কারিগরি ও সামরিক সম্পর্ক উন্নয়নে বাংলাদেশ by ওয়ালিউল্লাহ
এক সাগর রক্তের বিনিময়ে লাখ লাখ মানুষের ত্যাগের ফলে উন্নয়নের কর্মধারায় বাংলাদেশ প্রায় ৪১ বছর অতিক্রম করেছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়নের ক্রমবিকাশ বাংলাদেশকে আজ বিশ্বে উজ্জ্বলতম স্থান দখলের ক্ষেত্রে অবদান রাখতে সাহায্য করেছে।
শান্তিরক্ষা মিশনে সশস্ত্র বাহিনীসহ সবার অংশগ্রহণ এবং আত্মত্যাগ বাংলাদেশকে প্রথম স্থান দখলের বিরল সম্মান লাভের সুযোগ এনে দিয়েছে। জাতীয় ক্ষেত্রে আমাদের অর্জনগুলো কম নয়। শিল্প, কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়নের ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের রয়েছে যুগান্তকারী সফলতা। আমাদের সংগীত ও সাহিত্য সমৃদ্ধ করে চলেছে বাঙলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে। আমরা বীরের জাতি, আমাদের সশস্ত্র বাহিনী দেশের কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-জনতার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একাত্তরে আমাদের জন্য একটি স্বাধীন দেশ এনে দিয়েছে। অল্পসংখ্যক বন্ধুপ্রতিম দেশ ও সারা বিশ্বের মানবদরদি মানুষের সমর্থনে আমরা আমাদের সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য এনেছিলাম লাল-সবুজের পতাকা। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে দৃঢ় করার সাধ থাকলেও অর্থনৈতিক কারণে আমরা সাধ্যমতো প্রতিরক্ষাকে আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত করতে পারিনি। একটি আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতি হিসেবে আমাদের প্রধান কর্তব্য হলো সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষায় আমাদের সশস্ত্র বাহিনীকে আধুনিকায়ন করা। আমাদের সশস্ত্রবাহিনী আজ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দায়িত্ব পালনে সক্ষম, যা শান্তিরক্ষী কার্যক্রমে তাদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। এ দেশের সরকার সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব ও কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়- এই নীতিতে বিশ্বাসী। আমাদের স্বজাত অধিকার হলো নিজেদের রক্ষা করা। জাতি হিসেবে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে বৈরিতার পরিবেশ তৈরি করে আমরা কখনো আমাদের প্রাণপ্রিয় সশস্ত্র বাহিনীকে কষ্টার্জিত অস্ত্র অকারণে ব্যবহার করতে দেব না। আমাদের উদ্দেশ্য হলো, প্রতিরক্ষা বূ্যহ রচনা করা। সবার প্রতি বন্ধুত্ব, কারো প্রতি শত্রুতা নয়, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির এই দর্শনটি আমরা মেনে চলতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বাংলাদেশের অবস্থান আজ পররাষ্ট্রনীতির এই দর্শনের কারণে সারা বিশ্বে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়েছে। জাতিসংঘ থেকে শুরু করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় বাংলাদেশ তার ভূমিকা গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। নিকট প্রতিবেশী দেশ থেকে ক্ষমতাশালী বিশ্বের দেশগুলোর বলয়ে বাংলাদেশ তার অবস্থান দৃঢ় করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৫ জানুয়ারি বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর বিভিন্ন