জ্যোতি বসুর গ্রামের বাড়ি 'শত্রম্ন সম্পত্তি' অবমুক্ত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু by শংকর কুমার দে
কিংবদনত্মি রাজনীতিক জ্যোতি বসুর বারদীর গ্রামের বাড়িটি এনিমি প্রপার্টি করেছিল (শত্রম্ন সম্পত্তি) পাকিসত্মান সরকার। বাড়িটি প্রায় ২৪ বছর ধরে ছিল শত্রম্ন সম্পত্তির তালিকায়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শত্রম্ন সম্পত্তি অবমুক্ত করে তাঁকে ফিরিয়ে দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর স্মৃতিবিজড়িত গ্রামের বাড়িটি ফিরিয়ে দেয়ার ঘটনা ও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ও স্মৃতিবিজড়িত অনেক কথা এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপচারিতায় নিজেই বলেছিলেন জ্যোতি বসু।১৯৮৭ সালের ৩০ জানুয়ারি। নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও উপজেলার বারদীতে নিজ বাড়িতে জ্যোতি বসু আসছেন। এ খবরে হাজার হাজার মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত জমায়েত হতে থাকে বারদী খেলার মাঠে। তাঁকে দেখার অদম্য বাসনা নিয়ে মানুষজন জড়ো হতে থাকে। সবার দৃষ্টি আকাশের দিকে। ৰণে ৰণে এদিক ওদিক উঁকি মারছে। প্রতীৰার প্রহর যেন কাটছে না। ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন রোদের লুকোচুরি খেলা চলছে। অবশেষে প্রতীৰার অবসান ঘটিয়ে আকাশের বুকে দেখা গেল একটি হেলিকপ্টার। সবার মধ্যে আনন্দ উলস্নাস। আঙ্গুল উঁচিয়ে একে অপরকে হেলিকপ্টারটিকে দেখাচ্ছে। সে যে কি এক আনন্দের অনুভূতি তা ভাষায় বর্ণনাতীত। হেলিকপ্টারটি বারদী খেলার মাঠের আশপাশের আকাশে চক্কর দিচ্ছে। ক্রমেই নিচুতে নামতে লাগল জ্যোতি বসুকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি। মাঠে অবতরণের সময় হেলিকপ্টারের ঘর্ণায়মান পাখার বাতাসে ধূলি বালি উড়ে যেন ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। ঝড় কমতেই হেলিকপ্টার থেকে নেমে আসলেন ধবধবে সাদা ধুতি ও পাঞ্জাবি পরিহিত বেঁটে খাটো এক ব্যক্তি। তিনিই জ্যোতি বসু। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। বারদীর জ্যোতি বসু।
বারদীর মানুষজন শুনেছেন জ্যোতি বসু বারদীরই মানুষ। ঘরের ছেলেকে বারদীর খুব কম মানুষই দেখেছে। এজন্য তাঁকে নিয়ে বারদীর মানুষজনের গর্বের শেষ নেই। বারদীর জ্যোতি বসু বারদীতে এসেছেন। তাও প্রায় পঁয়তালিস্নশ বছর পর। তাঁর বারদী সফরের খবরটি কভার করার জন্য ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে অসংখ্য সাংবাদিক গেছেন বারদীতে। কলকাতা থেকে মিডিয়াকর্মীরা এসে ভিড় করেছেন। এত দিন পর জ্যোতি বসুর বারদী গ্রামে আসার পর তাঁর অনুভূতিসহ বিভিন্ন দিক নিয়ে নিউজ কভার করার আগ্রহ সকল সাংবাদিকেরই। আমি তখন দৈনিক বাংলার বাণীর স্টাফ রিপোর্টার। দৈনিক বাংলার বাণীর জন্য