মৌলবাদ ও জঙ্গী সন্ত্রাসী শক্তির উত্থান এবং জাতীয় নিরাপত্তা- মে. জেনারেল (অব) হেলাল মোর্শেদ খান, বীর বিক্রম
(গতকালের পর) জঙ্গী দলগুলোকে অবশেষে বে-আইনী ঘোষণা করা হয় এবং র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব বাহিনী) ও পুলিশ বাহিনীকে জঙ্গী দলের নেতৃবৃন্দকে আটক করার ব্যবস্থা নেবার নির্দেশনা দেয়া হয়।
এই আটক কার্যক্রম আংশিক সফল হলেও ততদিনে জনমনে সরকারের প্রতি আস্থা হারানোর ফলে এই কার্যক্রমগুলোকে লোক দেখানো বলে মনে হতে থাকে। অন্যদিকে গত চার বছরে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সরকারের সহযোগিতা পেয়ে মৌলবাদী জঙ্গী-সন্ত্রাসী দলগুলোর সংগঠন, অর্থ বল, জনবল এবং উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রম তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ার কারণে সরকারের পতন এবং তৎপরবর্তী দেশে জরুরী অবস্থা ঘোষণা এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক প্রায় ১২ জন শীর্ষস্থানীয় মৌলবাদী জঙ্গী-সন্ত্রাসী নেতার মৃত্যুদ- কার্যকর করা হলেও বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা এবং বাংলাদেশকে মৌলবাদী জঙ্গী-সন্ত্রাসী রাষ্ট্রের কবল থেকে বের করে আনতে পরবর্তী সরকারকে অনেক শ্রম ও খেসারত দিতে হয়েছে।তৃণমূল পর্যায়ে নিরাপত্তা হুমকির চিত্র ও বর্তমান সরকারের বিড়ম্বনা
পূর্বেই বলা হয়েছে দেশে ভ্রান্ত পরিম-লের রাজনৈতিক পরিবেশ বলবৎ থাকায়, মৌলবাদ জঙ্গী-সন্ত্রাসী দলগুলো চূড়ান্ত বিকশিত হয়ে ওঠে কিন্তু পরবর্তীতে তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষিত হলেও তাদের সংগঠনের শাখা-প্রশাখা তৃণমূল পর্যায়ে বিস্তৃত হয়ে যাওয়ার কারণে নব-গঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকারের এই গোপন তৃণমূল পর্যায়ের জঙ্গী-সন্ত্রাসী কার্যক্রমসমূহের দমনই প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনী এবং তার অগ্রভাগে থেকে চৌকস র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন প্রতিনিয়ত এই সন্ত্রাসী কর্মকা-ের দমনে নানা ধরনের সম্মুখ সংঘর্ষে লিপ্ত হতে থাকে। মৌলবাদী জঙ্গী-সন্ত্রাসীদের সাংগঠনিক গোপন সভায় বাধা প্রদান, উদ্বুদ্ধকরণ গোপন আলোচনায় হানা দেয়া, হিংসাত্মক লিফলেট বা প্রচারপত্র আটক করা, প্রাণঘাতী মারাত্মক অস্ত্র উদ্ধার করা, টন কে টেন আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ কিন্তু আসলে ভয়াবহ বিস্ফোরণ যন্ত্র তৈরির যন্ত্রাংশ বিশেষ শনাক্তকরণ ও উদ্ধারকরণ এবং নানা পর্যায়ে উদ্বুদ্ধ ও দীক্ষাপ্রাপ্ত হাজার হাজার সন্ত্রাসী নারী পুরুষ কর্মী বাহিনীর সদস্যদের গ্রেফতার করা একটি নিত্য নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সরকার গঠনের প্রায় দশ মাস পর ১ নবেম্বর ২০০৯ ঢাকার র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-৩ এর সদস্যরা কামরুন নাহার (২৫) এবং আসমা বেগম (২৮) নামে দু’জন তরুণীকে বাসা নং-৩/৪মায়া কানন, সবুজবাগ, ঢাকা থেকে গ্রেফতার করে। কামরুন নাহার নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)-এর আমির মওলানা সাইদুর রহমানের দ্বিতীয় স্ত্রী। এখানে স্ত্রী বিষয়টি মুখ্য নয়- মুখ্য বিষয়টি হলো এই তরুণীর নিকট থেকে অমূল্য এবং হতবুদ্ধি হবার মতো বিশাল অর্থ লেনদেনের হিসাবের দলিলাদি হস্তগত হয়, কারণ তরুণীটি জেএমবি-এর কয়েকজন প্রধানের একজন প্রধান হিসাবরক্ষক কর্মকর্তা। হিসাব দলিল পর্যালোচনায় দেখা যায় গত ৮ মাসে তিনি প্রায় ৮ কোটি টাকা (প্রায় ১ মিলিয়ন ইউএস ডলার) ১৫ জন কর্মকর্তার মাধ্যমে সাংগঠনিক ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের জন্য বিতরণ করেছেন। এই একটি উদাহরণই সারাদেশে জঙ্গী-সন্ত্রাসী কার্যক্রমের গভীরতার এবং তার তাৎপর্যের কথা স্মরণ রাখার জন্য পর্যাপ্ত বলে ধরা যায়। একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই ঘটনা অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সরকার গঠন হতে ১ নবেম্বর ২০০৯ পর্যন্ত সারাদেশে ১৯২৫ জনকে শুধুমাত্র সক্রিয় জঙ্গী-সন্ত্রাসী কার্যক্রমের জন্য আটক করা হয়েছিল তার মধ্যে ১৩২৪ জনই ছিল জেএমবি সদস্য বাকি ৬০১ জন ছিল পূর্বে উল্লেখকৃত অন্যান্য জঙ্গী সন্ত্রাসী সংগঠনের সদস্য।