অস্ত্র, সরঞ্জামাদি ক্রয়বিষয়ক চুক্তি এবং অন্যান্য কূটনৈতিক আলোচনার জন্য রাশিয়া সফর করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান এবং গুরুত্বপূর্ণ মিত্র দেশ রাশিয়ায় দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়নের স্বার্থে সফর করেন। তারই ধারাবাহিকতায় প্রায় চার দশক পর পুনরায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সফরের মধ্য দিয়ে সম্পর্কের একটি নতুন বীজ বপন হলো। রাশিয়া ও বাংলাদেশের মধ্যে শতকোটি ডলারের সামরিক সহযোগিতার চুক্তি উভয় দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছে। বাংলাদেশ-রাশিয়ার মধ্যে চারটি চুক্তি হয়েছে। এর মধ্যে সশস্ত্র বাহিনীর জন্য এক বিলিয়ন ডলার। এই অর্থ সশস্ত্র বাহিনী আধুনিকায়নের ক্ষেত্রে ব্যয় করার পরিকল্পনা রয়েছে। মুসলিম দেশগুলোতে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ক্ষেত্রে পশ্চিমা দেশগুলোর নেতিবাচক মনোভাব আছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো মুসলিম দেশে রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য রাশিয়ার সাহায্য লাভ আমাদের জন্য ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনতে পারে, যদি সরকার পরিবেশ বিপন্ন না হওয়ার বিষয়টি লক্ষ রাখে। আমাদের মনে রাখা দরকার, সমরাস্ত্র ক্রয়ের ব্যাপারটি আগেই টাইগার সামিট এ রাশিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে শেখ হাসিনার বৈঠকে আলোচিত হয়। বর্তমান চুক্তিটি করা হয়েছে মূলত সশস্ত্র বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি, ফোর্সেস গোল ২০৩০ বাস্তবায়নের, বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়নের এবং জাতিসংঘ শান্তি মিশনের জন্য উন্নতমানের সরঞ্জামাদি ক্রয়ের লক্ষ্যে। বিশ্বের অন্যান্য দেশ অত্যন্ত আধুনিক ও উন্নতমানের যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার করে থাকে। বর্তমানে জাতিসংঘ মিশনের প্রেক্ষাপটে আমূল পরিবর্তন হয়েছে। প্রথমবারের মতো জাতিসংঘে নিয়োজিত বাংলাদেশি আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল আমিরা হক সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ভ্রমণ করেন। তিনি উল্লেখ করেন, বর্তমান পটভূমির পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সামর্থ্য আরো অধিক শক্তিশালী করা প্রয়োজন। নিজের প্রতিরক্ষার প্রয়োজন ছাড়াও মিশন এলাকায় অবস্থিত অন্য দেশকেও সহযোগিতা করা অতীব কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। জাতিসংঘ মিশনে অংশগ্রহণ করতে হলে তাই আমাদের সশস্ত্র বাহিনীকে অস্ত্রে সজ্জিত হতে হবে। উল্লেখ্য, জাতিসংঘ মিশন থেকে বাংলাদেশ প্রতিবছর বিশাল অঙ্কের রিএম্বার্সমেন্ট পেয়ে থাকে। মিশনে নিয়োজিত শুধু একটি এপিসি থেকে বাংলাদেশ প্রতি মাসে প্রায় ৮০০০ ডলার আয় করে থাকে। সাম্প্রতিককালে জাতিসংঘ মিশনে প্রেরণকারী বাংলাদেশ কন্টিনজেন্টের কাছে ব্যবহৃত অনেক প্রয়োজনীয় অস্ত্রের অভাব দেখা দেয়। জাতিসংঘ মিশনের জন্য রাশিয়া থেকে ক্রয়কৃত অস্ত্র ও সরঞ্জামাদির অনেকাংশই মিশনে প্রেরণ করা হবে। এর থেকে যে টাকা অর্জিত হবে, তা দিয়েই ঋণ পরিশোধ করা যাবে, এমনকি ২০১৮ সালে ঋণ পরিশোধ শুরু হওয়ার আগেই অনেক সরঞ্জামের ক্রয়মূল্য রিএম্বার্সমেন্টের মাধ্যমে উঠে