নিউজ কভার করার এ্যাসাইনমেন্টটা নিজেই চেয়ে নেই। কারণ আমার বাড়িও বারদীতে। আমার স্বর্গীয় পিতা নারায়ণ চন্দ্র দে ছিলেন জ্যোতি বসুর খেলার সঙ্গী। জ্যোতি বাবুর চলে যাওয়ার মাত্র ৬ বছর আগে আমার পিতা স্বর্গীয় হন। পরপারে চলে যাওয়ার আগ পর্যনত্ম তাঁর খেলার সঙ্গী জ্যোতি বসু সম্পর্কে পারিবারিক আলোচনায় নানা কথা উঠত। কথা উঠলেই জ্যোতি বসুর গুণকীর্তন করতেন। আমার বাবার মুখ থেকে জ্যোতি বসু সম্পর্কে অনেক কথা শোনা আর নিজের চোখে জ্যোতি বসুকে দেখার লোভ সংবরণ করতে পারছিলাম না। জ্যোতি বসুকে দেখার সৌভাগ্যের সুযোগটি যেন হাতছাড়া না হয় সেই জন্য অফিস থেকে এ্যাসাইনমেন্ট নিয়েই চলে গেলাম বারদীতে। আশায় বুক বেঁধে আছি যদি জ্যোতি বসুর সঙ্গে কথা বলা যায়। সেই সুযোগটিও যেন হাতছাড়া না হয় তার জন্যও প্রতীৰা করতে থাকলাম। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর বারদীতে আসার প্রটোকল ডিঙ্গিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাওয়া তখন সহজ ছিল না। তারপরও বারদীর ছেলে বলেই সেদিন সাংবাদিক হিসেবে তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পেরেছিলাম, যা তখন দৈনিক বাংলার বাণীতে প্রকাশিত হয়েছিল।
পাকিসত্মান সৃষ্টি হওয়ার আগেই '৪২ সালের দিকে জ্যোতি বসুর পরিবার কলকাতায় চলে যায়। বাবার মুখে শুনেছি তিনি শৈশবে কলকাতায় লেখাপড়া করলেও নাড়ির টানে পিত্রালয় বারদীতে চলে আসতেন। তখন বারদীতে জলপথে আসতে হতো। যানবাহন ছিল স্টিমার। কলকাতা থেকে স্টিমারে চেপে গোয়ালন্দ হয়ে বারদীর ছটাইক্কার ঘাটে এসে স্টিমার ভিড়ত। জ্যোতি বসু বারদী পেঁৗছেই শৈশব-কৈশোরের বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলায় মেতে উঠতেন। বারদীর মাঠে ফুটবল খেলতেন।
'৮৭ সালে জ্যোতি বসু যখন বারদীতে আসেন তখন তাঁর বন্ধুদের মধ্যে বেঁচে আছেন এমন লোকই খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছিল না। বারদীতে এসে মহাপুরম্নষ বহ্ম মহাযোগী শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী বাবার আশ্রমে গিয়ে মন্দিরে উঠে প্রণাম করেন তিনি। বারদীর শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী বাবার আশ্রম থেকে অদূরেই জ্যোতি বসুর গ্রামের বাড়ি। গ্রামের অাঁকাবাঁকা মেঠোপথ পেরিয়ে বাড়ির উদ্দেশে হেঁটে চলেছেন জ্যোতি বসু। বাহাত্তর বছর বয়সী জ্যোতি বসুর জোর কদমে হাঁটার ৰিপ্রতা দেখে মনে হচ্ছিল তিনি যেন বিশ কি বাইশ বছরের যুবক। পালস্না দিয়ে তাঁর সঙ্গে হেঁটে কেউই কুলিয়ে উঠতে পারছিল না। তাঁর হাঁটার ৰিপ্রতার বিষয়টিও তখন সবার মুখে মুখে। জ্যোতি বসু কাঁচারাসত্মা দিয়ে হেঁটে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন। তাঁর পেছনে পেছনে জনতার ঢল নেমেছে। উঁচু-নিচু পথ পেরিয়ে বাড়ির আঙ্গিনায় উঠেই থমকে দাঁড়ালেন। বাড়ির সামনেই