নগর দর্পণ: চট্টগ্রাম- ৯০% পাস করাতে হবে! by বিশ্বজিৎ চৌধুরী
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের (চমেকসু) ফেসবুকে সংসদের ভিপি দেবাশীষ চক্রবর্তী লিখেছেন, ‘স্যারদের অত্যাচার অনেক সহ্য করেছি...প্রতিবার আশ্বাস দেয়, কিন্তু কোনোবারই কথা রাখা হয় না, চমেকের সব সহযোদ্ধা ভাইয়া-আপু সবাইকে জানিয়ে রাখলাম, এইবার প্রথম,
দ্বিতীয় বা ফাইনাল প্রফের কোনোটাতে পাসের হার যদি ৯০%-এর নিচে নামে, তাহলে আর ছাড় দেব না। কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমে ক্যাম্পাস অচল করে দেব। গতবার শুধু আগুনের ঝলকানি দেখেছে, এবার সত্যিকারের আগুন দেখবে। ছাত্র সংসদ ২০১২-১৩ (দেবু-রাফসান পরিষদ) তোমাদের সবাইকে নিয়ে সব সময় ভাবে, তোমরা আমাদের যেকোনো প্রগতিশীল কর্মসূচিতে অবশ্যই পূর্ণ সমর্থন দেবে আশা রাখি।’
একটি সামাজিক ওয়েবসাইটে একটি সরকারি মেডিকেল কলেজের ভিপি স্বনামে এ রকম একটি স্ট্যাটাস দিতে পারেন, বিশ্বাস হতে চায় না। কিন্তু ভিপি পত্রিকান্তরে স্বীকার করেছেন, এ বক্তব্য তাঁরই। এ রকম বক্তব্যের পক্ষে নিজেদের পছন্দ জানিয়েছেন ৪৯ জন শিক্ষার্থী। অভি আফসার নামের এক শিক্ষার্থী এই দাবির সঙ্গে সহমর্মিতা প্রকাশ করে মন্তব্য করেছেন, ‘ভাই, পরীক্ষা হয়ে রেজাল্ট দিয়ে দিলে তো খেলাটাই শেষ। তাই পরীক্ষার আগেও একটু ওয়ার্ম আপ দেওয়া উচিত।’
‘ওয়ার্ম আপ’ হিসেবেই সম্ভবত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার সাঁটানো হয়েছে, ‘পাসের হার ৯০%-এর কম হলে কলেজ ও হাসপাতাল অচল করে দেওয়া হবে—সৌজন্যে: দেবু-রাফসান পরিষদ, চমেকসু ১২-১৩’।
ছাত্র সংসদের জিএস রাফসান সালমান মাহমুদ আরও এক ধাপ এগিয়ে কলেজের অধ্যক্ষের সঙ্গে তাঁদের আলোচনার প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেছেন তাঁর ফেসবুকে। তিনি খোলামেলা জানিয়েছেন তাঁদের সঙ্গে আলাপের একপর্যায়ে অধ্যক্ষ একজন বিভাগীয় প্রধানকে ফোন করে কড়া ভাষায় ওই বিভাগে ছাত্রছাত্রীদের খারাপ ফল করার কারণ জানতে চেয়েছেন। বিভাগীয় প্রধান এর দায় পরীক্ষকদের ওপর চাপালে অধ্যক্ষ তাঁকে বলেছেন, পরীক্ষকদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে ভবিষ্যতে বিভাগীয় প্রধানের পদ নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হবে। অধ্যক্ষ এমনকি ছাত্র সংসদের নেতাদের আশ্বস্ত করেছেন, তাঁদের অভিযোগ অনুযায়ী মৌখিক পরীক্ষায় যেসব শিক্ষক কম নম্বর দেন, তাঁদের ভবিষ্যতে বাদ দেওয়া হবে।
অধ্যক্ষের সঙ্গে ছাত্র সংসদের আলোচনার বিষয় আমাদের জানার কথা নয়। এসব কথা ফেসবুকে লিখে জানিয়েছেন খোদ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক। চট্টগ্রামের একটি স্থানীয় দৈনিকে এর বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে।
একটি নির্বাচিত (বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়) ছাত্র সংসদের প্রতিনিধিরা কী রকম অযৌক্তিক ও অশোভন দাবি কলেজ কর্তৃপক্ষকে জানাতে পারেন এবং এসব দাবির কাছে কর্তৃপক্ষ কতটা অসহায়, ফেসবুকে দেওয়া রাফসান সালমানের মন্তব্য থেকেই সেটা উঠে এসেছে। আমরা কোন দেশে বাস করছি?
মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশে সরকারি মেডিকেল কলেজে পড়তে আসেন সবচেয়ে ভালো ছাত্রছাত্রীরা। তাঁরাই যখন দাবি তোলেন পরীক্ষায় কৃতকার্য হওয়ার মতো যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারুন বা না পারুন শতকরা নব্বই জনকে পাস করিয়ে দিতে হবে, তখন আমাদের উচ্চশিক্ষার মান ও ব্যবস্থাপনা কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে, তারই একটি চিত্র যেন ভেসে ওঠে আমাদের সামনে।
জানা গেছে, চট্টগ্রামে মেডিকেল কলেজে পাসের হার বাড়িয়ে দেওয়ার দাবির পেছনে যে কথাটি অনুক্ত ছিল তা হচ্ছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে পাসের হার তুলনামূলক বেশি। বলছি না বেসরকারি মেডিকেল কলেজের সবগুলোতেই পাসের হার বাড়িয়ে দেওয়ার এই প্রবণতা রয়েছে। কিন্তু সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে ভর্তি হওয়া দেশের সেরা ছাত্রদের তুলনায় যখন কিছু কিছু বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা ভালো ফল করেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, এটা কী করে সম্ভব? সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়ে যাঁরা বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন বেশি অর্থের বিনিময়ে (দু-একটি ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে), তাঁরা কী করে অপেক্ষাকৃত ভালো ফল করছেন? পত্রিকান্তরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষের বক্তব্যের মধ্যেও যেন এই প্রশ্নের প্রতিধ্বনি ছিল। তিনি বলেছেন, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনেক মেডিকেল কলেজ এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। কিন্তু রেজাল্টের তারতম্য হচ্ছে।’ তিনি খোলাসা করে কিছু বলেননি, কিন্তু আমরা কি ধরে নেব এই ‘তারতম্যে’র কারণ বাণিজ্যিক? তাহলে দেশের স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসাব্যবস্থার ভবিষ্যৎ কী?
এ কথা তো ঠিক, দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা দিন দিন কমছে। যাঁদের সামর্থ্য আছে তাঁরা প্রায়ই ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর বা আমেরিকার মতো দেশে পাড়ি দেন উন্নত চিকিৎসার আশায়। কিন্তু সেই সামর্থ্য কয়জনের আছে?
বিভিন্ন হাসপাতাল ও রোগনির্ণয় কেন্দ্রে রোগীর আত্মীয়স্বজনের হামলা ও ভাঙচুর ইত্যাদির খবর আমরা পত্রপত্রিকায় প্রায়ই দেখে থাকি। তাঁদের এ ধরনের প্রতিক্রিয়াকে উৎসাহিত করতে চাই না। কিন্তু এ কথা তো ঠিক, চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি একধরনের অনাস্থা থেকেই এসব ঘটছে।
আমাদের বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর অধিকাংশেরই মানসম্পন্ন হাসপাতাল নেই। যেটুকু আছে তাতে আস্থার অভাবে রোগীর সংখ্যা অপ্রতুল। যে শিক্ষার্থীরা তাত্ত্বিক পাঠ সম্পন্ন করে হাতে-কলমে অভিজ্ঞতা নিতে পারেন না, তাঁরা ভবিষ্যতে চিকিৎসাক্ষেত্রে কতটা সফল হবেন, তা সহজেই অনুমেয়। তা ছাড়া ভালো ও দক্ষ শিক্ষকের অভাব তো রয়েছেই।
আজ শিক্ষার্থীরা যে নব্বই ভাগ পাসের দাবি তোলার মতো ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছেন, তার পেছনে শিক্ষকদেরও কি দায় নেই? বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা যে বেশি নম্বর পাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে, এ শিক্ষকদের হাত দিয়েই তো তা হয়। তার মানে কোনো না কোনোভাবে লাভবান হয়ে অনৈতিক এসব কাজ করছেন তাঁদেরই কেউ কেউ।
