জীবন কথন- মানুষের অ্যাকচুয়াল ডেথ ও ভার্চুয়াল ডেথ- রণজি বিশ্বাস
আম ও ছালা যাওয়ার একটি গল্পের কথা আমরা বার বার শুনি। এই গল্পটি তেমন? : আমি যতটুকু বুঝি, একই সঙ্গে লাভ ও পুঁজি দুটোই হারানো। এই বিষয়টির সঙ্গে আরেকটি ঘটনার মিল আছে।
না গেলো পরাণ কিন্তু গেলো মোর ইজ্জত এই হচ্ছে সেই গল্পের বিষয়। মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরের এক বাঁচাল টাইপের অকৃতজ্ঞ লোকের কাছে গল্পটি শোনা। আমাদের কয়েক বছরের সিনিয়র, কথা বলে খুব বেশি; এক সময় ঢাকার এক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ত। লোকটির কাছে আরও চমৎকার একটি গল্প আমি শুনেছি। দেখা যাক, সময় পেলে সেটিও শোনাব। অশ্লীল শব্দে কিছু বিতিকিচ্ছি চিত্রকল্পও তিনি তুলে ধরতেন। এ সমস্ত ব্যাপারে তিনি অতিশয় ‘মাহের’ ও ‘মশহুর’ ছিলেন। : লোকটিকে আমরা বোধহয় ইতোমধ্যে চিনে ফেলেছি। আপনি তার কাছে পাওয়া গল্প দু’টি বলুন।: আমি ওর মতো করে বলতে পারব না। ঠোঁটকাটা থাকার কারণে ওর স্টাইলটাই আলাদা।
: ওর স্টাইলে বলার দরকার নেই। আপনি আপনার মতো করে বলুন। তাছাড়া, একজন মন্দ ও অকৃতজ্ঞ লোককে আমরা অনুকরণ বা অনুসরণই করতে যাব কেন!
: তা করতে যাব না বলেই আমি আমার মতো করে বলব। তবে, লোকটাকে অকৃতজ্ঞ বলে আপনি অনুকম্পা দেখাবেন না; ও আসলে কৃতঘ্ন।
: এবার আপনি ঐ কৃতঘ্ন লোকের মুখে শোনা গল্পটি বলুন।
: জীবনের ওপর বিতৃষ্ণ এক মানবী ঠিক করলেন রেলের নিচে কাটা পড়বেন। তিনি রেললাইনের ওপর শুয়ে থাকবেন। হঠাৎ তার মনে হলো, ট্রেন কাছাকাছি এলে ভয়ের চোটে আমি তো সরেও যেতে পারি। আমার তো বাঁচার আকাক্সক্ষা আবার জেগেও উঠতে পারে! প্রাণের মায়া তো মানুষের খুব বড় মায়া। তাহলে এক কাজ করি। পরিধেয় বিষয়ক জটিলতা থেকে আমি বরং মুক্তিলাভ করি। মরেই যখন যাব কিসের পোশাক, কিসের কি!
তাই শুধু করলেন না তিনি, পোশাকের বিভিন্ন অংশ তিনি ব্যবহার করলেন নিজেকে শক্ত করে রেললাইনের সঙ্গে বেঁধে রাখার জন্য। একটু পরে ট্রেন এলো এবং তাকে স্পর্শ না করে পাশের লাইন দিয়ে চলে গেলো। তিনি তাঁর প্রাণও হারাতে পারলেন না, মানুষও একটি নতুন দৃশ্য দেখে উপভোগের শব্দে বাদ্যে ধ্বনিতে শিসে হৈহল্লো করে গেলো।
: লোকটি তো তাহলে খুব ইন্টারেস্টিং করে গল্প বলতে পারতেন।
: পারতেন।
: ওর কি মৃত্যু হয়েছে?
