দেমেনত্মিয়েভার এগিয়ে চলা- দিলরম্নবা কোহিনূর সুইটি
পেশাদার টেনিসে ১২ বছর ধরে পদচারণা করা নিশ্চয়ই চাট্টিখানি কথা নয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ক্যারিয়ারের শুরম্নতে তাঁকে বাতিল করে দেয়া হয়েছিল মেধাহীন, অযোগ্য বলে।
অন্য কেউ হলে ােভে-দুঃখে-অভিমানে এপথে আর মাড়াতই না পা। কিন্তু তিনি তা করেননি। এগিয়ে গেছেন অমসৃণ, বন্ধুর, কণ্টকাকীর্ণ পথে। প্রমাণ করেছেন যাঁরা তাঁকে ছুড়ে ফেলে দিতে চেয়েছিলেন তাচ্ছিল্য ও অবহেলায়_ তাঁরা করেছিলেন চরম ভুল। তাঁরা চিনতেই পারেননি প্রতিভাকে, ব্যর্থ হয়েছিলেন মূল্যায়নের। যাঁর কথা বলছি, তাঁর ডাকনাম লেনা। ১৯৮১ সালের ১৫ অক্টোবর তাঁর জন্ম মস্কোতে, রাশিয়ায়। বর্তমান নিবাস মোনাকোর মন্টে কার্লোতে। তিনি বিশ্ব মহিলা টেনিসের একটি অতি পরিচিত নাম। দেমেনত্মিয়েভা। পুরো নাম এলেনা ভিয়াতচেসস্নাভোভনা দেমেনত্মিয়েভা। ছোটবেলা থেকেই এলেনার শিশুচিত্ত দখল করে নেয় টেনিস। নাওয়া নেই, খাওয়া নেই, সারাদিন শুধু টেনিস। টেনিসে তাঁর অসীম আগ্রহ দেখে মা-বাবা তাঁকে ভর্তি করিয়ে দেন 'ডায়নামো স্পোর্টস কাবে।' তখন এলেনার বয়স মাত্র ৭। কিন্তু বিধিবাম, প্রশিকরা ট্রায়ালে এলেনার খেলা দেখেই বললেন, এ মেয়ের মধ্যে টেনিসের বিন্দুমাত্র প্রতিভা নেই। কাজেই এর পেছনে অনর্থক শ্রম দিতে তাঁরা রাজি নন। স্বভাবতই হতাশ হয়ে পড়লেন এলেনার জনক-জননী। ছোট্ট এলেনারও মন খারাপ। কি করা যায়? এমন সময় খোঁজ পাওয়া গেল 'সেন্ট্রাল রেড আর্মি টেনিস কাবের।' কিন্তু সেই একই কারণে আবারও প্রত্যাখ্যানের ধাক্কা। নিজের মেয়েকে সুখী করার জন্য আর্দশ মা-বাবার মতোই সংগ্রাম চালিয়ে যাবার পণ করলেন তাঁরা। অবশেষে সফলতার মুখ দেখা গেল। একটি টেনিস প্রশিণ কেন্দ্রের সন্ধান পাওয়া গেল যাঁরা আগ্রহ নিয়েই ভর্তি করতে রাজি হলেন ুদে এলেনাকে। ছোট্ট এলেনার মুখে তখন উপচেপড়া হাসি। এবার স্বপ্ন হবে সত্যি। 'স্পার্টাক টেনিস কাবে' তিন বছর প্রশিণ নিলেন এলেনা। তাঁকে কোচিং করান রাওজা ইসলানোভা, তিনি দুই রাশান বিখ্যাত টেনিস খেলোয়াড় মারাত সাফিন ও দিনারা সাফিনের মা। মজার ব্যাপার হলো, এলেনার বয়স যখন ১১, তিনি গিয়ে ভর্তি হলেন সেন্ট্রাল রেড আর্মি টেনিস কাবে। এই সেই কাব, চার বছর আগে যেখানে তাঁর ঠাঁই হয়নি। কাবটি একপর্যায়ে স্বীকার করতে বাধ্য হয়, তারা সেবার এলেনাকে না নিয়ে ভুলই করেছিল। ১৯৯৭। ১৩ বছর বয়সে আনত্মর্জাতিক টেনিসে অভিষেক হয় এলেনার। তাঁর প্রথম টুর্নামেন্ট 'লেস পেতিত এস ওপেন।' এর ফলে ডবিস্নউটিএ র্যাঙ্কিংয়ে তিনি ৫০০তম খেলোয়াড় হিসেবে যাত্রা শুরম্ন করেন। স্বীয় নৈপুণ্যের দু্যতিতে প্রজ্বলিত হয়ে তিনি আলোচনায় চলে আসেন। অচিরেই দৃষ্টি আকর্ষণ করেন টেনিসবোদ্ধাদের। ১৯৯৮ সালে প্রবেশ করেন