আসবে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের বিভিন্ন রকম দুর্যোগ মোকাবিলার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা রাখে। এ ছাড়া বিশ্ব ইজতেমা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ অন্যান্য বন্যাদুর্গত এলাকায় সাধারণ জনগণের সাহায্যের জন্য সেনাবাহিনী পন্টুন ব্রিজ ব্যবহার হয়ে থাকে। পন্টুন ব্রিজ, হেলিকপ্টার ক্রয় করা হলে তা দুর্যোগ মোকাবিলায়- যেমন ত্রাণ বিতরণ ও উদ্ধারকাজ পরিচালনা সহজতর হবে। বর্তমানে বৈমানিকদের প্রশিক্ষণের জন্য বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে যেসব বিমান বা হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয়, তা অত্যন্ত পুরনো, যার কারণে প্রায়শই দুর্ঘটনা ঘটে। চুক্তি অনুযায়ী যে বিমান ক্রয় করা হবে, তা যুদ্ধোপযোগী এবং এগুলো দেশে এলে বৈদেশিক অর্থ ব্যয় করে বিদেশে বৈমানিক ও বিমান প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হবে না। বাংলাদেশ-মিয়ানমারের সাম্প্রতিককালে সংঘটিত বিভিন্ন ঘটনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মিয়ানমার এ দেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ এবং এ দেশের সমুদ্রসীমায় তেল আহরণের ক্ষেত্রে প্রচেষ্টা চালিয়েছে। সেই প্রেক্ষাপটে প্রতিবেশী দেশগুলোর সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে সক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যে আধুনিক অস্ত্র ক্রয় করা এখন সরকারের জন্য সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নির্ভরযোগ্য সূত্র মতে, বাংলাদেশ-রাশিয়া চুক্তির ক্ষেত্রে যে বিষয়টি বিবেচনায় এসেছে তা হলো বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে সঠিক মূল্যে আধুনিক অস্ত্র ক্রয়। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, সশস্ত্র বাহিনী এই চুক্তির আগেই ডিজিডিপির মাধ্যমে এসব অস্ত্রের বেশির ভাগই প্রতিযোগিতামূলক দামের মাধ্যমে ক্রয় করেছে, সুতরাং যা উচ্চমূল্যের সম্ভাবনাকে নাকচ করে দেয়। এসব ক্রয় প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকেও প্রতিনিধি রাখা হয়। এসব ক্রয়তব্য অস্ত্র যেহেতু শুধু সশস্ত্র বাহিনীর জন্য বরাদ্দকৃত বাজেট থেকে ক্রয় করা হবে, এ কারণে সরকারের অতিরিক্ত বাজেট বরাদ্দের কোনো প্রয়োজন পড়বে না। সূত্রে আরো জানা যায়, এই অস্ত্র এবং সরঞ্জামাদি ৪ শতাংশ হারে ২০ বছরে পরিশোধের লক্ষ্যে চুক্তি করা হয়েছে, যা ২০১৮ সাল থেকে কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে। বাংলাদেশ-চীনের দীর্ঘদিনের কূটনৈতিক সম্পর্কের ফলে ইতিপূর্বে বাংলাদেশ এক রেজিমেন্ট অত্যাধুনিক এমবিটি-২০০০ ট্যাংক, উইপন লোকেটিং রাডার, অ্যান্টিট্যাংক উইপন ইত্যাদি ক্রয় করেছে এবং আরো সরঞ্জাম ক্রয় প্রক্রিয়াধীন। এ ছাড়া সেনাবাহিনী ফ্রান্স থেকে হেলিকপ্টার, ইউক্রেন থেকে এপিসি ইঞ্জিন, সার্বিয়া থেকে এসপি গান ইত্যাদি ক্রয় করেছে অর্থাৎ বাংলাদেশ কখনোই সমরাস্ত্রের জন্য শুধু একটি দেশের ওপর নির্ভরশীল ছিল না। যখনই বাংলাদেশ মনে করেছে যে তার জন্য সুবিধাজনক দেশ কোনটি, তখনই সে দেশের সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। এ ছাড়া যেকোনো দেশের সামরিক বাহিনীর জন্য সরঞ্জামাদি ক্রয়ের ক্ষেত্রে একটি দেশের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হওয়া