ইরানের বিরম্নদ্ধে নতুন প্রচারযুদ্ধ 'সাই-আপ্স' by কামরম্নল হাসান
১৯৫১ সালের নির্বাচনে ইরানের জনপ্রিয় নেতা মোহাম্মদ মোসাদ্দেক বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে ইরানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। নির্বাচনউত্তর পরিস্থিতি তিনি ইরানের তেল বিপস্নবকে জাতীয়করণ করেন এবং ব্রিটিশ তেল কোম্পানিকে দেশ ত্যাগের নির্দেশ দেন।
কিন্তু ১৯৫৩ সালের আগস্টে ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই সিক্স এবং মার্কিন সংস্থা সিআইএর যৌথ প্রচেষ্টায় জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রীকে হটিয়ে ৰমতায় বসায় পশ্চিমাদের তাঁবেদার শাহ পাহভীকে। শাহ পাহভীর সময়কালে আমেরিকার মদদে ইরান পরমাণু কর্মসূচী শুরম্ন করে শাহের ৰমতায় আসীন হওয়ার পাঁচ বছরের মাথায়। এর পর ১৯৭৩ সালে মার্কিন প্রযুক্তি, প্রশিৰণ এবং জ্বালানির সহায়তায় ইরানের পরমাণু শক্তি কমিশন গঠিত হয়। কিন্তু দেশব্যাপী চরম বিরোধিতা এবং মার্কিন আধিপত্যবাদের বিরম্নদ্ধে দেশটির ইসলামী দলগুলোর চরম আন্দোলনের মুখে ১৯৭৯ সালের জানুয়ারি মাসেই মৃতু্য হুমকি মাথায় নিয়ে দেশ ত্যাগ করেন শাহ পাহভী। স্নায়ুযুদ্ধ সময়কালীন সেই খ-িত বিশ্ব রাজনীতিতে ইরান পরোৰভাবে যোগ দেয় রাশিয়ান শিবিরে। অন্যদিকে চীনের সঙ্গেও সু-সম্পর্ক বজায় রেখে নিজেদের পথচলা শুরম্ন করে ইরানের রৰণশীল শাসকরা। শিয়া-সুনি্ন দ্বন্দ্বের ফলে সুন্নীপ্রধান দেশগুলো হয়ে উঠে চিরশত্রম্ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতের পুতুল।ইরাক, পাকিসত্মান, সৌদিআরবসহ বিভিন্ন সুনি্নপ্রধান দেশের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক বজায় রেখেই এগুতে থাকে ইরান। আশির দশকের শুরম্নর দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট এই বৈরিতার সুযোগ নিয়ে প্রতিবেশী ইরাকের সঙ্গে তাদের যুদ্ধ বাঁধায়। এর আসল উদ্দেশ্য পরাক্রমশালী ইরানের সামরিক শক্তিকে দুর্বল করা।
দীর্ঘ প্রায় ৩০টি বছর তারা পরাক্রমশালী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের ভারাটে বাহিনী ন্যাটোর ক্রমবর্ধমান হুমকিকে অগ্রাহ্য করে এগিয়ে নেয় তাদের পথচলা। কিন্তু বিপত্তি বাধে গত বছরের জাতীয় নির্বাচনের ফলাফলকে কেন্দ্র করে। তিরিশ বছর আগে যে বিপস্নব ঘটেছিল তারই পুনরাবৃত্তি ঘটে দেশটিতে। দীর্ঘ রৰণশীলতার বিপরীতে ঐতিহ্যময় দেশটিতে বর্তমান বিৰোভ দেশটিকে রৰণশীলতার অাঁধার থেকে প্রগতির দিকে নিয়ে যাবে এমনি মনে করেন অনেক বিশেস্নষক। অনেকে মনে করেন, দমনমূলক ৰমতাতন্ত্রের কাঠামোর বিরম্নদ্ধে যে বিরাট নাগরিক প্রতিরোধ তৈরি হয়েছে তা শেষ অবধি দেশটির বর্তমান কাঠামোর পরিবর্তন ঘটাবে বলে অনেকে মনে করেছিলেন কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে গত কয়েক মাসের প্রতিরোধ লাগাতার দমন-নিপীড়নে ক্রমর্শ দুর্বল হয়ে পড়েছে। তবে এটা পরিষ্কার, ইরানের অভ্যনত্মরে একটা বিপস্নব ঘটে গেছে।
