জাতীয় দলে ফিরতে মরিয়া রোনাল্ডিনহো by জাহিদুল আলম জয়
জুনে দণি আফ্রিকায় শুরম্ন হতে যাওয়া বিশ্বকাপ ফুটবলের মূলপর্বে খেলার স্বপ্ন দেখছেন ব্রাজিলিয়ান সুপারস্টার রোনাল্ডিনহো। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সময় তাঁর মধ্যে এই প্রত্যয় প্রতিফলিত হয়েছে।
তাঁর বিশ্বাস, পারফরম্যান্সের ভিত্তিতেই বিশ্বকাপ দলে জায়গা হবে তাঁর। এমন আত্মবিশ্বাসের ঢের কারণও রয়েছে। গত বিশ্বকাপ থেকে খেই হারিয়ে ফেলার পর দেড় বছর অফ ফর্ম, ইনজুরি, পরকীয়া, নাইট কাবে জীবন যাপনসহ নানাবিধ বিতর্কের সঙ্গী হয়ে ফুটবল ক্যারিয়ারটাই প্রায় ধ্বংস করতে বসেছিলেন। তা থেকে তাঁর উত্তরণ শুরম্ন ২০০৮ সালের শেষ থেকে। এ সময় স্পেন ছেড়ে ইতালির এসি মিলানে এসে নিজেকে খুঁজে পান শৈল্পিক ছন্দের এ কারিগর। এখানে নিজের প্রথম মৌসুমটা বেশ সার্থকতার সঙ্গেই খেলেন। চলতি মৌসুমটা শুরম্ন করেছেন আরও দুর্দানত্মভাবে। ইতোমধ্যে খেলা ২টি ম্যাচেই পুরনো ঝলক দেখা গেছে রোনির খেলায়। সেই ড্রিবলিং, সেই পেস্নসিং, সেই হেডিং, সেই চিরচেনা ছন্দ। মাঠে আবারও আল্পনা আঁকছেন মাথার অাঁচড়ে কিংবা পায়ের তুলিতে। এই ফুটবল জাদুকরের স্বরূপে ফেরাতে সাফল্য পাচ্ছে এসি মিলানও। এমন পারফরম্যান্সের কারণেই দণি আফ্রিকা বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্নে বিভোর রোনাল্ডিনহো। অথচ অনেক দুর্দিন গেছে এই ফুটবলস্টারের। বার্সায় থাকতে কোচ ফ্রাঙ্ক রাইকার্ড তাঁকে ইচ্ছা করে সাইডলাইনে বসিয়ে রাখতেন। বার্সাও তাঁকে যোগ্য প্রতিদান দেয়নি। কিন্তু কাবের চরম দুর্দিনে পাশে এসে দাঁড়ান তিনি। পায়ের মন্ত্রমুগ্ধতে একের পর এক শিরোপা উপহার দিয়েছেন। এতকিছুর পরও সে সময় রাইকার্ড রোনাল্ডিনহোকে বলেছিলেন, 'বার্সিলোনার দরজা তোমার জন্য খোলা। তুমি ইচ্ছা করলেই যেতে পার।' রোনির বার্সা ছাড়ার গুজব অনেকদিন থেকে চললেও রাইকার্ডের এই ধৃষ্টতাপূর্ণ কথার পর নিশ্চিত হয় বিষয়টি। অবশ্য এরপর কিছুটা নমনীয় হয়েছিলেন রাইকার্ড। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। কেননা তাঁর আগেই বার্সা থেকে বিদায়ঘণ্টা বাজে রাইকার্ডের। এরপর নয়া কোচ পেপ গার্ডিওলা দায়িত্ব নিলে রোনির ক্যারিয়ারে নেমে আসে প্রগাঢ় অমানিশা। গার্ডিওলা সাফ জানিয়ে দেন, একাদশে জায়গা হবে না রোনির। এরপরই নু্য ক্যাম্প ছাড়তে মানসিকভাবে প্রস্তুত হন সাম্বা ছন্দের অন্যতম সেরা তারকাটি। অনেক ভেবেচিনত্মে সাবেক থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রার ইংলিশ কাব ম্যানচেস্টার সিটিকে পেছনে ফেলে এ তারকা নাম লেখান এসি মিলানে। ২০০৮ সালের ১৫ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে মিলানের পতাকাতলে হাজির হন এ পেস্নমেকার। স্যানসিরোর মানুষ এদিন রাজকীয়ভাবে বরণ করে নেয় রোনিকে। তাঁর প্রথম অনুশীলন দেখতে দর্শকে টইটুম্বর হয়ে গিয়েছিল পুরো গ্যালারি। এর সঙ্গে টিকিট বিক্রিও বেড়ে যায় দ্বিগুণ। রোনাল্ডিনহো নামের যে মাদকতা আছে এর মাধ্যমে তার প্রমাণও মেলে। ২০০৩ সালে ক্যাটালান শিবিরে যোগ দিয়েছিলেন রোনি। সেসময় প্রচ- দুঃসময় চলছিল নু্য ক্যাম্পে। চারদিকে বিরাজ করছিল হতাশা আর ঘোর অাঁধার। স্প্যানিশ এ জায়ান্টের দুঃখ ঘোচাতেই