গলাচিপার কুইট্টাল পাড়া_ রাতদিন কর্মচঞ্চল- উৎপাদিত চাল যায় আশপাশের জেলায় by শংকর লাল দাশ
গলাচিপা থেকে সালেহা, রাহেলা, মায়া, ইউনুস, হাকিম, শুক্কুরিজান থেকে শুরম্ন করে রামনাবাদ নদী তীরের কুইট্টালপাড়ার সকলেই এখন ব্যসত্ম। কি নারী। কি পুরম্নষ। কিংবা শিশু-কিশোর।
গা গরম করা রোদ পোহানোর ফুরসত কারোরই নেই। নেই লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমানোর অবসর। তীব্র শীত শরীরে হুল ফোটালেও সেদিকে নেই ভ্রূপে। সবার কাছে রাতদিন একাকার হয়ে গেছে। হাট থেকে ধান কেনা। সিদ্ধ করা। মাঠে ফেলে রোদে শুকানো। মিলে ধান ভাঙ্গানো। আবার তা বিক্রি। এসবেই কাটছে সময়। কুইট্টালপাড়ার প্রায় এক হাজার মানুষের এমন শ্রম ঘামের বিনিময়ে টিকে আছে পটুয়াখালীসহ আশপাশের কয়েকটি এলাকার চালের বাজার। প্রতি সপ্তাহে এখানে উৎপাদন হচ্ছে কম করে হলেও পাঁচ হাজার মণ চাল। যা গোটা এলাকার চালের বাজারকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করছে। মানুষ পাচ্ছে সহনশীল দাম। পরিবহন খরচও কমে এসেছে অনেক। এছাড়া, কুইট্টালপাড়া ঘিরে গড়ে উঠেছে নানা ব্যবসা বাণিজ্য। বেড়েছে কর্মসংস্থানের সুযোগ।পটুয়াখালী জেলার গলাচিপার রামনাবাদ নদীর পূর্ব তীরের এই 'কুইট্টালপাড়ার' ইতিহাস খুব বেশি প্রাচীন নয়। স্বাধীনতার পরে গড়ে উঠেছে। বরিশালের আগৈলঝাড়া, গৌরনদী, বানারিপাড়ার একদল খেটে খাওয়া পরিশ্রমী মানুষ কুইট্টালপাড়া গড়ে তোলে। তার আগে এলাকায় ধান ভাঙ্গানোর এ ধরনের 'চাতাল'ভিত্তিক কর্মকা- ছিল না। অথচ একমাত্র গলাচিপা এলাকায় কেবল আমন ধানই বছরে প্রায় এক লাখ টনের মতো উৎপাদন হয়। উৎপাদিত সমসত্ম ধান শুকনো মৌসুমে বেপারিদের নৌকা ভর্তি হয়ে চলে যেত ঢাকা, মুন্সীগঞ্জসহ বিভিন্ন মোকামে। আবার বর্ষায় মোকাম থেকে একই পদ্ধতিতে আসত চাল। এতে পরিবহন ছাড়াও নানা খাতে বড় পরিমাণ অর্থ খরচ হতো। সঙ্গে মধ্যস্বত্বভোগী বেপারিদের মুনাফা তো ছিলই। কিন্তু কুইট্টালপাড়া গড়ে ওঠার পরে চিরায়ত এ ধারার কিছুটা হলেও পরিবর্তন এসেছে। এলাকায় উৎপাদিত ধানের একটি অংশ কুইট্টালরা ব্যবহার করায় মধ্যস্বত্বভোগিদের দাপট অনেক কমে এসেছে।
'কুইট্টাল' শব্দটি অনেকটা অঞ্চলিক শব্দ। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ধান ভানার কাজ যারা করে, তারাই এখানে কুইট্টাল হিসেবে পরিচিত। কুইট্টালরা ছোট ছোট 'খইল্যান' গড়ে তুলে ধান ভানার কাজ করে। খইল্যান উত্তরাঞ্চলসহ অনেক এলাকায় 'চাতাল' হিসেবে পরিচিত। গলাচিপায় বেশ কয়েকটি খইল্যান রয়েছে। একেকটি খইল্যান ঘিরে অনেক কুইট্টাল পরিবার কাজ করে। প্রায় প্রতিটি খইল্যানে রয়েছে ধান ভাঙ্গানোর মিল। কারও কারও রয়েছে আধুনিক বয়লার মিল। এগুলো সবই মহাজনদের।
খইল্যান মালিক মঞ্জু মিয়া জানান, এখানে এক শ'য়ের বেশি কুইট্টাল পরিবার রয়েছে। শ্রমিকসহ সব মিলিয়ে ধান ভানার কাজে এক হাজারের মতো মানুষ কাজ করছে। প্রতি সপ্তাহে প্রায় পাঁচ হাজার মণ চাল উৎপাদন হচ্ছে। উৎপাদিত চাল গলাচিপা এলাকার চাহিদা মেটানো ছাড়াও বৃহত্তর পটুয়াখালী, ভোলা, বরগুনাসহ বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা হয়। এখানে চাল উৎপন্নের এ ব্যবস্থাটি গড়ে না উঠলে মানুষকে আরও বেশি দামে চাল কিনতে হতো। এখানে আরও বহু চাতালের চাহিদা এবং প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্তু মূলধনের অভাবে তা গড়ে উঠছে না। একটি খইল্যান বা চাতাল গড়ে তোলার জন্য বড় অঙ্কের পুঁজি প্রয়োজন।
কুইট্টাল ইউনুস বেপারি জানান, একটি কুইট্টাল পরিবারেরই কমপ ে৫/৭ লাখ টাকা পুঁজির প্রয়োজন। কিন্তু তা অধিকাংশের নেই। যে কারণে এখানে কর্মরতদের অধিকাংশই শ্রমিক। পুঁজি সরবরাহ করা গেলে তারা সকলেই হতে পারে একেকজন ছোট মহাজন। কিন্তু এখানকার কর্মরতদের কেউই স্থানীয় বাসিন্দা না হওয়া এবং নিজস্ব জমি জায়গা না থাকায় ব্যাংকগুলো তাদের কোন ধরনের ঋণ সহায়তা দিচ্ছে না।
চাতাল মালিক হোসেন মলিস্নক জানান, এখানে প্রতি সপ্তাহে ১০/২০ হাজার মণ চাল উৎপন্নের সুযোগ-সুবিধা ও চাহিদা রয়েছে। কিন্তু অর্থ সঙ্কটের কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না।
ধান ভানার কাজে যুক্ত কয়েকজন নারী পুরম্নষ জানান, এখানে আষাঢ় মাসে আউশ ওঠার পর থেকে ধান ভানার কাজ শুরম্ন হয়। যা চলে চৈত্র মাস পর্যনত্ম। বাকি সময়টা তাদের বসে থাকতে হয়। তারা কাজের বিনিময়ে লাভের একটি অংশ পান। সাপ্তাহিক হাটের দিনে ধান কেনার পর থেকে তাদের একদম ফুরসত মেলে না। দিনরাতের প্রায় ১৮/২০ ঘণ্টা কাজ করতে হয়।
শ্রমিক আবদুল হাকিম জানান, পরিবারের চারজনকে নিয়ে বছরের দশ মাস কাজ করে খাওয়া-পড়া খরচ বাদ দিয়ে ১০/১২ হাজার টাকা আয় হয়। তিন মাসের মতো বেকার থাকতে হয় বলে আয়ের টাকা জমা রাখা যায় না।
No comments