মফস্বলে নারী শিক্ষা ॥ কাছ থেকে দেখা by অমিত রায় চৌধুরী
খুব বেশি দিন আগের দৃশ্যপট নয়। কিছু সংখ্যক ছাত্রী জড়সড় হয়ে কমন রুমের পাশে অপেক্ষা করছে। শ্রেণী শিক্ষক অফিস থেকে বের হলেই ওরা তাঁর পিছু নিয়েছে।
ক্লাসে বসেছে কক্ষের এক পাশে। ক্লাসের মধ্যে এদের উপস্থিতি যতদূর মনে করতে পারি নিষ্প্রভ, প্রাণহীন। গ্রাম থেকে শহরে। বোধহয় একই প্রতিচ্ছবি। অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয় পরিম-ল আলাদা। দু’-চারটি মেয়ে ভাল করেছে। শুধু পড়াশোনায় নয়। আবৃত্তি, উপস্থাপনা বা সংস্কৃতিরও অনেক অনুষঙ্গকে ধারণ করে। কেউ কেউ এদের পরিচিত ঘরানার বাইরে এসেছে। নজর কেড়েছে। এদের সব অভিজ্ঞতা যে সুখকর, তা নয়। পরিবার থেকে সমাজ, সমাজ থেকে রাষ্ট্র। একটা গ-ির মধ্যে যেন এরা আটকে গেছে।আজ সে পরিবেশ নেই। বদলে গেছে খোদ গ্রামের অবস্থাও। মেয়েরা আসছে সাইকেলে চেপে। ঘাড়ে ব্যাগ দুলিয়ে, ভ্যানে, রিকশা অথবা বাসে চেপে। দৃপ্ত পদক্ষেপে। ভীষণ সপ্রতিভ মনে হয়। সেই লাজুক, দ্বিধাগ্রস্ত মেয়েটি আজ কমন রুমের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে না। মোবাইল ফোনে শিক্ষককে স্মরণ করিয়ে দেয়Ñস্যার আসুন। এক্ষুনি ঘণ্টা পড়বে। অথবা নিজে গিয়ে শিক্ষককে ডেকে আনে। ’৯০-এর দশক থেকে ২০১০। এর মধ্যে ঘটে গেছে একটি নীরব বিপ্লব।
কিভাবে এই মানস কাঠামোয় এমন বিবর্তন ঘটল? একটু পিছন ফিরে দেখা যাক। ছেলে কিংবা মেয়ে। স্বাধীনতা পূর্ব সময় শিক্ষা কিন্তু সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে ছিল না। শুনেছি কয়েক মণ ধান বিক্রি করে স্কুলের এক মাসের বেতন দিতে হয়েছে। এই ব্যয় বহুল শিক্ষা গ্রহণের সাধ্য কত জনেরই বা ছিল! নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণী তার কল্পনাকে মেলে ধরতে পারত না। সে সময় পরিবারের একটি ছেলেকে উপযুক্ত শিক্ষা দেয়ার সামর্থ্য অভিভাবকের ছিল না। মেয়ের বিষয়টি তো অনেক দূরের কথা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথমেই যে কাজটি বঙ্গবন্ধু করলেনÑপ্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সাবসিডি বৃদ্ধি করে সাধারণ মানুষের মাঝে শিক্ষা বিস্তারের আকাক্সক্ষা সৃষ্টি করলেন। সময়ের সাথে সাথে শিক্ষা বিস্তারে রাষ্ট্রের অংশীদারিত্ব বাড়তে লাগল। বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা, শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য প্রকল্প এবং সবশেষে নারী শিশুদের জন্য উপবৃত্তি প্রদান শুরু হলে দরিদ্র অভিভাবকদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি হলো। মেয়েরা স্কুলে আসতে লাগল। সংখ্যাও প্রতিবছর বাড়ল। ঝরে পড়া রোধকল্পে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হলো। শুধু সরকার নয়, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানও এগিয়ে এল।
