মাওলানা সুবহানের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত প্রতিবেদন ১৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে দাখিলের নির্দেশ- যুদ্ধাপরাধী বিচার
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা আব্দুস সুবহানের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত প্রতিবেদন ১৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে দাখিলের নির্দেশ দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।
অন্যদিকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার মামলা রিট্রায়ালের শুনানি আজ অনুষ্ঠিত হবে। রবিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ ও ২ এ আদেশ দিয়েছে। ২০ সেপ্টেম্বর মাওলানা আব্দুস সুবহানকে একটি মামলায় বঙ্গবন্ধু সেতুর টোল প্লাজা থেকে গ্রেফতার করে টাঙ্গাইল গোয়েন্দা পুলিশ। পরে তাকে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়। এর পর ২৩ সেপ্টেম্বর সুবহানকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে তদন্তের স্বার্থে তাকে গ্রেফতার (শ্যোন এ্যারেস্ট) দেখানোর আবেদন করা হয়। ট্রাইব্যুনাল প্রসিকিউশনের আবেদন আমলে নিয়ে তাকে ৩০ সেপ্টেম্বর ট্রাইব্যুনালে হাজির করতে পুলিশকে নির্দেশ দেন।
এদিকে প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম তদন্ত প্রতিবেদন দিতে আরও দু’মাস সময় চাওয়াতে ট্রাইব্যুনাল চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন ১৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে দাখিল করতে নির্দেশ দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি আনোয়ারুল হকের ট্রাইব্যুনাল ওই দিন ধার্য করেন। ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর উপস্থিত ছিলেন না। রবিবার দুটায় মুহাম্মদ আব্দুস সুবহানের বিরুদ্ধে তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে ।
৩০ সেপ্টেম্বর মাওলানা সুবহানকে মানবতাবিরোধী অপরাধে আটক দেখিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।এরপর ১ অক্টোবর মাওলানা আব্দুস সুবহানের পক্ষে করা জামিন আবেদন খারিজ করে দিয়ে একই সঙ্গে ৪ নবেম্বর তার বিরুদ্ধে তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।
এছাড়া মাওলানা সুবহানকে (সাবেক সংসদ সদস্য) তার বয়সের কথা বিবেচনা করে কারাবিধি অনুযায়ী তাকে ডিভিশন (প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা) দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।
তার বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আবেদনে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটতারাজ ও ধর্ষণের মতো সব মানবতাবিরোধী অপরাধ বিষয়ে তদন্ত চলছে। প্রাথমিক তদন্তে তার বিরুদ্ধে ব্যাপক গণহত্যার প্রমাণ পাওয়া গেছে। মুক্তিযুদ্ধকালে পাবনার ফরিদপুর থানার ডেমরা গ্রামের এক হাজার, সুজানগর থানার নাজিরগঞ্জ ও সাতবাড়িয়ায় ৪শ’ এবং কুচিয়াপাড়া আট জনসহ অসংখ্য মানুষকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া তদন্তকালে পাবনার নাজিরউদ্দিন নজরুল ইসলাম উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন বধ্যভূমি, নুরপুর বধ্যভূমি, পাওয়ার হাউস বধ্যভূমি, জাফরিয়াবাদ গোরস্তান সংলগ্ন বধ্যভূমি, কুচিয়া মুরাপুর বধ্যভূমি, টেবনিয়া বীজ গোডাউন সংলগ্ন বধ্যভূমি, বালিয়াহালট গোরস্তান সংলগ্ন বধ্যভূমি এবং মাদবপুর বটতলা সংলগ্ন বধ্যভূমি সংলগ্ন বধ্যভূমিসহ বৃহত্তর পাবনায় অসংখ্য বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে। মুক্তিযুদ্ধকালে এসব বধ্যভূমিতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সাধারণ মানুষদের হত্যা করে মাটি চাপা দেয়া হয়েছে ।
