দাম বেড়েছে ডিজেলের, ভাড়া বাড়ানোর চাপ সিএনজিচালিত বাসের! by আনোয়ার হোসেন
জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির পর রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরে চলাচলকারী বাসের ভাড়াও বাড়ানোর জন্য চাপ দিচ্ছেন পরিবহন মালিকেরা। অথচ ঢাকায় চলাচলকারী প্রায় সব বাসই সংকুচিত প্রাকৃতিক গ্যাসে (সিএনজি) চলে।
চট্টগ্রামেও অধিকাংশ বাস-মিনিবাস এখন সিএনজিচালিত। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির আগে থেকেই রাজধানী ও দূরপাল্লার পথে মালিকেরা সরকারের নির্ধারণ করে দেওয়া হারের চেয়ে বেশি ভাড়া আদায় করছেন। সরকারিভাবে ঘোষণা এলে প্রকৃত ভাড়ার চেয়ে কয়েক গুণ বাড়িয়ে আদায় করার নজির অতীতে রয়েছে। বিশেষ করে ন্যূনতম ভাড়ার হার কখনো মানা হয় না। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে বাসমালিকেরা সিএনজিচালিত বাসেও ভাড়া বাড়িয়ে নেওয়ার পাঁয়তারা করছেন। বাস পরিচালনায় অন্য যেসব খরচ হয়, সেগুলোও আমলে নিয়ে ভাড়া নির্ধারণের চেষ্টা করছেন তাঁরা। মালিকদের এ দাবি মেনে নিলে ভাড়া অনেক বেড়ে যাবে।বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সূত্র জানায়, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির আলোচনা শুরু হওয়ার পরই গত ২৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির পক্ষ থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রামে চলাচলকারী বাসের ভাড়া বৃদ্ধির আবেদন করে চিঠি দেওয়া হয়। চিঠিতে নতুন করে বাস পরিচালনার ব্যয় বিশ্লেষণ করে মূল্য নির্ধারণের দাবি জানানো হয়। এদিকে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির পর ঢাকায় বিচ্ছিন্নভাবে কিছু বাসমালিক ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন। রাজশাহীতেও এভাবে ভাড়া বৃদ্ধির খবর পাওয়া গেছে। দূরপাল্লার পথে বৃদ্ধি না হলেও যেকোনো সময় বাড়বে বলে একাধিক বাস কোম্পানির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
বর্তমানে ঢাকায় বড় বাসের ভাড়া কিলোমিটারপ্রতি এক টাকা ৪৫ পয়সা এবং মিনিবাসের ভাড়া এক টাকা ৪০ পয়সা। দূরপাল্লার পথের ভাড়া কিলোমিটারপ্রতি এক টাকা ৩০ পয়সা।
সরকার ২০০৩ সালে ঢাকায় সিএনজিচালিত বাস নামানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর চট্টগ্রামেও সিএনজিচালিত বাস নামে। এ সময় ডিজেলচালিত বাসও এই দুই মহানগরে চলাচল করত। কিন্তু দুই ধরনের বাস চলাচলের কারণে তেলের দাম বাড়ালে সিএনজিচালিত বাসের ভাড়াও বাড়িয়ে দিতেন মালিকেরা। একইভাবে সিএনজির দাম বাড়লে যাত্রীদের পকেট কাটা হতো ডিজেলচালিত বাসেও। এ সমস্যা এড়াতে ২০০৮ সালে সরকার ঢাকা ও চট্টগ্রামে শুধু সিএনজিচালিত বাস চলাচলের সিদ্ধান্ত নেয় এবং তা তিন মাসের মধ্যে কার্যকরের ঘোষণা দেয়। বর্তমানে ঢাকায় শুধু সিএনজিচালিত বাস ও মিনিবাসের ভাড়া নির্ধারণ করা আছে। কিন্তু এখন জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার সুযোগে ঢাকা ও চট্টগ্রামে সিএনজিচালিত বাসেও ভাড়া বৃদ্ধির জন্য চাপ দিচ্ছেন মালিকেরা।
বিআরটিএ সূত্র জানায়, সংস্থাটি হিসাব করে দেখেছে, বাস পরিচালনায় যেসব খাতে খরচ হয়, সেগুলো বাদ দিয়ে শুধু জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে প্রতি এক টাকার বিপরীতে ভাড়া বৃদ্ধি পায় এক পয়সা। সে হিসাবে বর্তমানে ডিজেলের মূল্য প্রতি লিটারে পাঁচ টাকা বৃদ্ধির ফলে বাসভাড়া পাঁচ পয়সা বৃদ্ধি পেতে পারে। কিন্তু মালিকেরা তা মানছেন না।
যানবাহনের ভাড়া নির্ধারণে বিআরটিএর চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে একটি ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটি আছে। ১৪ সদস্যের এই কমিটির সাতজনই মালিক সমিতির নেতা। বাকি সাতজনের ছয়জন সরকারি কর্মকর্তা এবং একজন থাকেন ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন সংগঠনের পক্ষ থেকে। সরকারি একাধিক সদস্য বলেন, কমিটিতে মালিক প্রতিনিধি বেশি এবং তাঁদের ইচ্ছাই প্রাধান্য পায়।