এই জঙ্গী সন্ত্রাসী দল ও কার্যক্রমকে প্রতিহতের পদক্ষেপ
বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী। এই সরকারের শীর্ষ অবস্থান থেকে সকল কর্মকর্তা কর্মচারীগণ গণতন্ত্র, সচ্ছতা, আধুনিক চিন্তাধারা এবং জনগণই সকল শক্তির উৎস এই বিশ্বাসে বলীয়ান। তাই তারা স্বভাবতই মৌলবাদ জঙ্গী সন্ত্রাসী চিন্তাধারা বা তাদের সংগঠনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ। এই ব্রত নিয়েই সরকার একটি আধুনিক ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার দিকে এগিয়ে চলেছে। এরই ধারাবাহিকতায় জঙ্গী সংগঠনগুলোর মধ্যম ও তৃণমূল পর্যায়ের অংশ বিশেষ এবং তাদের কার্যক্রমকে সমূলে উৎপাটন করতে নিয়োজিত দেশের পুলিশ বাহিনী ও র্যাব বাহিনীকে সহযোগিতার জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ১৭ সদস্যবিশিষ্ট “জাতীয় সন্ত্রাস দমন এবং নিয়ন্ত্রণ কমিটি” নামে একটি প্রণোদনামূলক কমিটি গঠন করেছে। এই ১৭ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি প্রায় সকল জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা প্রধান, আইনশৃংখলা বাহিনী প্রধান এবং বিষয় সম্পৃক্ত অন্য প্রধানদের নিয়ে গঠিত। স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই কমিটির প্রধান। যদিও অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস দমন ও নিয়ন্ত্রণ প্রধানত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব; কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে সমাজে সন্ত্রাসের মূল উপাদান অপসারণ করতে হলে শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কার্যক্রমের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলেই মূল উদ্দেশ্য পূর্ণ সফল হয়ে উঠে না, তাই এই কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রমকে পর্যাপ্ত প্রণোদনা দেবার ইচ্ছায় দেশের আর্থ-সামাজিক-ধর্মীয় সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে নিয়োজিত অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমকেও সমন্বয়ের মাধ্যমে এই সমাজের গভীরে প্রথিত জঙ্গী সংগঠন ও তাদের কার্যক্রমকে মোকাবেলা করার ব্যবস্থা একটি যুগোপযোগী ও যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত বলা যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্র চিহ্নিত করে যে সকল সমন্বয় কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে তা হলো;
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে
(১) দেশের প্রতিটি মসজিদে জুমার নামাজের ‘খুৎবা’ শুরুর পূর্বে সংক্ষিপ্ত আকারে (৪/৫ মিনিট); সুমহান ইসলাম ধর্মে বিধৃত মানব কল্যাণে ইসলাম ধর্মের প্রয়োগ কিন্তু তার বিপরীতে জঙ্গী-সন্ত্রাস কী ধরনের নেতিবাচক ফল আনতে পারে সে বিষয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করা।
(২) শীতকালীন সময়ে সারাদেশে ইসলাম ধর্ম প্রচার এবং ইসলামের মাহাত্ম্য প্রচারে নিয়োজিত ‘ওয়াজ মাহফিলে’ (যে জঙ্গী সন্ত্রাসীরা তাদের মতবাদ প্রচারে ব্যবহার করে থাকে) ধর্মীয় আলেম ওলামাদের জঙ্গী-সন্ত্রাসী ধারার ওলামাদের পরিহার করা এবং জঙ্গী মতবাদ ও কার্যক্রম বিশ্বব্যাপী ইসলামের জাগরণকে কিভাবে পশ্চাৎপদ করছে, সে বিষয়গুলো ওয়াজ মাহফিলে উপস্থাপিত এই বিশাল সংখ্যক ধর্মপরায়ণ এবং ইসলাম ধর্মের সত্যিকারের মাহাত্ম্যের প্রতি অনুগত গ্রাম অঞ্চলের শ্রোতা মানুষগুলোর নিকট তুলে ধরা।