প্রসিকিউশন সূত্রে জানা গেছে , মাওলানা আব্দুস সুবহানের বিরুদ্ধে বৃহত্তর পাবনা জেলায় ১৪০৮ জন নিরীহ মানুষকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা আব্দুস সুবহানের বিরুদ্ধে যে সমস্ত অভিযোগ আনা হচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে, একাত্তর সালের ১৭ মে অভিযুক্ত মাওলানা আব্দুস সুবহান তার উপস্থিেিততে পিসকমিটি, রাজাকার আলবদর বাহিনী নিয়ে পাবনা জেলার কুচিয়াপাড়া ও শাখারিপাড়াতে হানা দিয়ে সুধীর চন্দ্র অধিকারী, গোপাল চন্দ্র সাহাসহ ৮ জনকে হত্যা করে। এ সময় তারা ২০/২৫টি হিন্দু বড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে।
একাত্তরের মে মাসের কোন একদিন শান্তিকমিটি, রাজাকার বাহিনী ও আলসামস বাহিনী নিয়ে পাবনা জেলার ফরিদপুর থানার ডেমরাতে প্রায় ১ হাজার লোককে হত্যা করে। এ সময় সেখানে নারী নির্যাতনও করা হয়েছে। মে মাসের প্রথম দিকে সুজানগর থানার সাতবাড়িযা ইউনিয়নে ভোর বেলায় তার নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী আক্রমণ চালিয়ে ৪০০ জনকে হত্যা করেছে। এ সময় সেখানে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করা হয়। নারীদের উপর নির্যাতনও করা হয়েছে। এ সমস্ত অভিযোগসহ আরও কিছু অভিযোগ আনা হচ্ছে।
প্রসিকিউটর সূত্রে জানা গেছে, মাওলানা আব্দুস সুবহান ভাল উর্দু জানতেন, সে কারণে পাকবাহিনীর কাছে তার বেশি কদর ছিল। তিনি বাঙালীদের পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর কাছে তুলে দিয়েছেন। এবং তাদের চিনিয়ে দিয়েছেন। জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ১৯৭০ সাল পর্যন্ত পাবনা জেলার আমির ছিলেন। ১৯৭১ সালে শান্তি কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও পরবতীতে সহসভাপতি ছিলেন। ১৯৭২ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধে স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে হাজির হবার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। মাওলানা আব্দুস সুবহানের বিরুদ্ধে তদন্ত কাজ করছেন তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তা মতিউর রহমান।
কাদের মোল্লা
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার মামলা পুনরায় শুরুর (রি-ট্রাযালের) আবেদনের শুনানি পিছিয়ে। আজ তার বিরুদ্ধে শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীনের নেতৃত্বে দুই সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এ দিন ধার্য করেন।
বৃস্পতিবার আসামিপক্ষ কাদের মোল্লার মামলা পুনরায় শুরুর আবেদন করেন। ওই ট্রাইব্যুনাল এ বিষয়ে রবিবার শুনানির দিন ধার্য করেছিল। ধার্য তারিখ অনুযায়ী আজ শুনানি হওয়ার কথা থাকলেও হরতালের কারণে আসামিপক্ষের সিনিয়র আইনজীবীরা ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত না থাকায় তাদের পক্ষে একজন আইনজীবী সময় প্রার্থনা করলে ট্রাইব্যুনাল তা পিছিয়ে আজ ধার্য করে দেয়।
এদিকে গত ২৭ ডিসেম্বর কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হলে ৭ জানুয়ারি আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের দিন ধার্য করে দেয় ট্রাইব্যুনাল। সে হিসেবে আজ কাদের মোল্লার পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের দিন ধার্য রয়েছে। গত ১৭ ডিসেম্বর থেকে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে যুক্তি উপস্থাপন শুরু করেন প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী।
মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলা বর্তমানে বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে রয়েছে। প্রসিকিউশনের যুক্তি উপস্থাপন শেষে আসামিপক্ষ যুক্তি উপস্থাপন করবে। এরপরই কাদের মোল্লার মামলার রায় প্রদানের তারিখ ঘোষণা করবে ট্রাইব্যুনাল।
এর আগে ৩ জানুযারি জামায়াতের চার শীর্ষ নেতা গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের রিট্রায়ালের আবেদন খারিজ করে দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ ও ২। কাদের মোল্লার পক্ষে বার বার একই আবেদন করায় ট্রাইব্যুনাল-২ ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে।
No comments