একটি কূপ (কুয়া)। তখনকার দিনে গ্রামের জমিদার বা তালুকদার বাড়িতে সুপেয় পানির জন্য কুয়া খনন করা হতো। গ্রামের সবাই এসে সেই কুয়া থেকে জল নিয়ে স্নান সমাপন, রান্নাবান্না, খাওয়াদাওয়া করত। বাড়ির সামনের কুয়াটা দেখেই থমকে দাঁড়ানো জ্যোতি বসুর দিকে সবার দৃষ্টি পড়ল। কুয়ার সামনে দাঁড়িয়ে কুয়ার নিচের গভীরতার দিকে তাকালেন। কিছুৰণের জন্য স্মৃতির অতলে হারিয়ে গেলেন। একটা দীর্ঘ শ্বাস যেন বের হয়ে এল তাঁর বুক চিরে। ৰিপ্রগতিতে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলেন সেই পুরনো স্মৃতিসংবলিত কালের সাৰী বাড়ির দোতলায়। বাড়িতে গিয়ে দীর্ঘৰণ অপেৰা করলেন। বাড়িতে এলে কোথায় থাকতেন, কোথায় ঘুমাতেন, মা-বাবা কোথায় থাকতেন স্মৃৃতিচারণ করলেন।
বাড়ির সামনে গিয়ে দেখা গেল দেয়ালে শ্বেত পাথরের নেমপেস্নট, জ্যোতি বসু। নেমপেস্নটের জ্যোতি বসু নামের জ্যোতির উজ্জ্বলতা কমে গেছে। আমগাছ, জামগাছ, বেতঝাড়, কোথায় নাগদের বাড়ি ইত্যাদির কথা বললেন জ্যোতি বসু। '৮৭ সালে আসার দীর্ঘ ১০ বছর পর তিনি '৯৭ সালে আরেকবার এসেছিলেন বারদীতে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে তিনি বারদীতে এসেছিলেন। নারায়ণগঞ্জের সাংসদ শামীম ওসমানের নেতৃত্বে তাঁকে বারদীর মাঠে সংবর্ধনা দেয়া হয়। এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে নারায়ণগঞ্জ জেলার দলমত নির্বিশেষে সকল এমপি, সুধীজনসহ সর্বসত্মরের মানুষ উপস্থিত ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের আজকের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকেও (তখন মন্ত্রী ছিলেন) জ্যোতি বসুর সঙ্গে সংবর্ধনা দেয়া হয় তখন।
জ্যোতি বসু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশকে কত ভালবাসতেন তা তাঁর কর্মকা-ে প্রতিফলন ঘটেছে । জ্যোতি বসু বালিগঞ্জের বাড়িতে থাকতেন। আর মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে রাইটার্স বিল্ডিংয়ের যেখানেই থাকতেন না কেন বারদীর কেউ তাঁর সঙ্গে সাৰাত করতে এসেছে নাম শুনলেই হলো। কোন ধরনের প্রটোকলের বালাই ছাড়াই অতিথির সঙ্গে দেখা করতেন। এমনকি বালীগঞ্জের বাড়িতে বারদীর অনেকেই নাসত্মা বা আহার করে আসার মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর পরিবারের আতিথেয়তার গল্প করতেন।
আর জ্যোতি বাবুর গ্রামের বাড়ির কেয়ারটেকার শহীদুলস্নাহ কলকাতায় তাঁর বাড়িতে গেলে তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী বাড়ির ও পরিবারের লোকজনই মনে করত সবাই। জ্যোতি বাবু চিনুক আর না চিনুক বারদীর লোক নাম শুনলেই তিনি অনায়াসে দেখা দিতেন, গল্প করতেন, বারদীর খবর নিতেন। জ্যোতি বাবুর কাছ থেকে বারদীর নাম বলে কলকাতায় অনেকেই বিভিন্ন সমস্যা থেকে উপকৃত হয়েছেন। বারদীকে ভালবাসতে গিয়েই তিনি বাংলাদেশকে ভালবেসেছিলেন। দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি তাঁর স্বাৰর রেখেছেন। পশ্চিম বাংলাতেই ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার। জ্যোতি বসু বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য তখন যে কি করেছেন তাঁর স্বীকৃতি ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।