বিআরটিএ সূত্র জানায়, জ্বালানির দাম বাড়তে পারে—এমন বিবেচনায় গত ২৭ ডিসেম্বর ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটির বৈঠক হয়। সেখানে মালিক প্রতিনিধিদের পক্ষে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ সাফ জানিয়ে দেন, দূরপাল্লার সঙ্গে ঢাকা ও চট্টগ্রামের নগর পরিবহনেরও ভাড়া বৃদ্ধি করতে হবে। এ ছাড়া শুধু জ্বালানির মূল্য নয়, অন্যান্য খরচ বৃদ্ধি ধরে ভাড়া পুনর্নির্ধারণ করতে হবে। ফলে ওই বৈঠকে কোনো সুপারিশ তৈরি করা যায়নি।
খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির সম্ভাবনা তৈরির পরই তাঁরা বিআরটিএকে চিঠি দিয়েছেন, যাতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহানগরেও বাসের ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়। তিনি দাবি করেন, ঢাকায় এখন ৫০ শতাংশ বাস ডিজেলে চলছে। কোনটা ডিজেলে চলছে, আর কোনটা সিএনজিতে, সেটা কীভাবে আলাদা করা হবে—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘ডিজেলের দাম বাড়লে সিএনজিচালিতরা কিছু সুবিধা পায়। আবার সিএনজির বাড়লে ডিজেলচালিতরা সুবিধা পায়। এটা কিছু করার নেই।’
ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটির ২৭ ডিসেম্বরের বৈঠকের পর বিআরটিএ যোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে জানতে চেয়েছে, ঢাকা ও চট্টগ্রামে ডিজেলচালিত বাস-মিনিবাস চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত থাকার পরও এখন ভাড়া বৃদ্ধি করা যাবে কি না?
জানতে চাইলে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সড়ক বিভাগের সচিব এম এ এন সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটি সাত দিনের মধ্যে ভাড়া ঠিক করবে। বাসমালিকদের অনুরোধ জানানো হয়েছে, এই পর্যন্ত তাঁরা যেন ভাড়া না বৃদ্ধি করেন। এর পরও কেউ বৃদ্ধি করলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ঢাকা ও চট্টগ্রামে ভাড়া বৃদ্ধির মালিকদের দাবি সম্পর্কে তিনি বলেন, আইনের বাইরে কিছু করা হবে না।
কিছু বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ: সদরঘাট থেকে উত্তরা পথে চলাচলকারী সুপ্রভাত পরিবহনে গন্তব্যভেদে এক থেকে তিন টাকা বাড়তি ভাড়া আদায় করতে দেখা গেছে। এই পরিবহনে সদরঘাট থেকে রামপুরা পর্যন্ত এত দিন ১৫ টাকা ভাড়া আদায় করা হতো। গত শনিবার কাউন্টারে গিয়ে দেখা গেছে, তিন টাকা বাড়িয়ে ১৮ টাকা আদায় করছে তারা। মতিঝিল-গুলশান পথে চলাচলকারী লোকাল বাসে এত দিন সর্বনিম্ন ভাড়া তিন টাকা নেওয়া হতো। শনিবার এই পথের বাসগুলো সর্বনিম্ন ভাড়া পাঁচ টাকা আদায় করা হচ্ছে।
কিছু কিছু পরিবহন আগে থেকেই সরকার-নির্ধারিত হারের চেয়ে বেশি ভাড়া আদায় করে আসছে। সরকারের ঘোষণা না মেনে নিজেদের ইচ্ছায় তারা ভাড়া নির্ধারণ করে।
স্বকল্প পরিবহনে ফার্মগেট থেকে আগারগাঁও/তালতলা ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ১৪ টাকা। এই পরিবহনের এর চেয়ে কমে কোনো টিকিটই নেই বলে জানিয়েছেন কাউন্টারের ব্যবস্থাপক। অথচ এই পথের দূরত্ব ২ দশমিক ৯ কিলোমিটার। কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া এক টাকা ৪৫ পয়সা হিসাবে এই পথের ভাড়া হয় চার টাকা ২০ পয়সা। কিন্তু সরকার বড় বাসে সর্বনিম্ন ভাড়া ঠিক করে দিয়েছে পাঁচ টাকা। সে হিসাবে এই পথে নয় টাকা বেশি নেওয়া হচ্ছে।
আমাদের রাজশাহী প্রতিনিধি জানিয়েছেন, গত বৃহস্পতিবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পরদিন থেকেই মহানগরের বিভিন্ন পথে বাসমালিকেরা ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন। সেখানে বিভিন্ন গন্তবে যাত্রীদের কাছ থেকে পাঁচ টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
No comments