অনৈতিকতার কথা যখন উঠলই তখন উল্লেখ করা দরকার ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে নানা সুবিধা নেওয়া, রোগনির্ণয় কেন্দ্রগুলো থেকে নিয়মিত কমিশন নেওয়া, এমনকি অপ্রয়োজনে শল্যচিকিৎসার পরামর্শ দিয়ে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নেওয়ার মতো অনৈতিক কাজগুলোকেও প্রায় প্রথায় পরিণত করেছেন আমাদের প্রতিষ্ঠিত কিছু চিকিৎসক। মেডিকেল কলেজে চাকরিরত অবস্থায় সরকারি হাসপাতালের রোগীদের প্রতি অবহেলা করে প্রাইভেট প্র্যাকটিসের দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়ার অভিযোগ তো যথেষ্ট পুরোনো।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) বা ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব) প্রভৃতি সংগঠন ক্ষমতাসীন বা ক্ষমতাপ্রত্যাশী রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুড়বৃত্তি করতে যতটা আগ্রহী, দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নয়ন বা চিকিৎসকদের কল্যাণে কাজ করার ব্যাপারে ততটা আগ্রহী বলে মনে হয় না। ফলে একেকবার সরকার বদলের সঙ্গে চিকিৎসকদের ভাগ্য বদলের ব্যাপারটিও আজ প্রায় নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বদলি-আতঙ্কের কারণে সাধারণ চিকিৎসকেরা অনেকে এসব সংগঠনে সক্রিয় হন, কেউ অন্তত যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন।
চিকিৎসকেরা প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেতে চান না, বাধ্য হয়ে গেলেও নিয়মিত কর্মস্থলে থাকেন না—দিন গুনতে থাকেন কখন ফিরে আসবেন শহরে। অবশ্য এর জন্য পুরোপুরি তাঁদের দায়ী করলেও চলে না। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ডাক্তারদের থাকার মতো মানসম্পন্ন বন্দোবস্তও অনেক সময় থাকে না। সরকার এ ব্যাপারে উদাসীন। চিকিৎসকদের সংগঠনগুলো এ নিয়ে কোনো আন্দোলন-সংগ্রামের কর্মসূচি দিয়েছে বলে কখনো শোনা যায়নি। এই যখন স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাক্ষেত্রের সামগ্রিক চিত্র, তখন শিক্ষার্থীরা যে অনৈতিক ও অযৌক্তিক দাবি জানাবেন, তাতে আর সন্দেহ কী!
ভাবছি, চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা যদি শতকরা নব্বই ভাগের পাস নিশ্চিত করার দাবি জানান, তাহলে বিদেশে যাওয়ার সামর্থ্য নেই—দেশের এমন নব্বই ভাগ চিকিৎসাপ্রার্থীর জন্য অপেক্ষা করছে কেমন ভবিষ্যৎ?
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwa_chy@yahoo.com
একটি সামাজিক ওয়েবসাইটে একটি সরকারি মেডিকেল কলেজের ভিপি স্বনামে এ রকম একটি স্ট্যাটাস দিতে পারেন, বিশ্বাস হতে চায় না। কিন্তু ভিপি পত্রিকান্তরে স্বীকার করেছেন, এ বক্তব্য তাঁরই। এ রকম বক্তব্যের পক্ষে নিজেদের পছন্দ জানিয়েছেন ৪৯ জন শিক্ষার্থী। অভি আফসার নামের এক শিক্ষার্থী এই দাবির সঙ্গে সহমর্মিতা প্রকাশ করে মন্তব্য করেছেন, ‘ভাই, পরীক্ষা হয়ে রেজাল্ট দিয়ে দিলে তো খেলাটাই শেষ। তাই পরীক্ষার আগেও একটু ওয়ার্ম আপ দেওয়া উচিত।’
‘ওয়ার্ম আপ’ হিসেবেই সম্ভবত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার সাঁটানো হয়েছে, ‘পাসের হার ৯০%-এর কম হলে কলেজ ও হাসপাতাল অচল করে দেওয়া হবে—সৌজন্যে: দেবু-রাফসান পরিষদ, চমেকসু ১২-১৩’।
