিন্নভাবে দেখা হচ্ছে। অনেক দেশে উচ্চ প্রবৃদ্ধির পরও কেন বিপুলসংখ্যক দরিদ্র থেকে যাচ্ছে, সে প্রশ্নও উঠছে। ইনক্লুসিভ গ্রোথের তত্ত্বও রয়েছে। অসমতা কমাতে হবে, দরিদ্রদের আয় ধনীদের তুলনায় বেশি হারে বাড়তে হবে_ এসব কথাও শোনা যাচ্ছে। এমন অভিমত রয়েছে, দরিদ্ররা যাতে উদ্যোক্তা হতে পারে তেমন সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। উৎপাদিত পণ্য যদি কেবল দরিদ্রদের কাছেই বিক্রি করে তাহলে তারা নিজেরা দরিদ্র থেকে যাবে। কিন্তু ধনীদের বাজারে প্রবেশাধিকার পেলে চিত্র পাল্টে যেতে পারে। দরিদ্র এ জনগোষ্ঠীকে কি প্রাথমিক শেয়ারবাজারে আনা যায়? এটা সম্ভব যদি করপোরেট সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে এবং তার শেয়ার বাজারে আসে। তেমন কাঠামো গড়ে তোলার বিষয়টিও এখন দাতাদের কারও কারও এজেন্ডায় রয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সামাজিক বিনিয়োগের ধারণা নিয়ে প্রচার চালাচ্ছেন। তিনি মনে করেন, এভাবে প্রবৃদ্ধি বাড়বে এবং তার সুফল পাবে দরিদ্র জনগোষ্ঠী।
বাংলাদেশের প্রশ্নে দাতাদের মনোভাবের একটি সমালোচনা হচ্ছে এই, তারা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ইস্যুটিকে সর্বদা সমানভাবে ঊধর্ে্ব তুলে ধরে না। ওয়ান-ইলেভেনের পর দেখা গেল, গণতন্ত্রকে বনবাসে পাঠিয়েও কেউ কেউ গণতন্ত্র কায়েম করতে ইচ্ছুক এবং এর প্রতিও রয়েছে দাতাদের একটি অংশের সমর্থন। কর্তৃত্ববাদী শাসনের সমর্থন করতেও দেখা যায়। অথচ তাত্তি্বকভাবে এটাও বলতে হয়, যদি গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের সঙ্গে উন্নয়নের সংঘাত দেখা দেয় তাহলে প্রথমটিই বেছে নিতে হবে। কিন্তু কখনও কখনও দেখা গেছে, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের পথ থেকে সরে যাওয়া শাসকদের সমর্থন জুগিয়ে গেছে দাতারা। এ ধরনের মনোভাবে দাতাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর ইস্যুটি বাংলাদেশের পরনির্ভরশীলতার ঝুঁকির মাত্রা বাড়িয়েছে। বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ কমে এলেও এ ইস্যু কাজে লাগিয়ে দাতারা বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম। প্রতিবছর সশস্ত্র বাহিনীসহ বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায় ১০ হাজার সদস্য জাতিসংঘ বাহিনীতে দায়িত্ব পালন করে। এ দায়িত্ব পালন করে সংশ্লিষ্টরা ব্যক্তিগতভাবেও উপকৃত হয়। এ ধরনের দায়িত্ব পালন যেহেতু বড় ধরনের ইনসেনটিভ, এটা বন্ধ কিংবা সুযোগ সীমিত হয়ে পড়লে তাদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। এটা মনে রাখতে হবে, এ বাহিনী বহুপক্ষীয় সংস্থা জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত। কিন্তু অর্থের জোগান আসে দ্বিপক্ষীয় সূত্র থেকে। যদি এ অর্থের জোগানদাতা এক বা একাধিক দেশ কোনো কারণে বাংলাদেশের ওপর নারাজ হয় তাহলে শান্তিরক্ষী বাহিনীতে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে। এ সমস্যা কীভাবে মোকাবেলা করতে হবে এর সহজ উত্তর জানা নেই। কিন্তু বিষয়টির সন্তোষজনক নিরসন করতে না পারলে আগামীতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ওপর নতুন হুমকি বা চাপ আসতেই পারে।

ড. বিনায়ক সেন : অর্থনীতিবিদ ও প্রাবন্ধিক
 

No comments

Powered by Blogger.