এবার এত হ্যাল ক্য পড়ল_ তবু থেমে নেই জীবন- প্রচ- কুয়াশায়ও কাবু হয়নি কৃষক
সমুদ্র হক ঘন কুয়াশার মেঘ ঢেকে দিয়েছে রোদ, পড়েছে ছায়া। উত্তর-পশ্চিম দিক ও সাইবেরিয়া অঞ্চল থেকে ধেয়ে আসা বরফঝরা বাতাস গরম কাপড়ের ফাঁকফোকর দিয়ে আঘাত করছে দেহে। নাক চোখ দিয়ে পানি ঝরছে অনবরত।
দুই পাটি দাঁতের প্যারেডের কটকট শব্দে আহা উহু ছাড়া কথাও বের হয় না সহজে। কথা বললে কুয়াশার কু-লী যায় ভেসে। ঘরে বাইরে শীতের সঙ্গে যুদ্ধে নেমেছে মানুষ ও প্রাণী। 'এবার এত হ্যাল (শীত) ক্য পড়ল, মনে হয় বয়ফ ঝরে পড়তিছে, আর তো কুলান যায় না...' ভূমিকম্পের মতো দেহকম্পের সঙ্গে এমন কথা বললেন কৃষক খলিলুর। এত যে শীত তবু জীবন থেমে নেই ওদের। রোদবিমুখ বরফ শীতল প্রকৃতি যখন শহুরে জীবনের দিনলিপি খানিকটা পাল্টে দিয়েছে তখন গ্রামের মানুষের কৃষি পঞ্জির দিনলিপি ঠিক রাখতেই হচ্ছে। আবহাওয়া বিভাগ বলেছে, দু' এক দিনের মধ্যে রোদ উঠলেই দিনের শীত কম অনুভূত হবে। মেঘ রোদকে ঢেকে দিয়েছে বলেই এই অবস্থা। এই শীত ও ঘন কুয়াশার মধ্যে গ্রামের পথে পা বাড়ালে চোখে পড়ে শীতে জখম (কোল্ড ইনজুরি) হওয়া বীজতলা জমি থেকে কতই না যত্নে বোরো চারা তুলে এনে রোপণ করছে কৃষক। পাওয়ার টিলার দিয়ে জমি চাষ ও লেভেল করার পর শ্যালো ইঞ্জিন দিয়ে সেচে কাদা করে সেই পানির মধ্যে নেমে বোরো আবাদের সূচনা করতে হচ্ছে তাদের। সারিয়াকান্দির কৃষক রফিকুল বললেন, বোরোর চারা রোপণের সময় এখন, দিন চলে যাচ্ছে বসে থাকলে চলবে না, যত আগে রোপণ তত তাড়াতাড়ি ঘরে উঠবে ধান। এর মধ্যেই সুযোগ বুঝে অন্য ফসলও করতে হবে। কি শীত কি বর্ষা কৃষকের এখন আর একদ- ফুরসত নেই। উত্তরাঞ্চলের কৃষক এখন আর একটি দু'টি ফসলের ওপর নির্ভরশীল নয়। ফসলের মাঠের একখ- ভূমিও তাদের কাছে মূল্যবান। বছর ১০/১৫ আগেও নির্দিষ্ট আবাদের সময়ও অনেক জমি খালি পড়ে থাকত, এখন আর সেই দিন নেই। গ্রামের একান্নবর্তী পরিবারগুলো খ-িত হওয়া শুরম্ন হয়েছে অনেক আগেই। পরিবার প্রতি খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে (বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে) একদিকে পতিত জমিগুলো চাষের আওতায় আনা হয়েছে, আরেক দিকে একই জমিতে মৌসুমভিত্তিক ধান আবাদের মধ্যবর্তী সময়ে যখন যে ফসলের উপযুক্ত তাই আবাদ হচ্ছে। এমনকি জমির আইল ফাঁকা না রেখে সেখানেও সুযোগ মতো সবজি আবাদ হচ্ছে। বগুড়ার রাজাপুর এলাকায় গিয়ে দেখা যায় কৃষক জয়নুল তার কলা আবাদের মধ্যে শীতের সবজি আবাদ করছে। মাঘের এই সময়টায় এত যে শীত তবু কৃষকের কানত্মি নেই, কেউ ঠায় বসে নেই। সোনাতলার রানীরপাড়া গ্রামের কৃষক আজাহারের কথা, 'এবার দেখতিছি শীতের বেজায় দাপট। ঘর থাক্য বাড়ালেই শোঁ শোঁ কর্য বরফের বাতাস আসে চোখ কান নাক মুখ দিয়ে ঢুক্য এক্কেবারে কাহিল করে ফালায়, এ্যর মধ্যেই কিষানক (কৃষককে) মাঠত যাওয়া লাগে।' এবারের মাঘের এই শীতে শহরের লোক যখন ঘর থেকে বের হয় বেলা বারোটারও পরে তখন গ্রামের লোক সেই ভোরে ঘুম থেকে জেগে উঠে ঘন কুয়াশার মধ্যেই যায় ফসলের মাঠে। ফিরে দুপুরে ভাত খেয়ে চুলার ধারে শরীর তাপিয়ে নিয়ে ফের যায় মাঠে। সন্ধ্যার আগে ঘরে ফিরে খড়-লতাপাতা জ্বালিয়ে চারধারে বসে শরীর তাপিয়ে নেয় কিছুটা সময়। তারপর ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে যায় জীর্ণ কুটিরে। যে কুটিরেও শোঁ শোঁ করে এসে ঢোকে বরফের তীর। তবু জীবন থেমে নেই ওদের...।
No comments