(৩) প্রতিটি মসজিদ সংলগ্ন ‘মক্তবে’ যেখানে ধর্মীয় শিক্ষকগণ কোমলমতি শিশু-কিশোরদের কোরআন-সুন্নাহর আলোকে জীবন ধারণ সম্বন্ধে (সবক) বক্তব্য দিয়ে থাকেন সেই সব শিক্ষকগণকে নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে যাতে কোরআন-সুন্নাহর জীবন ধারণ সম্বন্ধে (সবক)-এর পাশাপাশি সরকার কর্তৃক বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রকাশিত মাদক সেবনের কুফল, শিশু নির্যাতনের অমানবিকতা, বহুবিবাহ এবং বাল্যবিবাহের কুফল বিষয়গুলোও তুলে ধরা হয়। বিশেষ করে আধুনিক চিন্তাধারার আলোকে বহুবিবাহ এবং বাল্যবিবাহের কুফলের প্রচারের বিরুদ্ধে মৌলবাদী ও জঙ্গী সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো কঠিন অবস্থান নিয়ে তাদের প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে থাকে। বহু বিবাহ ও বাল্য বিবাহকে তারা ধর্মীয় কাজের অংশ বলে আখ্যায়িত করে থাকে।
খ। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে
(১) কোমলমতি কিশোর ও তরুণ জনগোষ্ঠীকে সন্ত্রাস নৈরাজ্যবাদের ফল কিভাবে একটি জাতিকে বা তার সমাজকে বিপথে চালিত করতে পারে সে বিষয়ে পাঠ্যপুস্তকে শ্রেণীভেদে পাঠ্যক্রম সম্পৃক্ত করতে বলা হয়েছে।
(২) মাদ্রাসার বইপত্রসহ সকল প্রচার সংক্রান্ত বইপত্রে জাতীয় শিক্ষানীতি ও কার্যক্রমের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পাঠ্যক্রম তৈরি করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ কারণ মাদ্রাসাগুলো হতেই মৌলবাদী সংগঠনগুলো মূলত তাদের কর্মীদল সংগ্রহ করে থাকে।
গ। তথ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে
(১) ফিল্ম ও পাবলিকেশন বিভাগ কর্তৃক জঙ্গীবাদের নেতিবাচক প্রভাব সন্নিবেশিত করে ডকুমেন্টারী স্বল্প দৈর্ঘ্য ফিল্ম, পোস্টার ফিল্ম, ভিডিও ক্লিপ ইত্যাদি তৈরি করে দেশের ইলেকট্রনিক্স ও প্রিন্ট মিডিয়ায় বিশেষ ব্যবস্থায় গ্রামেগঞ্জে প্রচার করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কারণ মূলত মৌলবাদী জঙ্গী-সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সদস্য সংগ্রহের মূল উৎসটি হলো প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলের সাধারণ ধর্মপ্রাণ তরুণ জনগোষ্ঠী।
উল্লেখ্য, উপরের উদাহরণগুলো সরকারের সামগ্রিক কার্যক্রমের একটি খ-চিত্র মাত্র।
এটি আমাদের মানতেই হবে সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক সুবিধা লাভের আকাক্সক্ষায়, একটি হঠকারী সিদ্ধান্তের কারণে, বিশ্ব রাজনীতিতে কৌশলগত অবস্থানের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর কারণে এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের মতো একটি নিজস্ব সমাজ ব্যবস্থায় চালিত, নিজস্ব সংস্কৃতি কৃষ্টির প্রতি অগাধ ভালবাসায় সিক্ত দেশকে মৌলবাদী জঙ্গী সন্ত্রাসবাদীদের সাহায্য নিয়ে যে আতঙ্ক ও জনজীবন বিপর্যস্ত করার ব্যবস্থা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সরকার রচনা করেছিল তা থেকে আমরা এই ২০১২ সালের শেষ প্রান্তে এসে বহু দূরে সরে এসেছি। তবে অল্প কয়েকদিন পূর্বে বেশ কিছুদিন সুপ্ত থাকার পর মৌলবাদী জঙ্গী-সন্ত্রাসবাদী কর্তৃক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে হঠাৎ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর যে আঘাত হানা হয়েছিল তা থেকে প্রমাণিত হয়- বাংলাদেশের বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী যাই চাক না কেন, ক্ষুদ্র সংখ্যালঘিষ্ঠ প্রতিনিধিকারী কিন্তু সংগঠিত জঙ্গী দল, তাদের অর্থবল ও সুসংহত সংগঠন এখনো আমাদের প্রতিহত করার শক্তি ধারণ করে রেখেছে। এদের বিরুদ্ধে আমাদের আরও সোচ্চার, ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত হতে হবে। তা হলেই জাতীয় নিরাপত্তা স্থায়ী রূপ পাবে।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ
No comments