এই যে সামনে আসার তাড়না তা শুধু মেয়েটিকে বিদূষী বানানোর জন্য নয়, বরং অনেকাংশেই সামাজিক প্রণোদনা বা আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে, স্রেফ আর্থিক সংযোগের কারণেই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে নারী শিক্ষায় আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে। এরপর সেই মেয়েটি হাইস্কুলে এল, কলেজে এল। তার কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হতে লাগল। চাকরিতে নারীদের কোটা সংরক্ষিত হলো। বিভিন্ন এনজিও নারী কর্মীদের দিকে ঝুঁকে পড়ল। পরিবারের আরেকটি ছেলের মতো একটি মেয়েও রোজগারের উৎস হতে পারেÑএই বাস্তবতা একটি বড় সংখ্যক অভিভাবককে উৎসাহিত করল। বিভিন্ন গণমাধ্যম নারীর ক্ষমতায়নের সামাজিক আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে এল। মেয়েরা সাহস করে ঘরের বাইরে বেরুতে লাগল। লেখাপড়ার পাশাপাশি উপার্জনও শুরু করল। মেয়েদের আচরণে আত্মবিশ্বাস প্রতিফলিত হতে লাগল। রাজনীতিতে মেয়েদের দাপট অপ্রতিহত গতিতে প্রতিষ্ঠিত হলো। খেলাধুলা, সংস্কৃতি, শিল্প, সাহিত্য, সিভিল সার্ভিস, পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, রেল সর্বত্রই মেয়েদের অংশগ্রহণ বিশেষ মাত্রা সৃষ্টি করল। এই আইকনিক রেভল্যুশন মেয়েদের বিপুল সংখ্যায় লেখাপড়ায় আগ্রহী করে তুলেছে। এত সব ঘটনা ঘটে গেছে মাত্র ১৫ বছরে।
এখন আসি মফঃস্বলে নারী শিক্ষার বাস্তব চালচিত্রে। প্রয়োজন ও বাস্তবতার টানে মেয়েরা ঘরের বাইরে এলেও গ্রামের পুরুষেরা এটা সহজে মানতে চায়নি। এই যে না চাওয়া তার পিছনে প্রথমত, কাজ করে দারিদ্র্য। কারণ ব্যয়বহুল উচ্চশিক্ষা চালিয়ে নেয়ার সম্ভাব্য অক্ষমতা তাকে দুর্ভাবনায় নিক্ষেপ করে। দ্বিতীয়ত, উত্তরাধিকার বিবেচনায় একটি ছেলের পিছনে ব্যয় করলে সেটি বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচিত হয়, মেয়ের জন্য নয়। তৃতীয়ত, মেয়ে যখন পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া অবস্থায় পারিপার্শ্বিক কারণে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়, তখন স্বামীর উদারতার অভাব বা কর্তৃত্ব হারানোর আশঙ্কায় নারী শিক্ষাকে সে নিরুৎসাহিত করে। এ সবই নারী শিক্ষা বিস্তারে প্রত্যক্ষ অন্তরায়। আবার পরোক্ষ অন্তরায় হলোÑএকটি বিরাট সংখ্যক অভিভাবক বিভিন্ন সামাজিক প্রণোদনা সত্ত্বেও চায় না মেয়ে বেশি দূর লেখাপড়া চালিয়ে নিক। তারা চান মেয়েটি একটি সুপাত্রীর মর্যাদা লাভ করুক। এ অবস্থায় মেয়েকে কোনভাবে পাত্রস্থ করতে পারলেই ভেবে বসেন তারা সফল পিতা। এছাড়া যুগ লালিত সংস্কারের ভূত যে দরিদ্র অভিভাবকদের মধ্য থেকে সম্পূর্ণ উধাও হয়ে গেছে তাও নয়। দারিদ্র্য ও অশিক্ষা সেসব অমূলক সংস্কারগুলোকে বরং দৃঢ়মূল করেছে। এছাড়া মেয়ের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠাও অভিভাবককে নারী শিক্ষায় নিরুৎসাহিত করেÑ এ কথাও সত্য।
আমি আমার ২৫ বছর মফঃস্বল শিক্ষকতার প্রথম ১২ বছরের অভিজ্ঞতায় যেটি লক্ষ্য করেছি, নারী শিক্ষার্থীর বিকশিত হওয়ার প্রেক্ষিত, অন্তরায় ও সম্ভাবনা যেভাবে বিন্যস্ত দেখেছি, সেই ধারাপথকে সরলীকৃত করার চেষ্টা করছি। কিছু সমস্যা সাধারণ এবং তার পরিণতি প্রায় একইভাবে নিষ্পন্ন হয়েছে। যেমনÑদরিদ্র পটভূমি থেকে উঠে আসা মেয়ে পরীক্ষায় ভাল ফল করেছে, সবার নজর কেড়েছে, অর্থাভাবে তার পড়াশোনা থমকে গেছে, একটি বিয়ে হয়েছে, ঘর সংসার করছে। এদের মধ্যে ৫% মেয়ে রাজধানী কিংবা বড় শহরে চাকরি করেছে, ব্যাংকে কিংবা সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে। দেখা গেছে, এই মেয়েদের পিছনে পরিবারের সমর্থন অনেক বড়। মেধার চেয়ে পরিবেশগত সমর্থন এদের বেড়ে ওঠায় সহযোগী হয়েছে। এসব ঘটনা এক যুগ আগের। বলে রাখা ভাল এসব মেয়ে কিন্তু এখনকার মতো সরকারী প্রণোদনা পায়নি।