পেশাদারি সর্াির্কটে। এক বছর পরেই র্যাঙ্কিংয়ের ১০০ জনের মধ্যে চলে আসেন। ১৯৯৯ সালে দেশের হয়ে অংশ নেন 'ফেড কাপে।' প্রতিপ যুক্তরাষ্ট্র। রাশিয়া হেরে গেলেও একমাত্র পয়েন্টটি লাভ করে এলেনার কল্যাণে। পাওয়ার টেনিসের অন্যতম প্রবক্তা হিসেবে যাঁকে চেনে সবাই_ সেই ভেনাস উইলিয়ামসকে হারিয়ে টেনিসবিশ্বে তোলপাড় সৃষ্টি করেন। তাঁর কপালে জুটে যায় 'জায়ান্ট কিলার' খেতাব। টেনিস ভুবনে ছড়িয়ে পড়ে দেমেনত্মিয়েভার নাম। ২০০০ সালে আরেকটু উঁচুতে ওঠেন। ইউএস ওপেনের ৩য় রাউন্ডে ওঠার মাধ্যমে র্যাঙ্কিংয়ের সেরা ২০ জনের তালিকায় চলে আসেন। রাশিয়ার প্রথম মহিলা হিসেবে ওই আসরের সেমিতে ওঠেন। তবে হেরে যান আমেরিকার লিন্ডসে ডেভেনপোর্টের কাছে। একই বছরে প্রথমবারের মতো অলিম্পিকের আসরে অংশ নেন। পদকের েেত্র নিরাশ করেননি দেশকে। জেতেন রম্নপা। সোনা ছিনিয়ে নেন ভেনাস উইলিয়ামস। এলেনার এই উদ্ভাসিত সাফল্যে ২০০০ সালের ডবিস্নউটিএ টু্যরের 'মোস্ট ইমপ্রম্নভড পেস্নয়ারের' খেতাব পান। ২০০১ সাল। এ বছরটিও টপ টোয়েন্টির মধ্যে থেকে শেষ করেন। অস্ট্রেলিয়া টু্যরে খেলতে গিয়ে ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো ইনজুরিতে পড়েন। ২০০২ সালে মস্কো ওপেনে হারিয়ে দেন সুইজারল্যান্ডের মার্টিনা হিঙ্গিসকে। তাঁকে পরাভূত করে ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো ১নং র্যাঙ্কধারীকে হারানোর কৃতিত্ব দেখান। ওই আসরেই ফাইনালে ওঠেন। তবে হেরে যান অস্ট্রেলিয়ার জেলেনা ডকিচের কাছে। ২০০৩ সালে অফুরনত্ম প্রাণশক্তির খেলোয়াড় হিসেবে সবচেয়ে বেশি টুর্নামেন্টে (২৭টি) অংশ নেয়ার রেকর্ড গড়েন। প্রাইজমানি হিসেবে লাভ করেন ৮৬৯,৭৪০ ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের ফোরিডার এমেলিয়া আইল্যান্ডে 'বাউশ্চ এ্যান্ড লম্ব চ্যাম্পিয়নশিপে' অংশ নিয়ে তাতে শিরোপা জেতেন। এটা তাঁর ডবিস্নউটিএ টু্যরের প্রথম টাইটেল। শিরোপা জয়ের পথে একে একে হারান আমান্ডা কোয়েতজার, ড্যানিয়েলা হানকুচোভা, জাস্টিন হেনিন ও লিন্ডসে ডেভেনপোর্টকে। ২৪ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বাছাই র্যাঙ্ক (১০ম) নিয়ে ডবিস্নউটিএ টু্যরের শিরোপা করায়ত্বের কৃতিত্ব দেখান। তারপর টানা ২টি শিরোপা জেতেন বালি ও সাংহাই ওপেনে। বছর শেষ করেন ৮নং র্যাঙ্ক নিয়ে। ক্যারিয়ারে প্রথম শীর্ষ দশে উন্নীত হন। ২০০৪ সাল তাঁর ক্যারিয়ারের উলেস্নখযোগ্য অধিবর্ষ। মায়ামি ওপেনে কোয়ার্টারে তিনি ভেনাস ও সেমিতে নাদিয়া পেত্রোভাকে হারান। তবে ফাইনালে কুলিয়ে উঠতে পারেননি সেরেনারে সঙ্গে। ৫ এপ্রিল তিনি নাম্বার সিক্স পজিশনে চলে আসেন। টপটেনে তাঁর স্বদেশীদের মধ্যে আনাসত্মাসিয়া মিসকিনা (৫) ও নাদিয়া পেত্রোভাও (৯) টপটেনে ছিলেন। টেনিস ইতিহাসে এই