২০০৫ সাল থেকে কড়া রৰণশীল শাসনের পর ২০০৯ সালের ১২ জুন পুনরায় আহমেদিনেজাদকে বিজয়ী ঘোষণার পরই এই বিপস্নবের শুরম্ন। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ভয়াবহ দমনের সামনেও কুঁকড়ে যায়নি মিছিলকারীরা। সাধারণভাবে এই আন্দোলন যতটা না আহমেদিনেজাদের বিরম্নদ্ধে তার চেয়ে বেশি হলো রৰণশীলতার বিরম্নদ্ধে সংস্কার এবং প্রগতির পৰে। সামরিক ৰমতায়নের বদলে সামাজিক উন্নয়ন, বাক-স্বাধীনতার অধিকার, নারীর মৌলিক অধিকারের মতো দাবি উঠে এসেছে এই আন্দোলনে। তবে আপাত দৃষ্টিকোণ থেকে মনে করা হচ্ছে এই ইন্ধনের পিছনে পশ্চিমা তিনটি দেশের হাত রয়েছে। ইরান সরাসরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সকে এই ইন্ধনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক বলে চিহ্নিত করেছে। যদিও প্রধান ধমর্ীয় নেতা আয়াতুলস্নাহ এই অভিযোগ নাকচ করেছেন। বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট আহমেদিনেজাদ গণতন্ত্রের সব রীতিনীতি লংঘন করে এখন সব সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিদেশী চক্রানত্মের ছবি দেখছে। ইরান ইতোমধ্যে বিদেশী সংস্থাগুলোর সঙ্গে সে দেশের নাগরিকদের সহযোগিতা নিষিদ্ধ করেছে। সরকারবিরোধী বিৰোভে এ পর্যনত্ম আটজনের মৃতু্য এবং গ্রেফতার করা হয়েছে হাজারো মিছিলকারীকে।
গ্রেফতার হওয়া অনেক নারীবন্দী অভিযোগ করেছেন বন্দী অবস্থায় তারা ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন।
গত ডিসেম্বরের ১৯ তারিখে ভিন্নমতাবলম্বী গ্র্যান্ড আয়াতুলস্নাহ হোসেইন আলী মনত্মাজেরি ৮৭ বছর বয়সে মৃতু্যবরণ করেন। তাঁর দাফন অনুষ্ঠানেও সরকার বিধি নিষেধ আরোপ করে। তঁাঁর জন্মস্থান কোন শহরে নিরাপত্তা কমর্ীদের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষ বাঁধে মিছিলকারীর।
গ্র্যান্ড আয়াতুলস্নাহ্্ মনত্মাজেরিকে এক সময় ইরানের ধমর্ীয় নেতা আয়াতুলস্নাহ রম্নহুলস্নাহ খোমেনীর উত্তরসূরি মনে করা হতো। তিনি দীর্ঘ দিন ইরানের রৰণশীল শাসনের বিরম্নদ্ধে অবস্থান নেন। তবে একজন পশ্চিমা বিশেস্নষক জন পিলজার মনে করেন ইরানকে অবরম্নদ্ধ, বিচ্ছিন্ন ও দুর্বল করে ফেলার কূটনৈতিক এবং সামরিক প্রচারণায় লিপ্ত রয়েছে পেন্টাগন। হোয়াইট হাউস এখন মনসত্মাত্তি্বক অভিযান (সাইকোলজিক্যাল অপারেশন্স) চালাচ্ছে এবং এ ধরনের প্রপাগা-ার অফিসিয়াল নাম হচ্ছে সাই-আপস।
