শেষ রণাঙ্গন by এমদাদ হোসেন ভূঁইয়া
ওয়াজিরিসত্মান। ইসলামী উগ্রপন্থীদের সদর দফতর হিসেবে পরিচিত। এখানকার মানুষ খুবই স্বাধীনচেতা। বাইরের কতর্ৃত্ব বা প্রভুত্ব কখনই সাদরে মেনে নেয়নি। তাই বিদেশীরা কখনই এখানে শিকড় গাড়তে পারেনি।
তবে বর্তমানে পাকিসত্মান সরকার ওয়াজিরিসত্মানের ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আফগানিসত্মানের সীমানত্ম লাগোয়া উত্তর-পশ্চিম পাকিসত্মানে উপজাতি অধু্যষিত সবচেয়ে প্রত্যনত্ম অঞ্চল হচ্ছে এই ওয়াজিরিসত্মান। ওয়াজিরিসত্মানে ৮ লাখ উপজাতি পশতুনের বসবাস। বৈচিত্র্যময় ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ওয়াজিরিসত্মান পাকিসত্মানেরই অংশ তবে এটি পাকিসত্মান ও আফগানিসত্মানের মধ্যে ভৌগোলিক ও কৌশলগত কারণে অনেকটা করিডরের কাজ করছে। তবে এখানে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ একেবারে শিথিল। প্রশাসনিকভাবে এটি দু'টি ইউনিটে বিভক্ত। তা হচ্ছে উত্তর এবং দৰিণ ওয়াজিরিসত্মান। এর বেশিরভাগ অংশ বর্তমানে তালেবানদের নিয়ন্ত্রণে, তাদের সঙ্গে রয়েছে বিদেশী জেহাদী। কাজেই ইসলামী উগ্রপন্থীদের সদর দফতর বলে যদি কোন স্থানের নাম করতে হয় তাহলে প্রথমেই চলে আসে ওয়াজিরিসত্মানের নাম।স্বাতন্ত্র্য এবং স্বাধীনভাবে বিচরণের সুবিধার কারণে স্থানটি সন্ত্রাসীদের কাছে অত্যনত্ম আকর্ষণীয়, কিংবা বলা যায়, এটি তাদের জন্য একটি অভয়ারণ্য কিংবা নিরাপদ আশ্রয়স্থল। ওয়াজিরিসত্মানে মূলত ওয়াজির এবং মেহসুদ এই দুু'টি উপজাতির বসবাস। দুর্ধর্ষ প্রকৃতির এই উপজাতির লোকজন একসময় উত্তর পাঞ্জাবের সমতলভূমিতে নেমে এসে মানুষের ওপর নিপীড়ন নির্যাতন চালাত, সম্পদ লুট করে নিয়ে যেত। তৎকালীন মোগল, ব্রিটিশ কিংবা কোন প্রশাসনিক শক্তি তাদেরকে বশ মানাতে পারেনি। এক কথায় সরকার রাজকীয় শক্তি কিংবা পাকিসত্মানীরাও এদেরকে পুরোপুরি বাগে আনতে পারেনি। উনিশ এবং বিশ শতকে তৎকালীন ভারতের ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড কার্জন লিখেছিলেন, ওয়াজিরিসত্মানে সামরিক দমনপীড়ন চালিয়েও সেখানকার মানুষকে বশে আনা যায়নি।
বর্তমানে ৫০ হাজার পাকিসত্মানী সৈন্য ওয়াজিরিসত্মানে তালেবানদের বিরম্নদ্ধে লড়াই করছে। পাকিসত্মানী সৈন্যরা তাদের অভিযান সফল হবে বলে আশাবাদী। বর্তমানে চলমান সামরিক অভিযানের অন্যতম নায়ক মেজর জেনারেল তারিক খান। তিনি সেনাবাহিনীর ৬০ হাজার সদস্যের ফ্রন্টিয়ার কোরের (এফসি) প্রধান। এই জেনারেল মনে করেন, ওয়াজিরিসত্মান হবে শেষ উপজাতি এলাকা, যা পদানত হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র এবং আমাদের জন্য এটাই হবে শেষ রণাঙ্গন।
দুর্গম, প্রত্যনত্ম অঞ্চল হওয়ার কারণেই অতীতে কাবুল, দিলস্নী কিংবা অন্যকোন সরকার ওয়াজিরিসত্মানে তাদের পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থাপন করতে পারেনি। আর এই সুযোগটিই নিয়েছে ওয়াজির এবং মেহসুদ জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা।
১৯২৯ সালে ব্রিটিশ সমর্থিত আফগান নাদির শাহ কাবুলের সিংহাসন দখল করতে ওয়াজির সেনাদের ব্যবহার করেন। ১৯৪৭ সালে কাশ্মীর দখলের জন্য ওয়াজির এবং মেহসুদ সমন্বয়ে গঠিত একটি বাহিনী পাঠানো হয়। লৰ্য ছিল একটি নতুন ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। এই ঘটনা প্রথম ভারত-পাকিসত্মান যুদ্ধের সূচনা করে। ১৯৮০-এর দশকে আফগানিসত্মান থেকে সোভিয়েত দখলদারিত্বের অবসান ঘটাতে পাকিসত্মান, যক্তরাষ্ট্র এবং সৌদি আরব যৌথভাবে তালেবান যোদ্ধাদের অস্ত্রসজ্জিত করে। ২০০১ সালে হাজার হাজার আফগান তালেবান এবং তাদের সহযোগী আল কায়েদা যোদ্ধা ওয়াজিরিসত্মানে ঢুকে পড়ে। তারা এসময় সীমানত্ম বরাবর ন্যাটো সৈন্যদের বিরম্নদ্ধে জিহাদ শুরম্ন করে।
লড়াই এবং গোয়েন্দাবৃত্তি দুটোই এ এলাকায় যেন 'গ্রেট গেম'-এ পরিণত হয়েছে। এই মহাখেলার শরিক হচ্ছে সেনাবাহিনী, তালেবান এবং পাকিসত্মানী গোয়েন্থা সংস্থা আইএসআই। কে যে কার বিরম্নদ্ধে খেলছে, তা বোঝা মুশকিল।
যাহোক, ইসলামাবাদ ওয়াজিরিসত্মানে পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় তৎপর। শেষ রণাঙ্গনের লড়াইয়ে কে জিতবে, সময়ই তা বলে দেবে।
সূত্র : ইকোনমিস্ট
No comments