প্রথম সর্বাধিক ৩ রম্নশকন্যা শীর্ষদশে ঠাঁই পেয়ে ইতিহাস গড়েন তাঁরা। সে বছরই ফ্রেঞ্চ ওপেনে ডেভেনপোর্ট, সুয়ারেজ ও মরেসমোকে হারিয়ে ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো কোন গ্র্যান্ডসস্ন্যাম টুর্নামেন্টের ফাইনালে ওঠেন। মুখোমুখি হন মিসকিনার। এটা ছিল কোন গ্র্যান্ডসস্ন্যামের 'অল রাশান ফাইনালের' মাত্র ২য় নজির। দুর্ভাগ্য এলেনার। শিরোপা জিততে ব্যর্থ হন। সেবারই ইউএস ওপেনে মরেসমো ও জেনিফার ক্যাপ্রিয়াতিকে হারিয়ে ফাইনালে হেরে যান আরেক স্বদেশী প্রতিপ সভেতলানা কুজনেতসোভার কাছে। ২০০৭ সালে মস্কোতে অনুষ্ঠিত 'ক্রেমলিন কাপে' প্রথমবারের মতো পরাজিত করেন সেরেনাকে। জেতেন শিরোপাও। সেই সঙ্গে আবারও জায়গা ফিরে পান টপটেনে। তবে সেটা স্থায়ী হয় মাত্র সপ্তাহখানেক। ২০০৮। ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় সাফল্যটি পান বেজিং অলিম্পিকে স্বর্ণ জিতে। কোয়ার্টারে সেরেনা, সেমিতে ও ফাইনালে স্বদেশী ভেরা জনারেভা ও সাফিনাকে হারিয়ে মেতে ওঠেন সোনা জয়ের উলস্নাসে। ২০০৯। জেতেন সিডনি ওপেন। এককে টানা ১৫টি ম্যাচ জেতার পর এলেনার বিজয়রথ থামিয়ে দেন সেরেনা। জানুয়ারিতে 'ম্যারি ক্যারি রাশিয়া' ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে খোলামেলা ভঙ্গিমায় ছবি তুলে পুরম্নষদের স্বপ্নদেবীতে পরিণত হন। সে বছরেই ইউএস ওপেন শেষ হবার পর রাশান প্রেসিডেন্ট দিমিত্রির কাছ থেকে 'অর্ডার অব অনার' পুরস্কার গ্রহণ করেন। ২০১০। রাশিয়া অস্ট্রেলিয়ার পার্থে অংশ নেয় ৮ জাতির টুর্নামেন্ট 'হপম্যান কাপে।' রাশিয়া ফাইনালে উঠতে না পারলেও এককে তিনি ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল। সদ্যসমাপ্ত সিডনি ওপেন জিতে নিজেকে নিয়ে যান অনন্য উচ্চতায়। কেননা, হিঙ্গিসের পর তিনি এই আসরে টানা দু'বার চ্যাম্পিয়ন হবার গৌরব অর্জন করেন। এলেনা এ পর্যনত্ম টেনিস খেলে আয় করেন ১ কোটি ২৩ লাখ ডলারেরও বেশি। কোন গ্র্যান্ডসস্ন্যাম না জিতলেও একক শিরোপা হাসিল করেন ১৫টি। তাঁর খেলার স্টাইল অফেন্সিভ বেসলাইন। বর্তমান র্যাঙ্ক ৫। গত বছরের ৬ এপ্রিল ৩ নম্বরে উঠেছিলেন। এলেনা ভালবাসেন স্নো বোর্ডিং ও বেসবল খেলতে, বই পড়তে আর ঘুরে বেড়াতে। মারিয়া শারাপোভা ও তাঁকে নিয়ে অরোরা, কলারোডার গানের দল 'বস্নু ডগ এ্যান্ড স্পঞ্জি কেক' একটি গান রচনা করে। নাম 'দেমেনত্মাপোভা।' টেনিস থেকে মোটামুটি সবকিছু পেলেও এখনও অপ্রাপ্তি রয়ে গেছে দুটো ৰেত্রে। গ্র্যান্ডসস্ন্যাম জেতা ও এক নম্বর আসনে অভিষিক্ত হওয়া। শেষের অভিলাষ কবে পূরণ হবে কে জানে, তবে প্রথমটা পূর্ণ হতে পারে শুরম্ন হওয়া অস্ট্রেলিয়ান ওপেনেই। আবার কে জানে, থেমে যেতে পারেন শুরম্নতেই। কি ঘটবে? সেদিকেই দৃষ্টি তাঁর ভক্ত ও সমর্থকদের।
No comments