যুক্তিযুক্ত নয়। কোনো কারণে সম্পর্কের অবনতি হলে বিরূপ প্রভাব পড়ার কথা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর অফিসার ও সৈনিকরা, বন্ধুপ্রতিম দেশ রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়ে আসছে। যা সশস্ত্র বাহিনীর অফিসারদের উচ্চমানের প্রশিক্ষণ গ্রহণের ক্ষেত্রে অবারিত দ্বার খুলে দিয়েছে। এই চুক্তির ক্ষেত্রে অনেকে ধারণা পোষণ করেন যে রাশিয়ার খুচরা যন্ত্রাংশের মূল্য বিশ্বের বাজারে অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি এবং রক্ষণাবেক্ষণেও ব্যয়বহুল। উল্লেখ্য, রাশিয়া অন্য দেশে এ ধরনের সামরিক উপকরণ আরো বেশি সুদে বিক্রি করে থাকে। অতীতে অন্য দেশ থেকে বাংলাদেশ যে সরঞ্জামাদি কিনেছিল, তাতেও সুদের হার বেশি ছিল। নিকট অতীতে চীন থেকে ১৬টি এফ৭-বিজি এয়ারক্রাফট ক্রয়ের জন্য ৪ শতাংশ সুদে ৯ কিস্তিতে পরিশোধযোগ্য ১১৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়। সেখানে চুক্তি স্বাক্ষরের ৩০ দিন পরই প্রথম কিস্তি পরিশোধ করতে হয়েছে। যার শেষ কিস্তি পরিশোধ হবে ২০১৩ সালে। কিন্তু রাশিয়ার ক্ষেত্রে ২০১৮ সালে প্রথম কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। এ ছাড়া চুক্তিকৃত অর্থের পুরোটাই ব্যবহারের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। অব্যবহৃত অর্থের জন্য অল্প পরিমাণ সার্ভিস চার্জ প্রযোজ্য হবে। এই অর্থ ব্যবহার করে কোন কোন সরঞ্জাম কত মূল্যে ক্রয় করা হবে বা আদৌ ক্রয় করা হবে কি না তার সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ নিতে পারবে।
আরো উল্লেখ্য, রাশিয়া যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল তখন এর বিভিন্ন অংশে যেমন ইউক্রেন, বেলারুশ ইত্যাদিতে সরঞ্জাম তৈরির কারখানা স্থাপন করা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর ওইসব দেশ এখন খুচরা যন্ত্রাংশ প্রস্তুত করতে সক্ষম এবং এর ফলে বিশ্ববাজারে স্বল্পমূল্যে তা সরবরাহ করতে পারে। রাশিয়া থেকে ক্রয়কৃত এপিসি, এমআই-১৭ দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ আশা করে যে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এত অর্থ ব্যয় করে যে দ্রব্যসামগ্রী কেনা হচ্ছে, তাতে যেন স্বচ্ছতা থাকে এবং সরকার তা নিশ্চয়ই বিবেচনায় আনবে। বিশ্বের অন্যান্য সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে, শান্তিরক্ষা মিশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হলে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মনোবল অক্ষুণ্ন রাখতে নতুন আধুনিক সমরাস্ত্র সংযোজন করা ছাড়া বাংলাদেশের আর বিকল্প নেই। বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে আজ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার দৃঢ় অবস্থান প্রমাণ করেছে। শান্তিরক্ষা মিশনসহ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বিশ্বের অনেক শক্তিশালী দেশের তুলনায় আমাদের মেধা ও প্রজ্ঞা কাজে লাগিয়ে আমরা অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছি। আমরা কখনোই ভাবিনি, আমাদের হেলিকপ্টারগুলো আটলান্টিক সাগর অথবা আফ্রিকা থেকে তিমুরের আকাশে উড়ে চলবে, আমাদের নৌবাহিনীর নৌযানগুলো শান্তি স্থাপনে উত্তাল আটলান্টিক পাড়ি দেবে। আমাদের সেনাসদস্য সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ও গৃহযুদ্ধে বিবদমান দলকে নিবৃত্ত করার জন্য তাঁদের অস্ত্রসহ এপিসি নিয়ে এগিয়ে যাবেন। বাস্তবতার নিরিখে আজ আমাদের আধুনিক অস্ত্রসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম প্রয়োজন। বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে অনেক দেশকে পেছনে ফেলে দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে এগিয়ে চলেছে। গণতান্ত্রিক সরকার বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়নে যে যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছে, তা দেশপ্রেমিক জনগণের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাসের বাতাবরণ সৃষ্টিতে সহায়ক হবে।
লেখক : সাবেক সেনা কর্মকর্তা
নির্ভরযোগ্য সূত্র মতে, বাংলাদেশ-রাশিয়া চুক্তির ক্ষেত্রে যে বিষয়টি বিবেচনায় এসেছে তা হলো বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে সঠিক মূল্যে আধুনিক অস্ত্র ক্রয়। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, সশস্ত্র বাহিনী এই চুক্তির আগেই ডিজিডিপির মাধ্যমে এসব অস্ত্রের বেশির ভাগই প্রতিযোগিতামূলক দামের মাধ্যমে ক্রয় করেছে, সুতরাং যা উচ্চমূল্যের সম্ভাবনাকে নাকচ করে দেয়। এসব ক্রয় প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকেও প্রতিনিধি রাখা হয়। এসব ক্রয়তব্য অস্ত্র যেহেতু শুধু সশস্ত্র বাহিনীর জন্য বরাদ্দকৃত বাজেট থেকে ক্রয় করা হবে, এ কারণে সরকারের অতিরিক্ত বাজেট বরাদ্দের কোনো প্রয়োজন পড়বে না। সূত্রে আরো জানা যায়, এই অস্ত্র এবং সরঞ্জামাদি ৪ শতাংশ হারে ২০ বছরে পরিশোধের লক্ষ্যে চুক্তি করা হয়েছে, যা ২০১৮ সাল থেকে কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে। বাংলাদেশ-চীনের দীর্ঘদিনের কূটনৈতিক সম্পর্কের ফলে ইতিপূর্বে বাংলাদেশ এক রেজিমেন্ট অত্যাধুনিক এমবিটি-২০০০ ট্যাংক, উইপন লোকেটিং রাডার, অ্যান্টিট্যাংক উইপন ইত্যাদি ক্রয় করেছে এবং আরো সরঞ্জাম ক্রয় প্রক্রিয়াধীন। এ ছাড়া সেনাবাহিনী ফ্রান্স থেকে হেলিকপ্টার, ইউক্রেন থেকে এপিসি ইঞ্জিন, সার্বিয়া থেকে এসপি গান ইত্যাদি ক্রয় করেছে অর্থাৎ বাংলাদেশ কখনোই সমরাস্ত্রের জন্য শুধু একটি দেশের ওপর নির্ভরশীল ছিল না। যখনই বাংলাদেশ মনে করেছে যে তার জন্য সুবিধাজনক দেশ কোনটি, তখনই সে দেশের সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। এ ছাড়া যেকোনো দেশের সামরিক বাহিনীর জন্য সরঞ্জামাদি ক্রয়ের ক্ষেত্রে একটি দেশের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হওয়া যুক্তিযুক্ত নয়। কোনো কারণে সম্পর্কের অবনতি হলে বিরূপ প্রভাব পড়ার কথা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর অফিসার ও সৈনিকরা, বন্ধুপ্রতিম দেশ রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়ে আসছে। যা সশস্ত্র বাহিনীর অফিসারদের উচ্চমানের প্রশিক্ষণ গ্রহণের ক্ষেত্রে অবারিত দ্বার খুলে দিয়েছে। এই চুক্তির ক্ষেত্রে অনেকে ধারণা পোষণ করেন যে রাশিয়ার খুচরা যন্ত্রাংশের মূল্য বিশ্বের বাজারে অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি এবং রক্ষণাবেক্ষণেও ব্যয়বহুল। উল্লেখ্য, রাশিয়া অন্য দেশে এ ধরনের সামরিক উপকরণ আরো বেশি সুদে বিক্রি করে থাকে। অতীতে অন্য দেশ থেকে বাংলাদেশ যে সরঞ্জামাদি কিনেছিল, তাতেও সুদের হার