ছাত্র সংসদের জিএস রাফসান সালমান মাহমুদ আরও এক ধাপ এগিয়ে কলেজের অধ্যক্ষের সঙ্গে তাঁদের আলোচনার প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেছেন তাঁর ফেসবুকে। তিনি খোলামেলা জানিয়েছেন তাঁদের সঙ্গে আলাপের একপর্যায়ে অধ্যক্ষ একজন বিভাগীয় প্রধানকে ফোন করে কড়া ভাষায় ওই বিভাগে ছাত্রছাত্রীদের খারাপ ফল করার কারণ জানতে চেয়েছেন। বিভাগীয় প্রধান এর দায় পরীক্ষকদের ওপর চাপালে অধ্যক্ষ তাঁকে বলেছেন, পরীক্ষকদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে ভবিষ্যতে বিভাগীয় প্রধানের পদ নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হবে। অধ্যক্ষ এমনকি ছাত্র সংসদের নেতাদের আশ্বস্ত করেছেন, তাঁদের অভিযোগ অনুযায়ী মৌখিক পরীক্ষায় যেসব শিক্ষক কম নম্বর দেন, তাঁদের ভবিষ্যতে বাদ দেওয়া হবে।
অধ্যক্ষের সঙ্গে ছাত্র সংসদের আলোচনার বিষয় আমাদের জানার কথা নয়। এসব কথা ফেসবুকে লিখে জানিয়েছেন খোদ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক। চট্টগ্রামের একটি স্থানীয় দৈনিকে এর বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে।
একটি নির্বাচিত (বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়) ছাত্র সংসদের প্রতিনিধিরা কী রকম অযৌক্তিক ও অশোভন দাবি কলেজ কর্তৃপক্ষকে জানাতে পারেন এবং এসব দাবির কাছে কর্তৃপক্ষ কতটা অসহায়, ফেসবুকে দেওয়া রাফসান সালমানের মন্তব্য থেকেই সেটা উঠে এসেছে। আমরা কোন দেশে বাস করছি?
মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশে সরকারি মেডিকেল কলেজে পড়তে আসেন সবচেয়ে ভালো ছাত্রছাত্রীরা। তাঁরাই যখন দাবি তোলেন পরীক্ষায় কৃতকার্য হওয়ার মতো যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারুন বা না পারুন শতকরা নব্বই জনকে পাস করিয়ে দিতে হবে, তখন আমাদের উচ্চশিক্ষার মান ও ব্যবস্থাপনা কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে, তারই একটি চিত্র যেন ভেসে ওঠে আমাদের সামনে।
জানা গেছে, চট্টগ্রামে মেডিকেল কলেজে পাসের হার বাড়িয়ে দেওয়ার দাবির পেছনে যে কথাটি অনুক্ত ছিল তা হচ্ছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে পাসের হার তুলনামূলক বেশি। বলছি না বেসরকারি মেডিকেল কলেজের সবগুলোতেই পাসের হার বাড়িয়ে দেওয়ার এই প্রবণতা রয়েছে। কিন্তু সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে ভর্তি হওয়া দেশের সেরা ছাত্রদের তুলনায় যখন কিছু কিছু বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা ভালো ফল করেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, এটা কী করে সম্ভব? সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়ে যাঁরা বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন বেশি অর্থের বিনিময়ে (দু-একটি ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে), তাঁরা কী করে অপেক্ষাকৃত ভালো ফল করছেন? পত্রিকান্তরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষের বক্তব্যের মধ্যেও যেন এই প্রশ্নের প্রতিধ্বনি ছিল। তিনি বলেছেন, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনেক মেডিকেল কলেজ এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। কিন্তু রেজাল্টের তারতম্য হচ্ছে।’ তিনি খোলাসা করে কিছু বলেননি, কিন্তু আমরা কি ধরে নেব এই ‘তারতম্যে’র কারণ বাণিজ্যিক? তাহলে দেশের স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসাব্যবস্থার ভবিষ্যৎ কী?
এ কথা তো ঠিক, দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা দিন দিন কমছে। যাঁদের সামর্থ্য আছে তাঁরা প্রায়ই ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর বা আমেরিকার মতো দেশে পাড়ি দেন উন্নত চিকিৎসার আশায়। কিন্তু সেই সামর্থ্য কয়জনের আছে?