যেন ধূমকেতুর মতো আবিভর্ূত হন রোনি। তাঁর আবির্ভাবেই আমূল পাল্টে যায় দুর্দশাগ্রসত্ম বার্সার চেহারা। এখানে যোগ দেয়ার শুরম্নর দিনগুলো বেশ সুখে কাটতে থাকে ২০০২ বিশ্বকাপের পাশর্্ব নায়কের। স্বপ্নের ফর্ম দেখিয়ে ২০০৫ ও ২০০৬ সালের প্রিমিয়ার লীগ জেতানোর পাশাপাশি জয় করেন ২০০৬ সালের ইউরোপ সেরা ট্রফি চ্যাম্পিয়ন্স লীগের শিরোপা। দুর্দানত্ম এই ফুটবল নৈপুণ্যের সময় পর পর দু'বার ফিফা বর্ষসেরা খেলোয়াড়ও নির্বাচিত হন। কিন্তু দুঃসময়টা তাঁর ওপর ভর করে গত জার্মান বিশ্বকাপ থেকে। অসাধারণ ফর্ম নিয়ে বিশ্বকাপ খেলতে গিয়ে পুরো দলের মতো নিজেও খেই হারিয়ে ফেলেন। সেই সঙ্গে ইনজুরি আর বেপরোয়া জীবন ধীরে ধীরে তলানিতে ফেলে দেয় তাকে। ফলশ্রম্নতিতে টালমাটাল হয়ে ভুলের সাগরে নিমজ্জিত হন। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের মাসুল হাড়ে হাড়ে টের পেতে থাকেন। সেসময় তাঁর কর্মকা- পল গ্যাসকোয়েন আর জর্জ বেস্টের নষ্ট চরিত্রের কথাই সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেয়। অনেকেই তাঁকে দিয়েগো ম্যারাডোনার সঙ্গেও তুলনা করেন। দিয়েগোর মতোই মদ, নারী, নাইটকাব আর অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের ফলে রোনির ক্যারিয়ার পড়েছিল চরম বিপর্যয়ে। সেসময় এতটাই নেশায় বুঁদ হয়েছিলেন যে, নাইটকাবে সময় কাটানোর জন্য ইনজুরির মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে মাঠে অনুপস্থিত থাকতেন। শুধু তাই নয়, তাঁর কাব বস রাইকার্ডের কুড়ি বছরের মেয়ে লিন্ডসের সঙ্গে প্রেমে জড়িয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনার ঝড় বইয়ে দেন। তাঁর এমন পরিণতিতে সেসময় স্পেনের দৈনিক 'লা ভাঙ্গুয়ারদিয়া' লেখে, 'ব্যক্তিগত জীবনের কারণে একজন গ্রেট ফুটবলার নিজেকে হারিয়ে ফেলছে-এটা অত্যনত্ম দুঃখজনক।' স্পেনের ক্রীড়া দৈনিক 'মার্কা' রোনির আচরণে ুব্ধ হয়ে লেখে, 'রোনাল্ডিনহোকে ছাড়াই ভাল খেলছে বার্সা।' এমন কথার ভিত্তিও ছিল। কেননা ইনজুরি কিংবা নাইটকাবের ধকলের জন্য তিনি যে ক'টি ম্যাচ খেলতে পারেননি, সেগুলোর প্রায় অধিকাংশতেই বার্সা জেতে নয় তো ড্র করে। অর্থাৎ রোনি ছাড়া একটি ম্যাচও হারেনি বার্সা। তাই কোচ, কাব সভাপতি, সতীর্থসহ প্রায় সবাই রোনাল্ডিনহো থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। বিশেষ করে স্প্যানিশ মিডিয়া দারম্নণ প্তি হয়ে ওঠে রোনির ওপর। অবশ্য এধরনের অভিজ্ঞতা নতুন ছিল না রোনির জন্য। এর আগেও সপ্যানিশ মিডিয়া পিছু লেগেছিল তার। তখন অভিযোগ ছিল তিনি মুটিয়ে যাচ্ছেন, আগের সেই গতি নেই, একটুতেই হাঁপিয়ে উঠছেন। আর এবার তাঁরা হৈচৈ করে বলছেন মদের নেশা, নারীতে বুঁদ হয়ে নিজের ফুটবল প্রতিভা য় করে ফেলছেন এ তারকা। ২০০৩ সালে বার্সায় যোগ দেয়ার আগে ঠিক একই সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি। সেসময় ফরাসী কাব প্যারিস সেন্ট জার্মেইর কোচ লুইস ফার্নান্দেজ তাঁর 'নৈশজীবন' নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। অবাক ব্যাপার, বার্সা থেকে রোনিকে দায় নিতে হয়েছে একই অভিযোগ মাথায় নিয়ে! এমনিতেই বার্সা তলানিতে পেঁৗছে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন রোনি। এরপর নতুন কোচ গার্ডিওলা তাঁকে আরও তলিয়ে দেন। স্বাভাবিকভাবেই একটি পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিল। এসি মিলানে যোগ দেয়াটা তাই তাঁর জন্য সৌভাগ্যের প্রতীক হয়ে দেখা দেয়। এজন্যই সানসিরোতে নোঙর ফেলার পর বলেছিলেন, 'আমি সবসময় মিলানে আসতে চেয়েছি। এ চাওয়াটা বার্সাকে নিয়ে আলোচনার সময় নয়। জীবনের এ অধ্যায়টা উপভোগ করতে চাই। সেরাটা ঢেলে দিতে চাই মিলানের জন্য।' কথা রেখেছেন তিনি। কারণ সানসিরোতে পা রাখার সময় যে দল লীগে ৫ম ছিল সেই এসি মিলানই এবার চ্যাম্পিয়নের জন্য লড়ছে। চলতি মৌসুমের প্রথম ২ ম্যাচেই এর প্রমাণ মেলে। প্রতিপকে উড়িয়ে দিয়ে এসি মিলান ৮ম বারের মতো চ্যাম্পিয়ন্স লীগের ট্রফির জন্য দৌড়াচ্ছে। এটি সম্ভব হচ্ছে রোনাল্ডিনহোর উদ্ভাসিত নৈপুণ্যেই। পুরনো ফর্ম আর ছন্দ খুঁজে পাওয়ায় সঙ্গতকারণেই নিজের ৩য় বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন দেখছেন ২৯ বছর বয়সী এ তারকা। সমপ্রতি গেস্নাব টিভিকে দেয়া সাাতকারে জাতীয় দলে ফেরার প্রত্যয়ের কথা জানান, 'আরেকটি বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন রয়েছে। বিশ্বাস আছে, দলের সঙ্গে দণি আফ্রিকায় যাব ও আরেকটি ট্রফি জিতে দেশে ফিরব। এ মুহূর্তে আমার স্বপ্ন শুধুই বিশ্বকাপ খেলা।' প্রত্যয়ের সুরে আরও বলেন, 'কোচ ডুঙ্গার দলে সুযোগ পেয়ে আমার সেই স্বপ্ন পূরণ হবে বলেও বিশ্বাস আছে।' তাঁর এ কথার যুক্তিও আছে। কেননা বিশ্বকাপের চূড়ানত্ম দল তৈরির ভাবনায় যে রোনাল্ডিনহো আছেন তা আগেই জানিয়ে রেখেছেন ব্রাজিলের কোচ কার্লোস ডুঙ্গা। বর্তমানে এসি মিলানে রোনির যে দু্যতিময় নৈপুণ্য তা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে তাঁর বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্নটা পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা ৰীণ হলেও আছে। কারণ রোনির সমতা নিয়ে প্রশ্ন নেই কারও। যেকোন মুহূর্তে প্রতিপকে দুমড়েমুচড়ে দিতে সম বিস্ময়কর এই ফুটবল প্রতিভা। এ কারণে তাঁর মতো তাঁর অগণিত ভক্তরাও প্রত্যাশা করছে বর্তমান ফর্মটা ধরে রেখে রোনি দণি আফ্রিকা বিশ্বকাপ মাতাতে আসুক। কাবের জার্সি গায়ে যে ছন্দময় ফুটবল, ব্রাজিলের হয়ে সেটা এখনও খেলা হয়নি তাঁর। ২০০২ বিশ্বকাপে কোয়ার্টারে ইংল্যান্ডের বিপ েম্যাজিক নৈপুণ্য বাদ দিলে আসরে তেমন ঔজ্জ্বল্য ছড়াতে পারেননি। ২০০৬ সালে জার্মান বিশ্বকাপ শুরম্নর আগে থেকেই ধারণা করা হচ্ছিল, এবারই সেই ণ। এবারই হয়ত জাতীয় দলের হয়ে স্বরূপে আবির্ভূত হবেন কোটি দর্শকের নয়নমণি রোনি। কিন্তু গুড়েবালি সে আশায়! গত দেড় বছর সেই সুযোগও পাননি। এ সময় ফর্ম ও ফিটনেসের অজুহাতে তাঁকে দলে ঠাঁই দেননি ডুঙ্গা। কিন্তু একটি কাব বদল তার পুরনো বিধ্বংসী মেজাজকে ফিরিয়ে দিয়েছে। মিলানে এসে নিজেকে পরিপূর্ণভাবে ফিরে পেয়েছেন। এজন্যই বিশ্বকাপ দলে জায়গা পাওয়ার ব্যাপারে ডুঙ্গার আশ্বাস পেয়েছেন মধ্যমাঠের এ কুশলী কারিগর। এরপরও কাকা, ফ্যাবিয়ানো, পাতো, আদ্রিয়ানো, মাইকনদের সঙ্গে বিশ্ববাসীকে 'জাগো বোনিতো' ছন্দ উপহার দেয়ার সুযোগ শেষমেশ তিনি পাবেন কিনা তা সময়ই বলে দেবে।
No comments