বেশি ছিল। নিকট অতীতে চীন থেকে ১৬টি এফ৭-বিজি এয়ারক্রাফট ক্রয়ের জন্য ৪ শতাংশ সুদে ৯ কিস্তিতে পরিশোধযোগ্য ১১৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়। সেখানে চুক্তি স্বাক্ষরের ৩০ দিন পরই প্রথম কিস্তি পরিশোধ করতে হয়েছে। যার শেষ কিস্তি পরিশোধ হবে ২০১৩ সালে। কিন্তু রাশিয়ার ক্ষেত্রে ২০১৮ সালে প্রথম কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। এ ছাড়া চুক্তিকৃত অর্থের পুরোটাই ব্যবহারের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। অব্যবহৃত অর্থের জন্য অল্প পরিমাণ সার্ভিস চার্জ প্রযোজ্য হবে। এই অর্থ ব্যবহার করে কোন কোন সরঞ্জাম কত মূল্যে ক্রয় করা হবে বা আদৌ ক্রয় করা হবে কি না তার সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ নিতে পারবে।
আরো উল্লেখ্য, রাশিয়া যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল তখন এর বিভিন্ন অংশে যেমন ইউক্রেন, বেলারুশ ইত্যাদিতে সরঞ্জাম তৈরির কারখানা স্থাপন করা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর ওইসব দেশ এখন খুচরা যন্ত্রাংশ প্রস্তুত করতে সক্ষম এবং এর ফলে বিশ্ববাজারে স্বল্পমূল্যে তা সরবরাহ করতে পারে। রাশিয়া থেকে ক্রয়কৃত এপিসি, এমআই-১৭ দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ আশা করে যে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এত অর্থ ব্যয় করে যে দ্রব্যসামগ্রী কেনা হচ্ছে, তাতে যেন স্বচ্ছতা থাকে এবং সরকার তা নিশ্চয়ই বিবেচনায় আনবে। বিশ্বের অন্যান্য সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে, শান্তিরক্ষা মিশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হলে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মনোবল অক্ষুণ্ন রাখতে নতুন আধুনিক সমরাস্ত্র সংযোজন করা ছাড়া বাংলাদেশের আর বিকল্প নেই। বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে আজ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার দৃঢ় অবস্থান প্রমাণ করেছে। শান্তিরক্ষা মিশনসহ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বিশ্বের অনেক শক্তিশালী দেশের তুলনায় আমাদের মেধা ও প্রজ্ঞা কাজে লাগিয়ে আমরা অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছি। আমরা কখনোই ভাবিনি, আমাদের হেলিকপ্টারগুলো আটলান্টিক সাগর অথবা আফ্রিকা থেকে তিমুরের আকাশে উড়ে চলবে, আমাদের নৌবাহিনীর নৌযানগুলো শান্তি স্থাপনে উত্তাল আটলান্টিক পাড়ি দেবে। আমাদের সেনাসদস্য সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ও গৃহযুদ্ধে বিবদমান দলকে নিবৃত্ত করার জন্য তাঁদের অস্ত্রসহ এপিসি নিয়ে এগিয়ে যাবেন। বাস্তবতার নিরিখে আজ আমাদের আধুনিক অস্ত্রসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম প্রয়োজন। বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে অনেক দেশকে পেছনে ফেলে দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে এগিয়ে চলেছে। গণতান্ত্রিক সরকার বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়নে যে যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছে, তা দেশপ্রেমিক জনগণের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাসের বাতাবরণ সৃষ্টিতে সহায়ক হবে।
লেখক : সাবেক সেনা কর্মকর্তা
No comments