: দেখুন, মানুষের মৃত্যু দু’ধরনের অ্যাকচ্যুয়াল ডেথ ও ভার্চুয়াল ডেথ। শাব্দিক অর্থে মৃত্যু ও অধিশাব্দিক কিংবা বুৎপত্তিগত অর্থে মৃত্যু ডিনোট্যাটিভ ডেথ ও কনোট্যাটিভ ডেথ। মৃত্যুর এমন চক্করে আমাদের অনেকেই ছিল, আমরা অনেকেই আছি এবং অনেকেই থাকব। লোকটির শারীরিক মৃত্যু এখনও হয়নি শুনেছি, নাকি ইতোমধ্যে হয়ে গেছে তাও জানি না। তবে, অধিশাব্দিক মৃত্যু কিংবা ভার্চুয়াল ডেথ অথবা কনোট্যাটিভ ডেথ অনেক আগেই হয়ে গেছে। অন্তত পনেরো বছর আগে।
: তেমন মৃত্যু যাদের হয় তাদের উদ্দেশে আপনার কোন নিবেদন আছে?
: আছে। খুব বড়সড়ো ও অর্থঠাসা একটি নিবেদন। সে নিবেদন ক্ষুদ্র ও খবর্, আমার নিজের জন্যও। উদ্ধরণ চিহ্নে বেঁধে বলি ‘জীবনের বাতি নিভে যাওয়ার আগেই যেন বুঝে নিতে পারি জীবনের সার্থকতা জন্মের জমকেগমকে নয়; মৃত্যুর সৌন্দর্যে’ সে মৃত্যু যে মৃত্যুই হোক, অ্যাকচুয়াল অর ভার্চুয়াল।
: লোকটির কাছ থেকে আর কি কি শিখেছেন? আর কি কি গ্রহণ করেছেন আপনি?
: তিনি, তখনকার হরতালের সময় একটি শব্দ খুব ঘন ঘন ব্যবহার করতেন ভয়তাল। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টায় তিনি বলতেন যারে দেখি নাই সে বড় সুন্দরী; যার হাতে রানধন খাই নাই সে বড় রানধনী। মানুষের মধ্যে ভাগবাটোয়ারায় অনিয়ম হলে কিংবা সমতা না থাকলে কি অবস্থা হয়, তাও তিনি একটি গল্পে প্রকাশ করতেন।
পালাগানের গায়ক একবার লঙ্কাজয়ীর নাম ভুলে গিয়েছিলেন। যন্ত্রীদের কাছে জবাব আশা করে তিনি সুরে সুরে একটি লাইনই বার বার আওড়াচ্ছিলেন ‘লঙ্কা যে জয় করে তার নাম কি? তার নাম কি?’
যন্ত্রীরা যন্ত্রেযন্ত্রে জবাব দিল ‘দশ আনি ছয় আনি ভাগ আমরা জানি কী! আমরা জানি কী?’ বিপদ থেকে বাঁচার জন্য গায়ক গুনগুনোলেন ‘আইজ হইতে হৈল ভাগ সমান সমান।’ যন্ত্রীরা তাদের প্রক্রিয়ায় জবাব দিল ‘লঙ্কাজয়ীর নাম বীর হনুমান।’
:ভদ্রলোকের কাছে তাহলে আপনার কিছু ঋণ আছে।
:আছে। ঋণের কথা স্বীকার করাও ভালমন্দ। সব লোককে ভদ্রলোক না মানলেও গোনার সৌজন্য আমার আছে।
:আদর্শিক কারণে কিংবা সঙ্গতিহীন আচরণের কারণে যাদের পছন্দ করা যায় না তাদের কাছেও তাহলে শেখার কিছু থাকে!
: থাকে! অবশ্যই থাকে এবং খুব বেশি পরিমাণ থাকে। আদব শিখতে হয় বেয়াদবের কাছে। ভাল হওয়ার শিক্ষা নিতে হয় মন্দকে দেখে। চোরছ্যাঁচড়ের দুরবস্থা দেখে সৎ ও শুদ্ধ থাকার প্রণোদনা খুঁজে নিতে হয়। শিক্ষা তখন শক্ত ও পোক্ত হয়।
লেখক: শ্রমজীবী কথাসাহিত্যিক
No comments