সিডনির মেলব্যাগ- দেশের বাইরেও সিংহভাগ বাংলাদেশী এই বিচারের পক্ষে- অজয় দাশ গুপ্ত
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে কথা বললে অনেকেই তা অতীত বলে এড়িয়ে যেতে চান। দেশের ভেতরে যেমন দেশের বাইরেও সিংহভাগ বাংলাদেশী এই বিচার প্রক্রিয়ার অনুকূলে।
তাঁরা অতীতের কলঙ্কমুক্ত পূর্ণ গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার পক্ষে। দুর্ভাগ্য এই পাকিস্তানপন্থী রাজনীতি সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি আর ধর্মান্ধতার কারণে প্রবাসী বাংলাদেশীদের একাংশ এখানও দিশেহারা। এদের নিয়ে দুর্ভাবনার তেমন কিছু না থাকলেও ভয় যেতে চায় না। ভয়ের কারণও অমৌলিক কিছু নয়। গত কিছু দিন থেকে সিডনির ঘরোয়া সভা সমিতি বা আলাপ আলোচনায় অবরুদ্ধ মনমানসিকতার আচরণে আমি স্তম্ভিত হলেও বিস্মত নই। অতীতের দায় বা পাপ অস্বীকার করার জন্য সত্য-মিথ্যার মিশ্রণে এক ধরনের অদ্ভুত যুক্তি নামের কূটতর্ক পৃথিবীতে বহুকাল আগে থেকেই চলে আসছে। শুধু ভাবনার বিষয় এই, লাখো বাঙালীর রক্ত, হাজারো মা বোনের সম্ভ্রম আর ধ্বংস্তূপের ওপর দাঁড়ানো জাতিও কেন এই বিষয়ে সার্বজনীন ঐক্য বা বজ্রকঠিন শপথে এক হতে পারল না।অথচ অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়ার যে দু’একজনের সাথে আলাপ বা ভাব-বিনিময়ের সুযোগ হয়েছে, তাঁরা সম্পূর্ণভাবে বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ হবার পক্ষে। তাদের যুক্তি, বাংলাদেশ বা এমন দেশগুলোর অতীতাশ্রয়ী রাজনীতিতে সময় ব্যয় করার সুযোগ নেই। চল্লিশ বছর পূর্বের বাস্তবতা ও আজকের দুনিয়া এক নয়। এখন বিশ্বায়নের নামে খুলে যাওয়া পৃথিবীতে নতুন প্রজন্মের দাপট। এরা অতীত বা বর্তমানের চাইতে ভবিষ্যতে আগ্রহী। স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন জাগে, তাহলে অতীত নিয়ে কথা বলছি কেন? কেন চাইছি বিচার বা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি? এর উত্তরও দিয়েছেন তারা। পৃথিবীর উন্নয়নশীল নামে পরিচিত অগ্রসর দেশগুলোর রাজনীতি নানা কারণে নিরবচ্ছিন্ন শান্তির কিছু নয়। সত্তর থেকে আশির দশক পর্যন্ত রক্তপাত, অভ্যুত্থান আর অনিয়মতান্ত্রিক ক্ষমতা বদলে ঘটে যাওয়া অপরাজনীতি ও সন্ত্রাস এখনও এদের প্রধান প্রতিবন্ধক। কিছু কিছু দেশে যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্য ষড়যন্ত্র, প্রাণী হত্যা, মানব নিধনের ভেতর দিয়ে সংঘটিত কালো অধ্যায় উন্নয়নকে বৃত্তাবদ্ধ করে রেখেছে। তাঁদের অভিমত, সুস্পষ্ট উত্তরণ ও সে অতীত ধুয়েমুছে সাফ করতে না পারলে তৃতীয় বিশ্বের ঐ সব দেশ ও জাতি কখনোই অলোর মুখ দেখবে না। এ বিষয়ে মতপার্থক্যেরও কারণ নেই। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, এশিয়া ও ইউরোপের বহু দেশে এ জাতীয় পাপ বা যুদ্ধারাধের বিচার অথবা শাস্তি দেয়ার উদাহরণ রয়েছে। যুদ্ধ শেষে বিজয়ী ও বিজিতের সমঝোতা হয়েছে আইনী প্রক্রিয়ায়। আমাদের যে হতো না, তাও কিন্তু নয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্য বিচক্ষণ নেতারা নিজেদের ভুলত্রুটি বুঝে উঠে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। সে সুযোগে পুনরুত্থিত জামায়াত-শিবির ও প্রতিক্রিয়াশীল চক্র ক্ষমতা দখল করে যে গোলক ধাঁধার পথ তৈরি করেছিল, আজও আমরা তা থেকে পুরোপুরি বের হয়ে আসতে পারিনি। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এবার যখন তীব্র আবেগ ও দৃঢ়তায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ করার চেষ্টা করছেন তখনও আমরা পথ হারিয়ে হয় তাকে অপমান করার চেষ্টা করছি, নয়তো কূট কৌশলে রাজাকারদের পক্ষ নিতে মরিয়া হয়ে উঠছি। শুরুতেই বলছিলাম, এক দল নব্য রাজাকারের আস্ফালন বা কূট প্রক্রিয়ার কথা। এখনও তারা সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। বিতর্কের এক পর্যায়ে রণে ভঙ্গ দেয় বা তরুণ-তরুণীদের কাছে ধরা খেয়ে নির্বাক বা মৌন হয়ে যায়। কিন্তু খালেদা জিয়ার আশীর্বাদপুষ্ট এ জাতীয় সাপদের বিষয়ে এখন থেকেই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। অন্যথায় বিএনপি নামের বিষবৃক্ষ বেয়ে এদের অশুভ চিন্তা এক ধরনের কুপ্রভাব বিস্তার করবে। প্রবাসী তরুণ-তরুণীদের বিভ্রান্ত করবে। যে কারণে সাবধানতার পাশাপাশি কিছু কর্তব্যও মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে এবং বিচার প্রক্রিয়াধীন, অর্থাৎ আইনের অধীন একটি বিষয়। এ বিষয়ে যথেচ্ছ মতামত বা অন্যকে প্রভাবিত করার মতো বক্তব্য রাখা তা সামজিক নেটওয়ার্ক ফেসবুকে বা টুইটারে ছড়িয়ে দেয়া কতটা নৈতিক? কতটা যৌক্তিক? এই অপপ্রক্রিয়া বন্ধ হওয়ার প্রয়োজন। যারা এটাকে অগণতান্ত্রিক বা মানবাধিকার লঙ্ঘন মনে করেন তাদের কাছে প্রশ্ন রাখা উচিত যুদ্ধাপরাধীরা কি হত্যাকা- বা ধর্ষণের সময় মানবাধিকারের বিষয়টা মনে রেখেছিলেন? না আন্তর্জাতিক আইন মেনে বাঙালী নিধনে মেতে উঠেছিলেন? মানেননি। তারপরও আমরা তাদের পাখির মতো মারিনি। অন্যায়ভাবে হত্যাও করেনি কেউ। পাপ যেহেতু বাপকে ছাড়ে না। সময় ছেড়ে কথা বলে না। সে প্রক্রিয়ার পথ ধরেই আজ তারা বিচারের সম্মুখীন। আইনকে কাচকলা বা বৃদ্ধাঙ্গলি দেখানোর মতো স্পর্ধায় ফুলে ওঠা এই দালালদের আন্তর্জাতিক লবিং এখন সক্রিয়। তারা নানাভাবে নাক গলাতে চাইছে। ব্যাহত করতে চাইছে আইনী প্রক্রিয়া। সিডনির যে প্রাচীন বাঙালী প্রজন্ম পাকপ্রীতি ও ধর্মান্ধতায় যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নিচ্ছে তারা কোন সুযোগে বা অশুভ হাতছানিতে যে কোন সময় এক বা ঐক্যবদ্ধ হয়ে উঠতে পারেন।
সে কারণেই আমাদের বিদেশে অবস্থিত দূতাবাসগুলোর দায়িত্ববোধের পরিচয় দেয়ার সময় এসেছে। তাঁরা একা কিছ্ইু করতে পারবেন না। এ জন্য চাই দেশীয় সমর্থন, সরকার ও রাষ্ট্রের দিকনির্দেশনা। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যাপারে স্পর্শকাতর, ঈর্ষাকাতর নিন্দুক ও গা জ্বলে ওঠা বাঙালীর প্রকৃত অবস্থান বুঝতে আমার অন্তত বিলম্ব হয় না। আমি তা নিয়ে ভাবিতও নই। আমার ভাবনা ঐক্যবদ্ধ বাঙালী প্রগতিশীলতা যেন নষ্ট না হয়। চল্লিশ বছর পূর্বের রাজাকার দালাল বা তাদের রক্ত ও আদর্শের উত্তরাধিকারীরা যেন পুনর্বার আঘাত হানতে না পারে। ২০১৩ সালটি এদিক থেকে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এ বছর ভুলভ্রন্তি কুয়াশা কুহেলিকা সরিয়ে ঐক্যবদ্ধ থেকে জাতি ও রাষ্ট্রকে পাপ কলঙ্ক যুদ্ধাপরাধ মুক্ত করাই হোক প্রধান লক্ষ্য।
dasguptaajoy@hotmail.com
No comments