অন্যদিকে সিসত্মান ও বেলুচিসত্মানের গত অক্টোবরের হামলা এবং সম্প্রতি ১২ জানুয়ারির ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানীর হত্যাকা- নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে ইরানের রেভু্যলিউশনারি গার্ডকে। ইরানের রাজনীতিতে এই রেভু্যলিউশনারি বাহিনীর ভূমিকা ক্রমেই উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। ইরানের রাজনীতি এই মুহূর্তে ধমর্ীয় কর্তৃত্বের থেকেও সামরিক কর্তৃত্বের ৰমতায় এখন বেশি। এই পরিবর্তন হয়ত প্রকাশ্য নয় কিন্তু রাজনীতির ধারবাহিকতা লৰ্য করলে দেখা যাবে, এই প্রক্রিয়া শুরম্ন হয়েছে অনেক আগেই। বস্তুত আহমেদিনেজাদ যে ফিরে এলেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে এটা কিন্তু রৰণশীলতার কৃপায় নয় বরং সেনাবাহিনীর বদান্যতায়। বেশ কিছু উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা এবার আহমেদিনেজাদের ক্যাবিনেটে স্থান পায়। ইরানী অর্থনীতির যতটুকু তাৎপর্য রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে রয়েছে তার মধ্যে 'ইসলামিক রেভু্যলিউশনারি গার্ডস কোর' (আইআরজিসি)-এর ৭০ শতাংশের মালিক।
সিসত্মান ও বেলুচিসত্মান হচ্ছে ইরানের ৩০টি প্রদেশের সবচেয়ে বৃহত্তম প্রদেশ। এই প্রদেশের পাশে পাকিসত্মানের বিলুচিসত্মান প্রদেশ। ধর্ম বিশ্বাসের কারণে শিয়া প্রধান দেশটিতে তারা সংখ্যালঘু সুনি্ন। সুনি্ন অধু্যষিত এই এলাকা বরাবরি সংঘাতময়। ইরানের মূল শক্তি রেভু্যলিউশনারি গার্ডের উপপ্রধান জেনারেল নুর আলীসহ নিহত হন ৬ জন। এর পূর্বে ২০০৭ সালে এই গ্রম্নপটি প্রধানমন্ত্রী আহমেদিনেজাদের গাড়ি বহরে হামলা চালায়। ইরান এই গ্রম্নপটিকে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সহায়তা লাভেরও জন্য এই সংগঠনটিকে দায়ী করে। এ গ্রম্নপে ২ হাজারের বেশি গেরিলা সামরিক, রাজনৈতিক এবং আদর্শগত প্রশিৰণ নিয়েছে। তবে সাম্প্রতিক পরমাণু বিজ্ঞানী নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা সত্যিই বিস্ময়কর। মার্কিন ও ইসরাইলী হামলার আশঙ্কার কথা যখন বার বার উচ্চারিত হচ্ছে ঠিক তখন এই দুঃসংবাদ।
১২ জানুয়ারি ইরানের উর্ধতন পরমাণু বিজ্ঞানী অধ্যাপক মাসুদ আলি মোহাম্মদী নিহত হন। এর আগে একজন বিজ্ঞানী নিখোঁজ হন মক্কা শরীফে ওমরাহ পালন করতে গিয়ে। এসব হত্যাকা-ে ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের হাত রয়েছে বলে একটি রিপোর্ট বলা হয়। এতে বলা হয়েছে, ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ইরানের পরমাণু কর্মসূচীকে বন্ধ করে দেয়ার লৰ্যে একে একে তাদের পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যা করছে। এ ধরনের হামলা ইতোপূর্বে ইরাক এবং মিসরে চালানো হয়। ঘরে-বাহিরে এখন মারাত্মক চাপে আহমেদিনেজাদ। তবে আপাতত তার ভরস হলো বৃহৎ দুই পরাশক্তি রাশিয়া এবং চীন। এই শক্তির বৌদলতে হয়ত পশ্চিমা বিশ্ব দেশটিতে কোন রকম কর্মসূচীর ঘোষণা করছে না, তবে পরিস্থিতি দেখে মনে হয় ইরানে হামলার অপরিণামদর্শিতা দেখানোর মতো বোঁকা নিশ্চয় বারাক ওবামা নন।
No comments