এখন আমার দ্বিতীয় ১২ বছরের অভিজ্ঞতার কথা বলি। আর তা অবশ্যই আমার বর্তমান কর্মক্ষেত্রের আলোকে। মেয়েরা বড় সংখ্যায় আসছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। দারিদ্র্য বড় অন্তরায় নয়, বরং তারা আসছে দারিদ্র্য জয়ের মিশনে। সমাজ, রাষ্ট্র মেয়েদের পাশে আছে। প্রতিষ্ঠানের অবদানও কম নয়। কম বেশি সকল অভিভাবকই ভাবেন মেয়ে লেখাপড়া করে চাকরি পাবে, নিজের পায়ে দাঁড়াবে, না হলে অন্তত একটা ভাল বিয়ে হবে। সবচাইতে বড় কথা, পড়াশোনার খরচ রাষ্ট্র কিংবা সমাজ বহন করবে। সুতরাং এগিয়ে চলা। প্রায় ২৫% মেয়ে সফল হচ্ছে। এদের বিরাট অংশ প্রাইমারী স্কুল, নার্সিং, এনজিওতে যেমন এসেছে তেমনি কম হলেও চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কলেজ শিক্ষক, ব্যাংকার, পুলিশ এমনকি সেনা কর্মকর্তা হিসেবে চাকরিতে ঢুকেছে। আবার কেউ কেউ নারী উদ্যোক্তা হিসেবে বৃত্তি নির্বাচন করছে। এদের মধ্যে প্রায় সবাই নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে এসেছে। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে অদম্য ইচ্ছা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে তারা এই অবধি আসতে পারছে। এখানে অবশ্যই পরিবর্তিত সামাজিক পটভূমি তাদের সাহায্য করেছে।
আরও একটি পরিবর্তন আমাকে কৌতূহলী করেছে। একজন পরিশ্রমী রাজমিস্ত্রি, ওয়েল্ডিং মিস্ত্রি, মুদি দোকানদার, মেহনতি কৃষক এমনকি পরিচ্ছন্ন কর্মীর নারী সন্তানকে তারা লেখাপড়া শেখাতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। আরও লক্ষ্য করেছি, পরিবারের নারী সন্তানের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিও পাল্টাতে শুরু করেছে। এক্ষেত্রে অগ্রণী মনে হয়েছে এসব ছাত্রীর মায়েদের। এঁরা হয়ত সঙ্কল্পবদ্ধ তাদের নারী সন্তান স্বাবলম্বী হবে, শিক্ষায় মননে সম্পন্ন হবে। সন্তানের পেছনে তারা সাধ্যমতো বিনিয়োগ করছে। সামর্থ্যরে বিচারে এই অভিভাবকরা শহরের তুলনায় অনেক পিছিয়ে থাকলেও তাদের এগিয়ে আসাটা মোটেও সাধারণ নয়, অসাধারণ এক আত্মপ্রকাশের গল্প।
সবচাইতে বড় কথা। এসব মেয়ে এখন অন্তর্মুখী নয়। কথা বলছে সভা-সেমিনারে। অকপট সত্য, কঠিন কথা। সামাজিক প্রতিবেশ এদের মননশীলতা বিকাশে অনুঘটকের কাজ করেছে। ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটছে। মুক্ত মনে নিজেকে ব্যাপৃত করছে। পরিবেশ এদের ব্যক্তিত্বকে পরিচর্চা করে, পরিশীলন করে। মেয়েরা লড়াই করেছে ঘরে-বাইরে। নিজের সাথে। নিজের অবচেতন মনে বদ্ধমূল সংস্কারের সঙ্গে। আজ অনেককেই দেখেছি এরা মুক্ত মনের অধিকারী। তারা বোঝে সমাজকে। তাকে এবং তার করণীয়। এটাই অগ্রগতি, এটাই সাফল্য।
No comments