এত বড় কিংবদনত্মি রাজনীতিক জ্যোতি বসুকে কাছে পাওয়ার পর কথা বলার, সানি্নধ্য লাভের লোভ সংবরণ করতে পারে কে? একে তো সাংবাদিক তারপর বারদীর সনত্মান দুই দাবি নিয়ে জ্যোতি বসুর সামনে হাজির হলাম। তাঁর খেলার সঙ্গীর ছেলে পরিচয় দিয়ে সেদিন মুখোমুখি হয়েছিলাম। মনেপ্রাণে তখন এক অন্য রকম শিহরণ। আবেগে ভুলে গিয়েছিলাম সব কিছুই। জ্যোতি বসুর সামনে দাঁড়াতেই দেখলাম মুটেমজুর, কুলি, কামারের নেতা, সদা হাস্য এক অমায়িক মানুষ। হৃদয়ে এক অনন্য অনুভূতির ঢেউ খেলে গেল। তাঁর সঙ্গে কথা বলার সময় জানতে পেরেছিলাম তাঁর গ্রামের বাড়ি ফিরে পাওয়ার ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা। বঙ্গবন্ধু পরিবারের সঙ্গে তাঁর পরিবারের সম্পর্কটি যেন আত্মীয়তার চেয়েও আরও বড় কিছু। '৪৭ সালে পাকিসত্মান সৃষ্টি হওয়ারও প্রায় ৫ বছর আগে '৪২ সালের দিকে জ্যোতি বসুর পরিবার পূর্ব পাকিসত্মান ত্যাগ করে কলকাতায় চলে যান। জ্যোতি বসুর বাড়িটি ছিল তখন পরিত্যক্ত, রম্নগ্ন, ভগ্নদশায়। পাকিসত্মান সরকার বাড়িটিকে শত্রম্ন সম্পত্তি হিসাবে নাম জারির রেকর্ড করে। শত্রম্ন সম্পত্তি হিসেবে বাড়িটি তখন বেদখলের জন্য চেষ্টা করা হয়েছে একাধিকবার। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জ্যোতি বসু (তখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন না) টেলিফোন করেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। টেলিফোনে কুশল বিনিময়, আনুষঙ্গিক কথাবার্তার পর শত্রম্ন সম্পত্তি করা বাড়িটি ফেরত দেয়ার প্রসঙ্গটি উত্থাপিত হয়। জ্যোতি বসুকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে জ্যোতি বসুর বাড়িটি শত্রম্ন সম্পত্তি থেকে অবমুক্ত হয়। বাংলাদেশে সফরে আসার জন্য কথাও দিয়েছিলেন জ্যোতি বসু। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতে তা আর হয়ে ওঠেনি। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর তিনি খুবই দুঃখ পেয়েছিলেন। বাড়িটি রৰার জন্য জ্যোতি বসুর নির্দেশক্রমেই কেয়ারটেকার নিয়োগ করা হয় বারদী গ্রামের শহীদুলস্নাহকে। সেই থেকে তাঁর তত্ত্বাবধানেই আজ অবধি আছে জ্যোতি বসুর বাড়িটি। '৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ৰমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে বাড়িটির সংস্কার করা হয়। জ্যোতি বসুর বাড়ির জ্যোতি ফিরিয়ে আনা হয়েছে ঠিকই। কিন্তু জ্যোতি বাবুর জ্যোতি নিভে গেছে।
No comments