বিভিন্ন হাসপাতাল ও রোগনির্ণয় কেন্দ্রে রোগীর আত্মীয়স্বজনের হামলা ও ভাঙচুর ইত্যাদির খবর আমরা পত্রপত্রিকায় প্রায়ই দেখে থাকি। তাঁদের এ ধরনের প্রতিক্রিয়াকে উৎসাহিত করতে চাই না। কিন্তু এ কথা তো ঠিক, চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি একধরনের অনাস্থা থেকেই এসব ঘটছে।
আমাদের বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর অধিকাংশেরই মানসম্পন্ন হাসপাতাল নেই। যেটুকু আছে তাতে আস্থার অভাবে রোগীর সংখ্যা অপ্রতুল। যে শিক্ষার্থীরা তাত্ত্বিক পাঠ সম্পন্ন করে হাতে-কলমে অভিজ্ঞতা নিতে পারেন না, তাঁরা ভবিষ্যতে চিকিৎসাক্ষেত্রে কতটা সফল হবেন, তা সহজেই অনুমেয়। তা ছাড়া ভালো ও দক্ষ শিক্ষকের অভাব তো রয়েছেই।
আজ শিক্ষার্থীরা যে নব্বই ভাগ পাসের দাবি তোলার মতো ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছেন, তার পেছনে শিক্ষকদেরও কি দায় নেই? বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা যে বেশি নম্বর পাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে, এ শিক্ষকদের হাত দিয়েই তো তা হয়। তার মানে কোনো না কোনোভাবে লাভবান হয়ে অনৈতিক এসব কাজ করছেন তাঁদেরই কেউ কেউ।
অনৈতিকতার কথা যখন উঠলই তখন উল্লেখ করা দরকার ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে নানা সুবিধা নেওয়া, রোগনির্ণয় কেন্দ্রগুলো থেকে নিয়মিত কমিশন নেওয়া, এমনকি অপ্রয়োজনে শল্যচিকিৎসার পরামর্শ দিয়ে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নেওয়ার মতো অনৈতিক কাজগুলোকেও প্রায় প্রথায় পরিণত করেছেন আমাদের প্রতিষ্ঠিত কিছু চিকিৎসক। মেডিকেল কলেজে চাকরিরত অবস্থায় সরকারি হাসপাতালের রোগীদের প্রতি অবহেলা করে প্রাইভেট প্র্যাকটিসের দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়ার অভিযোগ তো যথেষ্ট পুরোনো।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) বা ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব) প্রভৃতি সংগঠন ক্ষমতাসীন বা ক্ষমতাপ্রত্যাশী রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুড়বৃত্তি করতে যতটা আগ্রহী, দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নয়ন বা চিকিৎসকদের কল্যাণে কাজ করার ব্যাপারে ততটা আগ্রহী বলে মনে হয় না। ফলে একেকবার সরকার বদলের সঙ্গে চিকিৎসকদের ভাগ্য বদলের ব্যাপারটিও আজ প্রায় নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বদলি-আতঙ্কের কারণে সাধারণ চিকিৎসকেরা অনেকে এসব সংগঠনে সক্রিয় হন, কেউ অন্তত যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন।
চিকিৎসকেরা প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেতে চান না, বাধ্য হয়ে গেলেও নিয়মিত কর্মস্থলে থাকেন না—দিন গুনতে থাকেন কখন ফিরে আসবেন শহরে। অবশ্য এর জন্য পুরোপুরি তাঁদের দায়ী করলেও চলে না। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ডাক্তারদের থাকার মতো মানসম্পন্ন বন্দোবস্তও অনেক সময় থাকে না। সরকার এ ব্যাপারে উদাসীন। চিকিৎসকদের সংগঠনগুলো এ নিয়ে কোনো আন্দোলন-সংগ্রামের কর্মসূচি দিয়েছে বলে কখনো শোনা যায়নি। এই যখন স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাক্ষেত্রের সামগ্রিক চিত্র, তখন শিক্ষার্থীরা যে অনৈতিক ও অযৌক্তিক দাবি জানাবেন, তাতে আর সন্দেহ কী!
ভাবছি, চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা যদি শতকরা নব্বই ভাগের পাস নিশ্চিত করার দাবি জানান, তাহলে বিদেশে যাওয়ার সামর্থ্য নেই—দেশের এমন নব্বই ভাগ চিকিৎসাপ্রার্থীর জন্য অপেক্ষা করছে কেমন ভবিষ্যৎ?
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwa_chy@yahoo.com
No comments